আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

প্রায় দু’ মাস পর নিজের সংসারে ফিরল নিপা। শোবার ঘরে পা দিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল। যাত্রা পথের সময়টুকু জুড়ে নিপার মনের মধ্যে যে অস্থিরতা কাজ করছিল, তা নিমেষেই কেটে গেল। তার ফেরা উপলক্ষে ঠিকে কাজের মেয়েটাকে দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে বাসাটা মোটামুটি গোছানোর চেষ্টা করেছে সাজ্জাদ। নিপা, সাজ্জাদ, নিপার সংসার সব ঠিকঠাক, আগের মতো।  

সাজ্জাদ বরাবরই এলোমেলো, অলস প্রকৃতির। এবার, বাসায় ফিরে অন্য এক সাজ্জাদকে আবিষ্কার করল নিপা। তার ওষুধপত্র, খাবার দাবার, বিশ্রামের দিকে বেশ খেয়াল রাখছে সে। সাজ্জাদের এই কেয়ারিং স্বামী রূপটা নিপার কাছে নতুন। সাজ্জাদের সযত্ন ভালোবাসায় দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছিল নিপা। সুস্থতো তাকে হতেই হবে; সাজ্জাদের জন্য, বাবা-মায়ের জন্য, নিজের জন্য, অধীর হয়ে নিপা যার পথ চেয়ে ছিল তার জন্য! ডাক্তার তো বলেছে, দু’এক বছর পরই বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করতে পারবে সে। অনেকদিন পর, শরীরের কথা ভুলে গিয়ে সংসারে মনপ্রাণ ঢেলে দিল নিপা। আসলে সংসারের ব্যস্ততায় নিপা ভুলে যেতে চাইছিল তার অসুখের কথা, অসম্পূর্ণ নারী শরীরটির কথা। 

মাস চারেক আগে হঠাৎই নিপার বুকে চিনচিনে ব্যাথাটা শুরু হলো। প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি, বলা যায় নানা ঝামেলায় অবকাশ পায়নি। কিছুদিন পর বাম স্তনে চাকার মতো কিছু একটা টের পাচ্ছিল। সাজ্জাদের কাছে বলব বলব করে অস্বস্তিতে বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছিল। তারপর দু’জনে সময় মিলিয়ে গাইনোকোলজিস্টের কাছে যেতে আরো মাসখানেক। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার জানালেন, ব্রেস্ট টিউমার, থার্ড স্টেজ। 

‘থার্ড স্টেজ! নিপা, তুমি এতদিন কিচ্ছু টের পাওনি?’ সাজ্জাদের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ছিল। বাকহীন নিপা বসেছিল পাথর হয়ে। তার অসচেতনতায়, অবহেলায় টিউমার দিন গড়িয়ে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। সাজ্জাদের দৃষ্টি বলতে চাইছিল, নিপা একজন শিক্ষিত মেয়ে। তার আরও আগে সচেতন হওয়া উচিত ছিল। অথচ সাজ্জাদকে ব্যাপারটা জানানোর পরও ডাক্তারের কাছে আসতে প্রায় দেড় মাস পার হয়ে গেছে। হ্যাঁ, নিপা একাই আসতে পারত, বা অন্য যে কাউকে নিয়ে আসতে পারত।  গড়িমসি করে হয়ে ওঠেনি। মেয়েরা নিজের শরীরের ভালোমন্দ নিয়ে হেলাফেলা করে। নিপাও তাই করেছে। এটাই মারাত্মক ভুল হয়েছে তার।   

সাজ্জাদের দিকে চেয়ে ডাক্তার বললেন, ‘সচেতন থাকলেও সবসময় আগে থেকে বোঝা যায় না। খুব শিগগিরই আপনার মিসেসের অপারেশনটা করে ফেলতে হবে, মি. সাজ্জাদ।  এটা খুব দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।’

অপারেশনের ডেট ফিক্স হওয়ার পর থেকেই মনে মনে ভেঙে পড়ছিল নিপা। কিন্তু সাজ্জাদ খুব করে সাহস দিচ্ছিল, ‘কোনো ব্যাপার না নিপা। তোমার সুস্থ হয়ে ওঠাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ 

