বৃষকেতু

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ, কৌরবকুল যুদ্ধে বিনষ্ট। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সিংহাসনে অভিষিক্ত, কিন্তু জ্ঞাতি বিনাশের দুঃখে তিনি মুহ্যমান, এই সিংহাসন যেন কণ্টকাকীর্ণ এক আসন, যা তাঁকে বিন্দুমাত্র স্বস্তি দিতে পারছে না। এইরকম অশান্ত সময়ে মহামুনি ব্যাসদেব এসেছেন যুধিষ্ঠির সন্দর্শনে, যুধিষ্ঠিরের মনোকষ্ট ও অনুশোচনা দেখে মহামুনি তাঁকে অশ্বমেধ যজ্ঞ করবার পরামর্শ দিলেন। বললেন—

‘অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে সব পাপের বিনাশ হয়। সর্ব সুলক্ষণ যুক্ত অশ্ব আছে যুবনাশ্বপুরে, মহারাজা যুবনাশ্ব প্রবল শক্তিধর, তাকে পরাজিত করে অশ্ব নিয়ে এস।'

ভীমসেনকে পাঠাও অশ্ব নিয়ে আসতে, এই যজ্ঞে বহু ধনের প্রয়োজন তাই হিমালয়ে একদা মরুত রাজার যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের দান করা প্রচুর ধনরত্ন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, ব্রাহ্মণরা সেই সম্পদ ত্যাগ করেছেন সুতরাং তা নিলে কোনো পাপ নেই, তুমি অর্জুনকে ধনরত্ন আনয়ন হেতু হিমালয়ে প্রেরণ করো।’ 

যুধিষ্ঠির ভীমকে একা যুবনাশ্বপুরে পাঠাতে চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কর্ণপুত্র বৃষকেতু যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তিনি যাবেন পিতৃব্য ভীমসেনের সঙ্গে অশ্ব আনয়নে। যুধিষ্ঠির তাকে বললেন, ‘পরিচয় না জেনে কর্ণকে হত্যা করে আমরা মহাপাপ করেছি, তোমাকে দেখে আমরা সান্ত্বনা পাই, তোমাকে কী করে যুদ্ধে পাঠাব?’

বৃষকেতু বললেন, ক্ষত্রিয়র ধর্মই হচ্ছে যুদ্ধ করা। পিতা কর্ণ যুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করে স্বর্গে গেছেন, আর তিনি জেনেশুনেই সহোদর ভাইদের পক্ষ ত্যাগ করে, দুর্যোধনের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, ভ্রাতৃ বৈরিতা এবং দ্রৌপদীকে উপহাস করবার পাপে তাঁর প্রাণ গেছে। আপনি অনুমতি করুন, আমি ভীমের সঙ্গে যুবনাশ্বপুরে যাই।’ যুধিষ্ঠির অনুমতি দিলেন। ভীম, বৃষকেতু ও ঘটোৎকচপুত্র মেঘবর্ণ গেলেন যুবনাশ্বপুরে, সেখানে বৃষকেতুর প্রবল পরাক্রমে রাজা যুবনাশ্ব বশ্যতা স্বীকার করলেন এবং স্বয়ং অশ্ব নিয়ে হস্তিনাপুরে এলেন যুধিষ্ঠির এবং শ্রীকৃষ্ণ দর্শনে। ওদিকে হিমালয় থেকে অর্জুন ধন সংগ্রহ করে ফিরলে অর্জুন, ভীম ও বৃষকেতু অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে বেরুলেন পৃথিবী পরিক্রমায়।

অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া যে রাজ্যে ঢুকবে, সেই রাজ্যের নৃপতিকে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের বশ্যতা স্বীকার করতে হবে ধনরত্ন উপঢৌকন দিয়ে, আর যে রাজা তা অস্বীকার করে যজ্ঞের ঘোড়া আটকাবেন, তাকে বশ্যতা স্বীকার করাতে যুদ্ধ করে যজ্ঞের ঘোড়া উদ্ধার করতে হবে। বহু রাজ্য ভ্রমণ করে, বহু যুদ্ধ জয় করে যখন মণিপুর রাজ্যে ঘোড়া ঢুকল তখন মহা পরাক্রমশালী মণিপুর রাজ বভ্রুবাহনের সৈন্যরা সেই ঘোড়া আটক করে নিয়ে এলো রাজ সকাশে। অশ্বের ললাট লিখন পড়ে বভ্রুবাহন বুঝতে পারলেন স্বয়ং তার পিতা মহা ধনুর্ধর পার্থ, অশ্বসহ মণিপুরে উপস্থিত হয়েছেন।

