নিঘুমওয়ালা 


খোদা দিবস দিয়েছেন কর্মের জন্য
আর রাত্রি বিশ্রামের...

মহুবরের কল্পনায় ভাসতে থাকে রাত। ঘন কুয়াশার মত দু’চোখ ছাপিয়ে ওঠা অন্ধকারে মহল্লা ঢেকে যাওয়া নীরবতা। আর পরতে পরতে রঙিন চুমকি বসানো কুচকুচে নকশা। অন্ধকারে মিশে যাওয়া কিছু আদিম সুড়সুড়ির কমনীয় সুখ তাকে তাড়া দিয়ে রচনা করে নিশিকাব্য। সেই নিশিকাব্য লুকোচুরি খেলে যায় দিনের বেলাকার প্রতিটি কদাকার ঘুমে অথবা টহল দেয়া নিঃসঙ্গ রাতগুলোর ভাঁজ থেকেই। অথচ তাকে ধরতে পারে না মহুবর, ছুঁতেও পারে না, শুধু অনুভব করে শরীর অসাড় করা জাড়ের মতো। তার পাশে পাশেই ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে রাতটা। দাঁত কেলিয়ে টিটকারিও করে যাচ্ছে সুযোগমতো। 

খোদার দেয়া বিশ্রামময় রাতগুলো মহুবর বেচে দিয়েছে অনেক আগেই। এছাড়া কি এমন ছিল যা সে বিকোতে পারত পেটেভাতের দরে? এ শহরের এমন কিছু নেই যাকে সে ভাবতে পারে নিজের বলে। লোকে কয়, মহুবর আলী নিঃস্ব হয়েছে অনেক আগেই, সেই প্রথম যৌবনেই বা তারও আগে বা জন্মের আগেই। তার মতো শত ফুটোওয়ালারা যেমন করে হয় আর কি! হাল-দুনিয়ায় একেবারেই বেমানান সে। নিজেকে ঠিক কোথায় চালিয়ে দেয়া যায়, তা ভাবতে গেলে মহুবরের দম বন্ধ হয়ে আসে। এই শহরে তার মতো রদ্দি মাল আর ঠিক ক’টা আছে তা নিয়েও সন্দিহান সে। শহরটার দিকে মাথা তুলে তাকালেই চারপাশ থেকে কেমন বিদ্রূপ ও নির্মমতা তাকে অস্থির করে তোলে। আকাশছোঁয়া দালানগুলো তার সিনার ওপর পিরামিডের মতো খাড়া হয়। কী ভারি, দম আটকানো আর নিষ্ঠুর! কখনো মনে হয় শহরটা মস্ত এক হাঙর। ধারালো চোয়াল দিয়ে নিমেষে থেৎলে দিচ্ছে তার করোটির হাড়গোড়, ঠিক রাস্তার ধারের আখ মাড়াইওয়ালার মতো। শেষ বিন্দু পর্যন্ত রস থেৎলে নিয়ে ছোবড়াগুলোকে ছুঁড়ে দেয়া হয় জাহান্নামে! 

অফুরান উদ্দীপনার আবেশ ছড়িয়ে, বাতাসে লম্বা শ্বাস টেনে টেনে বুড়ো মহুবর শুরু করেছিল বছর দু’য়েক আগে। এরপর, প্রতিটি কুহেলিকাময় রাতে নিজেকে দ্বিধাহীনভাবে সঁপে দিয়ে আসছে সে। উঠতি অভিজাত এলাকার তকমা পাওয়া মাঝশহরের এই পাড়ায় রাতটা তদারকি করাই এখন তার চলতি জীবনের সবচে অর্থপূর্ণ কম্ম। 

প্রায় হাড্ডিসার আটপৌরে গতরটায় ইউনিফর্ম চাপিয়ে অনেককিছু লুকিয়ে রাখে সে। নিজের অপুষ্টি, খামখেয়ালিভরা অতীত, বেআক্কেলেপনা—অনেক কিছু। এমনভাবে লুকিয়ে রাখা যে, কোনোকিছুই তার খোয়া যায়নি বা কিছুতেই তার কমতি নেই। এরপর রাতের পৃথিবীকে যেমন প্রদক্ষিণ করে চাঁদ তেমনি চলে মহুবরের রাতকে নিয়ে দৌঁড়ে বেড়ানো। পদাতিক সেপাইয়ের মতো ঠকঠক ঠকঠক। বিরামহীন ঠকঠকানি। লম্বা পা ফেলে মহুবর এগিয়ে যায় যুদ্ধবীরের মতো। নিজেকে ভীষণ সরেস আর করিৎকর্মা মনে হয় তখন। 