সাজ্জাদের কথায় নিপার মন কিছুটা শান্ত হয়েছিল। পরের সপ্তাহেই অপারেশন করে ফেলে দেওয়া হলো নিপার শরীরের নারী চিহ্ন বহনকারি একটা অংশ। অপারেশনের পর থেকেই নিজেকে কেমন অসহায়, অসম্পূর্ণ মনে হয় নিপার। ধীরে ধীরে এতদিন ধরে গড়ে তোলা নিলুফার আজাদ নিপা নামক চেনাজানা নারীটিকে হাসপাতালের ওটিতে যেন ফেলে এসেছে সে। আয়নার দিকে তাকিয়ে খোঁজে তাকে। যাকে দেখতে পায়, সে নিপার অচেনা কেউ! 

অনার্স প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাসে সাজ্জাদ আর নিপার বন্ধুত্বের সূচনা। নিজেদের অজান্তেই বন্ধুত্ব থেকে শুরু হয়েছিল যুগল পথচলা। ছুটিতে, হল থেকে বাড়ি এলে ফোন করে পাগল করে দিত সাজ্জাদ।  সপ্তাহ না যেতেই নিপার মনও অবাধ্য হয়ে উঠত সাজ্জাদের জন্য। অনার্স পরীক্ষা শেষ না হতেই নিপার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এটা সেটা বলে বাড়িতে বিয়ের আলাপ ঠেকিয়ে রাখছিল সে।  মাস্টার্স পরীক্ষার পর নিপার আব্বা আর সময় দিতে রাজি নয়।  প্রাইভেট জব করার একদমই ইচ্ছে ছিল না সাজ্জাদের, টার্গেট বিসিএস। সুতরাং সে সময়ে, সাজ্জাদের পক্ষে সংসারের ঝামেলা মাথায় নেয়া সম্ভব ছিল না। সাজ্জাদের পরিবারেরও মত ছিল না। 

এদিকে ছোট বোন দিপারও বিয়ের সম্বন্ধ আসছিল। নিপার কারণে ভালো ভালো সম্বন্ধগুলো ফিরিয়ে দিতে হচ্ছিল। অনেক কষ্টে নিপা তার আব্বাকে বোঝাতে সমর্থ হলো, ‘একটা চাকরি বাকরি না হওয়া পর্যন্ত আমি বিয়ে করব না। দিপাকেই আগে বিয়ে দিয়ে দাও।’

কিন্তু নিপার আম্মা নারাজ। বড়ো মেয়ের আগে কিছুতেই ছোট মেয়ের বিয়ে দেবেন না। নিপা আর সাজ্জাদ দু’জনই তখন বেকার। কিন্তু নিপার পক্ষেও আর অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। উপায়ান্তর না পেয়ে নিজের ক্যারিয়ারের স্বপ্ন মাথা থেকে সরিয়ে একটা এনজিওতে যোগদান করে ফেলল নিপা। কাজটা বেশ ভালো, স্বাস্থ্য সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে জাপানি একটা প্রকল্প। প্রাথমিক অবস্থায় বেতন ভাতাও মন্দ না। তারপর বাধ্য হয়েই সাজ্জাদকে বলতে হয়েছিল, ‘যদি আমার সাথেই ঘর বাঁধতে চাও, তবে বিয়েটা এবার সেরে ফেলতে হবে সাজ্জাদ। আমার বেতনতো নিছক মন্দ না। দু’জনের চলে যাবে মোটামুটি।’ 

সাজ্জাদ বলেছিল,  ‘তোমার পয়সায় কতদিন চলব?’
নিপা বলেছিল, ‘তোমার চাকরি হলে তখন তোমার পয়সায় চলব, শোধভাত’। 
নিপার দু’ কাধে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে সাজ্জাদ বলেছিল, ‘এমন একটা বউ, বদ্ধ পাগলও হারাতে চাইবে না।’

