ললাট

সুনসান নিস্তব্ধ যূথচারী আঁধারের এই রজনীতে শূন্য নিঃসঙ্গ আপন মনে আঁতুর হৃদয়ের প্রতিটি কপাট নাড়তে চেয়েও নাড়াতে পারিনি, হাঁপিয়ে উঠেছি। বিষণ্নতায় বুকটা অস্থির, ঘোর লেগেছে চোখে, এদিক থেকে সেদিক নড়তে বয়সের ভারে জীর্ণ -শীর্ণ হয়ে যাওয়া আমার চৌকিটা কটকট আওয়াজ করে ওঠে, তবু উঠে বসতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না, জানলার মিহি ছিদ্রগুলো দিয়ে খুব সাবধানে আমার ঘরে প্রবেশ করছে বাতাস, শীতলতায় ভরে আছে সারা ঘর। সময়টা দারুণ। তবে ভীতি প্রদর্শণ করছে।
এই বাড়িটা দোতলা বিশিষ্ট। আমি থাকছি দোতলার একটি রুমে, বাকি ঘর পুরোই খালি, মূলত বাড়িটা পরিত্যক্ত কারো থাকার জিজ্ঞাসাই নেই, বাড়ির মালিক কেন বাড়িটা বানিয়েছে? এই প্রশ্নটা এখনো আমার মাথায় ঘুরপাক খায়।
এই বাড়িটার আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই যদিও চোখের সীমানার মধ্যে আছে কিন্তু বিপদে পড়ে ডাক শোনে কেউ বাঁচাতে আসবে সে আশা করা যায় না।
বিদ্যুৎ নেই লোডশেডিং, ভয়ে বুকটা দুরু দুরু করছে।
নিজের হাতটা চোখের সামনে ধরলাম কিন্তু দেখতে পেলাম না। ঘোরলাগা অন্ধকার সম্ভবত আমার পূর্বজন্মের কোন এক রজনী। যেখানে আমাকে রাখা হয়েছিল অথবা আমি এক মৃত প্রাণ, নিদ্রার ঘোরে মরে ছিলাম। আমাকে সমাধিস্থ করা হয়েছে, আমার শব দেহে প্রাণ এসেছে। হিসেব হবে এখন আমল-আখলাকের, কিরামান কাতেবিন ফেরেস্তা নথিপত্র নিয়ে আসবে দেখানো হবে পাপের ফিরিস্তি, কত পাপ আমার, অনেক পাপের কথা ভুলেই গেছিলাম। কিরামান কাতেবিনের কথা মনে পড়ায় সেগুলো আবার মনে পড়েছে।
বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে মৃত্যু সংবাদদাতা পাখিটাকে থেমে থেমে কু-কু করে ডাকছে। তার শব্দ ডাক মধ্যরাতে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দের মতো ভয়ানক। এই বাড়িটার সামনেও জঙ্গল তবে পরিকল্পিত একপাশে দিঘির মতো বড় পুকুর মাথার উপর ছাতার মতো কতগুলো কড়ই গাছ।
কিরামান কাতেবিন এখনো আসছে না, ফেরেশতাদের রাস্তায় কি জ্যাম আছে? থাকার কথা নয়, জানালাটা একটু খুলে দেখলে কেমন হয়? 