বভ্রুবাহন মাতা চিত্রাঙ্গদাকে সে কথা জানিয়ে বললেন, ‘আমি যদিও না জেনেই অশ্ব ধরেছি তথাপি ক্ষত্রিয় হিসেবে আমি এই অশ্ব ফেরত দিতে অপারগ, ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করতে আমি যুদ্ধ করব এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রেই আমি পিতাকে আমার পরিচয় প্রদান করব, যুদ্ধ না করে তাঁর শরণ নিলে তিনি আমাকে হীন, কাপুরুষ ভাববেন।’ চিত্রাঙ্গদা বললেন, ‘পুত্র আমি কখনো তোমাকে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দিতে পারি না, তবে তো লজ্জায় আমার জীবন ধারণ করা চলে না, তুমি এখনই নিজ ভুল স্বীকার করে পিতার শরণ নেবে, তাকেই আদর্শ পুত্র বলে যে পিতার সেবা করে; পিতার সেবা করা মানে দেবতাদের প্রসন্ন করা এবং জেনো এই তোমার মাতৃ আজ্ঞা।’ 

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই বভ্রুবাহন বহু ধনরত্ন এবং চন্দনশোভিত পুষ্পমালাসহ অশ্ব নিয়ে আত্ম পরিচয় দিতে গেছিলেন অর্জুন সকাশে। 

সেখানে অর্জুনের কাছে পেলেন জারজ বলে সম্ভাষণ এবং পদাঘাত। অর্জুন বললেন, ‘আমার পুত্র ছিল বীর অভিমন্যু, একা সে পুত্র বুঝেছিল সপ্তরথীর সঙ্গে আর তুমি প্রথমে অশ্ব ধরে পরে ভয়ে এসেছ আমার শরণ নিতে। আমার ঔরসজাত পুত্রের এই আচরণ কখনো হতে পারে না। কে চিত্রাঙ্গদা? সে তো নটী, নটীর পুত্র হয়ে তুমি নিজেকে আমার পুত্রের পরিচয় দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছ!’

অর্জুনের পারিষদরা অর্জুনের এ হেন আচরণে তখন বিচলিত বোধ করছেন।  আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বৃষকেতু, অর্জুনের পদাঘাতে ভুলুণ্ঠিত মহারাজ বভ্রুবাহনকে হাত ধরে তুললেন, অঙ্গ বস্ত্রের ধুলো স্বহস্তে ঝেড়ে দিয়ে অর্জুনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে অর্জুন, বভ্রুবাহন পুষ্প চন্দনের পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে তোমাকে পুজো করল, সর্বসমক্ষে তোমাকে পিতা বলে স্বীকার করল আর তুমি মহাজ্ঞানী গুরুজন হয়ে তাকে পদাঘাত করলে! নিজের পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলতে একজন পুত্রের স্বাভাবিক ভাবেই লজ্জা হয়। বভ্রুবাহনের আচরণ একজন রাজার আচরণ, বভ্রবাহনের আচরণ একজন পুত্রের আচরণ। আমি নিশ্চিত বুঝেছি ওর ধমনিতে বইছে পাণ্ডবদের রক্ত, বভ্রুবাহন যে সম্পর্কে আমার ভ্রাতা, তার সমস্ত লক্ষ্মণ আমি দেখতে পাচ্ছি।’ 

সেখানে উপস্থিত রাজা হংসধ্বজ এবং নীলধ্বজ কর্ণপুত্র বৃষকেতুর কথা সমর্থন করলেন, কিন্তু অর্জুন অনড়, কারো কথায় কর্ণপাত করলেন না। অপমানিত বভ্রুবাহন অর্জুনের সভা ত্যাগ করার সময় বলে গেলেন, আগামী কাল যুদ্ধ ক্ষেত্রেই তিনি অর্জুনকে তার যথার্থ পরিচয় দেবেন। তার মা’কে নটী বলা এবং তাকে জারজ সম্ভাষণ করে পদাঘাতের ফল কাল অর্জুন হাতেনাতে পাবেন। মণিপুরের আকাশে বাতাসে বেজে উঠল রণদামামা।

