ফাতনাই জীবন
বাল্যস্মৃতির একটা বিশেষ মোহমুগ্ধতা সফিকে ভীষণভাবে গ্রাস করে নিয়েছিল। আসলে তা ছিল পরম্পরা।
বাপ পড়াশোনা জানত না। একেবারে অক্ষরজ্ঞানহীন। খালবিলে মাছ ধরেই জীবিকানির্বাহ। তারপরেও লোকটা একটা বিশেষ পছন্দের মননকে সারা জীবন নিজস্ব চর্চায় ধরে রাখতে পেরেছিল। সংসারের জন্যে চালডাল পর্যাপ্ত থাকলে কোনো কোনো দিন সফিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পাশে ছোট্ট ডোবার এক কোণে বসে সারাদিন ছিপ ফেলায় মগ্ন থাকত।
তা নিয়ে সফির মধ্যে যে প্রশ্ন জাগেনি তা নয় কিন্তু বলি বলি করে মনের কথা বলতে পারেনি সে। যে লোকটা খালবিলে খেপলা জাল ফেলে এত এত মাছ ধরে আনতে পারে, যাতে তাদের সংসার চলে, তাকে এভাবে ছোট্ট ডোবার ধারে ছিপ নিয়ে সারাদিন বসে থাকতে হবে কেন? ফাতনার চোরাডুব দেখে বাপকে মজা করে বারবার হাসতে দেখেছে সে। কিন্তু সেই হাসির অন্তরালে জীবনবোধের কী গূঢ়তা রয়েছে, তা কোনোদিন নিজের বোধগম্যতায় নিতে পারেনি। তার সোজাসাপ্টা ভাবনা, বারদুই খেপলা জাল ফেললেই তো ছোটো ডোবার প্রায় সমস্ত মাছ উঠে আসতে পারে। তাছাড়া খালবিল থেকে জালে পাওয়া জীবন্ত মাছগুলো তো ওই ডোবাতে ছাড়া হয়েছে। তারপরেও শুধু শুধু—।
নিজের অজান্তে বাস্তব প্রশ্নের আড়কাঠিতে যে কত বড়ো দার্শনিক তত্ত্ব লুকিয়ে ছিল, তা তখনো আবিষ্কার করতে পারেনি সফি। ওই তো বয়েস। মাত্র দশ-এগারো। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। দার্শনিক তত্ত্বকথা বুঝবে কী করে? জন্মের পর থেকে বাপের জীবনে যা দেখেছে, সেই স্মৃতির মোড়কে অনুপ্রাণিত হয়েছে বারবার। সফির সটান মনের কথা, জাল ফেলা লোককে সারাদিন এঁদো ডোবার ধারে বসে থাকা ঠিক নয়। যেন নেই কাজ তো খই ভাজ অবস্থানের মতো। সফির কিশোর মনের স্রোতে নেতিসূত্রের হ্যাঁচকা টান।
পরের শনিবার বেলা গড়িয়ে দুপুর। ফাতনাটা বেশ নড়ছে। বাপের কড়া নির্দেশ, চুপচাপ বসে থেকে দ্যাখ্না। অনেক কিছু শেখার আছে রে।
কিন্তু কিশোর সফি বাপের সেই ঘোর ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারল না। দুঠোঁট জুড়ে মিস্টিক হাসি আর পেটজুড়ে চোঁয়া খিদের টান। দোটানায় দোদুল্যমান। প্রশ্নের সূচ বাপকে নিয়েই। ফাতনার তালে তালে এভাবে মাথা নাড়ার কী আছে? মনের গভীরে বিরক্তির ভারী বোঝা। সফির মধ্যে ছন্নছাড়া বিক্ষিপ্ত চেতনার বিস্তার। ভাবল, মনের কথা কী খুলে বলব? শোনে কী বাপ রাগতো হতে পারে? কিন্তু...। দোটানার সমুদ্রে হাবুডুবু অবস্থান। শেষ পর্যন্ত তাকে কিছুই বলতে হলো না। চাপাস্বরে বাপের সূক্ষ্ম প্রশ্নের তির ধেয়ে এলো তার দিকে। —হ্যাঁরে, অমন উসখুস করছিস কেন? কিছু বলবি? খিদের টানে কী মনোসংযোগ দিতে পারছিস নে?
