ঘুলঘুলি

ভারি সাপের মতো মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছে অন্ধকার। নির্বিষ অন্ধকারের সঙ্গে জুড়ে আছে বেদনার বিষ, দিকশূন্য হাহাকার। ছন্দা অন্ধকারমুখী হয়ে বসে আছে। সুস্থির শরীরটি দেখাচ্ছে ইস্পাতের মূর্তির মতো। অন্ধকার পিছলানো মূর্তির দেহে হাওয়ার ঝাপটা লাগে। নিথর ছন্দার খোলা চুল তিরতিরিয়ে কাঁপে। হঠাৎ ঝুপ করে পানিতে কিছু পড়ার শব্দে ওর বুকের স্পন্দন গতিময় হয়ে ওঠে। 
রাত আনুমানিক দুই ঘটিকায় বাচ্চাটিকে বিছানা থেকে তুলে গলা টিপে হত্যা করা হয়। এরপর ঘাতকেরা ইটের সঙ্গে বেঁধে লাশটি বাড়ি সংলগ্ন পুকুরে ফেলে দেয়—স্থানীয় পত্রিকায় এভাবেই লেখা হয়েছিল সংবাদটি। বাসি পত্রিকা থেকে ছন্দাও পড়েছে বাচ্চাটির মৃত্যুর খবর। বাচ্চাটির নাম সুরভি, বয়স পাঁচ, পিতা-বাহারুল ছৈয়াল, মাতা-ছন্দা আক্তার, সাং-পায়রারটাকি, ডাকঘর-বুড়িমারি।
কক্ষের একমাত্র বাতিটি জ্বলে উঠেছে। ছন্দা ঘরের চারদিকে তাকায়। টিমটিমে বৈদ্যুতিক আলো ঘরময় ছড়ানোর সুযোগ পায় না। হলুদ আলো ঘিরে চটকা পোকা উড়তে শুরু করেছে। ছন্দার পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে ঘুঘরি পোকার দল। পোকার কাছ থেকে সরতে সরতে ছন্দা বাম দিকের দেয়াল ঘেঁষে বসে। 
জায়গায় জায়গায় চুনখসা দেয়ালে বড় করে লেখা, ‘সুরভি।’ কাঠকয়লার দাগ অস্পষ্ট হয়ে আসায় হ্রস্ব ই-কার ও ‘ভ’ বর্ণটি দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। নিজের হাতে লেখা শব্দটা ভুলভাবেই উচ্চারণ করে ছন্দা, ‘সুর।’ সুরেলা শব্দটি কোলাহলহীন বদ্ধ হাওয়ায় আটকে যায়। ছন্দা এবার পুনঃপুন উচ্চারণ করতে থাকে, ‘সুরভি, সুরভি...।’ ধীরে ধীরে সব নিস্পৃহতা কেটে গিয়ে ওর দুচোখ পানিতে ভরে যায়। হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে ছন্দা। কাঁদতে কাঁদতে শুকনো কণ্ঠনালীতে উঠে আসে বমির বেগ।
ঘরের ভেতরে দুর্গন্ধ বজবজ করছে। মানুষের ঘাম, প্রস্রাব আর মলের চাপা দুর্গন্ধের সঙ্গে বমির উৎকট গন্ধ মিলেমিশে দুঃসহ হয়ে উঠেছে হাওয়া। পানি ছিল না দুপুরের পর থেকে। টয়লেটের উৎকট গন্ধ ছোট্ট কক্ষটির কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে। সামনের মোটা লোহার গরাদের ফাঁকা পথ ধরেও দুর্গন্ধ বের হতে পারছে না। এই কক্ষে আটকে গেলে মুক্ত হওয়া সহজ নয়।
হাতের ওপরে তেরছাভাবে নকশাকাটা এক ফালি আলো পড়তেই ছন্দা চমকে যায়। হাত ঝাড়া দিতে দিতে সে ওপরে তাকায়। মেঝে থেকে অনেক ওপরে ছাদে কোণা ঘেঁষা ছোট্ট ঘুলঘুলিজুড়ে অন্ধকারের ব্যাপ্তি। এই আলো কোথা থেকে এলো সে বুঝতে পারছে না। ঘুলঘুলি বা গরাদের ফাঁক দিয়ে যে আসেনি তা নিশ্চিত।
বাইরে চাঁদের আলোর চিহ্নও নেই। সাত দিন ধরে একনাগাড়ে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। চাঁদ, সূর্য কিছুরই দেখা নেই। আজ দুপুরে যখন গোসলখানায় ঢুকেছে তখনো প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিল। বৃষ্টির পানি পেয়ে ছন্দা লাফিয়ে উঠেছে, বৃষ্টিতেই গোসল সারতে চেয়েছে। অনুমতি মেলেনি। তবে উঁচু দেয়ালঘেরা বৃষ্টিধোয়া বারান্দায় হাঁটাহাঁটির সুযোগ পেয়েছিল মিনিট পাঁচেকের জন্য। ধপধপে মেঝেতে খালি পায়ে হাঁটতে আরাম লাগছিল খুব। অন্য সময় হলে পনের-বিশ মিনিটও বাইরে থাকার অনুমতি মিলত। এখন নিয়মকানুন পাল্টে গেছে।
