অপরূপকথা

বাবা... বাবা...
অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে ডাকটা। যেন সমুদ্রের ভেতর থেকে, একটা অদ্ভুত বুদবুদের মধ্য দিয়ে। আহা সমুদ্র! আমি তো একবার গিয়েছিলাম সমুদ্রে। কী বিশাল! কী নীল! খুব বাতাস ছিল সেদিন। জলমাখা বাতাস। লোনা বাতাস। লোনা...
বাবা...
আমার চোখে পানি চলে আসে। আসে, কিন্তু গড়িয়ে পড়ে না। আগে পড়ত। আমার মেয়েটা বিশ্বাসই করে না এসব। সে মনে করে চোখের পানি চিরকাল বুঝি এমনই। ঘন আর আঠালো।
বাবা, তুমি কাঁদছ?
চোখ খুলি আমি। আমার মুখের ওপর আমার মেয়ে। বড় বড় চোখ তার। কিন্তু বড় মাছের মতো এই চোখ। নিষ্প্রভ! অথচ তার ভেতরেই কী একটা ঝিলিক এখন।
দেখ আমাকে... দেখ বাবা...
ওরে বাবা! তুই তো আজকে সেজেছিস মা!
মেয়েটা খুব খুশি হয়। একপাক ঘুরে যায়। একটা সস্তা রঙ লাগিয়েছে ঠোঁটে। আলগা একটা তিলও বসিয়েছে থুতনিতে। আর একটা নীল কাপড় পরেছে শাড়ির মতো পেঁচিয়ে।
মামার মতো লাগছে না বাবা?
তিন বছর বয়সেই মাকে মামা বলতে শিখে নিয়েছিল সে। আরও কত কী যে শিখেছিল! মায়ের মেকআপবক্স খুলে একা একা সাজত। আমার গালেই কতবার লিপস্টিক লাগিয়ে দিতো। লাল লাল গাল নিয়ে কত ছবিও তো তুলেছি সে সময়—এখন আর নেই ওগুলো। 
সেসব নিশ্চয়ই ওর মনে নেই। 
সেসব যেন একটা জীবন আগের গল্প। 
সেই ২০২০ এর গল্প৷ যেন কোনো রূপকথার গল্প! অথবা কোনো এক অপ-রূপকথার গল্প! 
পুরোনো দিনের বাতাস মুখে এসে লাগতেই মনে আসে মেয়েটা আজ ১৮ হলো। খুশিই হওয়ার কথা আমার, সন্তানের জন্মদিনে তাই তো হওয়ার কথা বাবাদের, কিন্তু ১৮ যে ভয়ংকর; ভয়ংকর বলেই হঠাৎ বিষাদে মনটা ভরে ওঠে। মুখের ভার ঢাকতে জোর করে হেসে বলি, হ্যাপি বার্থডে বাবা...
মেয়েও আমার হাসে। তারপর ল্যাপটপে খুলে দেখায়। ত্রিমাত্রিক কার্ড একটা। 