খেপলা জালটা বাড়ি থেকে নিয়ে আসব?
সফির বাপ হতবাক। ছেলেটা এতদিন সঙ্গে থেকেও তার অনুভূতির সূত্রটুকু ধরতে পারল না? এ কেমন ছেলে? বাপকা বেটা হতে চাচ্ছে না? সেই পাঠ দিতেই তো ওকে—। উঁচুমুখের স্থির দুচোখ সফির দিকে।
সফির মধ্যে তখনো কিন্তুর ক্ষিপ্র গতিবেগ, সবেমাত্র কলকলে জোয়ার শুরু হয়েছে। সফির বাপের মধ্যে বিপরীত চিন্তাস্রোত। সফির সুতীব্র আত্মজিজ্ঞাসা। সে কী কিছু ভুল বলে ফেলল? তাহলে বাপ কী তার কাছ থেকে বিপরীত কিছু চাচ্ছে? দিতে পারছে না বলেই এত বেশি বিরাগ?
সফির বাপের মধ্যে তখন ভিন্ন পর্যালোচনার সুর বাজছে রিনিঝিনি শব্দদোলে। ছেলের সামাজিক বোধের মধ্যে তার খেয়ালিপনা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে পারল না কেন? মূল ইচ্ছাটুকু ঠিকমতো স্থান করে নিতে না পারলে তো—। মনের আকাশে দ্বিধাদ্বন্দ্বের এক ঝলক কুয়াশা। আপন মনে এক পলক হাসল। তাহলে কী সে নিজেই ছেলেকে ঠিকমতো পাঠ দিতে পারছে না?
সেদিন রাতে ভাত-পাতে ছিপে ধরা রুই মাছের ঝোল। খেতে খেতে সফির বাপের উদাসীন প্রশ্ন, হ্যাঁরে, কেমন লাগছে?
বেশ তো।
এতক্ষণ বসে থেকে ছিপে মাছ ধরি কেন জানিস?
তা তো বলোনি কোনোদিন।
নিজে শিক্ষের অভাবে বড়ো হতে পারিনি কিন্তু বুঝেছি, বড়ো হতে গেলে গভীর মনোসংযোগ লাগে। তোকে সঙ্গে নিয়ে এত সময় ব্যয় করি শুধু সেটুকু শেখাতে।
সফি হতবাক। দুচোখ বাপের দিকে। মনের বিক্ষিপ্ত চত্বরে বেহিসেবের মেলা। মানসিক কৌতূহলে ভীষণ দোদুল্যমান। ভাবনার স্রোতে ভেসে একবার খিল খিল করে হেসে উঠল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর না হয়ে পারল না। তাহলে অন্তরালে এত বড়ো ইচ্ছা লুকিয়ে রয়েছে তার বাপের মধ্যে? তাকেই খাঁটি বাপকা বেটা হতে হবে? নতুন ক্ষেত্রে নতুন ভাবে, এক অচেনা জগতের স্বপ্নে বিভোর কিশোর সফি।
তারপর গঙ্গার বুক বেয়ে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। জোয়ার-ভাটার খেলা চলেছে হররোজ। সময়ের ঘণ্টায় সফির বয়স বেড়েছে। কালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে একসময় বাপকে হারাতে হয়েছে কিন্তু পুরোনো স্মৃতির ডাক তার জীবন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। স্মৃতির সরণিই তো অতীতকে বর্তমানের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে জুড়ে রাখে, তাৎক্ষণিকতাকে আরও বজ্রকঠিন করে তোলে।
