রাতের সঙ্গী

মনের নিবিড়তায় ছেদ পড়লেই মানুষ তা মেনে নিতে চায় না। ভিতরে ভিতরে ভীষণ কষ্টবোধ করে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ফোনে বাপের বাড়ির খবরটুকু শুনে আফরিন কেমন যেন আনমনা হয়ে যেতে বাধ্য হলো। একমাত্র দাদা গুরুতর অসুস্থ। মথুরাপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তখনো জ্ঞান ফেরেনি। বোনের কাছে এর থেকে খারাপ খবর আর কী হতে পারে।

সেই সঙ্গে ভিতরে ভিতরে অন্য দোলাচলের অস্থিরতা। ছেলে শাহিন স্কুলে। বিকেলের সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমের আকাশে। তেজ কমছে তর তর করে। শরতের হিমেল বাতাস মিঠে রোদের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব পাতাতে ব্যস্ত। আফরিনের মন তখনো দোটানার ব্যাকুলতায় দুলছে। সামনে পরীক্ষা, অসুস্থতার খবর কিছুতেই ছেলেকে জানানো যায় না। জানালে যে ক্ষতি তা বাস্তবিক অপূরণীয়। ওর বাপি গতকাল শিলিগুড়ি গেছে। ফিরবে এক সপ্তাহ পরে। একটা জটিল তাৎক্ষণিক সমস্যা।

পায়ে পায়ে পাশের বাড়িতে গেল। মুশির মাকে সামনে পেয়ে বলল, একটা অনুরোধ করতে এসেছি।

বলো বৌমা।
শাহিনের মামা গুরুতর অসুস্থ, মুশি যদি রাতটুকু শাহিনের সঙ্গে থাকে।
বেশ তো, বলছ যখন মুশিকে বলে দেব। তুমি কী এক্ষুণি বের হচ্ছ?
যেতে তো হবে, আরেকটা অনুরোধ—।
বলো বলো।
বাড়িতে ফিরলে শাহিনের কাছে বিপদের কথা কিছু বলবেন না, অকারণে আকাশ কুসুম ভাবতে পারে।
বেশ তো, বলছ যখন—।
তাহলে আসছি।
সাবধানে যেও বৌমা।

আফরিন আর কথা বাড়ালো না। শাড়ি পাল্টে সদর দরজায় লক করে চাবির গোছা মুশির মায়ের হাতে দিয়ে বের হয়ে পড়ল। কয়েক মিনিট হাঁটলেই বাসস্ট্যান্ড। তখনো আফরিনের মনের ইজেলে দাদাকে নিয়ে বিপদসংকেতের চোকরা-বোকরা ছবি ভেসে রয়েছে। প্রকৃতির ঝড় মনের ঝড়ের কাছে কত সহজে হার মানে, তা বেশ টের পাচ্ছিল আফরিন।

বিকেলের খেলা শেষ হলেই বাড়িতে ফিরে এসে শাহিন দেখল, মা বাড়িতে নেই, অবশ্য তা নিয়ে খুব বেশি সময় ভাবতে হলো না। মুশির মা এসে বলল, জরুরি দরকারে মামার বাড়িতে গেছে তোর মা। রাতে মুশি তোর সঙ্গে থাকবে। ভাত-তরকারি রান্নাঘরে হাঁড়িতে আছে, খেয়ে নিস।

সন্ধে উতরে গিয়েছে বলেই ছোপ ছোপ আঁধারের প্রলেপ শুরু হয়েছে মাটির বুকে। কলপাড়ে মুখহাত ধুয়ে বারান্দার উপর এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দেখল, ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনুব্রত এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে। দু’জনে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু কলেজ-জীবন শুরু হতেই দু’জনের পড়াশোনার ক্ষেত্র পাল্টে গেছে। যোগফলও বিপরীতমুখী। অনু ভর্তি হয়েছে বারাসাত ধ্রুবচাঁদ কলেজে। শাহিনের নতুন শুরু বিরেশ্বরপুর কলেজে। বিপরীতমুখী চারণক্ষেত্র হওয়ায় দু’জনের মধ্যে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ছিল না আর। ফলত সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলা অনুকে সামনে পেয়ে শাহিন আন্তরিকতা দেখিয়ে বলল, কেমন আছিস রে?

