বদর বদর

তিনি বিমল চন্দ্র। তিনি একা থাকেন। তাঁর যে বাড়ি ছিল বোড়ালে, যে অংশ তাঁর ছিল, তা ধ্বংসস্তূপ। প্রমোটার নিয়েছে। নিয়েছে বছর তিন। কিন্তু কিছুই করছে না। পড়ে আছে। তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মা বাবা মরে গেছে। তাঁর দুই ভাই ছিল, একজন বড় কমল, অন্যজন ছোট অমল। তারাও নেই। দিদি ছিল অন্নপূর্ণা, সেও নেই। তিনি ফোনে বন্ধুকে বললেন, না, কেউ নেই, সব মরে ঝরে গেছে, সব পাতা খসে গিয়ে একটি হলুদ হয়েও খসেনি। 
বন্ধু বিকাশ বলল, বিমল তাহলে তুমি থাক কোথায় বাড়ি যদি না থাকে, বাসস্থান কোথায়?
তুমি চিনবে না বিকাশ, একজন আমাকে থাকতে দিয়েছেন তাঁর লাইব্রেরির ভিতরে।
কে তিনি? বিকাশ জিজ্ঞেস করল। 
তুমি চেন না, তিনি নেই, তাঁর ছেলেমেয়েদের একজন থাকে ইতালিতে, আর একজন গড়িয়াহাটে, তারা তাদের বাবা মারা যাওয়ার পর আমাকে তুলে দেয়নি, ভালোবেসে রেখে দিয়েছে, আচ্ছা বিকাশ বলো দেখি অচিন সরখেল বলে একজন লেখে, সে কি অতীন সরখেলের ছেলে, অতীনকে তোমার মনে আছে তো, কবিতা লিখত, হঠাৎ করে মরে গেল ঘুমের ভিতর। 
বিকাশ জানে না। বিকাশ লেখে না। পড়ে। লেখকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক একটা আছে। অনেককেই চেনে। এখন ফেসবুক হতে অনেকের সঙ্গেই তার যোগাযোগ হয়েছে। অল্প বয়সে বিকাশ একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেছিল। তারপর আর কিছু করেনি। কিন্তু লেখকরা তাকে চেনেন। বইমেলা, নানা সেমিনারে সে উপস্থিত থাকে। একজন প্রবীণ পড়ুয়া হিসেবে তার নাম আছে। বিকাশ বলে, সকলে লিখলে, পড়বে কে? তার সংগ্রহে অনেক বই। সযত্নে তিনি তাঁর দু’হাজার বর্গফুট ফ্ল্যাটে বইকে জায়গা দিয়েছেন। 
বিমল কবিতা লেখে। সেই পঞ্চাশ বছর ধরে লিখছে প্রায়। কবিতার সূত্রেই বিমলের সঙ্গে পরিচয় বিকাশের। বিকাশ বলল, তুমি ফোন নং পেলে কোথা থেকে?
পেয়েছি বিকাশ, আমার ডায়েরিতে তোমার এই নম্বর আমি কবে লিখে রেখেছিলাম মনে নেই, কিন্তু দেখলাম আছে, মনে হয় বইমেলায় তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। 
হতে পারে। বিকাশ বলল, তাই হবে বিমল, তুমি তাহলে কোথায় থাকো বললে।
বললাম তো তাঁদের লাইব্রেরিতে, পুরো ফ্ল্যাট বইয়ে ভরা, আমি বইয়ের ভিতর থাকি বিকাশ।  
বিকাশ জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কোন জায়গায় বলো দেখি।
বৈষ্ণবঘাটা বাই লেন, তোমার অবিনাশের কথা মনে আছে বিকাশ?
