প্রতারিত
প্রতারক স্ত্রীর শাস্তি কী হতে পারে? মৃত্যুদণ্ড? আরব্য উপন্যাসে নায়কেরা তাদের ব্যভিচারিণী স্ত্রীদের কেটে দু’টুকরো করত। সঙ্গে তাদের প্রেমিকদেরকেও। কিন্তু এখন? এখন তো যুগ বদলেছে। মেয়েরা স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু স্বভাব কি বদলেছে? একটুও না। তারা এখনো আরব্য রজনীর নায়িকাদের মতোই রয়ে গেছে। কোনো মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করার দৃশ্য কখনো দেখেছেন? স্বামীর হাত দুটো শক্ত করে স্ত্রীর গলা চেপে ধরে আছে। নারীটির দম বন্ধ হয়ে আসছে। নাকের বাঁশি ফুলে গেছে। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার যোগাড় হয়েছে। এক্ষুণি দম বন্ধ হয়ে নারীটি মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করে চিরন্তন রহস্যে ঘেরা জীবনের অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাবে। মৃত ব্যক্তি জীবন্ত হয়ে কখনো ফিরে আসেনি। আসলে জানা যেত মৃত্যুর পর কী থাকে। প্রতারক স্ত্রীর নজির ভুরি ভুরি আছে। টলস্তয়ের নায়িকা আনা কারেনিনা, ফ্লবেয়ারের নায়িকা মাদাম বোভারি তাদের স্বামীদের সাথে বেইমানি করেছিল। ফলশ্রুতিতে তাদেরকে করুণভাবে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। আত্মহত্যা করলে নিজেকে না-হয় সান্ত্বনা দেয়া যায়। কিন্তু যদি সেপথে না যায়? তাহলে? রবার্ট ব্রাউনিং-এর মাই লাস্ট ডাচেস কবিতার ঈর্ষাপরায়ণ নায়ক তার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছিল শুধুমাত্র তার স্ত্রী সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলত এজন্য। আর যদি প্রতারণা করত তাহলে যে কী করত সেটা ঈশ্বরই ভালো বলতে পারেন।
আমার ফ্ল্যাট থেকে আকাশ দেখা যায়। এখন মাঝরাত্রি। ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আঁধারে রাত্রির রূপ দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ওই যে শবের মতো শীতল ডিম্বাকৃতির বিবর্ণ চাঁদ ছড়াচ্ছে ম্লান আলো যান্ত্রিকতায় ক্লান্ত ঘুমন্ত নগরীর পথ-ঘাট, অলি-গলি, মসজিদ-মন্দির, পাঠাগার-শৌচাগার, সচিবালয়-পতিতালয়, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, বিদ্যালয়, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড আর খেলার মাঠে। নক্ষত্রেরা লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে পাঠাচ্ছে নীলাভ আলোর রেখায় সান্ত্বনার স্নিগ্ধ সোনালি বার্তা। শোকার্ত মেঘেরা দলবেঁধে যেন সামিল কোন এক করুণ শবযাত্রায়। পাড়ার কুকুরগুলো ব্যস্ত ছিনালিপনায়। রাত্রির পাহারাদারের বাঁশিতে ফেটে চৌচির আঁধারের অখণ্ড নীরবতা। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা বিড়ালের কান্নার স্বর হিমেল রাত্রিকে দিচ্ছে যাদুময় বাস্তবতা।