আধা বেলা ঘুমালে পরের বেলাটুকু বুড়ির টুকিটাকি ফরমায়েশ খাটতে পারে। সংসারের এটা সেটা নিয়ে খুনসুঁটিও করতে পারে খানিক। এছাড়া রাতে পুরো দুনিয়াটাকে আগলে রাখার যে পরম দায় তার ঘাড়ে সেটাও ঠিকঠিক পালন করা যায়। অথচ প্রায়ই তালগোল পাকিয়ে যায়। হেঁয়ালিপনাভরা কাঁতর স্মৃতি তাকে যখন-তখন এলোমেলো করে দেয়। আবার কখনো-বা মাদী কুত্তার মতো বুড়িটার ঘেউ ঘেউ, শাপ-শাপান্তে পুরো দিনটাই বরবাদ করে। সে রাতটা ভিমরুলের মতো তাকে এমন হুল ফুটিয়ে দেয় যে, যন্ত্রণায় পুরোটা সময় ছটফট করতে থাকে। বুড়ো মহুবরের গলিময়, দালানময়, আকাশময় ছটফটানি। 

ভোর থেকে রাত-দুপুর—এমাথা ওমাথায় গিজগিজে। শহর বাড়ছে দিনে দিনে। দালানে দালানে ছেঁয়ে যাচ্ছে আকাশ। লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে, ধানী জমি গিলছে, বিল-ঝিল গিলছে। মহুবর ভাবে দেখতে দেখতে কি জামানা কি হয়ে গেল। পায়ে হাঁটা মানুষ, অটোরিক্সা, গাড়ি, মোটর বাইকের মুহুর্মুহু যানজট—পরিত্যক্ত  খেলনার মতো রাস্তায় স্তূপ হয়ে আছে। মনে হয় আর নড়বে না একটুও। আবার ফাঁক পেল তো হিড়হিড় করে ছুটল। ফুটপাত ধরেও হাঁটার সুযোগ নেই। ডিমসেদ্ধ, ফলের দোকানের কার্টুন, ভুনা মাংসের কড়াই, বট-পরোটা, জুতাকালি, চা-পান কত কি! সিটি কর্তৃপক্ষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চুলার ভাতের মতো টগবগ করে ফুটছে ফুটপাথ-রাস্তাসমেত সব। প্রতিদিন অঘোষিত যুদ্ধের ময়দানে সবাই যার যার মতো নেমে পড়ছে কোনো সেনাপতি বা হুকুমের নির্দেশনা ছাড়াই। মাঝেমধ্যে যুদ্ধ বিরতি দিয়ে কেউ কেউ পরম নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে বট-পরোটা, রসুনবড়া বা ডিমসেদ্ধ খাচ্ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মোবাইলে কথা চলছে অনর্গল। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা চলছে ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে তরুণরা। গৃহিণীরা বা সংসারী পুরুষেরা বাজার থেকে বেরিয়ে আসছে ঘেমেনেয়ে। উপচে পড়া ব্যাগগুলো নিয়ে রিক্সায় চেপে বসল কেউ আর রিকশাচালকের হাড্ডিসার কাঁধেই যেন গোশতঅলা পা’দুটোসমেত শরীরের ভারটা ছেড়ে দিল, আর ছেড়ে দিল একরাশ গরম নিঃশ্বাস—হু...য়ু..., হুহ্হ্! মহুবর দেখে আর ভাবে মহাপ্রলয়ের দিন ধেয়ে আসছে। 