অর্জুনের অপর এক স্ত্রী নাগরাজ কন্যা উলূপী তখন অর্জুনের মণিপুর আগমনের সংবাদ পেয়ে এসেছেন অর্জুন দর্শনে। দুই সখী চিত্রাঙ্গদা ও উলূপীর একান্ত ইচ্ছা, অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় তারাও হস্তিনাপুরে উপস্থিত থাকবেন এবং কুন্তীর সঙ্গে মিলিত হবেন।

বভ্রুবাহনকে সৎমাতা উলূপী অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন, বিস্মিত চিত্রাঙ্গদাকে উলূপী বললেন, ‘এই যুদ্ধ অমোঘ এবং এতেই সবার মঙ্গল।’ চিত্রাঙ্গদা বুঝলেন এই যুদ্ধ অলঙ্ঘনীয়, এর পিছনে রয়েছে কালের নির্দেশ, তিনি বভ্রুবাহনকে যুদ্ধের অনুমতি দিলেন। বভ্রুবাহন, সেনাপতিকে যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘আমি যাব পাণ্ডব শিবিরে ভ্রাতা বৃষকেতুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে, কেউ যেন আমার সঙ্গে না আসে, কোনোভাবে আমাকে বিরক্ত না করে।’ সেনাপতি বললেন, ‘মহারাজ, রাত পেরলে যার সঙ্গে জীবন মরণ যুদ্ধে লিপ্ত হবেন তার শিবিরে এই নিশীথে একাকী যাওয়া কি ঠিক হবে?’ বভ্রুবাহন ঈষৎ হেসে বললেন, ‘সেনাপতি তুমি ভুলে যেয়ো না যে আমি কর্ণপুত্র মহাযোদ্ধা বৃষকেতুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি, কোনো কসাইয়ের সঙ্গে নয়। কাল সূর্যাস্তর সময় আমাদের দু’জনের মাত্র একজনই জীবিত থাকব, সেটাই ক্ষত্রিয় ধর্ম, কিন্তু আজ নিশীথে অর্জুনপুত্রর সাক্ষাৎ হবে কর্ণপুত্রর সঙ্গে, একজন ভাইয়ের সঙ্গে আর একজন ভাইয়ের।’

বৃষকেতুর শিবিরের দৌবারিক এসে বৃষকেতুকে খবর দিল, মণিপুর রাজ বভ্রুবাহন স্বয়ং সাক্ষাৎপ্রার্থী। বৃষকেতু তাড়াতাড়ি উঠে এসে শিবিরের দ্বার থেকে হাত ধরে বভ্রুবাহনকে সাদরে শিবিরের অন্দরে নিয়ে এসে বসালেন। বললেন, ‘আমি আশা করেছিলাম তুমি আসবে।’ বভ্রুবাহন বললেন, ‘আজ অর্জুনের সভায় তুমি যে সংবেদনশীল আচরণ আমার সঙ্গে করেছ, তারপর না এলে খুব অন্যায় হতো। তোমার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ আর হয়তো হবে না। সম্ভবত কালকের সূর্যাস্ত দর্শনের সৌভাগ্য আমাদের যেকোনো একজনের হবে। তার আগে বলো, তুমি পাণ্ডবদের বিশেষ স্নেহভাজন, তাঁদের পুত্রদের প্রজন্মে একমাত্র জীবিত এবং সুযোগ্য বংশধর, কালকের যুদ্ধে যদি তোমার প্রাণনাশ হয় তবে মহাপরাক্রমশালী পাণ্ডব বংশের হয়তো যবনিকা পতন হবে না, অভিমন্যু, ঘটোৎকচ পুত্ররা বংশরক্ষা করবে, কিন্তু তুমিই পাণ্ডব ভ্রাতাদের পরবর্তী প্রজন্মের শেষ প্রতিনিধি, এই যুদ্ধ কি তোমায় করতেই হবে? যদিও উত্তরটা আমি জানি। বৃষকেতু যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না।’