কখনো প্রেমে পড়েছেন? সবাই পড়ে। প্রেম ছাড়া জীবন যৌবন অর্থহীন। জীবনকে তাৎপর্যমণ্ডিত করার জন্য, জীবনের প্রগাঢ় রহস্য উন্মোচনের জন্য, যৌবনকে শিল্পীত রূপ দেয়ার জন্য প্রেমে পড়তে হয়, প্রেম দিতে হয়, প্রেম নিতে হয়। আমিও পড়েছিলাম। সেটা আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য বলতে পারব না। ওকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই ওকে ভালোবেসেছিলাম। ওর ভরাট বুক দেখে মনে হয়েছিল যে ওই বুকে মাথা রাখলে মৃত্যু যন্ত্রণাকে মনে হবে গোলাপের সৌরভ মাখা। ওর মায়াবী চোখের দ্যোতি দেখে মনে হয়েছিল ওই আলোয় বর্ণিল হবে আমার বিবর্ণ পৃথিবীর যাপিত জীবনের ধূসর দিনগুলি। ওর বাঁকা ঠোঁটের হাসি দেখে মনে হয়েছিল সুরের মূর্ছনায় উদ্ভাসিত হবে আমার নিঃসঙ্গ সত্তার নির্জন ধু ধু বালুচর। তাই এক ভ্যালেন্টাইনস দিবসে তিনটি তাজা কৃষ্ণ গোলাপ দিয়ে বলেছিলাম ভালোবাসি। সেদিন ছেঁড়া মোটা কাপড়ের টুকরোর মতো মেঘেরা ঢেকে দিয়েছিল জ্বলন্ত সূর্যটাকে। আর সেই কাপড়ের চতুর্দিক দিয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল সূর্যের বর্ণিল বিচিত্র রঙের ধারা। সেই রঙে রঙিন শহরটাকে মনে হচ্ছিল অমর কোনো চিত্রকর্মের মতো। গাছে গাছে নতুন সবুজ পাতারা বসন্তের আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছিল। ইট পাথরের শহরে কোকিলেরা ডাকতে ভুল করেনি। সে সাড়া দিয়েছিল। আমাকে ভালোবেসেছিল। হলুদ ছিল ওর প্রিয় রং। ও যখন হলুদ শাড়ি পরত তখন সারা পৃথিবী শিল্পীর হলুদ তুলিতে সেজেছে বলে মনে হতো। বিয়ের পর যেদিন ওকে প্রথম বিবস্ত্র দেখি সেদিন ওকে মনে হয়েছিল কোন গ্রিক দেবীর বিস্ময়কর সুন্দর ভাস্কর্য।
প্রেম কি? মায়া, মমতা, মহব্বত, আকর্ষণ, যৌনাকাঙ্ক্ষা, তাড়না? যৌনতার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গভীর। এর স্থায়িত্ব কত? বিজ্ঞানীরা বলেন প্রেমের আয়ু চার বছর। হ্যাঁ, প্রেমও মরে যায়। প্রেমও নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রেমও ক্ষয়ে যায়, শুকিয়ে যায়, বিবর্ণ হয়ে যায় এবং এক সময় মৃত্যু এসে গ্রাস করে ফেলে প্রেমকে। ইউরোপ আমেরিকায় শতকরা নিরানব্বই ভাগ বিয়েই প্রেমের বিয়ে। কিন্তু ডিভোর্সের সংখ্যা আশি ভাগের বেশি। সে আমাকে ভালোবেসেছিল সাত বছরের মতো। তারপর? হ্যাঁ, তারপরই তো সব শেষ হয়ে গেল। সে তার খালাতো ভাইকে ভালোবেসে ফেলল। সে আমারই বিছানায় তার প্রেমিককে দেহ দান করত। সহ্য করা যায়? আমি একদিন অফিস থেকে কী কাজে যেন অসময়ে বাসায় ফিরেছিলাম। ব্যস হাতে-নাতে ধরে ফেললাম। এখন বলুন আমার কী করা উচিত? আমি ওকে আমৃত্যু ভালোবাসতে চেয়েছি, ওর নরম, কোমল, উষ্ণ বুকে মাথা রেখে মরতে চেয়েছি, একসঙ্গে বৃদ্ধ হতে চেয়েছি, একসঙ্গে সুখী হয়ে জীবন পার করতে চেয়েছি। কিন্তু? নরওয়ের শিল্পী এডভার্ড মুঙ্ক একটা চিত্রকর্ম এঁকেছেন যেখানে দেখা যাচ্ছে এক লাস্যময়ী নগ্ন নারী শয়তানের সঙ্গে সঙ্গমরত। ওরা সুযোগ পেলে শয়তানের সঙ্গেও যৌনক্রিয়ায় মত্ত হবে। এজন্যই নীটশে বলেছেন নারীদের কাছে যেতে হলে চাবুক হাতে যেও।