এতদিন অবশ্য অসংখ্যবার নিয়মের নড়চড় হতে দেখেছে ছন্দা। নিয়মের ফাঁকে ফাঁকে অনিয়ম গুঁজে দেওয়াই এখানকার নিয়ম। 
সারাদেশে মহামারি শুরু হওয়ার আগের মাসেই জজ কোর্ট থেকে বড় জজ স্যার এসেছিল পরিদর্শনে, অনিয়মের খোঁজখবর নিতে। নিয়ম ভঙ্গ করে এই সেলের কয়েদিদের ওয়ার্ডে নিয়ে রাখা হয়েছিল এর আগে। বড় স্যার আসার সংবাদে সেদিন ওয়ার্ড থেকে ওদের চারজনকে এই সেলগুলোতে দ্রুত স্থানান্তর করা হয়েছিল। আজও কোন এক কর্তাব্যক্তির আগমনের আভাস পেয়ে ওদের পুরোনো স্থানে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেদিনের মতো বারবার শাসানোও হয়েছে, খাওয়া-শোয়া-পরা বিষয়ক কোনো অভিযোগ যেন না করা হয়। করলে কী করা হবে তা আজও শোনেনি ছন্দা। কখনোই শোনে না। অভিযোগও করে না। যদিও এখানকার মানুষগুলোর অভিযোগের অন্ত নেই। এখন তো এদের হাহাকারে কান পাতা দায়।
দেড় মাস হলো স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ। কোর্ট-কাচারি বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন জামিনও হচ্ছে না কারও। বাইরে যাচ্ছে না কেউ, ভেতরে ঢুকছে। এক কারারক্ষী বলছিল গতকাল, আদালতে না বসলেও জামিন শুনানি শুরু হবে এবার, কম্পিউটারের সামনে বসে কোর্ট হবে। মুক্তি পাবে হাজতি-কয়েদিরা।
ছন্দা আপাতত মুক্তি পাবে না। ছন্দা জানে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির দণ্ডাদেশ অননুমোদন বা অনুমোদনের আদেশ না আসা পর্যন্ত ওর মুক্তি নেই। সবুজ অবশ্য বলে গেছে, ওর মুক্তির খুব বেশি দিন দেরি নেই।
দেড় মাস আগে সবুজ যখন ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তখন ওর চোখ-মুখ চকচক করছিল। মামলা থেকে ছাড়া পেয়ে বেশ বাবুটির মতো চেহারা হয়েছে সবুজের। হীনস্বাস্থ্য পুনর্গঠিত হয়েছে। সিঁথির দুপাশে তেল চুবানো চুল চাপতে চাপতে সে হড়বড় করছিল, উকিল সাহেব বলেছে, মেয়েলোকের ফাঁসির সাজা হবে না। আপিলে সাজা কমিয়ে দেবে। একবার গলা নামিয়ে ফিসফিস করেছে, ‘তাই না তোমারে দিয়া স্বীকারোক্তি করাইল। আমি ছাড়ান পাইলাম।’ যাওয়ার আগে—‘আবার আসমুনে, শালার করোনা বিদায় হউক’ বলে বুকপকেট থেকে কমলা রংয়ের গোল চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে হেসেছে সবুজ। ওই হাসি দেখেই ছন্দা বুঝে গিয়েছিল, মানুষটা আর আসবে না।
কেউ আসবে না আর ওকে দেখতে। ফোনও করবে না। ছন্দার ভাবনাকে মিথ্যে করে একজন মানুষ এসেছিল পরের দিনই।
কম্বলের ওপরে শরীর ছেড়ে দেয় ছন্দা। ওর পেটের ওপরে আলোর নকশাটা আবার নাচতে শুরু করেছে। অবিন্যস্ত শরীরে ধড়ফড় করে উঠে বসে ছন্দা। ঘুলঘুলির ফুল নিজের শরীর থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে এবার সে অস্থির হয়ে ওঠে।
‘সুরভি’ লেখা দেয়ালে একটি শরীরকে হাত দিয়ে ক্রমাগত বুকপেট ঝাড়তে দেখা যায়। এই দেয়ালের ওপারে অজস্র শব্দ, অবিশ্রান্ত কোলাহল-কোমরের কড়ির ঝুনঝুন, মনিবন্ধের রূপার চুড়ির রুমঝুম, বাতিজ্বলা প্লাস্টিকের স্যান্ডেলের প্যাচপোচ-ক্যাচকোচ, স্টিলের গ্লাসের ছিটকে পড়ার ঝনঝন। ওই দেয়াল পেরিয়ে গেলেই বিচ্ছিন্ন এক পৃথিবী।