না থাক মৃত্যু সংবাদের পাখিটা এখনো ডাকছে সম্ভবত সে আমারই মৃত্যুসংবাদ দিতে এসেছে না হয় এত ভয় লাগছে কেন? জানালা খুলতেই সে ভেতরে ঢুকে সংবাদটা দিয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো মৃত কিরামান কাতেবিন এর অপেক্ষায় আছি তাই আমার অস্থিরতা হচ্ছে।
একটা নারীর কণ্ঠ ভেসে আসছে, খুব বিরক্তিকর কণ্ঠে বলছে আমায় ছেড়ে দাও। প্লিজ আমি চলে যাব আমাকে মাফ করো সম্ভবত তার হিসেব চলছে, তার পর আমার পালা কিরামান কাতেবিন এর কাছে মাফ চাচ্ছে মহিলাটি।
আসুক কিরামান কাতেবিন আসুক, বিচার হয়ে যাক তবে হিসেবে চুকে যাক। এই আঁধার বিতাড়িত হোক। কিন্তু আমার দুঃখ কবে যে মরে গেলাম টেরই পেলাম না, আমার পরিবার-পরিজন কই? কেউ নাই পথে মরে পড়েছিলাম। সম্ভবত, কেউ ফেলে গেছে এই আঁধারে। আপনজনরা ভাবছে অভিমানে কোথাও লুকিয়ে আছি কিন্তু আমার তো কারও ওপর অভিমান নেই।
নিচে কেচি দরজা ধরে সম্ভবত কেউ চেঁচাচ্ছে, আমার ঘুম ভেঙে গেল। কী আশ্চর্য আমার রুমের লাইট জ্বলছে বুকের উপর বই নিয়ে আমি শোয়ে আছি, অথচ স্বপ্ন দেখছি অন্ধকার, ঘোর অন্ধকার, শ্লথ পায়ে নিচে নেমে এলাম। সজল ভাই দাঁড়িয়ে আছে ক্রুদ্ধ নয়নে। কিরামান কাতেবিন আসেনি, এসেছে এরা। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াকুব। ইয়াকুবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আপদমস্তক কালো বোরকায় আবৃত এক হুর নারী।
গায়ে চিমটি কাটলাম এটা বাস্তব? এখন আর স্বপ্ন নয় মেয়েটা চোর চোর চোখে তাকাচ্ছে, তার চোখ স্থির নেই অসীম রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।
সজল ভাই চেঁচিয়ে উঠলো বাইরের লাইট অফ কর, তাড়াতাড়ি গেট খোল সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি, মরণের ঘুম দিলি নাকি? মাত্র বাজে এগারটা!
তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিলাম, সজল ভাই সত্যিই খুব রেগে আছে, আমাকে সে আপনি সম্বোধন করে এখন তুই করে বলছে, বয়স হিসেব করলে সে আমার থেকে পাঁচ থেকে ছয় বছরের বড় হবে। পাশে থাকা ইয়াকুব ভাইয়ের বয়স হবে আমার থেকে ন্যূনতম দশ বছরের বেশি। তার পাশে থাকা নারীর বয়স অনুমান করা যাচ্ছে না।
সজল ভাই এবার শান্ত হলো। বলল, যান দো'তালার বারান্দার লাইট অফ করেন। আমি দৌড়ে গিয়ে অফ করলাম অনেকটা বাধ্য ছেলের মতো। 
এই পরিত্যক্ত বাড়িটার দায়িত্ব সজলের কাছে, তার কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ি তারা শহরে থাকে, আগে প্রতিবছর পুরো পরিবার এখানে বেড়াতে আসত। বিগত দশ বছরে নাকি কেউ আসেনি।
