জ্যোতিঃপ্রভা

শীতের সকালে জানালা-দরজা সাধারণত খোলা হয় না। খুলতে দেয় না বিপ্লব। আর শীতের ভয়ে ঘরটাকে গুমোট করে তোলা একদম ভালো লাগে না শতাব্দীর। প্রথম প্রথম মন খারাপের বিষয়টি বলতো না সে। এখনো বলে, তা নয়। তবে এখন খুব একটা পাত্তা দেয় না স্বামীর নিষেধাজ্ঞা। বদ্ধ ঘরের বাতাসে মিশে থাকা মন-খারাপের বাষ্প উড়িয়ে দেওয়ার জন্য জানালা খুলে শীতল বাতাসের ছোঁয়া নিল ও। নিজের দীনতা থেকে শুদ্ধ হয়ে কঠোর সংকল্পের আসল কথাটা বিপ্লবকে বলার জন্য তার দিকে ফিরে তাকানোমাত্রই বিপ্লবই বলে ফেলল, ‘দেখেছো, শীতে প্রকৃতি কেমন শুকনো হয়ে ওঠে! ব্যালকনিতে কয়েক স্তরের কেমন ধুলো জমেছে, দেখেছো !’ 
এ কথায় প্রতিক্রিয়া হলো না শতাব্দীর। সত্যিই ধুলো জমেছে। তা দেখে ধুলোর দিকেই তাকিয়ে রইল সে।
বিপ্লব আবার বলল, ‘দেখো, গাছের চিরচেনা সবুজ নেই কোথাও। সবুজ পাতারা ঝরে গেছে। কেমন ঠনঠনা হয়ে আছে ওই ঝাঁকড়া মাথার আমগাছটি। ডালপালাগুলো শুকিয়ে গেছে! রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখো, বর্ষায় যেখানে থকথকে কাদা জমতো, সেখানের উপরিভাগ থেকে কেমন শুকনো গুঁড়ো মাটি উড়ছে! আশপাশের সব ঘরবাড়ি কেমন ধুলোয় মলিন হয়ে গেছে, দেখেছো !’
দেখল শতাব্দী। প্রতিবাদ করার কিছু নেই।
স্ত্রীকে চুপ থাকতে দেখে বিপ্লব কিছুটা বিজয়ী ভাবতে লাগল নিজেকে। বিজয়ী কণ্ঠে আবার বলল, ‘এ জন্য শীতের ভোরে ধুলোর ভয়ে জানালা খোলা অপছন্দ আমার। তোমার পছন্দকে অবশ্যই দাম দেব, তবে আমার অপছন্দটাকেও একটু হলেও দাম দিয়ো।’ অনুরোধের সুরেই বলল বিপ্লব।
স্বামীর মধুর ঘোষণায় সুযোগ পেয়ে গেল শতাব্দী। ইচ্ছার ভাঁজ খুলে আসল কথাটা জানানোর উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমার ইচ্ছার দাম দেবে শুনে খুশি হলাম। তাই আমার আসল ইচ্ছার কথা তোমাকে জানাতে চাই এখনই।’ 
―শিওর। বলল বিপ্লব। 
―আমি চাই, সবার ঊর্ধ্বে আমার চাওয়া―নুহা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করবে। 
স্ত্রীর এ কথায় বিপন্ন বোধ করল বিপ্লব। এ চাওয়া তার নিজের চাওয়ার বিপরীত। দুজনের চাওয়ার এই দূরত্ব ঘোচাতে গেলে ফাটাফাটি অবস্থা তৈরি হবে ভেবে শতাব্দীর সামনে থেকে সরে গিয়ে ডাইনিং স্পেসে এসে পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টার থেকে গ্লাসে পানি ভরার কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল বিপ্লব চৌধুরী। শিশুকন্যার সামনে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া বাঁধাতে চাইল না সে। 
পলায়নে উদ্ধত স্বামীর পিছু ছাড়ল না শতাব্দী। ফিল্টারের ট্যাপ বন্ধ করে নিজের কথা আরও জোরালোভাবে তুলে ধরে বলল, ‘ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা বাংলা পড়তে চায় না। তারা ফেলুদা, কাকাবাবু ও চাঁদের পাহাড় পড়ে না―রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের নাম জানে না, সুফিয়া কামালের পল্লিমায়ের সৌরভ-সৌন্দর্য অনুভব করার সুযোগ পাবে না। মাটির সঙ্গে