বাবা

—বাবা, এই দ্যাখো তোমার জন্যে নাশপাতি কেটে এনেছি।
—আবার! এই না কিছুক্ষণ আগে জাম ভর্তা খাওয়ালি? 
—তাতে কী? জামে ভিটামিন সি আছে। আর নাশপাতিতে আছে ভিটামিন সি, পটাসিয়াম, আয়রন আর ক্যালসিয়াম। 
—কে বলল তোকে? তুই কি নিজেই ডাক্তার হয়ে গেলি নাকি? 
—বারে! ঘরে গুগল ডাক্তার আছে কোন দুঃখে? তুমি পৃথিবীর কোন বিষয়টি  নিয়ে জানতে চাও? বল আমাকে। আমি এক মিনিটের মধ্যে সব তথ্য তোমার সামনে হাজির করে দিব।
—হুম, তা পারবি। তো এত ঘনঘন আমি কি খেতে পারব রে মা? একটু বিশ্রাম নিতে দে।  
—আরে? তোমার তো এখন অলস সময়। কোন কাজ করছ না। এই সময়ে  তোমার খুব আনন্দে থাকতে হবে। খাবে, মুভি দেখবে আর ব্যায়াম করবে। এই সময়ে শরীরের এন্টিবডিকে চাঙ্গা রাখতে হবে।
—হুম! এন্টিবডি চাঙ্গা রাখতে হলে কি ঘন ঘন খেতে হবে নাকি? 
—অবশ্যই বেছে বেছে ভালো খাবার খেতে হবে। গান শুনতে হবে, সিনেমা  দেখতে হবে, বই পড়তে হবে, মোটেও বাড়তি কোন ট্রেস নেওয়া চলবে না আর আড্ডা দিতে হবে।
—বলিস কি আড্ডা? তাহলে আমি কোয়ারেন্টাইনে থাকব কীভাবে? 
—এই যে আমরা আড্ডা দিচ্ছি না? ৬ ফুট দুরুত্ব মেনে চললেই হবে। 
—আচ্ছা মা তুই কিন্তু কথা বলতে বলতে নো ম্যানস জোনে চলে এসেছিস! 
এবার টুনির টনক নড়ল। তাইতো! মেঝেতে চক দিয়ে দাগ কেটে তৈরি করা সীমানাটা সে লঙ্ঘন করেছে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে হলে এই সীমানা লঙ্ঘন করা চলবে না। সে নিজেই বানিয়েছে। নিজের ভুল দেখতে পেয়ে জিভে কামড় দিয়ে টুনি দুই পা পিছিয়ে এলো।
—সরি বাবা, আর হবে না। এবার বই পড়তে পড়তে লক্ষ্মী ছেলের মতো  নাশপাতিটা খেয়ে ফেল। আমি কিছুক্ষণ পরে আবার আসব। তখন যেন প্লেটটা শূন্য দেখি!
—ঠিক আছে, অনেকটা ভয়ে ভয়ে জবাব দিলেন এখলাস আলী। 
টুনি নাশপাতির বাটিটা রেখে যাওয়ার সময় দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারে ২০২০ সালের জুলাই মাসের ৫ তারিখের ঘরে একটা ক্রস চিহ্ন দিল। তারপর চিৎকার দিয়ে বলল, ‘বাবা, আর আছে মাত্র ৭দিন! তারপর তোমার কোয়ারেনটাইন শেষ। এভাবে চিৎকার দিয়ে ফুরুৎ করে চড়ুইপাখির মতো আবার হাওয়া হয়ে গেল টুনি। বাবা তার আদরের মেয়েটার দ্রুত চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন।’