এই মুহূর্তে এ বাড়ির মালিক সজলকে বলা যায়, আমি এখানে এসেছি ছোট একটা চাকরি নিয়ে, গ্রাজুয়েশন এখনো শেষ হয়নি অভাবের সংসার আমাদের। নিজের খরচ নিজেকে মেটাতে হয়, যার দরুণ চাকরিটা করা এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। এখানে এসে থাকার জায়গার অভাব হয়েছে অনেক অবশেষে সজলের সঙ্গে পরিচয়, সে পরিচয় থেকে এখানে থাকা বিগত দুই বছর ধরে আমি এখানে থাকি আজকের মতো ঘটনা কখনো ঘটেনি। এমন স্বপ্ন ও কখনো ভাবিনি। 
বাড়িটা পরিচর্যা ও আবাসহীনতার দরুণ অনেকটা ভুতুড়ে হয়ে আছে, সজলের এক চাচা দিঘিসম পুকুরটাতে মাছ চাষ করে, প্রতি সকালে আসে প্রথম প্রথম ভেতরে আসত এখন আর আসে না।
এখানে কোথাও নাকি সে জ্বিন দেখেছিল, তাই রাতে আসার প্রশ্নই উঠে না।
আমি টেবিলের সামনে বসলাম চেয়ার নেই, চৌকিটা চেয়ারের কাজ দেয়, চৌকিতে তোশক নেই, দুইটা বড় কার্টুন খুলে বিছিয়ে দিয়েছি, তার ওপর বিছানা চাদর। সজল ভাই একদিন এসে বসেছে, পরে উঠে গিয়ে একটা মোটা কাঁথা এনে দিলো, তারপর থেকে সেই কাঁথা। সারা ঘরে এই একজোড়া জুতো একটা মশারি স্ট্যান্ড নেই, একটা টেবিল আর ড্রয়ার ছাড়া, একটা ঝাড়ু, ছোট্ট একটা ব্যাগ যাতে গচ্ছিত থাকে আমার সংসার এবং ভবিষ্যৎ। 
এই একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা। এখানে কোনোভাবে কেটে যায় আমার দিনযামিনী। যেদিন সজল এখানে নিয়ে এলো সেদিন থেকে এখানে থাকছি। পড়ালেখার জন্য সুন্দর জায়গা ।
সজল এবং ইয়াকুব মেয়েটাকে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। ওই রুমটাতে খাট আছে তোশক আছে তবে অপরিষ্কার। সব আছে, বাড়ির মালিক আসলে ওখানে থাকত। চাবি তার সঙ্গে থাকে, একসেট চাবি সজলের কাছেও থাকে। আমার কাছে আছে একসেট। আমার কাছে যেটা আছে সেখানে ওই রুমের চাবি নেই। 
সজল আধঘণ্টা পর বের হয়ে আসল। তার কপালে মিহি ঘাম। শার্টের বোতাম খোলা এলোমেলো চুল। আমাকে যেতে হচ্ছে তাদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করতে, যা পাওয়া যায় রুটি কলা কিংবা গোশত পরোটা। গোশত পরোটা হলে ভালো হয়।
সজলের বোতামের মতো কি মেয়েটার বোরকা খোলা? 
হতে পারে। আরও অনেক কিছু খোলা থাকুক তাতে আমার কী? সজলকে আপাতত এড়িয়ে চলতে হবে
আরও আধঘণ্টা পরে আমি পৌঁছালাম। কলা রুটি পাওয়া গেল।
সজল একপলক আমাকে দেখে গেল, আমি আবার টেবিল সামনে বসে পড়লাম। অহেতুক বই নাড়াচাড়া করছি। কী করছে তারা মেয়েটাকে? তারা কী মেয়েটাকে রেখে যেয়ে আমাকে ফাঁসাবে? অথবা গ্রামবাসী এলে লাঠি হাতে, আমাকে ধরিয়ে দেবে?
অনৈতিক কিছু কি তারা করবে? দু'জনই বিবাহিত। দুজনেরই ছেলে সন্তান আছে, বউ আছে।
স্বপ্নের চেয়েও বেশি ভয় পেতে থাকি। যদি পুলিশ আসে, কিডন্যাপ মামলায় ফেঁসে যাই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে।
ভয় এবং আতঙ্কে আমি অস্থির। সজল এসে আমার ঘাড়ে মৃদু ধাক্কা দেয়।
আমি সংবিৎ ফিরে পাই, মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকি কিছু বলতে পারি না।
—চলবে নাকি? 
