লাফান্ডু

সময়টি বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপজনিত তুমুল-ধরনের দুপুর; মাতলুর আগে আগে শ্যামলাল এসে দাঁড়ায় ঘুসিক কোলিয়ারির স্টাফ কোয়ার্টারের দোতলায়, ইস্ট সাইড থেকে সাত নম্বর ওয়েস্ট সাইড থেকে দু নম্বর ঘরের বন্ধ দরজায়। মাতলুর ডান হাতে একটি হাতুড়ি, বাম হস্তে একটি সদ্য-ক্রীত নারকেল ও একটি ঝাড়ু। শ্যামলাল পকেট হাতড়ে চাবি বার করার আগেই মাতলু ধাঁই করে হাতুড়ি বসিয়ে দিল তালায়। 
—তোড়ো মৎ, তোড়ো মৎ... লো চাবি...
ততক্ষণে আর একটি ঘা, তালা ঝনাৎ করে পড়ে গেল মাটিতে। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শঃ তালা পায়েই পড়ে। শ্যামলাল আশ্চর্য হয়ে দেখল কী সুচারুভাবে বেঁকাচদা পা বাঁচিয়ে নিলো, শালা যন্ত্র বটে!
কথা হচ্ছে পোসেশনের দিন মালিক শ্রীযুক্ত শ্যামলাল বাউরি এক হাতে ঘরের চাবি এবং অপর হস্তে বকেয়া লছমি (চার হাজার) লেনদেন করে উভয়পক্ষ মিঠাই বিলোবে। বাঞ্চোত নিম্নচাপ সব প্ল্যান ভেস্তে দিল। মাতলু চকিতে ঘরে পা দিয়ে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এসে শ্যামলালের কলার চাপে : বহেনচোদ! রুপিয়া অয়াপস কর। ঘর নেহি লেঙ্গে।
—তুই শালা ঘর দেখেই তো এডভাঞ্চ দিয়েছিস। 
—এমন পানি গিরতৌ, তুম হারামি বোলা? 
—বর্ষাৎ কা দিন, পানিই ত গিরবেক... পিসাব ত গিরে নাই! এডভাঞ্চের লছমি রিটান হয় না। লেনা হ্যায় লো, নেহিত ভাগো! 
মাতলুকে বলা হয়েছিল নিচের কোয়ার্টারে ইসিএলের নোকরি-অলা মড়িরাম পিয়ক্কড়, খুব খিস্তিবাজ; তার বউ সুভাষিণী খুব নাংটা। নিচেরটি অকুপায়েড পাশেরটি অ্যালটেড—দুটি  কোয়ার্টার নিয়ে থাকে। সারাদিন খ্যাচরম্যাচর! তবে দুসরা কুন ডিসটাপ নাই। দু'বগলে দুজনই মালকাটা, একসাথে ডিবটি যাবি। উ শালা ভি ইললিগেল, তুম শালা ভি ইললিগেল। এথায় যে আসছে সেই ঘুঁসে যাছে, বাপের কোয়াটার যেমন!
অ্যালটেড অকুপায়েড সব কোয়ার্টারের গায়ে লেখা এবানডোনেড। ডরো মৎ!
ডর থাকলে মাতলু বিনা-খুঁটার খাদানে কয়লা খোঁদে?
ধড়াম করে একটা চাংড়া খসে পড়লো শিলিং-এর, মেঝেময় জলাশয়ে টাপুর টুপুর বৃষ্টির রিং চুরমার, শিলিং জুড়ে জলের ফুসকুড়ি সেই সময়। চাংড়া পড়ার শব্দে সুভাষিণী পেছনের উঠানে লাফায়, ইবেরে যদি চাংড়া খসে, পোঙায় ঘুসাই দুব বলে রাখলাম!
—রুপিয়া রিটান কর! তুর ঘর তুর পাশেই রাখ শালা! 
চাংড়া খসার সময়ই শ্যামলাল কেটে পড়েছে। 

এটি কিন্তু পলায়ন নয়, মাতলুর অতিক্ষুদ্র এবং শ্যামলালের ততোধিক ক্ষুদ্র ছিদ্রে একটি আঝোড়া বেম্বু ঘুসানোর পারস্পরিক তারিকা। মাতলুও খুশি হয় : দোকলাকো কৈসন ঝিটা (ঠকানো)! ঔর এক্কো সিক্কা নাই দুব! অতঃপর সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চিল্লায়, এ গে এ নানকি, সামান উতার!
যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, রাস্তার থোড়া সাইডে ঠেলার উপর চার ঠ্যাং তোলা তক্তা তার উপর কাঁথাকানির মোটরি বগলে বর্তনউর্তন জলের হুটুম সুঁচালো গাঁইতি দাঁতালো বেলচা তার উপর বিন-বেলাউজ শাড়ি হাটকে দুধের বাঁট ছিঁড়ছে এক বছরও হতে পারে চার বছরও হতে পারে পিকপিকে গণেশ, দুটি বাছড়া লছমি-সরসতিয়া নিয়ে হুটহাট বাতাসে নাচুনে পলিশিটের নিচে ভিজেসঁটুরে মাজননী—মাতলুর বউ নানকি। 
লছমি সরসতিয়ার কোলে গণেশসহ ঠেলার মালমোটরি ততক্ষণে কাদায়, দুজনে মিলে চৌকি তুলে প্রায় ঢোকাবার মুখে পেছনে টান : এই বহেনচোদ! কাঁহা ঘুসায়? ই মেরা ঘর! হাঁই দেখ কাগজ! জলে ভিজে ডানাভাঙা পাখির মতন একটি লাইন লেখা কাগজ সাইক্লোনি হাওয়ায় অল্পস্বল্প দোলে।
—দো হাজার রুপয়া এডভাঞ্চ দিয়েছি... 
—লে হালুয়া! হাম ভি ত দিয়ে! লেকিন কাগজ নাই। 
নানকি খ্যাক করে ওঠে : হ্যায়, পেপার হ্যায়। রুক দেখাতনি। ছুটে গিয়ে দৌড়ে আসে অবিকল অমনি একলাইনের ডানাভাঙা কাগজ নিয়ে নানকি। প্রায় হাতাহাতির মুখে পদনা সমবেত জনতার হয়ে মীমাংসাসূত্র বার করে : যিসকা হাজার রুপয়া এডভাঞ্চ, ঘর উসকা।
—মতলব? হাম জাদা দিয়ে, দো হাজার... 
ইসলিয়ে ত ঘর মাতলুকা। কিমত বাঢ়ে ভাই বাদমে, শুরুয়াতমে শস্তা। তুম সেকেন্ড। মাতলু ঘর ভ্যাকেট করেগা, চান্স তোহোরা। পেপার ঠিকসে রাখ।
—মাতলু ঘর নেহি ছোড়ে ত? 
—বৈঠল বৈঠল বাল তোড়, আঁটি বাঁধ। 
ছোটামোটা বাতিয়ায় কান না-দেওয়া রবিয়া রংবাজ কখন এসে হুঙ্কার ছাড়ে : কা বাত বে! হল্লা কিসের? দুজনের কাছ থেকে কাগজ নিয়ে হা হা করার আগেই খচাংমচাং ছিঁড়ে বয়ে যাওয়া জলে ভাসিয়ে দিল।
—ভারি এঁড়ের কাগজ! শ্যামলালুয়া আবার কবসে লিখিপড়ি? আঙুঠা ছাপ শালা, কাগজ দিয়ে! যা  ভাগ! 
দুজনকেই ধাক্কা মেরে নিচে নামিয়ে দিল রবিয়া।

স্থাপিত ১৮৮৭ সাল, মর্চে ধরা প্লেট লাগানো চিমনি টাওয়ারের পাশে দিয়ে বন্ধ কোলিয়ারি যাওয়ার পথে শ্যামলালের হাতে বিড়ি। কখন নিভে গেছে। দেশলাই বার করতে গিয়ে মনে পড়ে যায় কমরেড হারাধন রায় একটা বিড়িতে একটা ম্যাচবাক্স খতম করে দিয়ে যার কাছেই চাইতেন, সবাই বলতো নেই। টাওয়ারের তলায় বসে কমরেড কোম্পানি আমলের কথা বলতেন আর একজায়গায় পোড়া দেশলাই কাঠিগুলি ফেলতেন। "ওর থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে" কমরেডের সব গল্পের অন্তিম টিপ্পনি। তখনও অতীত চর্চা হোত সিপিএমে, তখন বর্তমানকে ধরে ভবিষ্যৎ ভাবতে শিখেছে কমরেডরা এবং এই সূত্রেই আইডিয়াটা আসে বিপরীত দিক থেকে আসা রবিয়ার জন্য।
কোলিয়ারির কোয়াটার বেচা যায়, বিচে রিটান নেওয়াও যায়। কেনাবেচা-সহ দুনিয়া জয় করার তত্ত্বটি শ্যাম-রবিয়া ম্যানিফেস্টো হিসেবে বহুদিন চলেছিল কোলিয়ারিতে, রচিত হয় ওই দিনই মদভাটিতে। আমরা পানশালাটিকে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি বলতে পারি—অনেক মন্ত্রণা অনেক মেধাপ্রতিভা সিদ্ধান্ত এই পানশালার অবদান। প্রমাণ সাইজের নয়া ডাস ক্যাপিটাল যা রচিত হল সেদিনই—তত্ত্বটি প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কার্যকরী, ফলে একে বিজ্ঞনসম্মত রবিয়াতত্ত্ব বলেই  কোলিয়ারি জানে, যেমন দুজনে মিলে প্রচার করলেও কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো মার্কসের নামে প্রচারিত, এঙ্গেলস কালেকলাপে। শ্যাম-রবির ইতিহাস থেকে শিক্ষাসূত্রটি স্মৃতিনির্ভর—উভয়েই সম্ভবত নিরক্ষর। কথক : হারাধন রায়।