বাপের ইচ্ছা অনুসরণ করতে করতে সফি গ্রাজুয়েট হতে পেরেছে, ছিপে মাছ ধরার খেয়ালিপনা কমবেশি গ্রহণ করতে পেরেছে কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, বাপের আত্মস্থ মননচিন্তাকে ততবেশি স্পর্শ করতে পারেনি। বাপ যে মনোসংযোগ শেখাতে চেয়েছিল, তা কেবলমাত্র ছবি হয়ে ফাতনার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পেরেছে। সেই শক্তি তার সাকার হবার চেষ্টার সঙ্গে ঠিকমতো জুড়ে যেতে পারেনি। সফি বাল্য থেকে কেমন যেন কবিমনের। কিন্তু কঠোর বাস্তবে ততদিনে প্রকৃত কবি হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। অবশ্য ডোবার ধারে নিমগাছের ছায়ায় বসে ছিপ ফেলার সময় নিজস্ব ভাবালুতায় নিজেকে কবি কবি ভাবতে বেশ লাগে। কঠোর বাস্তব ফলশ্রুতি বলতে শুধু এটুকুই।
চাকরি-প্রাপ্তির জন্যে যে আদৌ চেষ্টা করেনি, তা কিন্তু নয়। বেশ কয়েকবার ইন্টারভিউ দিয়েছিল, তাতে সাফল্য আসেনি। বন্ধু মৃদুলের আন্তরিক মন্তব্য, আরেকটু চেষ্টা নিলে সফি হয়তো সোনারকাঠি স্পর্শ করতে পারত কিন্তু সফির মধ্যে সেই হেলদোল ছিল না। বরং মৃদুলের মতো সাকার যুবকের ফাউ কথাকে থাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল। কেবল একটা মানসিক যন্ত্রণা থেকে তখনো সে মুক্ত হতে পারেনি। বউ রুবিনার গঞ্জনা দিন দিন তীব্রতর হয়ে উঠেছে। —অন্য সকলের মতো কেন সাকার হয়ে উঠতে পারল না সে? কিন্তু সফির দুর্ভাগ্য, বউ-এর সেই খোঁটা তার জীবনে ‘মরমে পশিল গো’ হয়ে উঠতে পারেনি।
বন্ধুবর মৃদুল দ্বিতীয় দিন সাক্ষাৎ করতে এসে সফিকে দেখতে পেল না। রুবিনা জানালো, মথুরাপুর বাপুলিবাজারে ছিপে মাছ ধরার পাশ নিয়েছে। সেখানেই গিয়েছে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে। বাধ্য হয়ে মৃদুলকে ফিরতে হলো। নিজের মন্তব্যে রুবিনাকে জানিয়ে গেল, মাছ ধরতে সফির যে খেয়াল, তার অর্ধেক সময় চাকরির পরীক্ষায় ব্যয় করলে দিব্যি সাকার হয়ে যেতে পারত।
সন্ধেয় বাড়িতে ফিরে রুবিনার ভারমুখ দেখে সফি বুঝল, কিছু একটা ঘটেছে কিন্তু সেটা কী? শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টায় রুবিনার মুখ থেকে মৃদুলের কথা উদ্ধারের পরে মন্তব্য করল, ওর ফাউকথায় বিশ্বাস করলে?