আমার কি আত্মহত্যা করা উচিত? অনেকেই তো আত্মহত্যা করেছেন। সিলভিয়া প্লাথ, মায়াকোভস্কি, হেমিংওয়ে, ভ্যান গগ প্রমুখ নিজেদের মৃত্যুর দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এভাবে মরলে দোযখে যেতে হবে নিশ্চিতভাবে। দান্তে তার ডিভাইন কমেডিতে নরকের বিশদ ও নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন। আগুনের লেলিহান শিখা সবকিছুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে কিন্তু কোনো কিছুই জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হচ্ছে না। অনন্তকাল ধরে পুড়ছে তো পুড়ছেই। আচ্ছা, বেহেশত, দোযখ, ঈশ্বর, পরকাল এগুলোর অস্তিত্ব আছে কি? ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কিনা জানার জন্য আমি প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, হাইডেগার, হেগেল, নীটশে, সার্ত্রে ইত্যাদি অনেকের লেখা পড়েছি। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এর উত্তর না জেনেই আমাকে মরতে হবে। যেমন হাজার বছর আগের মানুষও এর কোনো সদুত্তর না পেয়েই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
আমি এখন পত্র-পল্লবহীন বিবর্ণ বৃক্ষের মতো নিঃসঙ্গ। আমি এখন নক্ষত্রবিহীন সীমাহীন আকাশের মতো নিঃসঙ্গ। আমি এখন নির্জন বিস্তীর্ণ বালুচরে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত নৌকোর মতো নিঃসঙ্গ। আমি এখন অসীম ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিঃসঙ্গ ঈশ্বরের মতো একাকী। আমার একাকীত্ব বুঝবে একা একা মাঝরাতে দিগন্তের দিকে উড়ে চলা সঙ্গীহীন শঙ্খচিল। আমার একাকীত্ব বুঝবে সবুজের সমারোহে শিকারির গুলিতে সঙ্গী হারানো সম্মোহিত তৃণভোজী মায়া হরিণী। আমি এখন শূন্য হয়ে গেছি। আমার শূন্যতা মরুদ্যানবিহীন ধু ধু শূন্য মরুভূমির মতো। আমার শূন্যতা সীমাহীন আকাশের স্নিগ্ধ নীলিমার মতো। আমি বাঁচতে চাই। আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন চাই। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল সে। সে ছিল আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা, আমার জীবন, আমার যৌবন। আমার প্রতিটা শ্বাসপ্রশ্বাসে ছিল সে। আমার অস্তিত্ব অর্থময় হয়েছিল কারণ সে আমার ছিল। আমার সত্তার শাশ্বত সৌধের স্বর্ণোজ্জল মিনারের সে ছিল একমাত্র আলোকবর্তিকা।
ইংরেজিতে ব্যভিচারী স্ত্রীর স্বামীকে Cuckold বলা হয়। চিন্তা করে দেখুন লোকটা দু’দিক থেকে লাঞ্ছিত হচ্ছে। একদিকে সে স্ত্রীর প্রতারণার শিকার। অন্যদিকে সমাজও তাকে বিদ্রূপ করছে। আমাকেও তো সেই Cuckold বলা যেতে পারে। আমার স্ত্রী অন্যের সঙ্গে শয্যায় যায় একথা যদি মানুষ জানতে পারে তাহলে আমাকে কি ছেড়ে কথা বলবে? ভাববে লোকটা হয়তো অক্ষম। এজন্যই তার স্ত্রী অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে। বিশ্বাস করুন আর্থিক বা শারীরিক কোনোভাবেই আমি অক্ষম নই। বিছানায় আমি যে কোনো পুরুষের মতোই দৈহিক শিল্পে পারঙ্গম। কিন্তু একটা সমস্যা আমার আছে। সেটা হচ্ছে আমার সন্তান সৃষ্টির ক্ষমতা নেই। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। কিন্তু তাই বলে স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা! এটা মেনে নেয়া যায় না। কোনোভাবেই না। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। ওকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। ওকে ছাড়া আমি অপূর্ণ। ওকে ছাড়া আমি শিশুর ভেঙে যাওয়া অকেজো খেলনার মতো।