ভালো আছি, রোজ বিকেলে তোকে খুব মনে পড়ে, ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠি।

শাহিনের মধ্যেও অনুরূপ অনুশোচনার ঢেউ। অনুকে ঘরের ভিতরে বিছানার উপর বসতে দিয়ে পাশের বাড়িতে গিয়ে বলল, মুশিকে আর আসতে হবে না, অনুব্রত এসেছে, রাতে আমার কাছে থাকবে। কোনো অসুবিধা নেই। 

ঠিক বলছিস্‌ তো বাবা? মুশির মায়ের আন্তরিক প্রশ্ন।
শাহিনের মুখে হাসি, সুন্দর সদুত্তর।
তাহলে দু’জনে রাতটুকু একসঙ্গে থাক।
শাহিন আবার হেসে দিল।
সকালে তোর মা ঠিক চলে আসবে।

রাত বাড়ছে পলে পলে। অনুর সঙ্গে শাহিনের গল্পের মাত্রা বেড়ে চলেছে তির তির করে। অকৃত্রিম বন্ধু অনুর বিচিত্র কথায় শাহিন পুলকিত হচ্ছে বার বার। বিছানার উপরে দু’জনে মুখোমুখি বসে। অনুর মধ্যে আবেগের আতিশয্য। শাহিনকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুইয়ে ফেলল। হুল্লোড়ের মজা পেতে চাচ্ছে।

বাধা দিতে দিতে শাহিনের চাপা প্রশ্ন, এসব কী করছিস রে?
কতদিন পরে দেখা, একটু জড়িয়ে মড়িয়ে নিচ্ছি।
এখনো সারা রাত পড়ে রয়েছে।

বন্ধুত্বে রাতদিন হয়? তোর গলাটা কী তুলতুলে রে। দু’হাতের দশ আঙুল দিয়ে শাহিনের গলায় চাপ দিতে শুরু করল অনু। মুখে খিল্‌ খিল্‌ হাসির ফোয়ারা। অনুর অনুপ্রাস উক্তি, তোকে কী ভালো লাগছে রে।
শাহিন বাধ্য হলো অনুর হাসিতে যোগ দিতে। ফর্সা মুখে অনুপম হাসি। সেই মাত্রা বেড়েই চলেছে।
শাহিনের চকিত প্রশ্ন, এ্যাই অনু, একটু টি.ভি. দেখবি? জি-বাংলায় ভালো সিনেমা চলছে। দেবের ‘পাগলু’, দুটো গান যা হিট করেছে।
দে তাহলে।
শাহিন নিজস্ব মনোযোগ নিয়ে রিমোট্‌ ঘুরিয়ে জি-বাংলায় নিয়ে গিয়ে পাশে চেয়ে দেখল, অনু বিছানার উপর নেই। প্রশ্ন জাগল শাহিনের মধ্যে, পাশেই বসে ছিল, এক পলকে গেল কোথায়? ডাকতে শুরু করল, এ্যাই অনু, গেলি কোথায় রে?
এই তো আমি।
শাহিন অনুর গলা স্পষ্ট শুনতে পেল কিন্তু দেখতে পেল না। বাধ্য হয়ে দ্রুত পায়ে বারান্দায় এসে বলল, কোথায় রে তুই?
এই তো এখানে।
কোথায় বলবি তো?
রান্নাঘরে।
ওখানে গেলি কেন?
খুব তেষ্টা পেয়েছিল।
আমাকে বলতে পারতিস।
তুই তো টিভি দেখায় মত্ত।
আমাকেও এট্টু জল খেতে হবে রে।
তাহলে জলের পাত্রটা নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে দেখে তোর জল খাবার কথা মনে পড়ল?
তা হতে পারে।
রান্নাঘরে অনুর খিলখিলে হাসি।