দিনের আলো নিভে এলে মহুবরকেও নেমে পড়তে হবে মল্লযুদ্ধে। গলিময় অন্ধকারে খুচরো বদমাশ বনাম তালপাতার সেপাইয়ে রাতভর ইঁদুর বিড়াল খেলা চলবে। অজ্ঞাত শত্রুরা চারপাশে ওৎ পেতে থাকবে। আড়াল থেকে টিটকারি বা নিশানা করবে। তাই খোল-তলোয়ার নিয়ে কাকাতাড়ুয়ার মতো মহুবর নিশিরাতের কুরুক্ষেত্রে হাজির হয়। এরপর পাড়ার সব দালান-সংসার-আভিজাত্য মহুবরকে রাতভর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় যেমন দলছুট ফেরারি হরিণকে অবিশ্রান্ত তাড়া করে লোলুপ নেকড়ের পাল। সে ক্লান্তিহীন ছুটে। 

নিজেকে রক্ষার জন্য তার পড়িমড়ির কোনো শেষ নেই। একটু পরপর বাঁশিটাকে তেতো ঠোঁটের ফাঁকে চাপিয়ে সজোরে বাতাস ঠেলে—উউরররর! কখনো-বা গলা খাঁকারি দিয়ে, হইই, হটট হই ই ই! ডাক হরকরা দিনো ডাকের থলি নিয়ে ছুটছে। অন্ধকার, বুনোপথ। হাতের লণ্ঠন কাঁপছে। মনে হয় পায়ে পায়ে বিপদ তেড়ে আসে। এই বুঝি দস্যুর অতর্কিত তলোয়ারে ফালি ফালি হয় মাথা। তবু নিশানায় পৌঁছতেই হবে। গলির এ মাথা থেকে ও মাথা। থপ থপ পায়ে এগিয়ে যায় মহুবর, ফিরে এসে তেমাথার মোড়ে বসে খানিক দম নেয়। চোখ পাকিয়ে এদিক ওদিক তাকায় আর পরখ করে দেখে দু’একটা ছিঁচকে বদমাশ এরই মধ্যে কোনো মতলব এঁটেছে কি না। 

ঘুম কাতর পুরুষেরা বিরক্তিতে ঠোঁট নাড়ায়। কেউ কেউ সঙ্গম সেরে ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সেখানে বসে আয়েশ করে চা-বিড়ি ফুঁকে। আর চোখ বিঁধিয়ে নিচে দেখতে থাকে বুড়োভামটা ঠিক ঠিক চালিয়ে যাচ্ছে কি না। কখনোবা পাশে এসে দাঁড়ায় ঢিলা গাউনের স্ত্রীরা। হাই তুলে চোখ কুঁচকায়, বলছি না একটা আস্ত ফালতু। ঘুমকাতুরে বুড়ো। দেখো দেখো, কেমন টলছে! পুরুষটি তখন বউয়ের পাছায় চাপড় দেয়, লক্ষ্মী গুড়িয়া আমার...! 

রাত এক প্রস্থ পার হলে পাড়ার যুবকরা বাড়ি ফিরে। লম্বা স্বরে হাঁকে, চাচা ভালো তো? মহুবরকে সঙ্গে সঙ্গে আদপ কায়দায় মাথা নাড়াতে হয়, শ্বাস টেনে সজোরে জবাব দিতে হয়, আলহামদুলিল্লাহ্! থাকতেই হবে, ভালো তো ওকে থাকতেই হবে। নইলে দু’দিন বাদেই সবাই বলাবলি শুরু করবে, লোকটা আসলে রোগারোগা তাই না? আসলে ওকে দিয়ে...! এর চেয়ে নির্মম কোনো প্রহসন বা শাঁখের করাত তার জীবনে আছে বলে সে স্মরণ করতে পারে না। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গা ছেড়ে দিয়ে রাত বাড়ে। মহুবর সত্যিই ঘুমে কাতর হয়। নওম। মনে হয় মাথার ওপর আকাশটা নেমে এসে মুড়িয়ে ফেলছে তার মাথা, দু’চোখের পাতা ঠেসে ধরতে চাইছে। একটুও তাকানো, নড়াচড়া বা শব্দ করতে দিবে না। তলিয়ে দিবে ঘুমের এক গভীর সুড়ঙ্গে যেখান থেকে বেরোনোর পথ কিছুতেই পাবে না। কিন্তু নাহ্, মহুবর এক ঝাটকায় নিজেকে মুক্ত করে। গলির মোড়ে টেলিফোনের খুঁটিতে ঠেস দেয়া ভাঙা চেয়ার। মহুবর বসে খানিক দম নেয় আর গামছা দিয়ে একটু পরপর মশা তাড়াতে থাকে। দলে দলে মশারা তার উপর হামলে পড়ে বি ফিফটি টু বোমারু বিমানের মতো। শাঁ শাঁ শাঁ। যেখানে টার্গেট সেখানে জ্বালিয়ে দিবে সব, কিয়ামত নামাবে চোখের পলকে। সায়গন কি কান্দাহার, বাগদাদ কি ত্রিপোলি! এরপর আগুনে জিহ্বার মুখটা ঘুরে যাবে আরও অন্যসব টার্গেটে। সেখানেও খুলে দিবে নরকের দরোজা। আবার, আরও, আরও, যেখানে খুশি। যতবার। 