তখন দু’পক্ষের পরিবারেরই বিয়েতে আপত্তি। তাই একদম ঘরোয়াভাবেই বিয়েটা হলো। না হলুদ সন্ধ্যা, না সানাই, না আত্মীয় পরিজনদের আনন্দ উল্লাস।  কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরের প্রেম পর্বের পর মিলনাত্মক সমাপ্তিতে নিপা খুশি ছিল, সাজ্জাদও। মনিপুড়ি পাড়ার ছয় নম্বর রোডের ছ’তলা ভবনের চিলেকোঠার একটা ঘরে সংসার হলো তাদের। নিপার একার আয়ে দু’জনের সংসার চলছিল মন্দ না।  ঘরের সামনে উঠোনের মতো খোলা ছাদ। রাতে তারারা বাসর সাজিয়ে বসে থাকে তাদের অপেক্ষায়। প্রায়ই গভীর রাত পর্যন্ত সেই হীরেখচিত আকাশের নিচে বসে ভবিষ্যৎ জীবনের ক্যানভাসে ইচ্ছেমতো রং ছড়াত দু’জন। হাসত, খুনসুটিতে মেতে উঠত। 

চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া এক শুক্লপক্ষের রাতে সাজ্জাদের কাঁধে মাথা রেখে খুব আফসোস করেছিল নিপা, ‘কত স্বপ্ন ছিল, বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে কোনো পাহাড়ের চূড়ায় বসে ভরা পূর্ণিমায় ভিজব দু’জন। কিচ্ছু হলো না!’ 

'তোমায় ছুঁয়ে থাকলে ইট সুড়কির ছাদ বা পাহাড়ের চূড়া, সব জোৎস্নাই মায়াবী'  বলে নিপাকে নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল সাজ্জাদ। 
নিপা পারফিউম ব্যবহার করলে রাগ করত সাজ্জাদ। এমনকি গরমের সময়, রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে গলায় হালকা পাউডার বুলানোও পছন্দ করত না। বলত, নিপার গায়ে নাকি এমনিই খুব সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। সেই গন্ধে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে নিতে চোখ বুজত সাজ্জাদ। 

বছরখানেক বাদে নিপা চাইছিল মা হতে।  কিন্তু বেকার অবস্থায় বাবা হতে চাইছিল না সাজ্জাদ।  নিপার ব্যাকুলতায় বিরক্ত হতো সে ‘বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার সময় কী ফুরিয়ে যাচ্ছে নিপা! পার্থ, ফাহাদকে দ্যাখো, এখনো বিয়ের চিন্তাই করছে না। তোমার বান্ধবী অর্পা? তার সামনে তো বিয়ের কথা তোলাই যায় না। ওরা জানে, কীভাবে জীবনটা সাজিয়ে গুছিয়ে উপভোগ করতে হয়। তুমি এত ব্যস্ত কেন হচ্ছো, বুঝতে পারছি না!’ তাই অপেক্ষা করতে হলো নিপাকে। বিয়ের প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় সাজ্জাদের সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো। নতুন সংসার গোছানোর ব্যস্ততায় বছরটা বেশ কেটে গেল। সরকারি কোয়ার্টারে গুছিয়ে সংসার পেতে মা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল নিপা। অবশেষে নিপার পীড়াপীড়িতে ডাক্তারের কাছে যেতে বাধ্য হলো সাজ্জাদ।  

ডায়াগনিস্টক রিপোর্টে কারো তেমন সমস্যা ছিল না। দু’বছর টানা ট্রিটমেন্ট চলল। সাজ্জাদ হাল ছেড়ে দিলেও নিপা আশা ছাড়েনি। ধৈর্য না হারিয়ে বছরের পর বছর নিপা নিজের রক্তে গ্রহণ করেছে ফার্টিলিটির গাদা গাদা ট্যাবলেট, হরমোনের ইঞ্জেকশন। এসব কিছুর চাপে কবে কবে যে নিজের স্বপ্ন, সাধ হারিয়ে ফেলল নিপা!