তটস্থ শাহিন পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল, অনু রান্নাঘরে নেই। ভিতরে অচেনা কৌতূহলের চিত্রবিচিত্র ছবি। দু’চোখ তন্ন তন্ন করে রান্নাঘরের সর্বত্র আবার দেখে নিল। রহস্যের জড়তা সারা শরীর জুড়ে। শব্দ আছে, শারীরিক প্রকাশ নেই। এও কী সম্ভব? ভয়বিহ্বল শাহিনের প্রশ্ন, কই রে, কোথায় তুই?

জল খাওয়া শেষ করে ঘরের ভিতরে চলে এসেছি।

শাহিন হতবাক, কেমন যেন বিমূঢ়, ধস্ত মানসিকতায় জারিত হতে হচ্ছে তাকে। —কোন পথে গেল অনু? বারান্দা ধরে গেলে তো সে দেখতে পেত। হনহন পায়ে ঘরের ভিতরে ফিরে এসে দেখল, অনু বিছানার উপর বসে এক মনে টিভি দেখছে। —কোন পথে ঘরে ঢুকলি তুই?

কেন বারান্দা দিয়ে।
তাহলে তো দেখতে পেতুম।
মায়ের ভাবনা বেশি মাথায় নিলে চোখের দেখা এমনি হয়। 
মা কোথায় গিয়েছে বলতে পারবি?
মাসিমা এখন বাপের বাড়িতে।
জানলি কী করে?

অনু হো হো শব্দে হাসছে, শাহিনের মধ্যে তঠস্থ ইচ্ছার দ্রুত জাগরণ ঘটছে। আসার পর থেকে সে তো মায়ের কথা একবারও বলেনি অনুকে। শাহিনের ঝাঁকুনি প্রশ্ন, এ তথ্য জানলি কী করে?

জেনেই এসেছি, তারপর হাসির হুল্লোড়ে মেতে উঠল অনু। শাহিন প্রিয় বন্ধুর হাসিতে যোগ না দিয়ে পারল না। অনু আবার শাহিনকে জড়িয়ে মড়িয়ে নরম বিছানায় শুইয়ে ফেলল। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। তাতে বিটকেল গন্ধ। অনুর দিকে শাহিনের অপলক দু’চোখ। কোনো যুক্তির নিরিখ মিলছে না। শাহিনের তুলতুলে গলায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনুর স্বগত উক্তি, আহারে, কী নরম! রোজ ক্রিম মাখিস, না? আঙুল দিয়ে টিপছি। কী আরাম লাগছে।

অনুর আচরণে শাহিনের মধ্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থান। আগে কখনো এমনি আচরণ করেনি। মুখ ঘুরিয়ে অনু বলল, হ্যাঁরে, জল খাবি বলে জগ আনলুম, এক ঢোকও তো খেলি নে।
জলের পাত্রটা তোর বাম পাশে রয়েছে, সরিয়ে দে।
এই নে।
শাহিন পাত্রটা উঁচু করে ধরে ঢক ঢক শব্দে জল খেতে শুরু করল। অনুর প্রশ্ন, মিষ্টি জল বলে বেশি খাচ্ছিস?
কলসির জল মিষ্টি হলো কী করে বলতো?
মাসিমা হয়তো চিনি ফেলে দিয়ে গেছে। 
শাহিনের মধ্যে অভিনব ভাবনার ধাক্কা, মা তো কোনোদিন জলের কলসিতে চিনি ফেলে দেয়নি? কেনই বা দিতে যাবে? রান্নাঘরে গিয়ে কলসির জল আরেকটু খেয়ে দেখব? শাহিন উঠে দাঁড়ালো।
আবার জল খাবি নাকি?
আমার ইচ্ছা জানলি কী করে।
এমনি বললুম।
শাহিন চেয়ে থাকল অনুর দিকে।
এখন কলসির জল লোনা হয়ে গেছে রে।
একই পাত্রে দু’রকম জল থাকতে পারে?
কখনো কখনো তাই হয়।
শাহিন রাগ দেখিয়ে বলল, যা খুশি তাই বলছিস?
রান্নাঘরে গিয়ে জল খেলে বুঝতে পারবি।