এ জগৎ সংসারে জন্ম থেকে কোনো কোনো জীবনে বিশেষ মোহ এমনিই পেয়ে বসে যে তার পাশে কঠোর বাস্তবের প্রয়োজনটুকু অতিশয় তুচ্ছ বলে মনে হয়। সফির দুর্ভাগ্য, সে সেটুকুই রুবিনাকে ঠিকমতো বোঝাতে পারেনি।
সেদিন শনিবার। মেঘের কোল ঘেঁষে সারি সারি সাদা বকের উড়ার দৃশ্য। সত্যি অপূর্ব, চোখধাঁধানো প্রেক্ষিত। সারা আকাশ জুড়ে মেঘেদের লুকোচুরি খেলা, শরতের অভিনব সম্বর্ধনাসভা, সেসব সফির খেয়ালে এতটুকু ধরা পড়ল না। মাছ ধরার খেয়ালে বুঁদ হয়ে থাকল। দুচোখ নিবদ্ধ ফাতনার দিকে। মরা বাপের একাগ্রতা তখন সম্পূর্ণ আত্মস্থ হয়ে গেছে সফির।
শরৎ বলেই বোধহয় প্রকৃতির বুকে এমনি অন্তহীন রূপ অরূপের ছড়াছড়ি। নিসর্গচেতনায় তা রঙরূপে মাতোয়ারা। শরতের ভুবন এমনিই। মেঘ ঠেলে মিষ্টি রোদের প্রকাশ। তাতেও ধ্যান ছিল না সফির। পুকুরপাড়ে নিমগাছের ছায়ায় বসে ছিপ ফেলায় ব্যস্ত। গভীর নিমগ্নতর মধ্যে রুবিনাকে মনে করে বিড়বিড় করে বলল, মেয়ে মানুষটা কিছুতেই মূল সত্যিটুকু বুঝতে শিখল না। চাকরি পেলে তখন মাছ ধরার মনন জীবন থেকে উবে যেত। পরিবর্তে মাছ কিনে খাবার প্রবণতা প্রাধান্য লাভ করত। মেয়েটা তা তলিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না।
সেই প্রতীতিতে বিরক্তি থাকলেও এক অর্থে সফির মধ্যে অন্য প্রশান্তি ছিল। নিজের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখার সুগভীর আত্মপ্রত্যয়।
খেয়াল কখনো অর্থনীতির হিসাব মানে না। সফির খেয়াল সংসারজীবনে আর্থিক টানাটানিতে পরিণত হতে শুরু করল। রবিবারের বিকালে শূন্য হাতে ফেরার পরে রুবিনা বাকযুদ্ধ শুরু করল সফির সঙ্গে। —সংসার চলবে কী করে তা কী একবার ভেবে দেখেছ? একটা কাজকম্ম তো দরকার।
ছিপে মাছ ধরাকে কাজকম্ম হিসেবে ভাবতে পারছ না?
ওটা টোটোকোম্পানির কাজ।
কী বলতে চাচ্ছ তুমি? সফির রাগত প্রশ্ন।
তিক্ত রুবিনা হেসে প্রসঙ্গটা উড়িয়ে দিতে চাইলেও নাছোড় সফিকে কিছুতেই কব্জা করতে পারল না। তখনো সফির লাল দুচোখ রুবিনার দিকে। তড়বড় পায়ে হেঁসেলের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বলল রুবিনা, বিয়ের পরে বেকার সোয়ামিকে টোটোকোম্পানি বলে গো। টো টো করে ঘোরার সুবাদে এমনি শিরোনাম। এতে এত রাগ করার কী অছে? আর্থিক শক্তিতে দেউলিয়া হয়ে পড়লে চলতি কথায় তা টোটোকোম্পানি। মালিক কিন্তু সেকথা গায়ে মাখে না। দুঃসময় বলে নিজের হিসেবে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়। তুমি তো দেখছি অন্য মানুষ।
টো টো করে ঘোরাটা আর হলো কই, যেটুকু ঘুরেছি তা তো কেবল তোমার পিছনেই।