মৃদু হাসি ছাড়া আমার কোনো উত্তর নেই।
ইয়াকুব রসিকতার সুরে বলছে—আরে মিয়া পুরুষ মানুষের লজ্জার কী? যার লজ্জা থাকার সে কাপড় খুলে আছে। আপনার জন্য তৈরি হয়ে আছে, খুব যত্ন করবে যান।
সজল বলল, ‘নীরব ভাই যান, আমরাই তো।’
আমি হেসে বললাম না আমি এ অন্যায় করতে পারব না।
সজলের কাছে, ইয়াকুবের কাছে আমি সব সময় সৎ এবং ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত এবং তাদের সামনে আমি এক ধরনের অহমবোধকে জাগ্রত করে রাখি। আমি পড়ালেখা করা শিক্ষিত ছেলে তাদের সঙ্গে চলি বলে তারা গর্ববোধ করে। অন্যকে বলে। এদেরকে অশিক্ষিত বলা যায় তবে এরা ধূর্ত, চালাক প্রকৃতির।
এ পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয়ের সুবাদে তাদের সঙ্গে আমার চলতে হয়, তাতে মাস শেষে বাসা ভাড়া দু'হাজার টাকা বেঁচে যায়। তাই তাদের আজেবাজে রুচিহীন কথাবার্তায় হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দিতে হয়।
আমি অবিচল এ পাপ আমি করতে পারব না। সজল প্রলুব্ধ কণ্ঠে বলল। চলেন কিছু করা লাগবে না শুধু পরিচয় হয়ে আসেন । একটা মেহমান আসছে সামাজিকতারও একটা ব্যাপার আছে। সজল শক্ত হাতে আমাকে কব্জাভুক্ত করল, টেনে নিয়ে গেল কুরবানির গরুর মতো, পেছনে ইয়াকুব, বারান্দা পার হয়ে যেতে আমার বুকটা দুরু দুরু করছে। দরজাটা খোলা রুমে লাইট অফ, এরুম এ লাইট জালানো যাবে না। মেয়েটা অন্ধকারে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, সজলের হাতে টর্চ লাইট, টর্চ লাইট জ্বালিয়ে আমাকে বলল, দেখেন কেমন পরী এসেছে। 
আমি হতভম্ব! কি লজ্জার কি ঘৃণার এবং উত্তেজনার কথা, পুরো উদ্দাম কোন নারী। 
টর্চের আলোর সঙ্গে তার শরীর যেন সমান তালে জ্বলছে তার শরীরের আভায় আমার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছে। টর্চের আলো থেকে সে নিজেকে লুকাতে যেয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পড়লো, মনে হচ্ছে সাপ ওঝার ভয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে নিজেকে রক্ষা করছে।
আমি পেছনে ফিরে আসলাম। সজল ত্যাক্ত বিরক্ত সুরে বলল যান। আরও লোকজন আসবে, আপনি তার আগে যান, আপনি আমাদের মানুষ, আমাদের লোক, যতক্ষণ ইচ্ছে থাকেন, কাঁপাইয়া দেন যতবার মন চাইবে যাইবেন, আগে আপনার অধিকার।
জায়গা আমাদের, আমাদের পাওয়ার বেশি।
কি হলো যাবেন?
মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
সজল ইয়াকুব সমস্বরে হেসে উঠল। খসে পড়ল আমার এতদিন ধরে, ধরে রাখা শক্ত নির্মোকে আবৃত সকল অহমবোধ সততা আর ভদ্রতার ছাপ।
দারুণ বিরক্তি হচ্ছে, কিন্তু আমি এখনই তাদের দলে মাথা নেড়ে তাদের দলভুক্ত হলাম। সজল আমাকে হাত ধরে আবার রুমের সামনে নিয়ে গেল।
অন্ধকার একটা ঘর, জানালা খুলে দেওয়া। ঝাপসা আলোতে তার দেহের আকৃতি বুঝা যাচ্ছে। আবছা আলো তার দেহটা জ্বলজ্বল করছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি ভয় হচ্ছে খুব ভয়। আমি ফিরে এলাম এ ভয়ার্ত আতঙ্কিত ঘর থেকে কিন্তু অপমান, অপদস্ত ও পুরুষত্ব রক্ষায় পুনরায় প্রবেশ করলাম। ইয়াকুব পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
আমি শ্লথ গতিতে তার দেহের কাছে পৌঁছালাম। পেলব হাতে তাকে ছুঁয়ে দিলাম, বিদ্যুৎ ছুঁয়েছি যেন আমি। আসক্তি কামনা ভয়লজ্জা অহংবোধের বিসর্জন আমার ভেতর অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হলো। সে এক হেঁচকা টানে আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। আমি থরথর কাঁপতে ছিলাম, নিজেকে চরম অসহায় লাগছিল, সে খুব শাসিত গলায় কথা বলছে। সজল ইয়াকুবরা বের হয়েছে তালাবন্ধ, ভেতরে আমি আর এ রমণী ছাড়া কেউ নেই। আমরা দুজনই ভেতরে, বাহিরে থেকে আটকানো।
তাদের বাহিরে যাওয়া আমাকে আরও বিচলিত করে তুলেছে। ভয় লাগছে। কি হতে যাচ্ছে—ওরা কি আমার মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেবে? এখানে এ সমাজে আমার একটা সদাচরণের পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। মেয়েটা আরও শাসনের সুরে বলছে দেখো আমি কিন্তু খারাপ মেয়ে নয়। ইয়াকুব আমার সঙ্গে প্রেমের নামে প্রতারণা করেছে। সে নিজে একা বলে আমাকে এনে এখন বেশ্যা বানাচ্ছে। ওর খবর করে ছাড়ব।
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আমার। কেমন জটিলতায় পড়ে যাচ্ছি, কপালে খুব খারাপ কিছু লেখা আছে সম্ভবত! বিষণ্নতা নিয়ে রুমে চলে গেলাম।
সজল ইয়াকুব ফিরে এলো। সজল বলল শেষ?