বৃষকেতু বললেন, ‘আমি আমার জীবনের প্রারম্ভের একটা গল্প বলে আমার উত্তর শুরু করি। আমি কর্ণের ঔরসে অঙ্গদেশের পাটরাণি পদ্মাবতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেও আমার সৎমা সুপ্রিয়ার স্নেহেই আমি মূলত লালিত পালিত হয়েছি। তুমি জানো পিতা কর্ণ দানবীর হিসেবে ভুবন বিখ্যাত ছিলেন, ধনুর্ধর কর্ণের খ্যাতিকেও ছাপিয়ে গেছিলেন দানবীর কর্ণ। আমি তখন নেহাতই শিশু, সেইসময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একদিন দাতা কর্ণকে পরীক্ষা করবার জন্য বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে এসে পিতাকে বললেন, ‘আমি বৃষকেতুর মাংস ভোজন করে পরিতৃপ্ত হতে চাই।’ ছোটমা সুপ্রিয়া সম্ভবত সে সময়ে তাঁর পিতার অসুস্থতার কারণে আমাকে রেখেই পিত্রালয়ে গমন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনি উপস্থিত থাকলে অনর্থ ঘটত, যাই হোক পিতা তখন মাতা পদ্মাবতীকে রাজি করালেন, আমাকে হত্যা করা হলো এবং পদ্মাবতী ব্রাহ্মণ বেশি শ্রীকৃষ্ণকে আমার মাংস রন্ধন করে পরিবেশন করলেন। চমৎকৃত ভগবান, কর্ণের বহু প্রশংসা করলেন এবং মৃতসঞ্জীবনীর প্রভাবে আমাকে পুনরায় জীবনদান করলেন। সুতরাং আমার এতদিন বেঁচে থাকাই একটা চমকপ্রদ ঘটনা, যদি সেই শৈশবেই আমার মৃত্যু হতো তবে পাণ্ডবেরা আমাকে তাদের বংশধর হিসেবে পেতেন কীভাবে? আর আমি জানি আগামীকালের যুদ্ধে আমার মৃত্যু হলেও পাণ্ডব ভাইদের পরবর্তী প্রজন্ম লোপ পাবে না, মহারাজ বভ্রুবাহনও অর্জুনপুত্র। আমরা একজন বেঁচে থাকলেই হবে, সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ হিসেবে আশীর্বাদ করি তুমি বিজয়ী হও, তবে জেনে রেখ তা সহজে হবে না, কালকের যুদ্ধে আমার পরাক্রম দেখার জন্য প্রস্তুত থেক। আমার মনে একটা বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে, কালকের যুদ্ধক্ষেত্রেই হয়তো আমাদের শেষ সাক্ষাৎ হবে না, আবার আমাদের দেখা হবে, এই অনুভূতি ব্যাখ্যাতীত, যুক্তি দিয়ে এর বর্ণনা করতে আমি অক্ষম। আগামীকালের যুদ্ধে তোমার জয় অবশ্যম্ভাবী, কৃষ্ণসখা অর্জুন সমরে দুর্জয়, কিন্তু তোমাকে পদাঘাত করে তিনি তাঁর শক্তি হ্রাস করেছেন আর অর্জুনের ব্যবহারে ব্যথিত হয়েছেন স্বয়ং ভীমসেন। আজ যখন তুমি যুদ্ধ ঘোষণা করলে তখন বীর বৃকোদরের দু’চোখে কোনো রণলিপ্সা আমি দেখতে পাইনি, সেখানে দেখেছি অসহায়তা এবং বেদনার ছায়া, তিনি মহা বিচক্ষণ, তোমাকে দেখেই পাণ্ডব বংশধর বলে চিনেছেন। ক্ষত্রধর্ম রক্ষা করতে ভীমসেন যুদ্ধ করবেন বটে তবে তিনি স্বভাববিরুদ্ধভাবে আগামীকালের যুদ্ধে ম্লান থাকবেন। তাঁর ভ্রাতৃষ্পুত্র বভ্রুবাহনের তাঁর দিক থেকে আশঙ্কার বিশেষ কারণ নেই। অর্জুন নিজেকে তোমার যুদ্ধে রক্ষা করতে পারবেন না, তাঁর পদাঘাতে এবং মাতা চিত্রাঙ্গদাকে নটী বলায় যে ক্রোধ তোমার মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়েছে তার মোকাবিলা করা অর্জুনের পক্ষেও সম্ভব হবে না।