হেঁসেলের দেওয়ালে হেলান দিয়ে রুবির বিড় বিড় প্রত্যুত্তর—কী কথায় কী প্রসঙ্গ টেনে আনলে দ্যাখো। লোকটা এমনিই। গায়ে ঠেস দিয়ে বেশ কথা বলতে শিখেছে। রুবিনারও দুর্ভাগ্য। নিত্যদিনের সংসার-যাত্রায় সে সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে ঠিকমতো চিনতে পারল না। উপরে থুতু ছুঁড়ে দিলে সবার আগে নিজের গায়ে লাগে—সেই বোধটুকুও নেই। বড়ো বিচিত্র মনের মানুষ। সংসার প্রবাহে রয়েছে অথচ সঙ সাজতে শিখল না। চল্লিশ ঊর্ধ্ব বয়স। চাকরির পরীক্ষায় বসার সুযোগ সম্পূর্ণ হাতের বাইরে। সরকারি নিয়মের যাঁতাকলে আটকে গেছে তার বাকি জীবন। হালফিল সময়ে ছিপে মাছ ধরার খেয়ালে পড়ে থাকাই সফির শেষতম অনুধ্যান হয়ে উঠেছে।
সেদিন রবিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। চাকুরেদের জীবনে অবসর উপভোগের অপূর্ব সন্ধিক্ষণ। সারাদিন তাড়িয়ে তাড়িয়ে চলে, নিজস্ব গ্রাম কনকনদিঘিতে গাছের ছায়ায় বসে নিমগ্ন সফির চোখে পড়ল, অন্যদিনের তুলনায় ফাতনাটা নড়ছে বেশ। জলের ভিতরে বড়শির চারপাশে মাছেদের আনাগোনা শুরু হলে এমনি করেই ফাতনা নড়ে। সফির মনের সমুদ্রে খুশির বন্যা। একেবারে অবিচল চিত্ত। ভিতরে ভরপুর বিশ্বাস। অনিন্দ্যসুন্দর শুভক্ষণ। সবদিন এভাবে ফাতনা নড়ে না। মাছেদের জীবনেও খাদ্যগ্রহণের নির্দিষ্ট সময়ক্রম রয়েছে। কখনো সাগ্রহে সাড়া দেয়, কখনো দেয় না।
আরও দেখল, মাঝে মাঝে ফাতনাটা বেশ কাত হচ্ছে। আজ যে খালি হাতে ফিরতে হবে না, সেই প্রত্যয় সফির মধ্যে পর্বত-প্রমাণ হয়ে উঠল। রুবিনার খোঁটাকে সে নিশ্চিয়ই তুচ্ছ করে দিতে পারবে। খোঁটার কাঁটা উপড়ে ফেলার বড়ো বেলুন উড়ছে মনের আকাশ জুড়ে। শূন্য হাতে ফিরতে দেখে রুবিনা গতকাল মুখের উপর বলে দিয়েছিল—বেশ তো বেকার সময় কাটিয়ে এলে। তারপর টোটোকোম্পানি বললে এত লাল চোখ দেখানোর কী আছে? চনমনে মেয়েটা পাকা কথায় টনটনে। কেন যে সে আজও জীবনের বড়ো Philosophy বুঝতে শিখল না।
সংসারের ভরকেন্দ্রে আছে বলেই সফিকে নিরুত্তর থাকতে হয়েছে। আজ যেন সেই দুঃখবোধ ভোলার অপূর্ব সন্ধিক্ষণ তার সামনে। ফাতনার খেলায় বারবার চমকিত হচ্ছে। বিড় বিড় করে রুবিনার উদ্দেশ্যে সফির মানসিক তড়পানি, আজ তোমাকে দেঁতো কথা বলার কোনো সুযোগ দেব না। ফাতনা কথা বলছে গো আমার সঙ্গে, মাছ নিয়েই বাড়িতে ফিরব।
আরও নিমগ্নচিত্ত সফি। আরও বেশি মনোযোগী, নড়তে থাকা ফাতনার মধ্যে সফির স্বপ্নের বিভাবরী জাগছে। সে সম্পূর্ণ ফাতনাময়। পিছন থেকে এক পথচলতি মানুষের জিজ্ঞাসা, শুনছেন দাদা, রতন বৈরাগীর বাড়িতে যাব, ঠিক কোনদিকে একটু বলবেন?