কী বলেন ইয়ং মানুষ এত তাড়াতাড়ি শেষ। সংসার কেমনে করবেন? বউ পালাবে।
তাদের সঙ্গে এসেছে আরও তিনজন।
কিছুক্ষণ আগে আমার রুমটা ছিল শান্ত স্তব্ধ এখন আড্ডায় জমে উঠেছে।
নতুনদের একজনকে পাঠানো হলো। ওই রুমটাতে আমি জানি তারা মেয়েটার সঙ্গে জোর করছে, কিন্তু সে চিৎকার করছে না কেন? হয়তো মানসম্মানের ভয়ে সয়ে যাচ্ছে।
বাকিরা সিগারেট টানছে হরদম, হাসির মুখরোচক গল্পের অভাব নেই। আমিই একমাত্র শুধু শ্রোতা আমার কাছে কোনো গল্প নেই। আছে শুধু ভয়, আছে ইয়াকুবের কাছে কতগুলো জিজ্ঞাসা।
ক্রমাগত সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে চলছে।
জানলা খুলে দেওয়া হয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে নিচে যেন পুলিশের শব্দ পাই কিন্তু পুলিশ আসবে না, একটা মেয়ের সর্বনাশ হচ্ছে পুলিশ জানবে কীভাবে? এ পরিত্যক্ত বাড়ি আজ মেহমানে ভরপুর। এখানে বাসর হচ্ছে এ বাসরে কোনো বাচ্চা জন্ম নিবে না। নিলে সে হবে ঘৃণিত।
ইয়াকুব মাঝে মাঝে খিলখিল করে হাসে এবং মেয়েটার শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলোর বর্ণনা দিয়ে যায়।
কী নীরব ভাই কিছু বলছেন না কেন? মজা পাইছেন না? আরও পাইবেন আমাদের সঙ্গে থাকেন।
সজল একটা বোতল হলে আরও জমতো বলল ইয়াকুব। কি শিক্ষিত সমাজে এগুলা বেশি চলে। অভ্যাস আছে?  আনামু একটা? আমি ফোন দিলেই দিয়ে যাবে।
না দরকার নাই।
আমার দরকারে তাদের কী যায় আসে।
আধঘণ্টা পরে আগন্তুক ফিরে এসেছে।
নতুন একজনকে পাঠানো হলো।
যে এসেছে সে বলছে পাক্কা খেলোয়ার মাগি। কই পাইলি ইয়াকুব?
ইয়াকুব হো হো করে হেসে উঠল। নিজের প্রশংসা কার না ভালো লাগে? 