তৈরি হবে না তাদের কোনো সম্পর্ক। কেবল হ্যারিপটার পড়ে, টিভি অন করে হ্যারিপটারের উদ্ভট ছবি নিয়ে বসে থাকে। জসীমউদ্দীনের মটরশুঁটি, শিম আর শিমের সবুজ বাংলা দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবে। জীবনানন্দ দাশের বাংলার রূপ উপভোগ করতে পারবে না। নিজের নাড়িছেঁড়া ধনকে আমি রোবট বানাতে পারি না, নিজের বোধের মধ্যে, চোখের সামনে তাকে অপরিচিত করে তুলতে পারি না। নুহাকে বাংলা মিডিয়ামেই পড়াব আমি।’ 
―তুমি নিজেই তো বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছো ! “মিডিয়াম” শব্দটা কি বাংলা মায়ের স্বর, নাকি ইংরেজদের কাছ থেকে ধার করা?
স্বামীর শব্দাক্রমণে খেই হারিয়ে ফেললেও কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে শতাব্দী জবাব দিল, ‘যুক্তি বুঝি না। যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে তাদের কথাবার্তা আচরণ যেন কেমন হয়ে যায়, অচেনা লাগে, মধুর ভাষায় তারা ডাকে না মাকে, বাবাকে। “মাম্মি”, “ড্যাড্ডি” শুনলে মায়ের তৃষ্ণা মেটে?’ 
―ওহ্! মায়ের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য মেয়ের ক্যারিয়ার নষ্ট করতে চাও? চারপাশে সবাই এখন ইংরেজিতে পড়াশোনা করছে, ও যখন বড় হবে বাংলা বলার জন্য কোনো বন্ধু পাবে না। ইংরেজির স্রোতের অনুকূলে এগোতে না পারলে হীনম্মন্যতায় ভুগবে। কর্পোরেট বাণিজ্য কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি পাবে না। শিশুবয়সে নুহার ভবিষৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সিঁড়িটা গুঁড়িয়ে দিতে চাও? প্রতিযোগিতার এ বিশ্বে টিকে থাকতে পারবে ও? দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে না তোমাকে?
বিপ্লবের এ যুক্তি এই মুহূর্তে ধরাশায়ী না করলেও শতাব্দীর বোধের মধ্যে নাড়া দিয়েছে ভিন্নভাবে। সন্তানের উন্নতি ছাড়া কোনো মা-ই আলাদা কিছু চিন্তা করতে পারেন না। সেই চাওয়ার দড়িতে টান মেরে স্ত্রীকে বিভ্রান্ত করে বেশ তৃপ্তি নিয়ে সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল বিপ্লব। সরে যেতে পারল না। শার্টের একাংশ খামচে ধরে শতাব্দী বলতে লাগল, ‘শোনো, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার চটকদার বাণিজ্যিক মোড়কের হাতছানির পেছনে ছুটলে মেয়ের উন্নতি হবে, ভাবলে কীভাবে? ওর মন ও মেধার উন্নতি লাগবে না? প্রয়াত বিদেশি সাহিত্যিক কাজুও আজুমাও বাংলা শিখে বলেছেন―এত মধুর ভাষা আর নেই। রবীন্দ্রনাথ বাংলাতেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলা পড়লে ক্যারিয়ার হবে না, কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে? বরং আমার হাতে প্রমাণ আছে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়ারা মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও না। তো, দেশে পড়াতে হলে, এর চেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোথায় পাবে? নতুন প্রতিষ্ঠান বানাবে তুমি?’
