চ্যাপলিনের দুঃখ

অফিসের কাজ সেরে যখন বেরোলাম, তখন রাত সাড়ে নটা। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, সাড়ে নটা মানে গভীর রাত। সারা শহর যেন উষ্ণ চাদরে মুড়ে আছে। সারাটা দিন হৈ হৈ করে কাটানোর পর সন্ধ্য হতে না হতেই ঠান্ডায় সবাই জবুথবু  হয়ে পড়ে। রাস্তাঘাটে লোকজন কমে আসে। প্রায় সকলেই ঘরের দরজা জানলা আটকে টিভি আর গরম কফিতে চুমুক দেয়। পাড়ায় একটা জন্মদিনের নেমন্তন্ন। বুবাইয়ের আজ জন্মদিন। এলাকার বিশেষ পরিচিত সমীরণ চৌধুরীর নাতি। বুবাইয়ের বাবা অয়ন আমার বন্ধু। যদিও দেরি হওয়ার একটা আভাস অয়নকে দিয়েছিলাম। কিন্তু এত রাত হবে নিজেই বুঝতে পারিনি। সেখানে পৌঁছতে এখনো তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লাগবে।
বুবাই গতকালও বলেছিল, আঙ্কেল তুমি কিন্তু কাল তাড়াতাড়ি আসবে। ওইটুকু ছেলে ইভিনিং শিফটের কী বোঝে। তাই ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিলাম, বুবাই দেখিস তোর আন্টির আর দিদি তাড়াতাড়িই চলে যাবে, আর আমি একটু পরে যাবো।
বেলুন আর আলোয় সাজানো অনুষ্ঠান বাড়ির মুখে উবারের ভাড়া মিটিয়ে অবাক। দেখি কেউ নেই। আসলে শীতের রাত, তার ওপর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। কারো থাকার কথাও নয়। শুধু ছোটদের সন্ধে থেকে মাতিয়ে রাখা এক চার্লি চ্যাপলিন দাঁড়িয়ে আছে প্রবেশমুখে। যদিও সে কোন অভিনেতা নয়। আঠারো কুড়ি বছরের এক ছেলেকে তিনশো সাড়ে তিনশো টাকার বিনিময়ে এই ধরনের কোন আসরে পার্টি ক্লাউন হিসেবে ভাড়া করে আনা হয়। নিজেদের পয়সা খরচ করে এইরকম বিভিন্ন চরিত্র সেজে বিকেল থেকে অনুষ্ঠান বাড়ির গেটের সামনে এরা দাঁড়িয়ে থাকে। সাধারণত ছোটদের জন্মদিন, মুখেভাত কিংবা কোন আনন্দ অনুষ্ঠানেই বেশিরভাগ সময় এদের উপস্থিতি চোখে পড়ারমতো। ছোটদের সঙ্গে হাসি মুখে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আর ছোটরাও ভীষণ মজা পায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এদের সময় কাটে। একটু বসার ফুরসত নেই। ছোটদের বিনোদনের মাধ্যমে কিছু উপার্জনের আশায় এদের এই পেশায় আসা।
আমায় দেখে চ্যাপলিনবেশি ছেলেটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আস্তে আস্তে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, আচ্ছা অনেক রাত হলো। ছোটরা কি আর আসবে? 
আমি ওর হাতটা ধরে বললাম, না ভাই, আমি তো বলতে পারব না। যাদের বাড়ির অনুষ্ঠান, তারাই বলতে পারবে। আমি ভেতরে গিয়ে জানতে পারি। তা এত রাত হলো, সন্ধ্যেবেলা কিছু জলখাবার খেয়েছ?
… না স্যার। সেই বিকেল তিনটেয় ভাত খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। এখনো অবধি পেটে কিছু পড়েনি।
… সেকি! এরা কিছুই খেতে দেয়নি?
… আমাকে সাড়ে তিনশো টাকায় আনা হয়েছে ছ' ঘণ্টার জন্য। খাওয়ার কোন কথা হয়নি।
কথায় কথায় জানতে পারলাম, ছেলেটা এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে। অভাবের সংসার। পড়াশোনার খরচ জোগাতেই তাকে এইভাবে পার্টি ক্লাউন সাজতে হয়। এই পেশায় ভীষণ কষ্ট। সব অনুষ্ঠান বাড়িতেই টানা ছ সাত ঘণ্টা একটানা সবার মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকতে হয়। কোথাও খাবার পায়। কোথাও দু এক কাপ চা কফি। কোথাও কিছুই জোটে না। 
ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরোতেই বুবাইয়ের দাদু বেরিয়ে এসে বললেন—ওহে ছোকরা, দশটা বেজে গেছে। এবার তুমি তোমার সাজপোশাক ছেড়ে টাকাটা নিয়ে যাও। তারপর তিনি ইশারায় আমাকে বাড়ির ভেতর ডেকে নিলেন। 
অফিসের জামাকাপড়ে কিছু খাওয়ার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। বুবাইয়ের সঙ্গে দেখা করেই ফিরে যাচ্ছি, এমন সময় আমার হাতে খাবারের একটা পার্সেল ধরিয়ে অয়ন বলল, বাড়ি গিয়ে হাত পা ধুয়ে খাবারগুলো খেয়ে নিস। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওর পীড়াপীড়িতে পার্সেলটা নিতে বাধ্য হলাম।
বাড়ির বাইরে পা রাখতেই ঝুপ অন্ধকারে শীতটা কামড়ে ধরল। উইনচিটারের চেনটা গলা অবধি টেনে নিলাম। কুয়াশাও পড়তে শুরু করেছে। আশপাশের বাড়িগুলোর দরজা জানলার মতোই প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ। একেবারে ফাঁকা বড় রাস্তায় শুধু দু একটা দোকান খোলা। হঠাৎ একটা পানের ছোট্ট দোকানে চোখ পড়ল। এগিয়ে গেলাম দোকানের সামনে। অল্প আলোয় রঙমাখা এক মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, এই ছেলেটাই চ্যাপলিন সেজে দাঁড়িয়েছিল। একটা পাঁচ টাকার বিস্কুটের খোলা প্যাকেট তার হাতে। সেই কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। অনুষ্ঠান বাড়িতে এত কিছু খাবারের আয়োজন কিন্তু ওর ভাগ্যে এক কাপ চা পর্যন্ত জোটেনি, খিদে তো পাবেই।
… আরে, তোমাকেই আমি খুঁজছিলাম। তোমার জন্য খাবারের এই পার্সেলটা ওরা পাঠিয়েছে। 
ছেলেটার ইতস্তত ভাব কাটিয়ে বললাম, নাও, ধরো। এত কুণ্ঠিত হবার কিছু নেই।
… সত্যি ওরা আমার জন্য খাবার পাঠিয়েছে?
… এত প্রশ্ন করো না। অনেক রাত হয়েছে। সোজা বাড়ি চলে যাও।
তারপর হঠাৎ ছেলেটা আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল—কাকু,  অনেকদিন পর আজ মা বাবার সঙ্গে ভালো ভালো খাবার খাবো।
ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ছেলেটার চোখ ভর্তি জল। তার খেয়ালই নেই, জন্মদিনের বাড়ি থেকে পাওয়া নীল বেলুনটা কখন তার হাত ফসকে উড়ে গেছে।


সমাজ বসু, কথাসাহিত্যিক, ভারত

menu
menu