আগামীকালের যুদ্ধে আমিই তোমার প্রধানতম প্রতিপক্ষ। কাল যুদ্ধক্ষেত্রে তুমি আমার থেকে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি আশা করো না এবং আমাকেও কোনোরকম সহানুভূতি দেখিয়ে অপমান করো না। জেনে রেখো জন্মের পর থেকেই আমরা অমোঘ পদক্ষেপে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হই, আগামীকালের যুদ্ধে যদি সেই মৃত্যু আসে তবে তা হবে বীরের মৃত্যু, ক্লীবের মতো মৃত্যু, সে ক্ষত্রিয়ের মৃত্যু নয়। ক্ষত্রিয়ের মৃত্যু হবে যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধার বেশে। কালকে আমরা এমন যুদ্ধ করব যা আমাদের বিখ্যাত দুই ধনুর্ধর পিতাকেও গর্বিত করবে।’ 

বভ্রুবাহন বিদায় নেবার জন্যে উঠে দাঁড়ান, দু’জনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন, বৃষকেতু দ্বারপ্রান্ত অবধি বভ্রুবাহনকে এগিয়ে দিয়ে আসেন, মাতা চিত্রাঙ্গদাকে তার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাতে বলেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুক থেকে বেরিয়ে যেন শিবিরের আবহাওয়াকে ভারী করে তোলে।

পরের দিন সকালে, বৃষকেতু প্রবল ঝড়ের মতন আছড়ে পড়লেন মণিপুর সৈন্যদের ওপর, তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন মণিপুররাজ বভ্রুবাহন। শুরু হলো মহারণ, যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মুখোমুখি সমরে কর্ণ অর্জুন, প্রবল যুদ্ধের পর অর্ধচন্দ্র বাণে বভ্রুবাহন বৃষকেতুর মাথা কেটে ফেললেন। অর্জুন বিলাপ করতে থাকলে বভ্রুবাহন তাঁকে বললেন, ‘বিলাপ করো না, বৃষকেতু সম্মুখ সমরে নিহত হয়ে ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করে স্বর্গে গেছে, বিলাপ করে তাকে অপমান করো না, নিজেকে রক্ষা করো।’

সেদিন যুদ্ধে বভ্রুবাহনের হাতে অর্জুনেরও প্রাণ যাবে, উলূপীর পরামর্শে পাতাল থেকে অমৃতমণি নিয়ে আসবেন বভ্রুবাহন, মণিপুরে আসবেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এবং স্বহস্তে মণির স্পর্শে প্রাণ দান করবেন বৃষকেতু এবং অর্জুনকে। এইভাবে উলূপীর কৌশলে, শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অন্যায় যুদ্ধে ভীষ্মকে হত্যা করবার জন্য, গঙ্গা দেবির সম্মুখে অর্জুনকে বসুগণের দেওয়া শাপমোচন হবে, অর্জুন রক্ষা পাবেন অখণ্ড নরকবাসের হাত থেকে। বভ্রুবাহন নিজে বৃষকেতু এবং ভীমার্জুনের সঙ্গে যোগ দেবেন অশ্বমেধ যজ্ঞ সফল করতে, কিন্তু সে সবই এখন কালের গর্ভে। এই মুহূর্তে রণক্ষেত্রের মাঝখানে গতিশূন্য হয়ে থাকে যুদ্ধ। বভ্রুবাহন কপোলে অশ্রুর স্পর্শে অনুভব করেন এইমাত্র তিনি একজন পরমাত্মীয়কে হারিয়েছেন। 


পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি রপ্তানিকারক সংস্থায় কর্মরত। তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনি লেখেন। তাঁর লেখা আনন্দ, টাইমস অফইন্ডিয়া, দেবসাহিত্য কুটির, বিচিত্রপত্র, প্রসাদ, পরবাস, উদ্ভাস-সহ দেশে বিদেশে বিভিন্ন পত্রিকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।  

menu
menu