শতাব্দীকে টলানো যাচ্ছে না দেখে চুপ হয়ে গেল বিপ্লব। নীরব ভাবনায় তার মাথায় উড়ে এল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়―অনেক দিন আগে তিনি বলে রেখে গেছেন, ‘বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী ঢাকায় চলে যাচ্ছে।’ উচ্চ আয়, উচ্চশিক্ষার আশায় কলকাতায় ঘরে ঘরে বাংলা বর্জনের মহড়া চলছে। সে তুলনায় তো বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো। কলকাতায় বাংলা সাহিত্যেরও খোঁজখবর রাখছে না উঠতি প্রজন্ম। সেখানকার বাংলা ভাষাভাষীরা মাতৃভাষার ছায়া থেকে দূরে সরে নিজেদের স্বেচ্ছানির্বাসনে পাঠাচ্ছে, ঘরে ঘরে রাস্তাঘাটে অফিসে আদালতে মানুষের ঠোঁট থেকে মধুর ধ্বনি বাংলা বিতাড়িত হচ্ছে, অনর্গল হিন্দি কিংবা ইংরেজিতে কথা বলছে তারা। তার সঙ্গে ঢাকার ভালো অবস্থানের তুলনা করে, মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর একরোখা সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক হবে? নিজের ভেতর থেকে জেগে ওঠা প্রশ্নের তিরে আক্রান্ত হয়ে নতুন ভাবনার জালে জড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে চুপ করে রইল বিপ্লব।
বিপ্লবকে চুপ থাকতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেও, আনন্দিত হলো না শতাব্দী। অদৃশ্য একটা দ্বন্দ্ব চেপে ধরে রাখল নিজের বোধের জগৎ। এ জেনারেশনের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার জোয়ার দেখে মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় স্বচ্ছ আলোর উদ্ভাস দেখল না, কল্পচোখে অনিশ্চয়তার ধোঁয়াশা ছড়িয়ে গেল আগামী দিনের বাতিঘরে। 


ডোরবেলের শব্দ পেয়ে দরজা খোলার জন্য বাইরের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন শতাব্দী। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তারই সহকর্মী অন্তরা, সঙ্গে ছোট বাচ্চা আর তার স্বামী।
সহকর্মীকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফুঁ খেয়ে উড়ে গেল চাপা দ্বন্দ্বের ধোঁয়া। ঘরের ভেতর ঝড় তৈরি হওয়ার আগেই সহকর্মীর পারিবারিক উপস্থিতি রুপোর কাঠির পরিবর্তে সোনার জীয়নকাঠির স্পর্শের মতো মনের গাঙে মৃত পলি হটিয়ে জোয়ার বয়ে নিয়ে এলো। স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যের যে ঘূর্ণি তৈরি হয়েছিল, তাও উড়ে চলে গেল খিড়কি দিয়ে দূরে। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘দেখো, নুহার বাবা, এসো! দেখো কে এসেছে !’
ভেতরের ঘরে মনমরা হয়ে বসেছিল বিপ্লব। হঠাৎ আতশবাজির মতো আলোর ঝলক টের পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে এসে সে দেখল অন্তরাকে। নিজের পরনে ছিল ঘরোয়া কাপড়, দ্রুত আবার শোবার ঘরে গিয়ে শার্ট গায়ে বেরিয়ে এলো হাসতে হাসতে। হাত মেলাল অন্তরার স্বামীর সঙ্গে। কিছুক্ষণ আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে সংঘাত বেঁধেছিল, একে অপরের সিদ্ধান্তে অটল অনড় থেকেছিল, ঘরের মধ্যে যে উচ্চ আর নিম্নচাপের ঘোলাটে ঘূর্ণি তৈরি হয়েছিল, মুহূর্তে তা দূর হয়ে গেল। কুশল বিনিময়ের পর বিপ্লবের চোখ গেল ছোট্ট শিশুটির দিকে। আদর দিয়ে তাকে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করল, স্কুলে ভর্তি হয়েছো ?