সম্মোহিত সফি তখন ফাতনার খেয়ালে। গভীর সমুদ্রের তলদেশে ডুবন্ত ডুবুরির মতো নিশ্চল। —বারে বা, ফাতনার উচ্চ প্রশংসা তার মুখে। একবার ডোবে তো একবার ভাসে। দুচোখের সামনে ফাতনাবাজির দুরন্ত খেলা। সফি অধীর অপেক্ষায়, ডুবলেই সেও শিল্পসম্মত টান দিতে জানে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় একেবারে ঘোড়েল মানুষ। ফাতনার আড়ালে মাছেদের খেয়ালিপনা আত্মস্থ করতে তাকে বিপুল সময় ব্যয় করতে হয়েছে। ধ্যানমগ্ন ঋষির ঈশ্বরপ্রাপ্তির মতোই। সফির দুঠোঁটের ফাঁকে উৎফুল্ল হাসি। অস্ফুটে বলল, আরেকটু ডোবরে, তারপর দেখছি।
নিজস্ব স্বগতোক্তির তারজালিতে আবদ্ধ সফি। ভিতরে অদ্ভুত মানসিক প্রশান্তি।
পথচলতি পথিকবর তখনো রাস্তার উপরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন উপস্থিত থাকলে নিশ্চয়ই বলতেন, ‘দাঁড়াও পথিকবর, তিষ্ট ক্ষণকাল’। সফির মধ্যে কিন্তু সেই কাব্যিকতা ছিল না।
অচেনা পথিকবরের মধ্যে অভিনব কৌতূহল। ভারী অদ্ভুত মানুষ, নিজের খেয়ালে দারুণভাবে মজে থাকতে শিখেছেন কিন্তু নিজস্ব তাৎক্ষণিক তাগিদকে মন থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে পারল না। সন্ধের আগে কাজ সেরে তাকে বাড়িতে ফিরতেই হবে। অনেকটা পথ। অতিক্রমণের জন্যে বেশ সময় লাগবে। একবার ভাবল, লোকটা কানে কম শোনে না তো? শুনতে পেলে নিশ্চয় সাড়া দিতে পারত।
সফির অনুভূতি তখন ফাতনাবাজির অন্বেষণে ব্যস্ত। নিজস্ব খিদেয় হিরে-মানিকের প্রত্যাশা। আসন্ন জয়লাভের অনুধ্যানে ভরপুর। ফাতনা কাত হতেই তালে তালে নিজের শরীরটা কাত করল সফি। আবার সোজা হয়ে ফাতনাটা জলের উপর ভেসে উঠল। মাথা ঝাঁকিয়ে সফির স্বগতোক্তি, আহা, অমন হলে চলে?
সফির শারীরিক বিচিত্র ভঙ্গীমায় পথিকবর মজা উপভোগে মত্ত। সফিও মত্ততার সাগরে নিমজ্জিত। নিজস্ব তাগিদ ভুলে পথিকবর রাস্তায় দাঁড়িয়ে সফির মননের সঙ্গে একাত্ম হতে বাধ্য হলো কিন্তু সম্বিত ফিরল একটু পরে। শ্রী বৈরাগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে বাড়িতে ফিরতেই হবে। এত দূর এসে তো কিছুতেই ফিরে যাওয়া যায় না। দ্বিতীয় ভাবনায় আবার তটস্থ হতে বাধ্য হলো। গলা চড়িয়ে ডাকল, শুনছেন দাদা, রতন বৈরাগীর বাড়িতে যাব, ঠিক কোথায় যদি বলে দিতেন।
তাতেও সফির তন্ময়তা ভাঙল না। সে সুন্দরবনের মানুষ। মানসিক নিবিড়তায় খাঁটি মহারাজ। প্রকৃতি যেমন নিজস্ব চেতনায় তন্ময়, সফিও তেমনি। নিজের ভাবপ্রবণতায় অতলান্ত দার্শনিক। ফাতনাটা আবার নড়ে উঠল। তারপর সম্পূর্ণ কাত হলো। সফির স্থির দৃষ্টি সেই দিকেই। রুবিনার খোঁটকথা ভুলে যেতে বাধ্য হলো। নিজেই যেন ফাতনাবাজির সবচেয়ে বড়ো খেলুড়ে। বড়ো নিমগাছের প্রলম্বিত ছায়ায় নিমগ্নচিত্ত সফি। জলের উপর ফাতনার বিচিত্র লীলাখেলা।
পথের উপর তখনো থমকে দাঁড়িয়ে লোকটা। মনের গভীরে বিরক্তির বান। সফির প্রতি তার হৃদয় চরম বিদ্বেষে জর্জরিত। এতটুকু ভদ্রতা নেই লোকটির মধ্যে? সৌজন্য না থাকলে তো মানুষ জন্তুবৎ। এত কাছ থেকে ডাকার পরেও সাড়া দিতে পারল না? কালা নয় তো? শুনতে পায়নি বলেই কী?