সে আর সাজ্জাদ একই ইউনিভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী। অনার্সে সাজ্জাদের মার্কস কিছু বেশি থাকলেও মাস্টার্সে তার রেজাল্ট বেশ ভালো ছিল। মাস্টার্সের পর এমফিলে ভর্তি হয়েছিল নিপা। স্বপ্ন ছিল, পাবলিক না হলেও প্রাইভেট কোনো ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করবে। সকাল সন্ধ্যা এনজিওর চাকরির পেছনে দৌড়ে শেষ পর্যন্ত এমফিলটাও কমপ্লিট করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সাজ্জাদ সারাদিন অফিসে থাকে, ফিরতে ফিরতে রাত। অপারেশনের পর  নিপাকে দেখাশোনার কেউ ছিল না। অপারেশনের পর হাসপাতাল থেকে মেয়েকে নিজের জিম্মায় নিয়ে গিয়েছিলেন নাছিমা বেগম। সে সময়, সারাদিনে দু’তিনবার ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছে সাজ্জাদ। প্রতি বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ থেকে ছুটে গেছে সাভার। নিপার অফিস থেকে একমাসের ছুটি নেওয়া ছিল। ছুটি শেষে অফিসে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না নিপা। কলিগদের সামনে গিয়ে কীভাবে দাঁড়াবে সে! সুন্দর, সাবলিল, স্মার্ট নিপার দিকে যারা সপ্রংশ দৃষ্টিতে তাকাত এতদিন; তাদের দৃষ্টিতে এখন কী দেখবে নিপা? সমবেদনা না সহমর্মিতা? নিপা কারো দৃষ্টিতে তার জন্য সমবেদনা দেখতে চায় না।  সাজ্জাদের পরামর্শে ছুটি আরও এক মাস বাড়িয়ে নেয়া হলো। দু’মাস পরও যোগদান না করায় নিপার চাকরিটা চলে গেল। 

কেমো চলছিল, সেই সঙ্গে কাউন্সেলিং। মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর নিপার মা মেয়েকে ছাড়তে রাজি হলো। 

নিজের সংসারে ফিরে, সাজ্জাদের কাছে ফিরে ক’দিনেই নিপার শরীর, মন বেশ ঝরঝরে উঠেছিল। কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার পর ধীরে ধীরে নিপার মনে হচ্ছিল, তার আর সাজ্জাদের ভেতরে কী যেন ক্ষয়ে গেছে। তাকে ভালো রাখার জন্য সাজ্জাদ যা করছে, তা বাইরে বাইরে। ভেতরে ভেতরে তাদের মধ্যকার উচ্ছল দাম্পত্যের স্রোতে ভাটার টান। রাতে বিছানায় শোওয়ার পর দু’জনের মাঝে অস্বস্তিকর, অদৃশ্য এক দেয়াল লাশ হয়ে পড়ে থাকে অবিবেচকের মতো। তাকে হাজারো চেষ্টায়ও সরানো যায় না। 

এতদিনকার হাতের রেখার মতো চেনা সাজ্জাদ, তাদের সম্পর্কের সমীকরণ সবই যেন নতুন রূপে ধরা দিতে লাগল নিপার চোখে। 

সাজ্জাদ আড়াল করতে চাইলেও, ইদানীং ওর মাঝে অদ্ভুত সলজ্জ আড়ষ্টতা টের পায় নিপা।  

সারাদিন পর ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরে সাজ্জাদ। রাতে বিছানায় শুয়ে নিপার গায়ে আলগা হাত রেখে দু’এক কথায় শরীরের হাল হকিকত জানতে চায়। কিন্তু, নিপার বুকে মুখ গুঁজে নরম মাংসপিণ্ডটুকুর অনুপস্থিতি উপেক্ষা করতে পারে না সে। চোখ বুজে, শত চেষ্টা করেও নিপার সুগন্ধে আর মাতাল হতে পারে না। 

সাজ্জাদের অস্বস্তিভরা স্পর্শে নিপার দুর্বল শরীর, মন মাড়িয়ে যাওয়া শুকনো পাতার মতো প্রাণহীন হয়ে পড়ে। 

পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে সাজ্জাদ। কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমায় না, উশখুশ করে। যৌবনের উদ্দীপনায় উদ্দাম সাজ্জাদ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। পাশে জেগে থেকে টের পায় নিপা। নিপার মতো কাউকে নিয়ে সামনের পুরোটা জীবন কাটাতে হবে, ভেবে সাজ্জাদ কী ভয় পাচ্ছে? নাকি, এসবই নিপার দুর্বল, অসুস্থ মানসিক অবস্থার অবান্তর উপলব্ধি!  

তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে শরীরের এই বিয়োগটুকু মেনে নিয়ে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছিল নিপা। নিজের ওপর, সাজ্জাদের ওপর বিশ্বাসটুকু আঁকড়ে ধরে ধীরে ধীরে শক্ত হতে চাইছিল।  

কিন্তু, একান্ত মুহূর্তে সাজ্জাদের এই নীরব বিমুখতা তার মানসিক জোর ভেঙে দিচ্ছিল ক্রমশই। সকালে, দিনের আলোয় সাজ্জাদের সহজ, স্বাভাবিক ব্যবহারের অক্লান্ত চেষ্টায় সাজ্জাদ না নিপাই হাঁপিয়ে উঠল। 

তবে কি, নিপার শারীরিক সৌন্দর্যই ছিল তাদের সম্পর্কের প্রধান নিয়ামক? তার সুগঠিত দেহসৌষ্ঠবই ছিল সাজ্জাদের ভালোবাসার একমাত্র ভিত্তি? বাবা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ার, স্বপ্ন বলি দিয়ে সাজ্জাদের প্রেমিকা, স্ত্রী হয়ে উঠেছিল যে নিপা; তার পুরোটাই মিথ্যে? সাজ্জাদের কাছে সে এক শরীর সর্বস্ব নারীমাত্র? 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে নিজেকে দেখে নিপা।  কেমোয় যৌবনের জৌলুশ হারিয়ে যাওয়া চামড়া, মাথার পাতলা হয়ে যাওয়া চুল, একটা স্তনহীন অসম্পূর্ণ এক নারীর প্রতিবিম্ব অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থকে নিপার দিকে। নিজের কাছেই মূল্যহীন, অসহায় মনে হয় নিজেকে।

প্রশ্ন করে নিজেকে, তাহলে নিপার নিজের কাছেও কি তার বাহ্যিক সৌন্দর্যই মূখ্য ছিল? নইলে, দেহের সামান্য খামতিটুকু কেন তার মেধা, শিক্ষাদীক্ষা, সব অর্জন, জীবনবোধ সবকিছুকে ম্লান করে দিচ্ছে? শরীরের স্বাভাবিকতার সামান্য ঘাটতির কারণে নিজেকে কেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে ভাবতে পারছে না সে! তাহলে, সাজ্জাদের আর দোষ কোথায়? আয়নায় নিজের চোখে চোখ রেখে উত্তর খোঁজে নিপা।  

শরীর আবার খারাপ হতে শুরু করলে নিপাকে নিয়ে এসেছিল ওর আম্মা। কাউন্সেলিং শুরু হলো আবার। প্রায় দু’ মাস হয়ে এল নিপা বাবার বাড়ি। মায়ের যত্ন, বাবার উষ্ণ সান্নিধ্যে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি ক্ষয়িষ্ণু মানসিক জোরটুকু একটু একটু করে ফিরে পেতে চেষ্টা করছিল সে। সাজ্জাদ আসত মাসে দু’বার রুটিন মাফিক। যেন শুধু দায়িত্বের খাতিরে সাজ্জাদের এই শারীরিক হাজিরা। সাজ্জাদের থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে কষ্ট হয় নিপার। কিন্তু এই সাজ্জাদকে সামনাসামনি দেখতে কষ্ট আরও বেড়ে যায়, দমবন্ধ হয়ে আসে। তাই নিপাই বলেছিল, এত ঘনঘন কষ্ট করে আসতে হবে না তোমায়। আমিতো এখন ভালোই আছি।  

মাসখানেক পর সাজ্জাদ এসেছিল গতকাল। দু’হাতে মিষ্টির প্যাকেট আর মুখ ভরা উচ্ছ্বাস নিয়ে জানাল, অস্ট্রেলিয়ায় এক বছরের ট্রেনিং পড়েছে তার।  দু’সপ্তাহের মধ্যেই কাগজপত্র রেডি করে জমা দিতে হবে।

তার এই দুঃসময়ে, বিদেশ যাত্রার সুযোগে সাজ্জাদের উচ্ছ্বাসে অবাক নিপা। সাজ্জাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিল নিপা। সে মুখে, তাকে এ অবস্থায় ফেলে দীর্ঘ একটা বছর দূরে থাকার সম্ভাব্য কোনো বিষাদের ছায়াও নেই। 

তাই নিপাও ভাবল, ভালোই হলো। কিছুদিন দূরে থাক সাজ্জাদ। দূরে থেকে নিজেকে ভালো করে বুঝুক। নিপারও এই সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে নিজের মনকে স্থির করা প্রয়োজন। তাই ভেতরের বিষণ্নতাটুকু ঢেকে রেখে হাসিমুখেই অভিনন্দন জানাল সাজ্জাদকে। 