―ইয়েস, সানি ডেলে। নাও ইন গ্রেড ওয়ান।
আরও কিছুক্ষণ কথা হলো দুজনের। অসাধারণ সুন্দর স্পোকেন ইংলিশ। বিপ্লব মুগ্ধ হয়ে গেল শিশুটির কণ্ঠস্বর শুনে। 
আহ্! নেহাকেও যদি সানি ডেলে ভর্তি করানো যেত! ভাবামাত্রই বোধের ঢেউ বার কয়েক কম্পন তুলল বিপ্লবের মনোভুবনে। সেই কম্পন নিয়ে তাকাল সে শতাব্দীর চোখের দিকে। চোখের ভাষায় কথা হলো দুজনের। অনুচ্চারিত শব্দতরঙ্গ শতাব্দীর চেতনে নাড়া দিল উল্টোভাবে―তার মনে হলো ভিনগ্রহের এক শিশু এসে হাজির হয়েছে তাদের বাসায়। অন্তরা আর তার স্বামীকেও অচেনা লাগছে। চেনা মানুষজনকে এমন অচেনা লাগছে কেন? পরিবেশটা এমন ভারী ভারী লাগছে কেন? কানে এমন ঝিঁ ঝিঁ আওয়াজ হচ্ছে কেন? নাকে এমন ঝাঁজ লাগছে কেন? অসংখ্য প্রশ্নবাণ মাথায় ঠুকে নিয়ে সে একবার তাকাল বিপ্লবের দিকে। বিপ্লবের চেহারার মধ্যে উল্লাসের আভা ফুটে উঠেছে। তার চোখ হাসছে, মুখ হাসছে, দেহের ভাষার মধ্যেও হাসির বর্ণালি রং ঝিকমিক করছে। নিজের সমস্ত অভিব্যক্তি দিয়ে ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বিপ্লব তার আনন্দের নীরব বার্তা পাঠিয়ে দিল স্ত্রীর গহিনে। ইন্দ্রিয়শক্তির মাধ্যমে চারপাশ প্রত্যক্ষণের বাইরেও হৃদয় দ্বারা যেন শতাব্দী প্রত্যক্ষ করে নিল বিপ্লবের না-বলা কথার অর্থ; বস্তুজগতের বাইরের আরেক জগতের কণ্ঠস্বর নীরব তরঙ্গের মধ্য দিয়ে হানা দিল মস্তিষ্কে, এই আক্রমণে বিভ্রান্ত হলো না শতাব্দী। তার অটল সিদ্ধান্ত আরো দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেল মস্তিষ্কে―বিপ্লবের ছোড়া নীরব আক্রমণে মর্যাদাবোধের প্ল্যাটফরমের কাঁপুনি থেকে জেগে উঠতে চাইল অপমানবোধ! সে বোধে দুমড়েমুচড়ে গেল না। বরং ইগোর নতুন অহংকার থেকে জেগে ওঠে, দুজনের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্ব বাঁধেনি, খুবই ভালো সম্পর্ক বহমান, এমন একটা আবহ তৈরি করার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিপ্লবের পক্ষ নিয়ে সে বলল, ‘দেখেছ অন্তরার ছেলে অনতু কী সুন্দর ইংরেজি বলে !’ উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে সে গাল টিপে দিল খুদে অতিথির। তারপর আদরের চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে অনতুকে প্রশ্ন করল, ‘মাকে তুমি কী বলে সম্বোধন করো ?’
অনতু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শতাব্দীর মুখের দিকে। ‘সম্বোধন’ শব্দটার অর্থ তার মাথায় ঢোকেনি। তার শূন্য চোখ আর শূন্য ভাবের প্রকাশ দেখে মনে প্রশ্ন জেগে উঠল, ‘ও কি সত্যিই কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী? এমন নির্বোধের মতো তাকিয়ে আছে কেন ?’