ওরা পাঠিয়েছে, সুন্দর না?
আমি কার্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি। মেয়ে বলে, আমরা কিন্তু আজকে বাইরে যাবো... তুমি না করতে পারবে না... এই কার্ড তো থাকছেই, রাস্তায় কেউ ধরতেও পারবে না। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক, বলো?
বাইরে বের হওয়াটা এক ঝক্কি। এত কিছু পরে এত সেফটি নিয়ে বেরোতে হয় যে খুব অস্বস্তি লাগে। পনের বছরেও সেটা কাটেনি। শুধু মনে হয়, এরচেয়ে আমার এই কাচঘেরা আধভাঙা ঘরদোরই ভালো!
তবুও আমরা বের হই। এমন সুযোগ যে আর আমাদের আসবে না! বেরোনোর আগে অবশ্য দুজনে রেশনের দুটো প্রোটিন ক্যাপ খেয়ে নিই। এগুলোর জন্যই তো আমরা এখনো বেঁচে আছি। আমাদের সারাদিনের খাদ্য এই বড়ি। শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে... তবে জীবিত রাখে কিনা কে জানে! আফসোস হয়, যদি আরও আগে এগুলো আসত... দুজনের বদলে হয়তো তিনজন আজ বেরোতে পারতাম। আবার স্বস্তিও লাগে... সময়মতো এসেছিল বলেই হয়তো আজ দুজন বেরোচ্ছি। না হলে হয়তো একজন... অথবা কেউ না!
মহল্লার মাথাতেই জোনাল সুপার আটকান। 
মেয়ে আমার খুব চটপটে তো... সুপারের স্ক্রিনেই নিজের পাসওয়ার্ড দিয়ে ইউনিয়নের পাঠানো কার্ডটা দেখিয়ে ফেলে। 
সুপার হাসে। শুভ জন্মদিনও বলে বোধহয়। আমি ঠিক শুনি না। এদের কথা শুনতে কোনোদিনই আমার ভালো লাগে না। বেরিয়েই যাচ্ছিলাম, সুপার বলে উঠেন, চাচা, এইবার আপনি কী করবেন?
ঝা করে রাগটা চলে আসে মাথায়। মেয়ে বুঝে আমার হাত ধরে নেয়। পিঠে আলতো হাতের চাপড়ও।
চলো তো... দিনটা কী সুন্দর, না?
দিন সুন্দর মানে রোদে ঝলমল করা দিন। জন্মদিনের জন্য উপযুক্ত। বিস্তৃত রাস্তা, ফাঁকা। অনেক দূরে একটা খাবার দোকান। খোলা। আমরা ওখানে যেতে পারি না। আমাদের কোনো ক্রেডিট নেই। ইউনিয়নের বরাদ্দ প্রোটিন ক্যাপ... আমাদের জন্য অতটুকুই।
এসবে খুব যে বেশি দুঃখ হয়, তা না। ২০২০ আমাদের সমস্ত অনুভূতি পাল্টে দিয়েছে। এখানে এখন বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। যেভাবেই হোক। আর শুধু আমরা তো না, আমাদের মতো সর্বস্ব হারানো মানুষই এই শহরজুড়ে। ওই খাদ্যবিতান তাই খালিই থাকে... ইউনিয়নভুক্ত কেউ কেউ যায় হয়তো ওখানে... জানি না ঠিক... তবে ওরাই তো যাবে!
আমরা অনেকটা পথ হাঁটি। আমার ক্লান্ত লাগে। নুয়ে আসে শরীর। কিন্তু বসতেও ইচ্ছা হয় না আমার। মেয়েটা দুনিয়া দেখছে। যেন প্রথমবার! পরক্ষণেই মনে হয়, কে জানে, হয়তো শেষবার! ১৮... কী ভয়ংকর একটা বয়স!
আমরা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াই। এখানে এক সময় কত বসতি ছিল। মানুষ আর মানুষ ছিল। হৈ ছিল, ছিল হল্লা! মেয়ে বিশ্বাস করে না। বলে, তুমি এত বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারো না বাবা... আমি কি আর সেই ছোট্ট খুকি... আমি না এখন ১৮!