শাহিন ডিগ্রি কোর্স পড়ে। কোনো লজিক মিলছে না। সাগ্রহে রান্নাঘরে গিয়ে এক ঢোক জল খেতেই সারা শরীর বিড় বিড় করে উঠল। কৌতূহলের বন্যা তার ভিতরের নদীতে। দ্রুত পায়ে বারান্দা পার হয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখল, অনু সেখানে নেই। আবার গেল কোথায়? কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। ডাকতে শুরু করল শাহিন, কই রে তুই?

এই তো রান্নাঘরে।
আবার ওখানে কেন?
ভাবলুম, আমিও একটু খেয়ে দেখি।
কলসিতে তো লবণ জল।
কী বাজে বকছিস? এই তো খাচ্ছি, সরবতের মতো মিষ্টি।

শাহিনের কৌতূহল উঁচু পাহাড়ের সমতুল্য। স্রেফ বাজে বকছে অনু। একই কলসির জল দু’রকম হয় নাকি? রাগ দেখাতে হুড়মুড়িয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, অনু সেখানে নেই। তবুও ভাবল, কলসির জল খেয়ে অনুকে মিথ্যা প্রমাণিত করতেই হবে। গ্লাসে ঢেলে জিভে দিয়েই বুঝল, সত্যি খুব মিষ্টি। লেবুর সেন্ট মেশানো। এভাবে পরিবর্তন সম্ভব হলো কী করে? সাধারণ পানীয় থেকে মিষ্টি পানীয়, তা থেকে লবণাক্ত, আবার মিষ্টি পানীয়? হতবাক শাহিনের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত কম্পন। প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে ডাকল, এই অনু, অনু রে—।

এই তো আমি।
কোথায় বলবি তো?
ঘরের ভিতরে এসে টি.ভি. দেখছি।
গেলি কোন পথে?
আমার সঙ্গে খচরামি করিস নে, দেখলুম তো, তুই বারান্দা ধরে রান্নাঘরে গেলি।
সত্যি বলছিস?
যা দেখেছি, তাই বললুম।

শাহিনের অবচেতন মনে ভৌতিক চেতনার সূত্রপাত। যত সব তাজ্জব ঘটনা! অনু তাকে দেখতে পেল অথচ সে—। এমনি করেই কী সম্ভব? ভুল করে রিমোটটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে গিয়েছিল। তাহলে অনু টিভি দেখছে কী করে?

দেওয়াল ঘড়িতে সাড়ে দশটা। শাহিন দ্রুত পায়ে ঘরের ভিতরে এসে দেখল, নিমগ্ন অনু সিরিয়াল দেখায় মত্ত। শাহিনের প্রশ্ন, হ্যাঁরে টিভি খুললি কী করে? রিমোট তো আমার হাতে।
টিভি খুলতে রিমোট লাগে নাকি?
কী বাজে বকছিস?
বন্ধ করে দেখিয়ে দেব?
পারবি?