আমার দুঃখগুলোকে কোথায় রাখি? আমার দুঃখগুলোকে যদি ভরা জ্যোৎস্নায় যমুনার জ্বলজ্বলে জলে ভাসিয়ে দিতে পারতাম! আমার কষ্টগুলোকে যদি কাচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারতাম! আমার যন্ত্রণাগুলোকে যদি আগুনের নীলাভ শিখায় পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলতে পারতাম! দুঃখের রঙ কী? লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, সোনালি? আমার দুঃখের কোনো রঙ হয় না। কোনো রঙ দিয়েই আমার দুঃখের সীমাহীনতাকে প্রকাশ করা যাবে না। তুলির কোনো আঁচড় দিয়েই আমার দহন যন্ত্রণার তীব্রতাকে ব্যক্ত করা যাবে না। কোনো শব্দ, কোনো ভাষা ধারণ করতে পারবে না আমার পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া হৃদয়ের তাম্রবর্ণ মাংসপিণ্ডকে। আমার অন্তরের রক্তজবার মতো লাল ক্ষতকে পৃথিবীর কোনো দাওয়াই দিয়েই সারানো সম্ভব না।
ফজরের আযান দিয়ে দিয়েছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। তুমুল বৃষ্টি। ভিজে গেছে দালান-কোঠা, রাস্তাঘাট। দালানগুলোর কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। উল্টো দিকের দালানের সামনে যে কাঁঠাল গাছটা আছে তার পাতাগুলো চকচক করছে। একটা দাঁড়কাক বিদ্যুতের তারে বসে ডেকে ডেকে ভোরকে রহস্যময় করে তুলছে। ভোরের ম্লান আলোয় কয়েকজন মুসুল্লি ছাতা মাথায় মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। ছাই রঙা আকাশকে আলোকিত করে কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট ঊষর হৃদয় বৃষ্টির জলে সিক্ত হোক। আমার কষ্টগুলো বৃষ্টির পানিতে নগরীর আবর্জনার সঙ্গে ভেসে যাক নদী পথে সীমাহীন সাগরে। আমার দুঃখের দাবদাহে চৌচির আত্মার মৃত্তিকা উর্বর হোক বৃষ্টির স্ফটিক কণার সৃষ্টিশীলতায়। নবজন্মের আনন্দে উদ্ভাসিত হোক আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা। স্বামীর উদ্দাম ভালোবাসায়, সন্তানের উত্তাল সোহাগে সুখের সুরম্য অট্টালিকায় বেঁচে থাকুক আমার প্রিয়তমা।
কায়সার আহমদ কবি ও কথাসাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে সম্মানসহ স্নাতক এবং ইংরেজি সাহিত্যে এমএ। নোয়াখালীর একটি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ভ্রমণ করা তাঁর শখ এবং লেখালেখি অদম্য নেশা। পঠিত বিষয়ের মধ্যে আছে সাহিত্য ছাড়াও দর্শন, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান এবং চিত্রকলা। ২০১২ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ নিদ্রাহীন রাত্রির কবিতা প্রকাশিত হয়।