কোন অবিনাশ? মনে পড়েনি বিকাশের। 
সেই যে বক্সিগঞ্জের হাট ও অন্যান্য গল্প। বিমল বলল। 
বিকাশ বলল, আহা, তাই তো, বইটা দারুণ ছিল।
বিমল বলল, বক্সিগঞ্জ মানে ওদের গ্রাম নিশ্চিন্তা, মেদিনীপুরের ঘাটালের কাছে, ও যা লিখেছিল সব নিশ্চিন্তার কথা। 
তুমি নিশ্চিন্তা চেন ? বিকাশ জিজ্ঞেস করল।  
অবিনাশ নিয়ে গিয়েছিল বিকাশ, ওরা চাষী পরিবার, চাষবাস খুব ভালো জানত তারপরের বছর মারা গেল বেঘোরে রেললাইন পার হতে গিয়ে, দ্যাখো বিকাশ ওর নিশ্চিন্তায় রেললাইন নেই, এই বৈষ্ণবঘাটায় রেললাইন নেই, মারা গেল বারুইপুরে গল্প পড়তে গিয়ে, আমি উপস্থিত, এখনো মনে পড়ে।
বিকাশ চুপ করে থাকল। অবিনাশ ঘটকের কথা মনে পড়ছিল তার। কী সুন্দর চেহারা তাঁর। মরে গেলেন একটি বই লিখে। সেই বই রিপ্রিন্ট হয়েছে পঁচিশ  বাদে। ফেসবুকে তা দেখেছেন বিকাশ। কথাটা বলতে বিমল হা হা করে উঠল,  সে জানে না খবরটা, যে পাঁচ-সাত হাজার বইয়ের ভিতর সে বাস করে, তার ভিতরে অবিনাশের বইটি নেই। কত বই নেই। কত বই আছে। বিমল বলল, অবিনাশ থাকত রবিন সামন্তর বাড়ি, রবিনদা নেই, অবিনাশ নেই, অবিনাশের বউ গড়িয়ায় ফ্ল্যাট কিনেছে, সেখানেই থাকে, দুই মেয়ের একজন থাকে দিল্লি, অন্যজন কাছেই। 
বিমল বলল, বিকাশ তুমি কী বই পড়ছ?
বিকাশ বলতে বিমল বলল, পড়েছি, বইটি ভালো, নতুন লেখক, কিন্তু তারা কেউ অবিনাশের নামই জানে না, এইবার যদি পড়ে তার বক্সিগঞ্জের হাট  গল্পটি, মনে আছে বিকাশ? 
বিকাশের আবছা মনে পড়ে। কুয়াশা কুয়াশা লাগে। সেই যে ধানকাটার পর  গোরুর গাড়ির সার চলেছে বক্সিগঞ্জের হাটের দিকে। সমস্ত রাত ধরে চলেছে তো চলেছে। বস্তা বস্তা ধান। ধান বেচে কেনা হবে তেল নুন। আচ্ছা এই গল্পটি তো বিমল?
বিমল বলল, না, সেই হাট অন্য হাট, সেই গল্প লিখেছিল রাধানাথ, সেও বেঁচে নেই, কেউ বেঁচে থাকল না কেন বিকাশ, আমার দাদা ভাই, মা বাবা, আমার কাকা, জেঠা, মামা মামি, দীপঙ্কর মারা গেল দু’বছর আগে, ভাবতেই পারি না সে থাকবে না, আমাকে খুব ভালোবাসত, তার বাড়ি গিয়ে কতবার কবিতা পাঠ করেছি, সে গল্প শুনিয়েছে, সব ভুলে সে যেতে পারল, এই লাইব্রেরিতে তার বই নেই বিকাশ। 
বিকাশ বসু বলল, অন্য কোথাও আছে নিশ্চয়, আচ্ছা ঐ পাড়ায় সন্দীপ সেন থাকতেন না?
উনি তো নেই। বিমল বিষণ্ণ গলায় বলল। 
ওঁর ছেলে, মেধাবী ছিল খুব?  
সেও নেই, ওদের কেউ নেই। হাহাকার ঝরে পড়ে বিমলের কণ্ঠ থেকে, ছোটদেরও হার্ট অ্যাটাক হয়! 
বিকাশ বলল, ছেলের নাম ছিল সুগত, তার সঙ্গে সঙ্গীতা বর্মণের বিয়ে হয়েছিল।
সে বিয়ে টেকেনি, সঙ্গীতা আছে নাকতলার দিকে কোথায়, কিছু মনে রাখতে পারে না, ও কবিতা লিখত, আমি ওর বই আনতে গিয়েছিলাম, লাইব্রেরিতে রাখব তাই, কিন্তু চিনতেই পারল না, মানুষের কত কষ্ট বলো বিকাশ, এ আর যাবে না।
যাবে, যেতে পারে। বিকাশ বলল। 
কীভাবে যাবে? বিমল জিজ্ঞেস করল।
মিরাক্যেল হবে একটা, আমি আজ তোমার কথা ভাবছিলাম বিমল, ময়লা শার্ট, প্যান্ট, পকেটে কবিতা, তুমি রোববারে আমার বাড়িতেও এসেছ, কবিতা শুনিয়ে গেছ। 
বিমল বলল, আমার কবিতার বই তোমার কাছে আছে? 
না, কতকাল আগের কথা সেসব।  
বিমল বলল, আসলে এই লাইব্রেরিতে নেই, থাকলে থাকত, যাকগে বিকাশ, কেউই যখন নেই, কবিতার বই থেকে কী হবে?