দেখলেন কী বলে? আবার যাবেন নাকি? এই যে ট্যাবলেট এটা পানি দিয়ে গিলেন। আধঘণ্টা পাক্কা আধ-ঘণ্টা পারবেন।
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাসলাম।
—না আমি ঘুমাব। 
সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লাম তাদের সিরিয়াল মেনটেন করে যাওয়া-আসা দেখতে দেখতে।
মনেই হচ্ছে না গতরাতে এই পরিত্যক্ত বাড়িতে একটা মেয়েকে সর্বনাশ করা হয়েছে। তবে বাড়িটা অনেকদিন পর এতগুলো মানুষ একসঙ্গে পেল। 
সূর্য উঠার পর এ রকমই মনে হচ্ছে।
আহা! আমার সঙ্গে এ বাড়িও এমন একটা ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল।
বাড়ির মালিকের অঢেল টাকার নিদর্শন এ বাড়ি।
খুব সুন্দর ডিজাইন করা হয়েছে, পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়ি হলেও এর সৌন্দর্য এতদিন আমায় মোহিত করে আসছিল কিন্তু আজ তার কোনো সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে না। আমি অপেক্ষায় আছি পুলিশের মেয়েটা নিশ্চিত পুলিশে নোটিশ করেছে। ধর্ষণ মামলা করেছে। পালাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছি না। 
সজল এসে আমাকে মর্মাহত দেখে আশ্চর্য! কিরে ভাই ফুরফুরে থাকার কথা, মন মরা হয়ে আছেন কেন?
আমি তাকে ঘটনার বিবরণ দিলাম। শোনে সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। বেশ্যারে ভাই বেশ্যা। একটা ডেবনি মাগী সে। আপনার কাছে ভালো সেজেছে, আমি তাকে বলেছি আপনাকে ভালো করে খাতির যত্ন করতে—আপনি ছাত্র পড়ালেখা করেন। নতুন পাইয়া আপনারে মাগি কট দিছে।
আপনি জানেন! এক রাতের জন্য কত টাকা নিয়েছে?  তিন হাজার টাকা নিয়েছে। আপনার টাকা লাগেনি আমার লাগেনি আমরা জায়গার মালিক আমাদের একটা পাওয়ার আছে না?
টাকা নিয়েও সে আপনা কট দিছে। তিন হাজার টাকা, টাকা কি গাছে ধরে? একটা মানুষ সারাদিন কাজ করে পায় পাঁচশো আর সে একদিনে পাইলো তিন হাজার।
আমি সজলের দিকে তাকিয়ে থাকি, ইয়াকুবের কথা ভাবি তাদের বউ আছে, বাচ্চা আছে তবুও পর নারী আসক্তি। সজল এমন ছিল না। 
নীরব ভাই সমস্যা নেই এখন থেকে মাঝে মাঝে পাবেন। ফ্রিতে পাবেন। টাকা পয়সা লাগবে না, শুধু একটা তোশক কিনে নেন। ভালো মানের মেহমান আসবে তো।
ঘরটা সত্যি বনু টাইপের হয়ে গেছে কিন্তু এসব বিষয়ে আমার চিত্তবিক্ষেপ, তাই অন্তত নিজের ঘরটা পরিচর্যা করা হয় না। 
দু'দিন পর ঠিক একই কাজ হয়েছে রাত দশটার মধ্যেই সজল ইয়াকুব হাজির হিজাব পরিহিতা সে রমণীকে নিয়ে। আজ আমার কোনো উচ্ছ্বাস নেই, উত্তেজনা নেই, একই রকম চিত্র ঘটল। জায়গার মালিক বলে সজল উদ্বোধন করবে এটাই নিয়ম করেছে। এতক্ষণে আমার কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সত্যি সে মেয়েটি কি না দেখার জন্য, সত্যিই কি তাকে প্রতারণা করা হয়েছে? জানা দরকার।
ঘণ্টাখানেক পর সুযোগ আসল।