আজ দুপুরে সাজ্জাদের ফ্লাইট। খুব ভোরে, সাজ্জাদকে বিদায় দিয়ে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছিল নিপা। ধীর কদমে মাথা নিচু করে বাগানটা পার হলো সাজ্জাদ। প্রায় নিঃশব্দে গেটের ভারী পাল্লাটা খুলে বের হয়ে আবার সাবধানে ভেজিয়ে দিল। পেছনে ফিরে তাকাল একবার, ডান হাতটা সামান্য উঁচিয়ে দেয়ালের ওপাড়ে পৌষের কুয়াশায় অদৃশ্য গেল। ভোরের আবছায়ায় সাজ্জাদের পেছনে ফেলে যাওয়া পথটার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিপার বুক চিড়ে। 

আনমনে ঘরে এসে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ায় নিপা। গায়ে জড়ানো পশমি হলদে শালটা একটানে ফেলে দেয় বুকের ওপর থেকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মুখোমুখি দাঁড়ানো নারীটির দিকে। বুকের একদিকের উঁচু সুডৌল স্তনের পাশে খাঁ খাঁ বেসদৃশ সমতল মরুভূমি। কী বেঢপ, সামঞ্জস্যহীন! অসম্পূর্ণ নারী প্রতিবিম্বটির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অবসন্ন শরীরে বসে পড়ে বিছানায়। দু’হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে খুলে দেয় গতরাত থেকে জোর করে ধরে রাখা চোখের বাঁধ।  

বেশ কিছুটা সময় পর, মাথায় আলতো হাতের স্পর্শে নিজেকে সামলে নেয় নিপা ‘কী নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা করছিস, নিপু? সাজ্জাদ একবছর পরই ফিরে আসবে। তুইও চাইলে কাগজপত্র গুছিয়ে যেতে পারবি ওর কাছে।  তুইতো এখন পুরোপুরি সুস্থ। ডাক্তার তো বলেছে, এবারের রিপোর্ট একদম ভালো।’ মায়ের কথায় মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে নিপা ‘সাজ্জাদকে নিয়ে ভাবছি না আম্মা, নিজেকে নিয়ে ভাবছি।’ 

মেয়ের কাছ ঘেঁষে বসে নাছিমা ‘সাজ্জাদ এলেই তুই কেমন মলিন হয়ে যাস। তিনটা বছর তুই একাই সংসার টেনেছিস। ওকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় দিয়েছিস। এখন ওর উপস্থিতি যদি তোকে দুর্বল করে দেয়, মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়; তাহলে কষ্ট হলেও মনকে বোঝাতে হবে, ওর থেকে দূরে থাকাটাই তোর জন্য এখন ভালো। তোদের সম্পর্কটা এখন সময়ের হাতে ছেড়ে দে মা। সময়ই বলে দেবে তোর জীবনে সাজ্জাদের অবস্থান কী? ওর শোকে মুখ গুঁজে ঘরে বসে থাকলে শুধুই নিজেকে অসম্মান করা। সাজ্জাদ তোকে কীভাবে দেখছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুই সেভাবেই নিজেকে দেখার চেষ্টা করছিস। অন্য কারো দৃষ্টিতে নয়, নিজেকে নিজের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়।’ 

মায়ের কথায় মনের ভেতর জমে ওঠা বাষ্প আবার বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে নিপার দু’চোখে। মেয়ের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয় নাছিমা ‘তোর আগের অফিসের বসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলি, কথা হয়েছে?
‘হ্যাঁ হয়েছে।’     
‘কী বলেছে?
‘দুই একদিনের মধ্যে দেখা করতে বলেছে।  একটা পোস্ট নাকি রিসেন্ট ফাঁকা হয়েছে’
‘তাহলে দেরি করছিস কেন? আজই দেখা করে আয়।’ 
‘হ্যাঁ, আজই যাব ভাবছি।’ নিপা উঠে দাঁড়ায়। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নেয় ভালো করে। অনেকদিন পর, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যত্ন করে প্রসাধন মাখে, পাতলা চুলগুলো বাঁধে। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে  প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর নাইমা আপার মুখটা মনে পড়ে নিপার। অপারেশনের পর সাড়ে চার বছর বেঁচেছিলেন। দু’টো স্তন ফেলে দেয়ার পরও অফিসে তার মুখে হাসি নেই, কখনো এমন দেখেনি নিপা। কাজের ফাঁকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রায়ই বলতেন, প্রতিটি প্রাণীর জন্যই মৃত্যু অবধারিত। তাই যেক’টা দিন বাঁচো, হাসিমুখে কাজ করে যাও। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এ সুন্দর জীবনের এক মুহূর্তও হা হুতাশ করে নষ্ট করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। যে ক’টা দিন বাঁচব, প্রাণভরে বাঁচব, আনন্দে বাঁচব।’ বলে সুন্দর করে হাসতেন আপা।