বিকাশের মনে পড়ল আজ যে সিনেমা দেখছিল সে ল্যাপটপে। সিনেমা বন্ধ করে সে কথা বলছে। মস্ত একটা মাঠে ঝুপড়ি তৈরি করছে বহু মানুষ যাদের কোনো আশ্রয় নেই। বিমল কি ছিল তাদের ভিতর? বিমল বিমল, তোমার কিছু সঞ্চয় আছে? 
বিমল বলল, নেই বিকাশ, সঞ্চয় থাকবে কী করে, আমি তো কোনো কাজই করিনি সেই ভাবে, যে কাজে ঢুকতাম, কাজ চলে যেত, আমি যেন অপয়া, কোম্পানি তুলে দেওয়াই আমার কাজ। 
কী করে যেত কাজ, ফাঁকি মারতে? 
বিমল বলল, না, কাজ তো সকলের সঙ্গে করতাম, ফাঁকি মারব কেন, কিন্তু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেল তিন বার, পত্রিকায় ঢুকলাম, ডেইলি নিউজ, চিট ফান্ড, উঠে গেল মালিক পালিয়ে যেতে, আর একটা তুলেই দিল সরকার, অলাভজনক, আমরা চালাতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না, ডুবে গেল সব বিকাশ। 
বিকাশ বলল, তাহলে, মাথায় ছাদ থাকলে তো হয় না, তোমার অন্ন?
তাঁদের বাবা বলে গিয়েছিল কবিকে দেখতে, তাঁদের ব্যবস্থা করা আছে, হোম ডেলিভারি, বিল তাঁরা মেটান, আমি শুধু একটা পাবলিশারের প্রুফ দেখি, বই সংশোধন করে দিই, তাতে কিছু পাই, সাবান টাবান কিনি, বিড়ি কিনি, ফোন রিচার্জ করি, বিকাশ আমার বাড়ির উল্টো দিকে ব্যালকনিতে রবিন সামন্তর স্ত্রী বসে থাকেন, মাথায় সাদা চুল, মেমসায়েব যেন, খুব ফর্সা ছিলেন তো বউদি।
কথা হয় তোমার সঙ্গে? বিকাশের মনে পড়ল রবিন সামন্তর কথা। 
হয়, উনি জিজ্ঞেস করেন সে কোথায়, ও কোথায়, মাথার ঠিক নেই মনে  হয়, অবশ্য এই বয়সে মানুষ সব ভুলতে শুরু করে, তাই তো বিকাশ? 
বিকাশ বলল, সকলে ভোলে না, কেউ কেউ ভোলে।
আমার সব মনে আছে বিকাশ, বোড়ালে পথের পাঁচালীর শ্যুটিং হয়েছিল, তখন আমার চার বছর বয়স, ইস যদি একটু বেশি হতো, আমিই হয়তো অপু হতে পারতাম।
এইসব ভাব নাকি? বিকাশ হাসল, তারপর বলল, মিরাক্যেল হয় তো জীবনে, হয়তো হতো।
আমারও তাই মনে হয়, আমার দুনিয়ায় শুধু খারাপ ঘটনাই ঘটবে, ভালো কিছু ঘটবে না, আমি আর দিদি ছুটছি ট্রেনের ধোঁয়া দেখতে, দিদি মরে গেছে বছর পাঁচ।
বিকাশ বলল, বিমল এত মৃত্যুর কথা ভেব না, তোমার তো খারাপ কিছু হয়নি বিমল, এত বই পেয়েছ।
বিমল বলে, তা ঠিক, কিন্তু কত বই পাইনি, আমি, মনে হচ্ছে লাইব্রেরিটাকে আপডেট করে যাই, যা নেই, তা ভরে দিয়ে যাই।
বিকাশ বলল, কত বই বেরোয় প্রতিদিন সারা পৃথিবীতে, সব বইয়ের জন্য কি জায়গা দিতে পারবে?