প্রথম প্রথম হাত-পা ছুড়াছুড়ি চললেও শেষে মহুবর মশাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করে আর খিস্তি ঝাড়ে—হারামখোরের দল, বুড়ো হাড়মাস পুঁজ কাহাতক খাবি, চেটে চেটে খা! 

কোনো কোনো দিন চেয়ারটাও থাকে না। অথবা এমনো হতে পারে চেয়ারটা কেউ কৌশলে সরিয়েছে সন্ধের আগেই। তখন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় টেলিফোনের খুঁটি ধরে। সারারাত হাঁটে আর দাঁড়িয়ে থাকে। ‘ওকে তো আমরা ঘুমানোর জন্যে মাস মাস মাইনে দিই না, কি বলেন বেলায়েত সাহেব?’ কোনোদিন হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো তো ভয়ানক বিপদ নেমে এলো। কোনো বাসার গেইটে শরীরটা সেটিয়ে দিয়ে টানটান দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ভোরে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরলে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে।  

চেয়ারে বসে বুড়ো মহুবর বামহাতের চাটি দিয়ে দাঁড়িওয়ালা থুতনিটা বারবার ঘঁষছে। আর বিষণ্ন মনে এমন একটি মড়কের জন্য অপেক্ষা করছে যা ক্লান্তিকর রাতগুলোর অবসান ঘটিয়ে দিতে পারে। এমনকি অবসান ঘটিয়ে দিতে পারে এই আপদময় পৃথিবীর। উপচে পড়া মানুষের পদচারণা। অগুনতি কর্মব্যস্ততা, মল্লযুদ্ধের হিংস্রতা, স্বার্থপরতা। চারপাশের দুনিয়ায় পাপপঙ্কিল, লোভাতুর, নির্দয় গিজগিজ করা মানুষ কৌশলে রাত বা অনেককিছু বা জীবনটাই তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে!

রাত গভীরে পথটা প্রায় জনশূন্য। বহুতল দালানগুলো বাইরে খানিকটা আলোকিত হলেও ভেতরটা অন্ধকার, নিদ্রামগ্ন। আশপাশে এখন তেমন কাউকেই আর পাওয়া যায় না যাদের দেখে অন্তত তার বুড়ো চোখদুটো নড়ানড়ি করতে পারে। বুড়ো অবাক হয়ে ভাবে, এত শোরগোল কোথায় হারিয়ে গেল? এ শহরে কি সবাই তার মতো কড়িকাঠ হয়ে গেল? সঙ্গীহীন মহুবর হতাশায় টলতে থাকে। কিন্তু দেখতে দেখতেই চারপাঁচটা নেড়িকুত্তা এসে হাজির। ওরা লেজে মুখ ঢুকিয়ে বুড়োর পা বরাবর মাঝরাস্তায় বসে থাকে। আর একটু পর পর গা ঝাড়া দিয়ে ওরাও মশা বা আপদ তাড়ায়। একসময় বুড়ো ওদের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে আর তার মনে হয় কোনো মানুষই আর এ শহরে অবশিষ্ট নেই শুধু কুকুরগুলো ছাড়া। তার অন্তহীন নিঃসঙ্গ রাতের প্রকৃত সঙ্গী এই কুকুরগুলো ছাড়া কে? কতকাল ধরে সে শঙ্কাময় রাতকে তাড়া করছে এদের নিয়ে। 