বলেই মেয়ে আমার কেঁপে ওঠে। বুঝতে পারি কেন... আমার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কিন্তু মুখের পলিমাস্কে সেটা বাষ্প হয়েই জমে থাকে, পৃথিবীর কোথাও তার আশ্রয় হয় না!
হঠাৎই মেয়ের কী হয়... আমার হাত ধরে টানে! টানতে টানতে দাঁড় করায় একেবারে নদীর কিনারে। এখানে বালি একটু ভেজা। চোখকে কেমন ঠান্ডা করে। মেয়ে বলে, চলো বাবা, একটা খেলা খেলি...
কী খেলা?
বসো না তুমি এখানে...
মেয়ে কাঠবেড়ালির মতো ঘুরতে থাকে। কখনো একমুঠো ভেজা বালি তো কখনো একমুঠো ধুলো তো কখনো ইঁটের গুড়ো নিয়ে এসে জমাতে থাকে। তারপর সেগুলোকে একটা ভাঙা প্লাস্টিকের পাত্রে ওঠাতে থাকে। ছুটে পানি নিয়ে আসে আঁজলা ভরে। আরও কী কী সব করে... পাত্রটির ওপর ধুলোবালির গোল একটা বস্তু তৈরি হয় এক সময়। মেয়ে বলে, চলো বাবা... কেক কাটি?
ঝপ করে চোখে পানি চলে আসে। ওর প্রথম তিনটা জন্মদিনে আমরা কেক কেটেছিলাম। হ্যাপি বার্থডে গাইতে গাইতে আমরা কত হুল্লোড় করেছিলাম। 
তিন বছরের স্মৃতি কি মানুষ বহন করে? ওর মাথায় কি কেক কাটার বিষয়টি রয়ে গেছে? 
অথচ ওইসব স্মৃতি মুছে দেয়ার জন্য আমাদের ঘর থেকে মাত্র একটা ফ্যামিলি ফটো রেখে, ইউনিয়ন সব ছবি সব ফাইল মুছে নিয়ে গেছে। ইউনিয়ন মনে করে পুরোনো জীবনের এইসব স্মৃতি মানুষের এখনকার নতুন জীবনে অকারণ বাধা। আমার মেয়ের তাই স্মৃতিশূন্য হয়ে বেড়ে ওঠার কথা!
বাবা…  কেক কাটো না! আমার তো খুব খিদা পেয়েছে!
চমকিত হই। খিদা আমাদের এখন কারও পায় না। ওই যে প্রোটিন ক্যাপ... তাহলে ও কি আসলে সব মনে করতে পারে?
একটা কাঠি এগিয়ে দেয় সে। ভ্রু নাচিয়ে ধুলোবালির কেকটা দেখিয়ে দেয়। ইশারায় বলে, কাটো!
আমি কাঁপা হাতে কেক কাটি। একটা অংশ তুলে দিই মেয়ের দিকে। মেয়ে সেই ধুলোবালির কেকে কামড় বসায়। নিষেধ করার ইচ্ছা হয় না আমার। আমিও তো আলগোছে একটুকরো কেক মুখে তুলে নিই। কত দিন পর..।  মেয়ে আমাকে জাপটে ধরে। বলে, তুমি ভালো থেকো বাবা!
রাত এগারটা বাইশ মিনিটে ওরা আসে। 
আমার মেয়েটাকে নিয়ে যায়। 
১৮ হলেই এখন সবাইকে চলে যেতে হয় অন্য এক পৃথিবীতে। ১৮ বছর এই পৃথিবীতে যারা টিকে থাকতে পারে তারা মানবপ্রজাতিকে এগিয়ে নেয়ার বড় ভূমিকায় অংশ নেয়৷ ইউনিয়ন তাদের পাঠিয়ে দেয় আলোকবর্ষ দূরের কোনো এক গ্রহে। সেই গ্রহটা কেমন কোনো ধারণা নেই আমার। কিন্তু আমার মনে হয় সেই গ্রহটা হয়তো ১৫ বছর আগের এই গ্রহটির মতোই অপরূপ সুন্দর। আমার মেয়েটি সেখানে নতুন জীবন গড়বে... সেখানে সে হাসবে, গাইবে, নাচবে... নিশ্বাস নেবে।
আমরা যেমন নিতাম ১৫ বছর আগে।
আমার বড় চোখের সুন্দর মেয়েটির নাম রূপকথা!


আহমেদ খান হীরক কবি, কথাসাহিত্যিক। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত আছেন। কাব্য : আত্মহননের পূর্বপাঠ (২০১০) রম্য সংকলন : যে কারণে আমি সাকিব আল হাসান হতে পারি নি (২০১৭), কী একটা অবস্থা (২০২২) গল্প সংকলন : য পলায়তি স জীবতি (২০২০), সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা (২০২১) কিশোর নভেলা : জাফির অ্যাডভেঞ্চার (২০২২)

menu
menu