অণুগল্প

গ্রিক সুন্দরী

ঘরোয়া এক পার্টিতে গেছি। হাউজ-ওয়ার্মিং পার্টি। পার্টির হোস্ট হচ্ছে মার্গারেট আর এ্যালেন। নতুন বাড়ি কিনেছে ওরা। বাড়ির দোতলায় কাচঘেরা লিভিং-রুমের বাইরে বড়, ছড়ানো ডেক। ডেকটা ঢালু ল্যান্ডস্কেপের ওপরে। ওখান থেকে জর্জেস রিভার দেখা যায়। সিডনি শহরের এতো কাছে গাছগাছালি ঘেরা নদী, অপার্থিব। সন্ধ্বেবেলায় সূর্যের ঘন সোনালি আলো ছোট ছোট টুকরো হয়ে তিরতির করে কাঁপতে থাকে নদীর পানিতে। দেখতে দেখতে মিটিমিটি করা সন্ধেটা গড়িয়ে গেছে তখন। মনকাড়া জায়গায় ওদের বাড়িটা। মার্গারেট আর এ্যালেন এই বাড়িতে আসবার আগে আমাদের প্রতিবেশী ছিল।  

আজকের পার্টিতে আসা গেস্টদের সংখ্যা পঁচিশ-তিরিশ জনের মতো হবে হয়তো। গেস্টরা অলমোস্ট সকলেই আমাদের অপরিচিত। আমাদের মানে, আমার আর সোহানার। লিভিং-রুমে ঢুকেই, ডেকের এককোণে, কাঠের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো দু’টি মেয়ের ওপর চোখ লেগে গেল। দু’জনে হাতে চিকন শ্যাম্পেনের গ্লাস। গ্লাসের বাইরের দিকটা পানীয়ের শীতলতার কারণে ভিজে আছে। অনুভব করতে পারি শীতলতার ভেজা, ওদের আঙুলগুলোকে স্পর্শ করে আছে। পরিমিত সবকিছু দু’জনেরই; ওদের বয়স, বক্ষের ভার, পায়ের গোছের ভাঁজ, নিতম্বের গড়ন। বাইরে তখন আলো কমে গেছে, তারপরেও বেগুনি রঙের ফুলে ভরা বড় একটা জাকারেন্ডা গাছ ওদের মাথার ওপর ঝুঁকে আছে, দেখা যায়। মেয়ে দু’টির সঙ্গে মার্গারেট পরিচয় করিয়ে দিল, একজন এ্যালেনের কলিগ, অপরজন ওই কলিগের বান্ধবী। বান্ধবীটিকে খুব মনে ধরেছে আমার। সোনালি চুল, সবুজ চোখ। গালের ওপর ঝুলে থাকা একগোছা চুল, কিছুক্ষণ পরপর কানের পেছনে গুজে দিচ্ছে, মোহনীয়। 

আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘মেয়েটা দেখতে দারুণ। পৌরাণিক কাহিনির গ্রিক সুন্দরীদের মতো।’ আমার স্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন। 
পার্টির সমস্ত সময় জুড়ে, যতটা সম্ভব মেয়েটির সঙ্গেই গল্পে মেতে ছিলাম। মার্গারেট দু’বার এসে আমাকে কুশল জিজ্ঞেস করে গেছে, ‘ইজ এ্যাভরিথিং অলরাইট?’

এক পর্যায়ে আমার স্ত্রী এসে বললেন, ‘বাড়ি যাবে না?’ অকারণে তখনো তিনি মিটিমিটি করে হাসছেন।

আমি মেয়েটিকে ‘উই স্যুড টক মাইকেলেঞ্জেলো সাম ডে।’ বলে বিদায় নিয়েছি।

বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে আমার স্ত্রী অনবরত মিটিমিটি হাসছেন। অকারণে। 

আমি জানতে চাইলাম, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’

আমার স্ত্রী হাসেন, ‘তুমি কী বুঝেছ, ওই মেয়ে দু’টো কাঁপল?’ 

আমি তো পুরোই ধরা। আমার বাম হাতের ওপর, আমার স্ত্রী তার ডান হাতটা রাখলেন। আস্তে আস্তে ট্যাপ করতে করতে বললেন, ‘দ্যাটস্ ওকে, কাভি কাভি হোতা হ্যায়।’ সোহানা তখনো মিটিমিটি হাসছে।
 

চূড়ামনকাটি বাজার 

দুপুরবেলা। বাজারে একটি চায়ের দোকানে বসে শফিক আর আমি চা খাচ্ছি। যশোর শহর থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এই চূড়ামনকাটি বাজার। মলিন একটা বাজার। চূড়ামনকাটি গ্রামের বসতি অঙ্ক ৫৫৮৯ জন। যশোরের দড়াটানা থেকে চূড়ামনকাটি বাজার পৌঁছাতে পিয়াজু গাড়িতে ভাড়া লাগে তেরো টাকা। 

শফিক, আমার বন্ধু। ও এখন যশোরে থাকে। মাস্টারি করে। কলেজে পড়ায়। মাঠেঘাটের, খালবিল, জলজংলার ছবি তুলব, তাই ওর কাছে গেছি। সকালেই শফিক আমাকে নিয়ে বেরিয়েছে।

অলস দুপুর। অনেকক্ষণ ধরে এদিক-ওদিক ঘুরে, পিপাসা নিয়ে চূড়ামনকাটি বাজারে এসে একটা চায়ের দোকানে বসেছি। দুপুরবেলায় মানুষজন কম। ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি দোকানে এসে চা চাইলেন। পরে শফিকের কাছে জেনেছি, মানুষটি নাম দশরথ গোঁসাই। জুতা-স্যান্ডেল সেলাই-পলিশের দোকান তার। দোকান বলতে একটা মান্দার গাছের নিচে, বেড়া-চাল নেই। চূড়ামনকাটি বাজারেই দশরথ গোঁসাইয়ের আদিনিবাস। 

দোকানি বলল, ‘তোর নিজের গিলাস নিয়ে আই।’ 

অগত্যা দশরথ গোঁসাই চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একটা অনেক ব্যবহার করা, ময়লা কাপ হাতে ফিরে এলেন। দোকানি আর একটা কাপে চা বানিয়ে গোঁসাইর কাপে ঢেলে দিলো।

ব্যাপারটা কী, জানতে চাইলে দোকানি বলল, ‘উরা মুচি, উরা দোকানের গিলাসে খেলে, আর কেউ উদের খাওয়া গিলাসে খাবে না, এমনটাই নিয়ম।’ 

দশরথ গোঁসাই তখনো ওখানে দাঁড়িয়ে। এই কথার পরে মাথা নিচু করে দ্রুত চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে মানুষটার চলে যাওয়া দেখতে থাকি, ততক্ষণ তাকিয়ে থাকি, যতক্ষণ দেখতে পারা যায়। এক সময় একটা দোকানের আড়ালে মানুষটা হারিয়ে যায়। সেই সময়টায়, দুপুরবেলায় বাজারে মানুষজন কম।


সরকার কবিরউদ্দিন, গল্পকার, অস্ট্রেলিয়া

menu
menu