কুকুর হওয়াই ভালো। নিঃস্বার্থ পুতপবিত্র আমার কুকুরেরা। আমার আদরের সন্তানেরা। আমার বন্ধুরা। এ দুনিয়াতে ওরা ছাড়া আর কে আমাকে এমন সম্মান বা দয়া দেখায়, কে বিনে পাওনায় সঙ্গ দেয় রাতের পর রাত আর অভিশপ্ত নির্ঘুম রাতগুলোতে ঘিরে থাকে মহান প্রেমিকার মতো। ওরা আছে বলেই কিনা ছিঁচকে চোরদের সামনে আমার বুড়োহাঁড়ের তাগদটা বেড়ে যায়। 

বুড়ো কুকুর মহুবর আলী একটু পর পর বাঁশি ফুঁকোয়। নেড়ি কুত্তারা দৌঁড়ে গলির এ মাথা থেকে ও মাথা টহল দিয়ে আসে। কুকরগুলোর কাছে এ বুড়োটা বড্ড আপন। এমন সম্মান তাদের কে দেয়? শুধু ঘৃণা আর তাড়া—ছেই ছেই। কিছু কর আর নাই কর—পথের কিনারা ঘেঁষে হেঁটে গেলেও ওটাই জুটে। বুড়োটাই একমাত্র সত্যিকারের বন্ধু। এভাবে কুকুরময় রাত বাড়ে আর পেটটা চো চো শুরু করলে ওরা চোখ বুজে নিঃশব্দে পড়ে থাকে।  

মহুবর জানে চোরবদমাশ বা ঘুমকেও রাতভর ফেরারির মতো তাড়া খেয়ে ছুটতে হয়। এ এমন এক আরাধ্য শিকার যাকে কখনো ছোঁয়া যায় না অথচ যাকে ফেরি করতে হয়। সবাই মিলে চমৎকার এক পাতানো রাতের মালিক তারা। বুড়ো তাই ঘুম আর বিশ্বস্ত বন্ধুদের সঙ্গে, মার্কিন বোমারু বিমানের সঙ্গে, সম্ভাব্য নিশিচোরদের সঙ্গে, আরাধ্য শিকারের সঙ্গে, সম্ভাব্য সকল আপদের সঙ্গে ব্যাটবল খেলে খেলে রাতটা পার করে। ঘুমকাতুরে তারারা যেমন ঝাড়বাতির মতো ঝুলে থাকে, জেগে জেগে খোদার আকাশটাকে পাহারা দেয়, তেমনি। এসব করতে করতে রাতের আকাশ বা বুড়ো মহুবর নিজেও অজান্তে খানিকটা স্মৃতিকাতর বা ঘুমকাতরতায় নেতিয়ে পড়ে। বুড়ো নিজে, বন্ধু নেড়িকুত্তার দল, ফেরারি, নিশিচোর আর ঝাড়বাতি বা জোনাকি পোকার মতো তারাদের দল—সবাই মিলে খোদার রাতটা বেচে দিয়েছে।  

মাঝরাত পার হলে কুয়াশার প্রলেপ শহরটাকে অবশ অদৃশ্য করে ফেলে। মনে হয় আর কখনো দৃশ্যমান হবে না এই শহরের যাবতীয় কোলাহল, লাটিমের মতো বন বন করে পাঁক খাওয়া জীবন। নিষ্পলক আকাশে তাকিয়ে থাকে মহুবর। রাত শেষের তারারা ঝিমিয়ে গেছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের চাঁইগুলো থমকে দাঁড়িয়ে যে যার মতো—অবিন্যস্ত ও উদ্দেশ্যহীন। আকাশ ও পৃথিবী কোনকিছুকেই আর মহুবর আলাদা করতে পারে না। এমনকি সে নিজেও ওই থমকে যাওয়া আকাশে কালো বিন্দুর মতো আটকে থাকে। এমনি করে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে পোয়াতি রাত্রির জঠর থেকে নবজাতক উঁকি দেয়। 

‘খোদার দুনিয়া দেখভালের দায় এখন তোমার হাতে’—অঙ্কুরিত সূর্যের দিকে মাথা হেলে বুড়ো বিদায় অভিভাষণ পাঠ করে। যদিও জানে, ফের আসন্ন রাতের ঘানি টানার জন্য নিজেকে বেশ্যার মতো সাজিয়ে নিতে হবে।


মিজানুর রহমান নাসিম কথাসাহিত্যিক এবং সম্পাদক

menu
menu