ইয়াকুব এসেই একটি ট্যাবলেট দিয়েছিল। খেতে ইচ্ছে করেনি, আজকে বোতলও আছে। তিনটা বোতল ভদকা, জোরপূর্বক একঢোক গিলেছি, গলাটা পুড়ে গেছে, আজ নাকি অন্য দিনের চেয়ে লোক বেশি। তবে ইয়াকুবের পক্ষ থেকে আমার জন্য ফ্রি টাইম। একমাত্র আমিই যতক্ষণ চাই মেয়ের সঙ্গে থাকতে পারব।
আমার ভয় হলো নিশ্চয়ই তারা কোনো ফন্দি করেছে। আমাকে নিশ্চয়ই আটকাতে চায়। ভীতসন্ত্রস্ত মনে ধীরগতিতে হেঁটে গেলাম যা হবার তা হবে, তবে আমাকে জানতে হবে মেয়েটা কেন এই কাজ করছে।
আজকে বিছানা অন্য একটা মনে হচ্ছে। ঘরে ঢুকার সময় সজলের হাতে অন্য কিছু একটা ছিল। সম্ভবত সে এনেছে কিন্তু বিছানার উপরে সেদিনের সেই কামিনী ঠিকই শয্যা পেতে আছে।
আমাকে চমকে দিয়ে কোমল দুটি হাতে আমাকে জড়িয়ে ফেলল। হ্যাঁচকা টানে বিছানায় শুইয়ে দিল, খুব রসিয়ে যত্ন চলছে, খুব যে অভিনয় তা বোঝা যাচ্ছিল। বুঝতে পারলাম এ ঘরে যারা আসে সবাই অভিনয়ে পাক্কা বর কনে বাসর বাসর খেলে কিন্তু এখানে কোনো বাচ্চা জন্ম নেবে না, এরা দারুণ অভিনয় করে। 
আমি যেন মহুয়ার রসে আসক্ত আমাকে ভস্ম করে ফেলেছে তার উষ্ণতা, এমন আলিঙ্গন মহুয়ার চেয়ে কম নয়। পাশের রুমে কতগুলো কাপুরুষ ঢক ঢক করে মদ গিলছে এবং আহ্লাদে, গল্পে ফেটে পড়ছে আর এখানে এক কাপুরুষ টাকায় কেনা বেশ্যার স্বামী অভিনয়ের রিহার্সেল করছে।
কিন্তু আমাকে জানতে হবে কেন সে বেশ্যাগিরি করে। এমন প্রশ্নের উত্তরে সে আমাকে দারুণ আলিঙ্গনে চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। আমি হতবাক হয়েছি এত সহজে মানুষ কান্না করতে পারে? 
—আমি এমন ছিলাম না, অভাবে অনটনে বড় হলেও চরিত্র নষ্ট করিনি এই যে ইয়াকুব দেখছেন, সে আমার ছোট বোনের জামাই। আমার চাচাতো বোন। আমি তার জ্যাঠশ। আমার স্বামী অপু একটা বখাটে, ছিচকা চোর। চুরি-চামারি করত। মানুষের মার খেত। নেশা করত। বাড়িতে এসে আমাকে মার-ধর করত। আমার দুটো মেয়ে, একটা মেয়ে এখনো দুধ খায়। এই যে দেখুন ইয়াকুব বাচ্চার খাবার সব খেয়ে নিয়েছে। আমার এই ছোট বাচ্চাকে রেখে এখানে মনের সুখে শরীরের সুখের চাহিদা মেটাতে আসিনি। এসেছি শরীর দিয়ে শরীর বাঁচাতে, ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালারে ভাই। না খেয়ে থাকতে চেয়েছি পারি না। বড় খাদক মেয়ে আমি, না খেয়ে বাঁচতে পারব না।
আমার স্বামী অপু যখন মাদক মামলায় ফেঁসে যায়, তার জেল হয়, গত এক বছর সে জেলখানায়। ইয়াকুব মাঝে মধ্যে কিছু সাহায্য সহযোগিতা করত। কিন্তু তার আড়ালে ছিল আমার শরীর। শরীরের দিকে তার নজর। সে আমাকে ঋণী করে ফেলে আমারও গতি কি? ইয়াকুব প্রতিদান হিসেবে শরীর চায়। আমিও অভুক্ত ভেবে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে, না করতে পারিনি। তখন থেকে ইয়াকুব বউয়ের চাইতে বেশি আমাকে ব্যবহার করছে। আমি নিজে এবং মেয়ে দুটোকে বাঁচাতে নিরুপায়, তার কথামতো আমাকে চলতে হচ্ছে। তার কথামতো সে অনেক খাওয়াইছে। আমার জন্য অনেক কিছু করছে, আর না। কিন্তু তার আমার শরীর চাই, আমারও চাই টাকা।
