ইশরাত তানিয়া

এই দূরত্বকে অগম্যই বলা যায়। অগম্যকে একটা শক্তি গন্তব্য বানায়। সে শক্তির নাম ক্ষুধা। চৈত্র মাসের গরমে তাই অগণন মানুষের মুখ ফুটে ওঠে ঢাকা মহাসড়কে।  
এসব কথা জানত না ঢাকা শহরের অধিবাসী—যেকোনো পিউ কিংবা তুষার। এপ্রিলের শুরুতেই লু হাওয়া বয়ে যায়। পিউর কপালের ডান দিকে জেগে ওঠা ঘামের চিকন ধারা নামে। কানের পাশে উড়তে থাকা কেশচূর্ণগুলোকে গালের সঙ্গে লেপ্টে দেয়। একই সময়ে বাঁ দিকের ধারা গাল পেরিয়ে চিবুক ছুঁয়ে গলার দিকে পৌঁছাতে চায়। এর আগেই ফ্যানের বাতাস জলীয় প্রবাহটুকু শুষে নিলে আরাম লাগে পিউর। খাবার টেবিলের ওপর চপিং বোর্ড আর ছুরি রাখা। পাশে লাল, সবুজ আর হলুদ ক্যাপসিকামের আভায় চারপাশ উজ্জ্বল। ক্যাপসিকামগুলো ধুয়ে রাখে সে। তারপর সাবান দিয়ে ফেনায় ফেনায় হাত ঘষে ধুয়ে ফেলে।  
লকডাউনের জেরে মাছ, মাংস, দুধ আর ফ্রোজেন আইটেমে ডিপ ফ্রিজে আর জায়গা নেই। ফ্রিজের ওপরের দিকে যে ট্রে থাকে, সেখানে বাকি দুই লিটার দুধের প্যাকেট রেখে দেয়া যায়। ক্যাপসিকাম ও ব্রকোলি মাঝারি টুকরো করে কাটতে কাটতে এই বুদ্ধি বের করে পিউ। এতে অন্তত পাঁচ দিন দুধ টাটকা থাকবে। টমেটোকে চার টুকরো করে পিউ। একটা প্লেটে কাটা সবজিগুলো ঢেকে ফ্রিজে রেখে দেয়। এমনভাবে রাখে যেন একটার ওপর আরেক টুকরো না থাকে।      
চাল, ডাল, আলু, তেল, ম্যাগি একমাসের বরাদ্দ আগেই কেনা হয়েছে। তেমন দরকার পড়লে বাজারঘাট ডটকমে কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে মাছ-মাংস সবই অর্ডার করা যাবে। পিউর মনে পড়ে দু’দিন আগে ৪০১ এর ভাবি ফোন করেছিল—বাজারঘাট ডটকমের সবজিগুলো নাকি তেমন ফ্রেশ ছিল না। একেকটা পোকাধরা বেগুনের প্রায় অর্ধেকটা ফেলে দিতে হয়েছে। ফেসবুকের সঙ্গে টিভি’র চ্যানেল বদলে বদলে কত কী দেখে পিউ! প্রকৃতির আশ্চর্য বৈপরীত্যের খেলায় মানুষ ঘরবন্দি। হাইওয়েতে হরিণ ঘুরে বেড়ায়, সৈকতে ডলফিন খেলে। লকডাউনে ভিড়ভাট্টা নেই। ব্যালকোনি থেকে দেখে সুনসান পাড়ার রাস্তা বয়ে গেছে যতদূর তার দৃষ্টি। চেনা পৃথিবী হঠাৎই অচেনা হয়ে যায়। পিউ বাজারঘাট ডটকম ওয়েবসাইট থেকে ঘুরে আসে একবার। অর্ডার দেয়ার ব্যাপারটা বুঝে ফেলে। আগে সে কখনো অনলাইনে বাজার অর্ডার করেনি।   
ফেসবুকে ডালগোনা কফি খায় সবাই। নানান পদের তরকারি রান্না করে ছবি পোস্ট করে। অনাহারীদের জন্য রিলিফের চাঁদা তোলে। ফেসবুকের একটা প্রাইভেট গ্রুপে জয়েন করে পিউ। নাম ‘যদি বন্ধু হও, বাড়াও হাত’। এই ভয়াবহ সময়ে কর্মহীন মানুষ আর তাদের পরিবারের দুবেলা ডাল-ভাতের ব্যবস্থার জন্য গ্রুপ খোলা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত পেতে টাকা বা খাবার চাওয়ার মতো সামাজিক অবস্থানে যারা নেই মূলত তাদের জন্য। বিশাল প্রয়োজনের সামনে নিতান্ত ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। কিছু টাকা বিকাশ করে পিউ। মানুষের জ্বর আসে। গলাব্যথা করে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আচানক সবাই মাথা ন্যাড়া করে ফেলে। এসব ঘটনা আগে কখনো দেখেনি কেউ।