ভোরবেলা খুব কুয়াশা ছিল। এতক্ষণে গাছের পাতার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে টুকরো টুকরো রোদ। বাড়ির সামনের চিলতে বাগানটাতে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় নিপা। একসময় তার খুব শখের বাগান ছিল এটা। অনেকদিন ফিরেও তাকানো হয়নি। যেন নিপার ওপর অভিমানে আগাছার চাদরে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। গেটের কাছাকাছি পুরোনো দেয়ালের ইটের খাঁজ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে নাম না জানা একটা ছোট্ট গাছ। ডগায় ছোট্ট সাদা ফুলটা নতুন সূর্যের দিকে মুখ তুলে হাসছে। নিপার চোখদুটো আটকে যায় তার ওপর। একটু দাঁড়ায়, ফিসফিসিয়ে বলে, ‘শুভ সকাল!’

আজ প্রায় ছ’মাস পর ডাক্তারের উদ্দেশ্য ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরিয়েছে নিপা। অনেকদিন পর, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে গতিময় পৃথিবীটা কেমন অন্যরকম লাগে। ব্যস্ত পথিকদের তালে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে অদ্ভুত এক সুখের আলোড়নে কেঁপে ওঠে। বড়ো রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিজের মাঝে যেন আগের সেই নিপাকে খুঁজে পায়। এইতো সেই নিপা! যাকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। যে ব্যস্ত পথিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটত, আর মনে মনে হাসত। এ ক’টা মাস বদ্ধ ঘরের ভেতর থেকে মনটা কেমন সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। ভুলে গিয়েছিল, এই আলোর মাঝে, জীবনের টানে ছুটতে থাকা মানুষজনের মাঝে ছুটে চলার আনন্দ। ভুলে যেতে বসেছিল, বিধাতার দেয়া এই অমূল্য জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার অপার সৌন্দর্য। 

সামনের বাস স্টপিজে একটা বাস এসে দাঁড়ালে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে বাসে উঠে পড়ে নিপা। জানালার পাশে একটা খালি সিট পেয়ে বসে পড়ে চটজলদি। পাশে বসা ছেলেটি কানে মাইক্রোফোন গুঁজে হাতের মোবাইলে সিনেমা দেখছে। একসময় সিনেমা, নাটকের পোকা ছিল নিপা। হলে বা থিয়েটারে ভালো সিনেমা, নাটকের খবর পেলে দল ধরে গিয়ে দেখত। অনেকদিন কোনো সিনেমা, নাটক দেখা হয় না। বাসের জানালায় চোখ রাখে নিপা। বাইরে রাস্তার পাশে জমা করা আবর্জনার স্তূপ, আবর্জনার মাঝে জীবন খুঁজে ফেরা টোকাই ছেলেমেয়েদের উল্লাস, বাসের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত কোলাহল, বাসের হেল্পারকে উদ্দেশ্য করে অফিস যাত্রীদের তাড়া, পেছনে ছুটে চলা ব্যস্ত শহর সবকিছু মিলিয়ে এই গতিময় পৃথিবীটা নতুন এক সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয় নিপার চোখে। জানালা দিয়ে আসা হু হু করা বাতাসে নিপার কপালে নতুন গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চোখের ওপর। হাতের আঙুলে চুল ঠিক করে চোখ বোজে নিপা। চোখ বুজে বেঁচে থাকার সুখটুকু অনুভব করতে চায় মন প্রাণভরে।


সায়মা ইসলাম গল্পকার। ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। বর্তমানে শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিব কলেজ, টাঙ্গাইলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ঘুণপোকাদের জলসাঘর। 

menu
menu