বিপ্লব নিজের আসন ছেড়ে অনতুর কাছে এলো। ওকে সহযোগিতা করার জন্য স্ত্রীর উদ্দেশে বলল, ‘ও কি এত কঠিন বাংলা শব্দের অর্থ বুঝেছে? সহজ বাংলায় জিগ্যেস করো।’
জিজ্ঞাসার সুযোগ স্ত্রীকে না দিয়ে, নিজেই প্রশ্ন করল, ‘মাকে কী বলে ডাকো?’
‘কী বলে ডাকো’ বাক্যটির অর্থও বুঝে উঠতে পারল না অনতু। এবারও বোকার মতো তাকিয়ে রইল। 
অনতুর বাবা তখন সহযোগিতার জন্য ছেলেকে কাছে ডেকে জিগ্যেস করল, ‘হাউ ইও অ্যাড্রেস ইওর মাদার ?’
―ইয়া। আই কল হার মম, অ্যান্ড ড্যাড টু ইউ।
জবাব শুনে যেন একটা বিচ্ছুর কামড় খেল শতাব্দী। আর উত্তর দিতে পেরে আচমকা আরোপিত চাপ থেকে মুক্ত হয়ে অনতু বাবার কোল থেকে বেরিয়ে ঢুকে গেল মায়ের কোলে। তারপর মায়ের কান চেপে ধরে মাথাটা নিচের দিকে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘হোয়ার ইজ নুহা, ইউ টোল্ড আবাউট হিম। আই নিড হার অ্যাজ মাই ফ্রেন্ড।’
ওরে বাবা! কী বিচ্ছু রে! এই পিচ্চি বয়সে একটা পিচ্চিকে ফ্রেন্ড বানাতে চায়! তার মাকে ডাকে ‘মম’ বাবাকে ‘ড্যাড’! একদম তেতো শব্দ দুটো কেবল বিচ্ছুর কামড় নয় কানেও ঢেলে দিল বিষ। ওর কথা থেকে তেতো স্বাদ পাওয়ায় নুহাকে ডেকে আনার ইচ্ছাও তার উবে গেল। বাসায় শিশু অতিথির আগমনে বসার ঘরের পাশের দেয়ালের আড়ালে চুপি চুপি এসে দাঁড়িয়েছিল নুহা। অদ্ভুত ভাষায় কথা বলা এই অপরিচিত ছেলেশিশুর মুখে নিজের নাম শুনে ছুটে সে পালিয়ে গেল দেয়ালের আড়াল থেকে। 
ফ্লোরের ওপর দিয়ে নিঃশব্দ ছুটে যাওয়া মেয়ের পায়ের নীরব শব্দ পৌঁছে গেল মায়ের অ্যান্টেনায়। বসার ঘর থেকে উঠে শতাব্দী ধেয়ে এলো মেয়েকে ধরতে। বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল নুহা।
জোর করল না শতাব্দী। দরজা খোলার চেষ্টা করল না, দরজায় টোকাও দিল না। ফিরে গেল বসার ঘরে।
অনতুর মধ্যে জড়তা নেই। মায়ের কোল থেকে বেরিয়ে বসার ঘর থেকে লম্বা স্পেসের শেষ প্রান্তে বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল। তারপর দরজায় টোকা দিয়ে বলতে লাগল, ‘হাই নুহা ! দিস ইজ অনতু। কাম আউট। আই অ্যাম ইওর গেস্ট নাউ, ইউ শুড প্লে উইথ মি।’
দরজা খুলল না নুহা। ভেতর থেকে সাড়াও পেল না। ভেতরে কেউ আছে তাও বুঝতে পারল না অনতু। সে দূর থেকে দেখেছে, এ ঘরেই ঢুকেছে নুহা। অথচ কথা বলছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার ফিরে গিয়ে ঢুকে রইল বাবার কোলে। 