এখলাস আলী একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। চুলে হালকা পাঁক ধরেছে। চম্পা কলার মতো একটা নাক যেন মুখের ওপর ঝুলে আছে। শরীর স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো না। কারণ আগে থেকেই হাঁপানি অর্থাৎ ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমার কারণে শ্বাসকষ্ট আছে। ডাক্তার বলেছেন একটু সাবধানে থাকতে হবে। ঘরে ইনহেলার আছে। ডাক্তারের পরামর্শ হলো নিয়ম করে খেতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে, নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে তাহলেই সব ঠিক থাকবে। সম্প্রতি শ্বাসকষ্টের কারণে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে গেলে করোনা টেস্টে তার পজেটিভি ফল আসে। ডাক্তারের পরামর্শে এখলাস আলী তার নিজ বাসায় এখন চৌদ্দ দিনের জন্যে কোরাইন্টাইনড। টুনি তার একমাত্র মেয়ে। বয়স চৌদ্দ বৎসর। ক্লাস নাইন এ পড়ে। মেধাবী ছাত্রী। খুব দুরন্ত। সবাই বলে বাপের একেবারে নেওটা। বাপ বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই তার পিছন পিছন সে ঘুরঘুর করবেই। আর বাপও ঠিক তার মেয়ের মতোই। মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে না পেলে তার মাথা ঠিক থাকে না। এই তো সেদিনের কথা। অফিস থেকে এখলাস আলী ঘরে ঢুকেই সোজা চলে গেলেন গোসল করতে। করোনার সময় এমনটাই নিয়ম। গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে খাবার টেবিলে একটা চেয়ার টানতে টানতে হাক দিলেন, ‘টুনি, তুই কোথায় রে? দেখছি না কেন?’
কিন্তু টুনির কোন হদিস নেই।
এবার এখলাস আলী চেয়ার থেকে উঠে মেয়েটাকে খুঁজতে যাবেন কিন্তু স্ত্রী সনজিদার বড়বড় চোখের সামনে সে উৎসাহে ভাটা পড়ল।
—আচ্ছা তোমার হয়েছে কী? তোমাদের এই বাপ-বেটির কাজ কারবার  আমার মোটেও ভালো লাগছে না। সারাক্ষণ মেয়েটাকে নিয়ে কোলে করে নাচছো। আচ্ছা, ওকে একটু বড় হতে দিবে না? চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে! আর তোমার সঙ্গে ওর আহ্লাদ দেখলে মনে হয় যেন তার বয়স এখন চার বছর!
এখলাস আলী কিছু না বলে টেবিলে রাখা খাবারের দিকে হাত বাড়ায়। তারপর মুখটা নিচু করে বলে, ‘বুঝলে সনজিদা এই মেয়েটা আমার একটা কলিজার টুকরা। ও যদি ব্যথা পায় আমিও ব্যথা পাই। কোথায় গেল মেয়েটা? একটু ডেকে দাও না, দেখি তাকে।’ 
সনজিদা এবার পেছন থেকে এখলাসের কাঁধে হাত রাখল। ‘আচ্ছা, তুমি এত ছেলেমানুষ কেন বলত? মেয়েটা কি একটু বিকেলে ছাদে যেতে পারে না? ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করছে। সারাদিন ঘরে থাকতে থাকতে টায়ার্ড। মেয়ের জন্য এত উতলা হলে কি চলে?’ কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলেন সনজিদা। এখলাস নীরবে স্ত্রীর সব কথা শুনে গেলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন
‘টুনিকে না দেখলে আমার শ্বাস কষ্ট বেড়ে যায়। মনে হয় কি যেন নেই। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা শূন্যতা টের পাই।’
এবার সনজিদা একটা চেয়ার টেনে এখলাসের সামনাসামনি বসলেন। তারপর মুখটা কাছাকাছি এনে কপাল কুঁচকে বললেন, ‘আচ্ছা, মেয়েটা বড় হচ্ছে। একসময় তাকে বিয়ে দিতে হবে। তারপর সে স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। তারপর? তুমি কি মেয়েকে বিয়ে দিবে না? সারা জীবন তোমার বুকে আগলে রাখবে? এত ভালোবাসা কী ঠিক ‘
এখলাস এবার হঠাৎ করে কুপিবাতির নিভে যাওয়া সলতার মতো চুপসে গেলেন। কিছুক্ষণ পর গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলেন, ‘মেয়েটাকে এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিব যে, আমাদের বাড়িতে ঘরজামাই হয়ে থাকতে রাজি আছে। আর যদি ঘরজামাই থাকতে রাজি না থাকে তাহলে আমিও মেয়েটার সঙ্গে তার শ্বশুর বাড়িতে চলে যাব। মেয়ে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।’
সনজিদা এবার তার স্বামীর বোকাসোকা মুখটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,
‘ঘরজামাই দেখে বিয়ে দিবে? তুমি তো তোমার শ্বশুর বাড়িতে এক দিনের বেশি দুই দিনও থাক না। তাহলে তুমি কীভাবে আশা কর যে তোমার মেয়ের জামাই ঘরজামাই হয়ে থাকবে? এটা বাস্তব কোনো কথা হলো?’
এটাই বাস্তব কথা। পৃথিবীতে এমন অনেক অবাস্তব ঘটনা ঘটে। এটাও ঘটবে। আর টুনিতো আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না। আমার গায়ের ঘ্রাণ না নিলে সে ঘুমাতে পারে না। আমার বুকে মাথা রাখলে আমি যখন তার চুল একটু বিলি করে দেই তারপরই সে ঘুমাতে যায়। এত নতুন কোন নিয়ম না সনজিদা! তার জন্মের পর থেকেই এই নিয়ম চালু আছে! আর আমিও তাকে একটু জড়িয়ে না ধরে থাকলে ঘুমাতে পারি না। এসবই তো জানা কথা! এখলাস আলী যেন কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
আচ্ছা ঠিক আছে। মেয়ে বড় হলে একটা ঘরজামাই বর খুঁজে তাকে বিয়ে দিও। সে তো অনেক পরের হিসাব। এখন একটু বিশ্রাম কর। যাও। আমি মেয়েকে ছাদ থেকে ডেকে নিয়ে আসছি।
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এখলাস আলীর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।