অনুর মুখে কয়েকটা শব্দের বিড় বিড় উচ্চারণ। টিভি বন্ধ হয়ে যাওয়া। শাহিনের বিহ্বল দুচোখ অনুর দিকে। এ কোন অনু? এতটাই বিবর্তন ঘটে গেছে?
অনু হো হো শব্দে অট্টহাস্য করে উঠল।
অমন হাসছিস যে?
আমি ম্যাজিক পাওয়ারে টিভি খুলি, বন্ধ করি।
এসব শিখলি কী করে?
ফিলিপ শিকারীর আত্মার যোগফল লাভ করতে পেরেছি! এখন যা খুশি তাই করতে পারি।
কী রকম?
টিভি খুলতে চাইলে বলি, নাতাং নাতাং পুতুং পুতুং। বন্ধ করতে চাইলে উল্টো করে বলি, পুতুং পুতুং নাতাং নাতাং।
অর্থ বুঝলুম না।
অনুপ্রাস ছন্দের হেবরু শব্দ। খোলার জন্য বাংলা শব্দার্থ, পুটুস করে খুলে যা। বন্ধ করতে চাইলে ফিলিপের আত্মা ছুঁয়ে যে মন্ত্র বলি, তার অর্থ, খুটুস করে বন্ধ হ্‌।
দারুণ মন্ত্র। অভিনবত্বে ভরপুর।
শিখবি তুই?
আমার পক্ষে কী সম্ভব?
খুব মজা পাবি রে?
দিনের বেলায় এ ম্যাজিক পাওয়ার কাজ করে?
প্রয়োগ করতে যাবি কেন? এ তো মায়া-ক্ষমতা, কেবল রাতে প্রয়োগ সম্ভব।
তাহলে তো দারুণ।
চাপা কণ্ঠস্বরে অনুর ছোট্ট প্রশ্ন, রাত তো অনেক হলো, খাবি নে?
তাহলে রান্নাঘরে চল।
অনু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
শাহিন রান্নাঘরে ঢুকে দেখল, হাঁড়িতে ভাত-তরকারি কিছুই নেই। কুকুর ঢোকেনি তো?
এত কী ভাবছিস? অনুর তাৎক্ষণিক প্রশ্ন।
হাঁড়ি শূন্য।
খেতে বস, ম্যাজিক ক্ষমতায় উড়িয়ে আনছি।
তা কী সম্ভব?
শাহিন খেতে বসল। অনু হাঁড়ির ভিতরে হাতা ঢুকিয়ে শাহিনের থালায় ভাত ভরে দিল। বলল, তরকারি দেব তো?
নাহলে খাব কী করে?

অনু শাহিনের খাবার পাত্রে পর পর নানা পদ সাজিয়ে দিতে থাকল। আলু ভাজা, ডিম ভাজা, একটু ডাল, ইলিশ মাছের ঝোল, দেশি মুরগির কারি, কিছুটা চাটনি।

শাহিনের মধ্যে বহুমুখী প্রশ্নের ডালি। মা তার জন্যে শুধুমাত্র ডিমের তরকারি রান্না করে রেখে গেছে। অনু এতগুলো পদ খেতে দিতে পারল কী করে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, তাহলে মায়ের রান্না ভাত-তরকারি খেয়ে ফেলল কে? কুকুর ঢোকার সম্ভাবনা নিজেই খারিজ করে দিল। সামনের গ্রিলে লক করা, ঢুকবে কী করে?

শাহিনের বুকের গভীরে অদ্ভুত কম্পনের রিদম। দুচোখ অনুর দিকে। স্থিরদৃষ্টি। তাতেই ঝাপসা ভাবনার ছবি, শাহিনের মধ্যে অন্তহীন দোদুল্যমানতা। অনুর বেশে অন্য কেউ নয় তো? কিন্তু কঠোর বাস্তবে তা কী সম্ভব?