অনতুর কাণ্ড দেখে শতাব্দীর গায়ের জ্বালা আরও বেড়ে গেল। মেহমানদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত আড্ডায় অংশ নিতে পারছে না সে। বরং অফিসের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অন্তরার আগমন বিষময় হয়ে উঠল। কখন তারা যাবে সে-চিন্তায় আক্রান্ত হলেও বিপ্লব অন্যরকম অনুভবে ঋদ্ধ হয়ে শতাব্দীর উদ্দেশে বলল, ‘দেখেছ, অনতু কী স্মার্ট বয়! ইংরেজি মিডিয়ামের সবাই এমন স্মার্ট হয়ে ওঠে।’
ছেলের প্রশংসা শুনে আগত মেহমানরা খুশি হলেও এ কথায় সাড়া দিল না শতাব্দী। বরং চোখ বড় করে দাঁত কিড়মিড়িয়ে একবার মাত্র তাকাল স্বামীর চোখের দিকে। চোখ থেকে চোখে নিক্ষিপ্ত নীরব তিরের ঘা খেয়ে চুপ হয়ে গেল বিপ্লব। 


লটারির মাধ্যমে সব স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ঘোষণায় উদ্বেগ ও স্বস্তি দু’ধরনের আবেগে ডুবে থেকে শতাব্দী ভর্তির ফরম তুলে আনল ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে। ফরমে অভিভাবকের স্বাক্ষর কলামে বাবা-মা উভয়ের দস্তখত করার নির্দেশ রয়েছে। গোপনে ফরম জমা দেওয়ার উপায় নেই। বাংলা মাধ্যমের ঘোরতর বিরোধী বিপ্লবকে লুকিয়ে বা এড়িয়ে ফরম জমা দেওয়াও ঠিক হবে না ভেবে ফরম ফিল-আপ করে, টেবিলে লেখায় মগ্ন স্বামীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, নতজানু গলায়, যেভাবে কর্মচারী বা কর্মকর্তারা বসের কাছ থেকে কাজ হাসিল করার জন্য অ্যাপ্রোচ করে, সেভাবেই বলল, ‘নাও। সিগনেচার দাও। ভর্তি ফরমে এবার বাবা-মা উভয়ের দস্তখত দেওয়ার নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।’
স্ত্রীর মায়াবী কণ্ঠে পটে গিয়ে কাগজ টেনে দস্তখত করার পর চট করে আপন কাজের মগ্নতার ভেতর থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে বিপ্লব প্রশ্ন করল, ‘এই ! কীসে সিগনেচার নিলে ?’
ততক্ষণে ফরমটি নিজের দখলে নিয়ে শতাব্দী বলল, ‘প্রথম শ্রেণির ভর্তি ফরমেই সিগনেচার দিয়েছ। লটারির মাধ্যমেই ভর্তি করানো হবে এবার ছাত্রছাত্রীদের, বুঝেছো?’
―বাংলা মিডিয়ামে?
―হ্যাঁ। বাংলাই তো ! 
‘আমি তো চাচ্ছি... !’ বিপ্লবের মুখের কথা টেনে নিয়ে শতাব্দী বলল, ‘তা তো জানি। এখন জানুয়ারি মাস। ভর্তি মৌসুম। আর ইংরেজিতে অ্যাডমিশন হয় জুলাই সেশনে। তত দিন মেয়েকে বসিয়ে রাখবে? ভালো কোথাও চান্স পেলে ভর্তি করিয়ে রাখতে দোষ কী?’