তার পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। রতন বৈরাগীর নির্দিষ্ট ঠিকানা কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে।
একটু পরেই ফাতনাটা সম্পূর্ণ ডুবে গেল। সফি সেই প্রত্যাশায় ছিল। ছিপ ধরে শিল্পসম্মত টান দিল। খেলা শুরু হলো প্রমাণসাইজ কাতলার দৈহিক বলের সঙ্গে হুইলের শক্ত সুতোর। কখনো খল্খল্ শব্দে সুতো খুলছে। সফি পাকা খেলুড়ে। সময় করে তা গুটিয়েও নিল। তার দিব্যি ধারণা, কাতলার ওজন চার কেজির কমে নয়। সুদীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতা। বাপের কাছে হাতেখড়ি, তারপর নিজের অভিজ্ঞতায় পরিপক্বতা লাভ। মুখে আওয়াজ করল, জানিস নে, কার হাতে পড়েছিস। আমিও এ খেলায় জিততে পারি।
শেষ পর্যন্ত ইয়া কাতলাকে পাড়ের উপর তুলতে সমর্থ হলো সফি। দু’চোখে উত্তেজনার সমুদ্র। সমগ্র অন্তরজুড়ে অভিনব পরিতৃপ্তি। তাতেই সে রুবিনার উঁকি নতুন করে দেখতে পেল। কসরতের ঘামে সারা মুখ ভিজে সপসপে। ইয়া কাতলাকে উদ্দেশ্য করে সফির দাম্ভিক উক্তি, আমার সঙ্গে চালাকি। আবেগে আপ্লুত হয়ে পিছনে তাকিয়ে রাসভ স্বরে ডাকতে শুরু করল, ও দাদা শুনছেন, কী যেন বলছিলেন আমাকে?
লোকটা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হল। পায়ে পায়ে পিছনে সরে এসে ঝাঁঝালো স্বরে বলল, এভাবে পিছন থেকে ডাকছেন কেন?
না মানে, কী জানতে চাচ্ছিলেন?
আপনি তো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
তখন কাত হওয়া ফাতনার সঙ্গে ছিলুম।
লোকটার রাগ দেখানো প্রত্যুত্তর, আমার সঙ্গে কথা বলতে কে আপনাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে?
আরে দাদা, এভাবে রাগছেন কেন?
আপনি ফাতনাবাজি ছাড়া কিছুই জানেন না। না বোঝেন সৌজন্য, না বোঝেন মানবিক মূল্যবোধ।
সফি রাগ করল না, বরং ভাবল, বেশ তো মন্তব্য করতে পারল। এত সঠিক মূল্যায়ন করতে পারল কী করে?
আর বিলম্ব করল না সফি। পিছন থেকে লোকটাকে দ্বিতীয়বার ডাকারও প্রয়োজনবোধ করল না। প্রায় কেজি চারেক ওজনের কাতলা ডান হাতে ঝুলিয়ে সদর্পে হন্হন্ পায়ে এগিয়ে চলল। যেন যুদ্ধজয় করে দেশে ফিরছে পরম গৌরবের মুকুট মাথায় পরে। বাড়ির উঠোনে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো। রুবিনাকে উদ্দেশ্য করে তারস্বরে ডাকল, কই গো, গেলে কোথায়?
এই তো রান্নাঘরে।
আগে ফাতনাবাজিতে তোমাকে তুলেছি, আজকে কাতলার সাইজটা দ্যাখো।
রুবিনা লজ্জাতুর না হয়ে পারল না। বিড় বিড় করে বলল, পুরনো কথা নতুন করে তুলে লাভ কী? লোকটা একেবারে যা তা—।
মুসা আলি কথাসাহিত্যিক। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।