ইয়াকুবের যখনই মাংসের নেশা আসে তখনই সে আমার কাছে আসে। আমি মাংসের সওদাগর, এখন সে আমাকে ভাড়ায় খাটায় নিজের চাহিদা ফ্রিতে। সে যদি এক রাতে সারা গ্রামের মানুষ আনতে পারত তাহলে সেই কাজটাই করত। এই যে এতগুলো মানুষ সে নিয়ে এসেছে তাদের কাছ থেকে সে পয়সা কড়ি নেবে। আমাকে যৎসামান্যই দিবে। ইয়াকুব আমাকে পথে নামিয়েছে বেশ্যা বানিয়েছে, হ্যাঁ আমি এখন পাক্কা বেশ্যা। লোকে আমাকে মাগি ডাকতে সংকোচ বোধ করে না। ভালোমানুষ সম্মানী মানুষ আমার চোখের দিকে তাকায় না, পেছনে আমার শরীরে দিকে তাকায়।
এই যে যারা সারারাত আমার শরীরে নিয়ে মাতামাতি করেছে, গিলে খেয়ে ফেলতে চায়। মাথায় তুলে নাচতে চায় তারা। এরাও সকাল হলে আমার দিকে ফিরে তাকাতে চায় না, কারণ আমি বেশ্যা আমি পাপী শুধু আমি পাপী। আমার নামের সঙ্গে যুক্ত হলো বেশ্যা তকমা।
আমার নাম সাথী এখন কেউ এ নামে ডাকে না। 
আমি সাথীর বন্ধনে আবদ্ধ। 
তার অশ্রু উষ্ণতা ছড়াচ্ছে, মেয়েটা ক্রমাগত অশ্রু ঝরিয়ে চলছে আমি নিজেকে তার বাহু বন্ধন থেকে আলাদা করলাম বেরিয়ে পড়লাম গভীর বেদনায়।
সঙ্গে সঙ্গে অন্য একজন ঢুকল মনে হচ্ছে সে ক্ষুধার্ত বাঘ, দরজা খোলার অপেক্ষায় ছিল। এখন সে ক্ষুধা মেটাবে, সাথীর শরীরটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। 
তার পঙ্কিল জীবন, শুধুমাত্র স্বামী এবং ইয়াকুবের অবিমৃষ্যকারিতার দরুণ।
ইয়াকুব সজল-সহ আরও কয়েকজন গল্পে মেতে আছে, বোতল বোতল মদ শেষ করছে, হো হো করে গাল খুলে হাসছে। ইয়াকুবের চেহারায় যেন শয়তান ভর করেছে। নাকি সাথীর কথা শোনে আমার এমন মনে হচ্ছে, জানি না।
আমার সারা শরীর বিবশ হয়ে আছে এ অন্যায় এখানে প্রতিদিন চলবে। আহত হৃদয়ে নিজের চৌকিতে শুয়ে পড়লাম আর সাথীর রুমে তাদের ক্রমাগত যাওয়া-আসা দেখলাম। 
জানি না তার ছোট্ট মেয়েটা কী করছে। এত ছোট্ট মেয়ে কি তার মা ছাড়া থাকতে পারে? তার তো মায়ের বুকে থাকার কথা কিন্তু তার জায়গা নিয়েছে ইয়াকুবরা। এ অন্যায়ের সাক্ষী হতে আর ইচ্ছে করছে না। এই পরিত্যক্ত বাড়ি আমাকে ছাড়তে হবে। এ বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে লেগে গেছে ছোট্ট মেয়েটির অভিশাপ। অভিশপ্ত এ নগরীতে আমার স্থান নেই আমাকে চলে যেতে হবে।
বাড়িটার দিকে একবার ফিরে তাকালাম। না কোন মায়া হচ্ছে না, এখনো আলো পরিস্ফুট নয়। আমি পালিয়ে যাচ্ছি, পা বাড়ালাম সামনে কাঁধে ঝুলি, ঝুলিতে আমার ভবিষ্যৎ, আমি কি চোর? কেন পালিয়ে যাচ্ছি—জানি না। সাথী এবং তার মেয়েদের নিয়ে পালানো যেত, একটা সুন্দর জীবন তাদের পাওয়া উচিত। 
আমার কি সাহস হবে?


আউয়াল যাযাবর কথাসাহিত্যিক। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : খাঁচায় বন্দি ভাষা এবং উপন্যাস : বিত্ত বিহনে। বর্তমানে কাতার প্রবাসী।

menu
menu