এখলাস আলীর আজ করোনা পজিটিভের ১০ দিন। ১৪ দিনের মাথায় বিপদ কেটে যাবে বলেই বিশ্বাস। বাবার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ার পর থেকে টুনির কাজ আগের থেকে আরও বেড়ে গেছে। বাবার এন্টিবডি কীভাবে শক্তপোক্ত করা যায়, কোন খাবারগুলো এই মুহূর্তে শরীরের জন্যে ভালো, কোন ফলের কোন ভিটামিন, শরীরের যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ডি মজুদ আছে কিনা। না থাকলে জানালা দিয়ে আসা রোদে বাবা সময় করে বসছেন কিনা সব রকম পথ্য টুনির মুখস্থ। এখলাস আলী তার মেয়ের এই অত্যাচার খুব আনন্দ সঙ্গেই সহ্য করছেন। টুনি তার বাবার ঘরের দরজার সামনেই একটা চেয়ার বসিয়ে সেখানে আস্তানা বানিয়েছে। এই চেয়ারে বসেই বাবা-মেয়ের রাজ্যের আড্ডা চলে।
—বাবা
—বল মা 
—তোমার কি মনে হয় করোনার কোন ভ্যাকসিন সহসাই আবিষ্কার হবে? 
—নাহ! আমার মনে হয় না। ডেঙ্গুরই কোনো ভ্যাকসিন বের হলো না আর  করোনা তো সেদিনের ব্যাপার। তবে করোনার একটা সুবিধা হলো মৃত্যুহার অনেক কম। একশো জনে ধরা পরলে মাত্র ৪/৫ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। একটু সাবধানে থাকতে হবে, এই যা।
—কিন্তু তারপরও তো মানুষ মারা যাচ্ছে। বাবা তোমার কিন্তু শ্বাসকষ্ট  আছে। কথাটা যেন মনে থাকে। তোমার এন্টিবডির অবস্থা কেমন সেটা যদি মাপা যেত সবচেয়ে ভালো হতো। কাল একটা অক্সিমিটার কিনে নিয়ে আসব। তোমার শ্বাস নিতে কোন কষ্ট হলে অক্সিমিটার দিয়ে আগাম বুঝতে পারব। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের মতো করে কথাগুলো বলল টুনি।
—কিন্তু কি দরকাররে মা? আমার তো শ্বাসকষ্ট আর হচ্ছে না। এত চিন্তা  করিস কেন?
—কে বলল হচ্ছে না। গত পরশু তুমি বলছিলে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। 
—হুম, সেতো আমার পুরানো রোগ। 
—না তোমার শরীরের ভেতর এখন করোনা ভাইরাস আছে। অতএব হিসাব  করে চলতে হবে বাবা। আমি কালই একটা অক্সিমিটার কিনে নিয়ে আসব।
—আচ্ছা মা। নিয়ে আসিস কিনে। 
—বাবা, এবার তুমি একটু ঘুমাও। বিকেল হয়ে গেছে। বিকেলে মালটা  কেটে দিব। প্রচুর ভিটামিন সি পাবে মাল্টায়। 
—আচ্ছা মা। দিস মাল্টা কেটে।  
—হ্যারে টুনি, তোকে দূর থেকে দেখি অথচ কাছে টেনে আদর করতে  পারছি না। তোর একটা জামা এনে দিবি মা। তোর গায়ের একটু ঘ্রাণ নিতে পারতাম। তোর ঘ্রাণ না নিলে আমার ঘুম আসে না। সেটা কি ভুলে গেছিস? এখলাস আলী বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে কথাগুলো বললেন।
—আমিতো বাবা তোমার একটা শার্ট মাকে না বলেই আমার ঘরে এনে  রেখেছি। ঘুমানোর আগে আমি সেই শার্ট থেকে তোমার গায়ের ঘ্রাণ পাই। আচ্ছা বাবা, আমি কি সত্যি খুব সেলফিস হয়ে গেলাম? শুধু আমার কথাটাই ভাবলাম! অথচ তোমার কথাটা মনেই এলো না? ছি!
—যা পাগলি। এখন ঘর থেকে একটা জামা নিয়ে আয়। সাবানে ধোওয়া  জামা আবার আনবি না যেন! তোর গায়ের ঘ্রাণ আছে এমন জামা।
টুনি এক দৌড়ে তার নিজের ঘর থেকে বাবার জন্যে একটা জামা নিয়ে আসে।
—এই যে বাবা। এবার ঘুমাও।


আদনান সৈয়দ কথাসাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক, যুক্তরাষ্ট্র 

menu
menu