এখন কয়টা বাজে কে জানে? দিন তারিখের খোঁজ খবর নেই। সবই যেন শুক্রবার কিংবা শনিবার। পিউ দু’হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার লাগায়। কয়েক মুহূর্তে সুবাসিত স্যানিটাইজারটুকু শুষে নেয় ত্বক। এরপর লোশান লাগানোর দরকার আছে কিনা এ নিয়ে দোটানায় পড়ে সে। যতবার হ্যান্ড স্যানিটাইজার লাগায়, এই চিন্তাটা মাথায় ঘুরপাক খায়। কখনো লোশান লাগাবে, কখনো লাগাবে না শেষতক এমন একটা সিদ্ধান্তে আসে পিউ। স্বস্তিবোধ করে। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে মাথা চুলকায়। গতকাল কি যেন মনে রেখেছিল আজ করবে বলে। সেটা ভুলে যায়। হয়তো চিনি শেষ হয়ে গেছে, তেলাপোকা মারার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, কিনতে হবে কিংবা হতে পারে সেটা চুলে মেথিবাটা লাগানোর কথা। 
৪০১ এর ভাবি বাজারঘাট ডটকমের পর সেদিন বলছিল ওদের বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের কথা। সামনের মাসের মধ্যেই নতুন ফ্ল্যাট রেডি হয়ে যাবে। পিউ জানে ৬ মাস ধরেই ফ্ল্যাটের কাজ চলছে। বসুন্ধরায় ৪০০০ স্কয়্যার ফিটের সাউথ ফেসিং ফ্ল্যাট। দশ আর এগার তলা মিলিয়ে। মেটেরিয়ালস, ফিটিংস সবই নাকি বিদেশি। মিরর পলিশড টাইলস। বিশাল বিশাল সব ঘর, লিভিং আর কিচেন এরিয়া। চারটা কার পার্ক। প্রচুর আলো বাতাস। খোলামেলা চারপাশ। মাত্র সাড়ে তিন কোটি টাকা। পিউ ভেবে পায় না ৩ জনের পরিবার ৫টা বেডরুম দিয়ে আসলে কী করবে? অকারণেই হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে সে আবার হাত ধোয়। নিজের হাত দুটোকে নিয়ে আজকাল ওর খুব সন্দেহ।                 
সাড়ে তিন কোটি কত টাকা ভাবতে ভাবতে পিউ আলমারি আর টেবিল মোছে। পয়লা বৈশাখের শাড়িটা আলমারিতে রাখা। গত মাসে বুটিক থেকে শখ করে কিনেছিল। সাদা জমির তাঁতের শাড়ি। মেরুন-লাল আঁচল ও পাড়ে জরির নকশায় বর্ণিল ফ্লোরাল মোটিফ। কিসের আর পয়লা বৈশাখ? কাল রাতে ভালো করে ঘুমই হয়নি। কী এক চাপা অস্বস্তিতে এপাশ-ওপাশে ভোর হলো। কাপড়ের বাড়িতে ড্রেসিং টেবিল ঝাড়ে পিউ। কাচ মোছে। তিনটা হাঁচি দেয়ার পর বলে—এতো ধুলাবালি আসে কোত্থেকে? বাকি দুটা হাঁচির ফাঁকে পরের কথাটা কোনো মতে ছিটকে বেরিয়ে যায়—বাপের জন্মে, হ্যাঁচ্ছো... এতো ধুলাবালি দেখি নাই, হ্যাঁচ্ছো।      