ছোট্ট হাই তুলে অনুর প্রশ্ন, কেমন খাচ্ছিস বল্‌? ম্যাজিক পাওয়ার শিখলে এমনি করে যখন তখন যা খুশি খেতে পারবি।

শাহিনের বুকের গভীরে ঢিপঢিপ শব্দদোল। দ্রুত খাওয়া সেরে অনুকে বলল, তুই খেলি নে?
হো হো শব্দে অট্টহাস্য করে উঠল অনু। হেঁসেলের কানায় কানায় সেই শব্দবিম্বের বিস্তার ঘটে গেল। —মাসিমা তো তোর জন্যে ভাত আর ডিমের ঝোল রেখে গিয়েছিল।

জানলি কী করে?
খেতে খেতে জানলুম।
কখন খেলি এসব?
আবার অনুর অট্টহাসি। —ম্যাজিক পাওয়ারের খাওয়া রে। যেকোনো সময় সেরে ফেলতে পারি। সেজন্যে রান্নাঘরে যেতে হবে কেন? চল দুজনে শুয়ে পড়ি, বেশ রাত হয়েছে।

কোনো হিসেব মিলছে না শাহিনের। তালগোল পাকানো একটা অসম্ভব অবস্থান। নিজের হাতে বারান্দার লাইট নিভিয়ে দিল। ঘরের ভিতরে ঢুকে বলল, নাইট বাল্বের সুইচটা অন করে দিই?
না—, সজোরে চেঁচিয়ে উঠল অনু।

অমন চিৎকার করলি যে?
আলো থাকলে ঘুমুতে পারি না।
বেশ তো তাই হোক।
অনু সজোরে শাহিনকে জড়িয়ে ধরে বিছানার উপর আবার শুইয়ে দিল।
এসব কী করছিস?
তুই কী ভালো রে।
ছাড় আমাকে।

অনু কিন্তু ছাড়ল না। দু’হাতের দশ আঙুল দিয়ে শাহিনের গলায় চাপ দিতে শুরু করল। শাহিনের মধ্যে মৃত্যুভয়ের রেশ। একটা অচেনা টানাপোড়েনের জলছবি, অনু কিন্তু আর বেশি কিছু করল না।

বাহির থেকে তারস্বরে রাত-প্যাচার ডাক ভেসে আসছে। ঝিঁঝির হিল্লোল, ঝিল্লির শব্দের অপূর্ব ছন্দবিলোল। রাতের প্রহর এগিয়ে চলেছে। দুটোর দিকে ঘুম ভেঙে গেল শাহিনের। পাশে চোখ রেখে দেখল, অনুর দুচোখে আগুন জ্বলছে। সমস্ত ঘর আলোকিত। সেই জ্যোতি নাইটবাল্বের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল। ভয়ে কুঁকড়ে থাকল শাহিন। পাশের বেডশিটটা টেনে সারা শরীরে মুড়ে দিল। খুব করে মনে পড়ছে মায়ের কথা। তার জীবনের শেষ সময়টুকু মা কী দেখতে পাবে না? নিজের মৃত্যুভয় আর মায়ের মমত্বময় মুখ—পাশাপাশি দোল খাচ্ছে।    

শাহিনের মাও হাসপাতালের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে ভিন্ন চিন্তায় ভীষণ উদ্বেল। ডাক্তারবাবু স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, আর কোনো ভয়ের কারণ নেই, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবেন কিন্তু রাতে ছেলে শাহিন কেমন করে সময় পার করছে, সেটাই তাৎক্ষণিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠল। কৌতূহলের সমুদ্র নিয়ে মানুষের মস্তিষ্ক ও তার কাজকর্ম। এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকতে পারে না। উপযুক্ত ক্ষেত্র না থাকলে নতুন কোনো ভাবনা খুঁজে নিয়ে চরম দুর্ভাবনায় রূপান্তরিত করে তোলে। তাহলে কী মস্তিষ্কের শক্তিকে কেবল নাসূচক হিসাবে গণ্য করব? গ্যালিলিও জীবনের শেষ ন’টা বছর কারাগারে বসে অসহনীয় জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছেন ধর্মবাদীদের চাতুরী চিন্তার কারণে। চিন্তার ক্ষেত্রে এমনি প্রকারভেদ রয়েছে। যা সদর্থক চিরন্তন, সেটাই কেবল গ্রহণীয়। শাহিনের মা তো তুচ্ছ একজন মেয়ে। নিজের ছেলের জন্যে দুর্ভাবনা থাকাটা তো তার জীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক গুণ।