‘না। দোষ নেই।’ চিন্তিত গলায় জবাব দিল বিপ্লব।
কৌশলী কথায় স্বামীকে ঘায়েল করে তৃপ্তি নিয়ে ফেরার সময় তাকে ডেকে বিপ্লব আবার বলল, ‘পরবর্তীকালে স্কুল চেঞ্জ করাও তো বাচ্চাদের মনস্তত্ত্বের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আর মাধ্যম চেঞ্জ আরও বেশি ক্ষতি করে শৈশবের ফাউন্ডেশনের।’
শতাব্দী মুখ ফিরিয়ে শুনল বিপ্লবের কথা। জোরালো প্রতিবাদ করল না। ঠান্ডা মাথায় কেবল তাকে স্মরণ করিয়ে দিল এক অনুষ্ঠানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বলা কথা―‘ভাগ্যিস দেশটা ভাগ হয়েছিল, তাই বাংলা ভাষাটা এক অংশে (বাংলাদেশ) বেঁচে আছে, না হলে সবটাই মুছে যেত।’
নিজের শোনানো কথা স্ত্রীর মুখ থেকে ফেরত পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে আবারও যুক্তি দেখিয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘বাংলা এ দেশে টিকে থাকুক গৌরবের সঙ্গে, আমিও চাই। তবুও মেয়ের মঙ্গলের জন্যই তাকে...’ কথা শেষ করতে পারল না বিপ্লব। তার আগেই স্বাক্ষরসমেত ফরম নিয়ে উধাও হয়ে গেল শতাব্দী।


মেয়ের কল্যাণচিন্তার ঘোরে ডুবে থাকলেও মাঝে মাঝে দ্বিধাগ্রস্ত হয় শতাব্দী। বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে বড় হতে পারবে তো নুহা! ভালো ফ্রেন্ড সার্কেল পাবে তো বড় হওয়ার পথে, তার মধ্যে তৈরি হবে না তো হীনম্মন্যতা! আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি? বাবা-মা দুজন একমত না হতে পারলে, একজন সন্তানকে একদিকে অন্যজন ভিন্ন দিকে টানলে, সন্তানের মধ্যে ডিভাইডেড রুলস তৈরি হতে পারে―এ ধরনের প্যারেন্টিং শিশু লালনপালনে ক্ষতিকর, জেনে এসেছে সে। বিশেষজ্ঞরা প্রায় বিষয়টি নিয়ে টিভি টকশোতে কথা বলেন। অথচ সন্তানের ভালো দিকটা বিকশিত হোক―স্বামী-স্ত্রী সেটাই চান। চাওয়ার ফাঁক দিয়ে উৎকট হয়ে উঠছে বিপ্লবের অবস্থান, ইংরেজি মিডিয়ামে মেয়েকে ভর্তি করানোর আগ্রহ, উৎসাহ আর ব্যাকুলতা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার ব্রেনসেল থেকে বাংলা মিডিয়াম ধৌত হয়ে গেছে। তাকে পুরোপুরি দোষ দিতে না পারলেও নিজের মন মানে না। স্কুলের সামনে বিশাল মাঠে অপেক্ষারত শতাব্দীর স্নায়ুকোষ থেকে এমনি সব চিন্তার উদ্গিরণ ঘটছে।
কিছুক্ষণ পর লটারির ফল ঘোষণা করা হবে। লাইভ প্রোগ্রাম। লটারির নম্বর তুলবে ছোট্ট কয়েকটি শিশু, যারা ভর্তির ফরম তোলেনি, এখনো বেশ ছোটো, তারা। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই উৎকণ্ঠার চাপ বাড়ছে। হাঁসফাঁস লাগছে। একাই এসেছে সে। কয়েক হাজার নারী-পুরুষের ভিড়ে, অধিকাংশই নারী, নিজেকে একা একাই লাগছে। জনতার ভিড়ে জনশূন্যহীন এ প্রান্তরে জনতার, নারী-পুরুষের মুখে শব্দ নেই। শব্দহীন প্রাণহীন জড়-জনতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে শ্বাস রোধ হয়ে আসছে। অপেক্ষারত মাঠের