পারব না, কিন্তু মনে হয় তো। বিমল বলল, এমন একটা লাইব্রেরি হোক, সেখানে সব বই থাকবে, মৃত লেখকরা বেঁচে থাকে লাইব্রেরিতে, স্মৃতি সঞ্চয় হয় বইয়ে।  
বিকাশ বসুর বয়স এখন সত্তর। চোখ পরিষ্কার, রোগবালাই বিশেষ নেই। বিকাশ সকাল থেকে পড়ে। বিকেলে ল্যাপটপে সিনেমা দেখে। সিনেমাই দেখছিল বিকাশ। ইতালির পরিচালক ভিত্তোরিও ডি’সিকার মিরাক্যেল ইন মিলান সিনেমা। আগে দেখেছে, আবার দেখছে মিলান শহরের ঘটে যাওয়া এক অলৌকিক ঘটনার চিত্ররূপ। গরিব মানুষ একটা জনপদ গড়ে তুলছিল পতিত জমিতে। নিরাশ্রয় মানুষ কাঠ-কুটো, পলিথিন, প্লাস্টিক, পাইপ এইসব দিয়ে ঝুপড়ি বানাচ্ছিল। সেই সব মানুষের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বিমল কী ফোন করেছে? বিমল কি সেখানে একটি লাইব্রেরি বানাচ্ছিল। সেই শীতের দেশ, এক ফোঁটা সূর্যের আলোর জন্য কী আকুতি! যেখানে সূর্যের আলো পড়ছে, মানুষ ছুটে যাচ্ছে। এতদিন বাদে বিমল সেখান থেকেই বুঝি ফোন করেছে, অমুকের বইটি কি আছে বিকাশ তোমার কাছে, আমার লাইব্রেরিতে রাখব। স্পষ্ট তাঁর মনে হচ্ছে সেই অনেক লোকের ভিতরে বিমল ছিল। সিনেমা বন্ধ করেই সে বিমলের সঙ্গে কথা বলেছে। একবার বন্ধ করে আর খুলবে না। আগামীকাল আবার দেখবে। 
বিমল বিমল, তুমি একা থাক, ভয় করে না?
বিমল হা হা করে হাসে, এত বই, বইয়ের ভিতর এত লোকজন, ভয় করবে কেন, আমি অনেক রাত জাগি, ঘুমুতে রাত দুটো হয়ে যায়।
এত রাত অবধি কী করো তুমি? বিমলকে জিজ্ঞেস করে বিকাশ।  
বিমল বলল, ভাবি, কতজন চলে গেছে, কত জনকে দেখিনি অনেক বছর ধরে, চিঠি লিখি বিকাশ, আমার পুরোন ডায়েরি থেকে ঠিকানা বের করে নানা জনকে চিঠি লিখি, সেদিন লিখেছিলাম অজয়কে, অজয় গল্প লিখত, প্রবন্ধ লিখত  ভারি ভারি সব বিষয়, মনে আছে বিকাশ? 
বিকাশ বলল, হুঁ, লেখা আর দেখি না। 
পোস্ট কার্ডের নিচে আমি মোবাইল নং দিয়ে দি, সেদিন ফোন এলো, তিন বছর মারা গেছে অজয়, তার আগে পাঁচ বছর প্যারালাইজড ছিল, কিছুই জানতাম না, সবাই মরে গেল বিকাশ, শুধু আমি।
বিকাশ বলল, বেঁচে আছে অনেক বেশি।   
সে আছে, কিন্তু আমার প্রায় সবাই মরে গেছে, সেদিন বোড়ালে নিজের ফেলে আসা বাড়ি দেখতে গেলাম, জঙ্গলে ভরে আছে, প্রোমোটার বলছে প্ল্যান পাস হলেই আরম্ভ করবে, আমার আর ইন্টারেস্ট নেই বিকাশ, ফ্ল্যাট বাড়ি হলো না হয়, কিন্তু ফাঁকা ঘরে আমি করব কী, দেওয়ালে মাথা ঠুকব?
বিকাশ চুপ করে আছে। বিমল বলছে, ধুস, ও জমি নিয়ে যা করে করুক।
বিমল তোমরা কি বোড়ালের আদি বাসিন্দা?
না, বাবা ১৯৫০-এ একটা পুরানো বাড়ি কিনেছিল বরিশাল থেকে এসে,   তারপরই তো পথের পাঁচালীর শুটিং আরম্ভ হয়, হরিহরের বাড়ি, সেই মুখুজ্জ্যেদের ভাঙা  বাড়ি আছে এখনো, রুইন্স, আমাদেরটাও তাই, সব ক্রমে ধুলো হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীও একদিন ধুলো হয়ে যাবে বিকাশ।  
বিকাশ বসু বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না।    
বিমল বলল, বরিশালে আমাদের গ্রাম কীর্তনখোলার ধারে ছিল বলে, জীবনানন্দের শহরে নয়, অনেক দূর, গ্রামের নাম তেঁতুলিয়া, মা বলত, আমি দেখিনি, পরে শুনেছি সেই গ্রাম আর নেই, নদী গর্ভে গেছে, ভালোই হয়েছে। আমি মাথার কাছে বরিশাল বাখরগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে ঘুমোই, বই থেকে জলের স্রোতধ্বনি শোনা যায়। 
বুকটা ধক করে উঠল বিকাশ বসুর। বিমল বলছে, এ যদি বরিশাল হতো, কিংবা পদ্মাপার হতো, আমাদের বাবার কেনা সেই বাড়ি, জমি নদী গর্ভে যেত, মানুষগুলোকে খেয়েছে নদী তো বাড়ি কী হবে, চাই না। 
বিকাশ বসু জানে, বোড়ালে আদিতে গঙ্গা বয়ে যেত। তার চিহ্ন আছে। গঙ্গা ভাগিরথীর একটি শাখা খিদিরপুর হয়ে এই পথে বোড়াল ছুঁয়ে বারুইপুর দিয়ে কাকদ্বীপের কাছে মুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশেছিল, তারপর সাগরে, সেই প্রবাহ নেই, কিন্তু ছিল। এই পথে বণিকের দল বাণিজ্যে যেত। চাঁদ সদাগর গিয়েছিল একদিন। নদী আর নেই। থাকলে নদী তার বাড়িটাকে খেয়ে নিত। 
বিকাশ ডাকল, বিমল শুনতে পাচ্ছ?  