ভোর হতেই শাহিনের মা যন্ত্রচালিত ভ্যানে বাড়িতে ফেরার উদ্যোগ নিল। সকাল হতে তখনো আধঘণ্টা সময় বাকি। চারদিকে ছোপ ছোপ অন্ধকার। একটানা ঝিল্লির শব্দ ভেসে আসছে কানে। যন্ত্রচালিত ভ্যান এসে থমকে দাঁড়ালো মূল রাস্তার ডানপাশের বাড়ির সামনে। নেমেই শুনল, ভিতরে ভীষণ ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে। অবাক না হয়ে পারল না। বলল, এ্যাই শাহিন, কী হয়েছে রে?

দ্যাখো না মা, অনু আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাচ্ছে।
ও এসেছে কখন?
সন্ধের সময়।
তোর ক্লাসমেট অনু তো? চাপলায় বাড়ি?
হ্যাঁগো মা।
তাড়াতাড়ি সামনের গেটের চাবিটা খুলে দে।
পারলে তবে তো—
কেন কী হয়েছে?
অনু কিছুতেই ছাড়ছে না। বুকের উপর চেপে বসে রয়েছে।
কী বলছিস তুই?
হ্যাঁগো মা।
একটু দাঁড়া, পাশের বাড়ির কাউকে ডেকে আনছি।

অনু ত্রস্ত হতে বাধ্য হলো। সেটাই শাহিনের কাছে অনন্য সুযোগ হয়ে দেখা দিল। প্রচণ্ড ঝটকায় অনুকে ঘরের মেঝেতে ফেলে দিয়ে ছুটে গিয়ে সামনের গেটের লক খুলে দিল।

ভিতরে ঢুকেই শাহিনের মায়ের তির্যক গর্জন, অনু কই?
ওই তো ঘরের মেঝেতে?
শাহিনের মা দ্রুত ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখল, সেখানে কেউ নেই।
শাহিন ডাকল, এ্যাই অনু, অনু রে।
রান্নাঘর থেকে অনুর গলা ভেসে এল, এই তো আমি এখানে।
শাহিনের মা আধদৌড়ে হেঁসেলে ঢুকে দেখল, সেখানেও অনু নেই। গেল কোথায় ছেলেটা? শাহিনকে উদ্দেশ্য করে হাঁকল, গেটের সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়া, তারপর দেখছি।

টিউব ফেটে গেলে যেমন একসঙ্গে অনেক হাওয়া বের হয়ে আসে, ঠিক তেমনি করে দমকা হাওয়ার দোল গ্রিলের দরজার ফাঁক গলে বের হতে থাকল। বাড়ির সামনে বড়ো দেবদারু গাছে ঝড়ের তাণ্ডব। এই বুঝি গাছটা ভেঙে মাটিতে শুয়ে পড়বে।

ভয়বিহ্বল কণ্ঠস্বরে শাহিনের প্রশ্ন, দেখছ মা, কী ভীষণ জোরে হাওয়া বইছে।
ওরে, চলে যাচ্ছে রে।
কে মা?
তোর বন্ধু অনু দিন পনেরো আগে বাইক এ্যাকসিডেন্ট মারা গেছিল। পরশু ওর শ্রাদ্ধ হয়ে গেছে। নেমতন্নও করেছিল। সামনে পরীক্ষা বলে তোকে কিছু বলিনি। ওই তো টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে সেই নেমতন্ন্ পত্রটা।

শাহিন ভয়ানক স্তম্ভিত। শরীর মনে কম্পিত। ত্রস্ত ও আতঙ্কিত। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে ডাকল, মা, মাগো—। তাহলে এত সময় ধরে কে আমার সঙ্গে ছিল? 


মুসা আলি কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক, ভারত

menu
menu