অন্য কোনো মা-ও নিশ্বাস ছাড়তে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। কপালের শিরা দাপাচ্ছে, শীতেও ঘাম বেরিয়ে আসছে মাইকের আওয়াজে। ফল ঘোষণা শুরু হচ্ছে। একটি শিশু তুলে নিচ্ছে লটারির টিকিট। অবরুদ্ধ শ্বাস থেকে বেরোচ্ছে উৎকট উৎকণ্ঠার ছাট। গেল রাতজাগা ক্লান্তি ধুয়ে গেছে উদ্বেগের স্রোতে। বোধশূন্য অতলে গাঢ় রাত্রির কালো আঁধার ছেয়ে গেছে। সন্তানের মমতার যা কিছু সঞ্চয় চোরাপথ-গলি পেরিয়ে কি চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও? একের পর এক নাম ঘোষিত হচ্ছে। নুহার নাম এখনো লটারির ডাকে উঠছে না কেন? লটারির টিকিট টানার পর ছাত্রীর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষিত হচ্ছে বাবা-মায়ের নামও। আগে উচ্চারিত হচ্ছে মায়ের নাম। তারপর বাবার―সংস্কৃতিতে এ পরিবর্তন খেয়াল করার পর মুহূর্তের উপলব্ধিটি, আকাশ ভেঙে নামতে থাকা কান্নার নোনাজলের ক্ষরণ থামিয়ে দিয়েছে। জমাট বুকের ভেতর থেকে পাথরচাপা ভারটা কমে গেছে। ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে না সে। আকাশে শকুনের চোখের মতো স্থির চেয়ে আছে মাইকে ঘোষকের দিকে।
একসময় থেমে গেল ঘোষণা। ওয়েটিং লিস্টেও নাম উঠল না নুহার।
মেঘ উড়ে এলো শতাব্দীর আকাশে! খোলা আকাশের উষ্ণ আলো ধুয়ে দিতে পারল না হতাশ মায়ের চোখের জলধারা। ভেজা চোখ বন্ধ করে জীবন্ত স্থাপত্যের রূপ ধারণ করে সে দাঁড়িয়ে রইল মাঠে।
আকস্মিক মূর্তির ভেতর থেকে মাতৃরূপ ধরে বেরিয়ে এলো সে। স্পষ্ট করে শুনতে পেল নুহার কণ্ঠ, ‘মাম্মি, আই লাভ ইউ...ইউ... ইউ...আই লাভ, মাম্মি !’
মগ্নতা টুটে গেল। চট করে চোখ খুলে সে তাকাল সামনে। মাঠ প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। প্রায় সবাই চলে গেছে। দেহটাকে এক চক্কর ঘোরাল এবার। চারপাশ তাকিয়ে খুঁজল নুহাকে।
না। নেই।
অন্যরকম জ্যোতিঃপ্রভায় মায়ার বিকীর্ণ ঢেউ ছড়িয়ে যেতে লাগল। সে-প্রভায় নিজেকেই একবার দেখার চেষ্টা করল। নিজের কিছুই দেখতে পেল না। চোখ প্রসারিত করে আবারও তাকাল আপন অস্তিত্বের আরও ভেতরপানে... নিজের চেতনার দিগন্তসীমায় হঠাৎ দেখল একরোখা জেদের শিরস্ত্রাণ মাথায় পরে নুহাকে কাঁধে নিয়ে বিজয়ীর বেশে আনন্দে ভাসছে বিপ্লব। আর হাত নেড়ে নুহা ডাকছে, ‘মা ! মা !’
মেয়ের মুখ থেকে প্রিয় বর্ণমালায় মধুর ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের বিজয়শিরস্ত্রাণ যেন উল্কার গতিতে উড়ে এসে বসে গেল নিজের মাথায়। আর একই সঙ্গে শুনতে লাগল নুহার প্রাণকাড়া ডাক―মা ! মা !
অবাক হয়ে শতাব্দী আরও অনুভব করতে লাগল এ মধুর শব্দতরঙ্গের জ্যোতিঃপ্রভার দাপটের সামনে টিকতে পারছে না ‘মাম্মি’ ‘মাম্মি’ ডাক―ক্রমশ তা সরে যেতে লাগল দূরে, বহুদূরে। 


মোহিত কামাল, চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক এবং সম্পাদক, বাংলাদেশ

menu
menu