হ্যাঁ বিকাশ, সব আমার কথা শুনলে, তোমার কথা? বিমল জিজ্ঞেস করল।  
বিকাশ বসু চুপ করে থাকল। সত্তর হয়েছে। তার সঞ্চয় কম না। সব ঘরের দেওয়াল জুড়ে বই। “ভাই বিমল তুমি ক’দিন এসে থাকো, আমি কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতন যাই, তারপর করোনা চলে গেলে ইতালি যাব, মিলান শহরে, আমার পুত্র সেখানে থাকে, স্ত্রী নেই। বিমল আসবে?” বলতে গিয়ে তিনি চুপ করে থাকলেন। বিমলকে একদিন এই ভাবে ডেকে এনে তিনি উধাও হয়ে যাবেন। তিনি তো বিমলের কাছেই গচ্ছিত রেখেছেন সব বই, সে বুক আগলে রক্ষা করছে সব। এমন তো হতে পারে। হয়েছে হয়তো। এই সব কথাবার্তার সময়, অসময়ের ঠিক নেই। আগের কথা পরে, পরের কথা আগে। একজনের কথা অন্যজনের মুখে। লেখকরা যা করে থাকেন। বিকাশের কথা থেমে আছে। 
বিমল চাপা গলায় বলছে, আমি কিন্তু এক একদিন স্বপ্ন দেখি, বাড়িটা তলিয়ে গেল জলে, আমি দাঁড়িয়ে আছি পাড়ে। 
কোন বাড়ি, আমার বাড়ি, হাজার বিশ বই ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে। বিকাশ আর্তনাদ করে উঠলেন, বই সমেত তলিয়ে গেল!   
বিমল বলল, না গো না, আমাদের সেই ফেলে আসা ধুলো হয়ে যাওয়া বাড়ির কথা বলছি, সেই বাড়িতে কিছুই ছিল না, প্রমোটার সব ফাঁকা করে ফেলে রেখেছিল, বই সব এখানে, আমি নিয়ে এসেছিলাম বিকাশ, তোমার বইয়ের ভিতর আমার বই মিশে গেছে।
আহারে এত বই, রেকর্ড তাঁর সংগ্রহে, অবর্তমানে যাবে কোথায়? বিকাশ ভাবছিলেন। তাঁর চোখে জল এলো। তখন বিমল বলছে, আরে, চিন্তা করো না, আমি থাকতে তোমার একটা বইও জলে যাবে না, তবে যে পড়তে চায়, তাকে দেব, পড়ুয়ারা কেউ মরে না, মরে আবার জন্ম নেয়... বই খুঁজে খুঁজে বেড়ায়, আমি হাঁক দেব, এই দ্যাখো কত বই, খুঁজে নাও গো খুঁজে নাও, আমার নাও বইয়ের নাও, বই নিয়ে দেশ দেশান্তরে ঘোরে বিকাশ, স্বপ্ন দেখেছি বিকাশ, স্বপ্ন, আমার স্বপ্নে সমুদ্রযাত্রা। 
তারপর? বিকাশ জিজ্ঞেস করল। কানে এলো শাঁ শাঁ বাতাসের শব্দ। জলের শব্দ। মাঝি হাঁকছে, বদর বদর। বই নিয়ে বাণিজ্যে যাবেন বিমল চন্দ্র, কবি। তাঁর কোনো কবিতার বই পাওয়া যায় না। আপনাদের কাছে আছে কি না দেখে নিন। তাঁর নাওয়ে তুলে দিন।


 অমর মিত্র, কথাসাহিত্যিক, ভারত

menu
menu