শব্দে শব্দে উচ্ছ্বসিত হবার বদলে ছন্দা সিঁটিয়ে যায়। ওর বুকের মাঝে আবার আলোর ঝালর এসে পড়ে। আলোর ভারে নুইয়ে পড়া ছন্দা গোঙাতে গোঙাতে মাটিতে মিশে যায়। এমনি করে সেদিন সে মিশে গিয়েছিল একটা লোমহীন বুকে। দুপুরের নিস্তব্ধ স্বরে নিশ্বাসের বিলোড়ন ছিল শুধু। ঘুলঘুলি ভেদ করে আলোর তেরছা নকশার ঝিলিক লেগেছিল তার নগ্ন বুকে। আলোডোবা স্তনাগ্র নিষ্পেষিত হচ্ছিল এক জোড়া বলবান হাতে। তারপর...জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া দুটি চোখ মুহূর্তেই ছাই করে দিয়েছিল শরীরের সব ভাঁজ, উত্তাল উলঙ্গ নিতম্ব সাঁই করে বিধ্বস্ত হয়েছিল ঘরের তপ্ত মেঝেতে। ‘মা, মা...ও মা’ করে একটি পাখি উড়ে গিয়েছিল ঘুলঘুলির ফাঁক গলে।
‘মা, মা...ও মা...’ কোথাও নেই সেই স্বর। বাইরে আম্পানের শোঁ শোঁ শব্দের নাচন। ভেতরে ঝড়ের তাণ্ডব খাবি খায়। ছপাৎ শব্দে কেউ পানিতে ঝাঁপ দেয়, ছুপছুপ, ছপছপ তরঙ্গ তুলে নাচে গভীর কালো পুকুরের মাঝখানে। ছন্দা অন্ধকার হাতড়ে কিছু খোঁজে, কাউকে খোঁজে। পায় না।
সেলের অন্য মানুষগুলো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকার ঘিনঘিনে আওয়াজ দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ছন্দার কানের লতিতে ধাক্কা দেয়। দুকান চেপে ছন্দা চোখ বুজে শুয়ে পড়ে। নরম একটা শরীরের স্পর্শ পায়। চোখ বড় বড় করে তাকায়। দেখে সুরভি ওর বুক ঘেঁষে শুয়ে আছে। এক ঝটকায় ছন্দা সুরভির পুঁটলির মতো শরীরটা সরিয়ে দেয়। হ্যাঁচোড়প্যাঁচড় করে সুরভি তবু মায়ের দিকে এগিয়ে আসে। অন্ধকারেও সুরভিকে স্পষ্ট দেখতে পায় ছন্দা, বাহারুলের মুখটা একেবারে কেটে বসানো সুরভির মুখে।
বাহারুল বলতো, ‘অয় আমার মা না শুধু, আমি নিজে।’ সুরভির জন্মের পর পর বাহারুলের ব্যবসায় আয়-উন্নতি হয়েছিল বেশ। মেয়ের জন্য রূপার চুড়ি, কোমরের বিছা বানিয়েছিল সে। শহর থেকে ফিরে মেয়ের হাত ধরে উৎফুল্ল বাহারুল বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াত। বেঁটেখাটো মানুষটির কৃষ্ণবর্ণ মুখটি হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত।
সেদিন দেখা করতে এসে ছন্দার মুখের ওপরে এক দলা থুতু ছিটিয়েছিল বাহারুল। ‘ডাইনি, ডাইনি’ বলে কণ্ঠনালী ছিঁড়ে চিৎকার করেছিল বারবার। কারারক্ষীরা টেনে হিঁচড়ে বাহারুলকে সাক্ষাৎকার কক্ষের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল।
ছন্দা নাকে-মুখে হাত বুলায়। থকথকে থুতুতে জবজব করছে মুখমণ্ডল। ছন্দা বিভীষিকাময় অন্ধকারে পথ হাতড়ায়। শূন্যগর্ভে হাত রেখে হাঁপানির রোগীর মতো শ্বাস টানে। অন্ধকারের অবরুদ্ধ পৃথিবীতে বাতাসের শব্দও নিটোল হয়ে উঠছে। নিস্তরঙ্গ আঁধারে ঝুপ করে কেউ তরঙ্গ জাগায়। 
অন্ধকার পরিভ্রমণ শেষে আলো ফিরে যাচ্ছে ঘুলঘুলিতে। প্রস্থানরত আলো পিছনে ফিরে শেষবারের মতো বিদ্ধ করে ছন্দাকে। বুকে সাঁড়াশির টান লাগতেই ছন্দা গরাদের কাছে সরে হাঁপায়। গরাদের বাইরে শীর্ণ হাত গলিয়ে সে এবার সুর করে কাউকে ডাকে, ‘আয় আয়, তোর চুলে ত্যাল দিয়া দেই মা, ও মা আয়, বেনি কইরা দিই...।’ কেউ আসে না, শুধু মরমি এই সুর হাওয়ার হাত ধরাধরি করে অন্ধকার আকাশে মিলিয়ে যায়।


সাদিয়া সুলতানা, কথাসাহিত্যিক, বাংলাদেশ।

menu
menu