এপ্রিলের শুরুতে এত ধুলা ওড়ার কথা না। হাঁচি দেয়া শেষ হলে একটা চাপা দুশ্চিন্তায় পিউ বিচলিত হয়ে পড়ে। বেসিনে হাত ধোয় তারপর চুপচাপ রান্না ঘরে গিয়ে গোলমরিচ, তেজপাতা আর লবঙ্গ দিয়ে পানি ফোটায়। আদা ছেঁচে দেয়। সুপ্রাচীন ভেষজ উপাদানের মধ্যেই নাকি আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ৪০১ এর ভাবি বলেছে—মাস্ক, স্যানিটাইজার ইত্যাদির পাশাপাশি শরীরের ভেতরটাকেও সুরক্ষিত করতে হবে। জীবাণুর সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষমতা বাড়াতে হবে মশলা চা খেয়ে। গরম মশলায় লালচে হয়ে আসা ফুটন্ত পানিতে চায়ের পাতা ছেড়ে দেয় পিউ। দু’কাপ চা বানায়।        
বায়িং হাউজের সঙ্গে অনলাইন মিটিং শেষ। ড্রইং রুমে ল্যাপটপ মুছে পরিষ্কার করছে তুষার। হন্যে হয়ে খুঁজে দুটো হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সঙ্গে অ্যালকোহল সোয়াব কিনে এনেছিল। সেটা দিয়ে ল্যাপটপ জীবাণুমুক্ত করে। হঠাৎ পিউর হাঁচির শব্দে চমকে ওঠে তুষার। সেদিন নিজের গলার বাঁ দিকটা চিনচিন করে উঠলে কী ভয়টাই না পেয়েছিল! হঠাৎ মনে হয়েছিল ইনফেক্টেড হলে কই যাবে? জানে না তো! গুগল করে চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের তালিকা দেখেছিল। উৎকণ্ঠায় তুষারের কপালে ভাঁজ পড়ে। আজকাল ওষুধের দোকানে সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।  
পিউর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে আনমনে চুমুক দেয় তুষার। পিউ নিজের কাপ হাতে তুষারের পাশে বসে।
—জানো? ৪০১ এর ভাবিদের ফ্ল্যাট প্রায় রেডি। সামনের মাসে শিফট করবে। 
—ওরা তো বিরাট ধনী। এইসব লকডাউনে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের কিছুই আসে যায় না। তার ওপর সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার  ইনসেনটিভ প্যাকেজ দিচ্ছে। 
—এর সাথে ফ্ল্যাটের কী সম্পর্ক?  
—আরে? ডেভেলপারকে এই টাকা থেকে বাকি টাকা দিয়ে দিলেই তো ফ্ল্যাটের হ্যান্ডওভার পেয়ে যাবে। 
—আগে টাকা দিতে হয়েছে না?      
—সেটা তো মাত্র ১০ পারসেন্ট। ডাউনপেমেন্ট। এবার ৯০ পারসেন্ট দিয়ে উঠতে হবে।  
—তোমার সব সময় না... একটা বাঁকা কথা বলা চাই। মৃদু কটাক্ষ পিউর গলায়।   
—আচ্ছা, পিউ, তুমি কোনো খোঁজ খবর রাখো? ২ পারসেন্ট ইন্টারেস্ট রেটে ইনসেন্টিভ প্যাকেজ মানে বোঝো? সহজ শর্তে ঋণ। ঋণ নিয়ে গার্মেন্টস মালিকরা কী করে জানো? শ্রমিকের বেতন দেয় না। বড়জোর আগের ঋণ রিশিডিউল করে। এতেও যদি গার্মেন্টস মালিকদের না পোষায় তখন ইন্টারন্যাশনাল ডোনাররা টাকা দেবে। এদের যে কত রকম সুবিধা!        
—যাই বলো, ভাবিকে অনেক মিস করব। পিউর চোখ ছলছল করে ওঠে।   
—এখন আবার কান্নাকাটি শুরু করবে নাকি?    
পিউ একটু বিরক্ত হয়েই চায়ের কাপ হাতে উঠে যায়। তুষার ল্যাপটপ টার্ন অফ করে। এক সপ্তাহ হলো ঢিলেঢালাভাবে ‘ওয়ার্ক অ্যাট হোম’ শুরু হয়েছে তুষারের। কতদিন পর্যন্ত চলবে কে জানে? ডিলাররা অর্ডার ক্যান্সেল করেনি। শিপমেন্ট হয়তো ডিলে হবে। কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। চায়ের কাপে চুমুক দেয় তুষার। সে চুমুকও অনিশ্চয়তার।    
এই প্রথম তুষার বিভিন্ন আকৃতির হাঁড়ি পাতিল ধোয়ার চেষ্টা করে। ট্রিক্স লেমন ডিশ ওয়াশিং লিকুইড দিয়ে বাঁ হাতে পাতিল ধরে ডান হাতে মাজাঘষা করতে গিয়ে বোঝে এসব যথেষ্ট কায়দাকেতার ব্যাপার। রোজ বিকেলে রোদ তলিয়ে গেলে ব্যালকনির সৌখিন টবগুলোতে সে জলসেচ করে। সেখানে সারাদিন টাটকা রোদ ঢালে আকাশ। রোদে-জলে যত্নে বেড়ে ওঠে পুদিনার চারা। বেলিগাছ সন্ধ্যার হাওয়ায় সুগন্ধি নিঃশ্বাস মিশিয়ে অক্সিজেন বাড়িয়ে দেয়। বৃন্তচ্যুত বেলিগুলো স্বচ্ছ কাচের বাটিতে পানিতে ভাসিয়ে রাখে পিউ। 
সেই কাচের বাটির দিকে তাকিয়ে আছে তুষার। বাটির কারুকাজ আর পানিতে আলোর প্রতিবিম্ব বেলির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। টেবিলের ওপর মিহি ধুলার পরত। বাটির আশেপাশে ধুলার প্রলেপ।    
ইদানীং ঘর ঝাড়ু দেয় তুষার। সারা বাড়ি মপিং করে। অবাক হয় ধুলার প্রাবল্যে। ধুলা আর ধুলা! অথচ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে ঢাকার অবস্থান ৮। বাতাস এখন অনেকটাই ধুলাহীন। তাহলে এতো ধুলাবালি আসে কোত্থেকে?      
পিউ কিংবা তুষার তখনো জানে না লকডাউনের মধ্যেই পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা হয়েছে। হয়তো ৪০১ এর ভাবি এটা জেনে গেছে আগেই। হতে পারে পিউকে জানাতে মনে ছিল না। পিউ কিংবা তুষার ধুলাবালি মুছতেই থাকে আর ধুলাবালি ফিরে ফিরে আসে। এই অফুরান ধুলার উৎস নিয়ে একবার ওদের মনে ভাবনা জাগে। আরেকবার মনে হয় আদৌ কি ধুলাবালির প্রাবল্য বেড়েছে?        
গণপরিবহণ বন্ধ অথচ সময় মতো ফ্যাক্টরিতে না পৌঁছালে শ্রমিকদের চাকরি থাকবে না। তাই অগণন মানুষের মুখ ফুটে উঠছে ঢাকা মহাসড়কে। লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক ঢাকা ফিরে আসছে। শত শত কিলোমিটারের অগম্য দূরত্ব পায়ে হেঁটে।   
ওদের চোখের সামনে দৃশ্যত যা কিছু আছে চৈত্র মাসের উত্তাপে ঘোলাটে হয়ে কেঁপে উঠছে। অসুস্থ, পিপাসার্ত, ক্ষুধার্ত... এক দিন ধরে দু’দিন ধরে ওরা হাঁটছেই...  অজস্র সহস্র কণা ধুলাবালি উড়িয়ে...


ইশরাত তানিয়া, অধ্যাপিকা, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ

menu
menu