দ্বারকানাথ কেলো-গণেশ উল্টে বেলগাছিয়ায় রিটার্ন হলে রানিগঞ্জের কোলপ্রিন্স হয় বেঙ্গল কোল কোম্পানি। তাদের প্রায় অধীনে মনসবদারহেন গুজরাটি পাঞ্জাবি মাড়োয়ারি পার্সিদের এক আধটা কয়লাখনি। কয়লার পুরো বাজারটাই বেঙ্গল কোলের—মনসবদারদের বিক্রিবাটা নাই। হপ্তা পেমেন্ট—যেমন কয়লা কাটবে সেই হারে লেবার পেমেন্ট। লেবাররা তো পঁদ খুলে কয়লা  কেটে পব্বত করে দিল—মালিক ছুটলো সুদখোরের দরজায়। মিশ্রাজিকে বলে, খাদান আপকা,  রুপয়া দিন; চৌরাশিয়াকে বলে, খাদান আপকা, রুপয়া দিন। যাহা চুক্তিপত্র তাহাই দরপত্র, দুজনকেই দিয়ে মালিক হাওয়া। দুজনেই দখল নিতে এলে থার্ডপাটি, প্রায় ক্ষেত্রেই ভাটার কোম্পানি, পহেলবান লাগিয়ে দুজনকেই ভাগিয়ে দেয় পেপারউপার ছিঁড়েছুড়ে—রবিয়া যেমনটা  করলো মাতলুদের। কোলিয়ারি মালিকের; জমিদারের তো জমি। কোয়াটার যেমন শ্যামলালের না, ইসিএলের। হিস্টরি রিপিটসের মতো মালিক কতবার ভেগেছে টাকা মেরে, লেবাররাও কয়লা তুলে ঘরে এনেছে; মালিক বৈঠল বৈঠল...
পদ্ধতিগতভাবে কোয়াটার বিক্রি-রিটার্ন কর্মসূচি খুব সাফল্য পায়নি যতটা জনসমর্থন পেয়েছিল খাদান-প্রোজেক্ট। সরাসরি রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষ বলে সংবাদপত্রেরও ভূমিকা ছিল। আসানসোল-দুর্গাপুর-রানিগঞ্জ পাতায় আনন্দবাজারের প্রতিক্রিয়াশীল সাংবাদিক রাষ্ট্রের হিত করতে গিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানারই জয়গান গেয়ে ফেললো, সিটুর মূল্যায়ন। এটি একটি পেইড নিউজ। নরসিংহ রাওয়ের সর্বার্থসাধক মুক্তবাজার অর্থনীতির মুখড়ার পরপরই দ্য হিন্দু পর্যন্ত ফ্রন্ট পেজে নিউজ মেরে দিল বেসরকারি ক্ষেত্রের উৎপাদন সরকারি ক্ষেত্র থেকেও বেশি; ফলত উৎসাহজনক। গোঁফে তেল লাগিয়ে কেলে সিং, রাজু ঝাঁ, জয়দেব মণ্ডলদের পূর্বপুরুষেরা ইললিগাল কোল কিংপিনসদের পয়দা করে যাবে এরপরই; প্রেসিডেন্ট অব চেম্বার অব কমার্স বাতলাবে কয়লা সর্টেজের একমাত্র দাওয়াই "Serious privatization of coal sector." ঠিক তারপরই কোল ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা শ্যাম-রবিদের পিঠ চাপড়ে বাহাবা দিল পাওয়ার প্ল্যান্টকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য "Continue to import more coal in order to meet their demand from illegal mines."
অতি উৎসাহে যা হয় কিম্বা অতি ভক্তে। জলেজঙ্গলে যেদিকে যাও কপিকলের রিনরিন আওয়াজ আর রশিটানার পদশব্দ, এই কয়লার পব্বত এই লেবেল। এমন পিকপয়েন্টে ফির আনন্দবাজার। আসানসোল-দুর্গাপুর-রানিগঞ্জ পেজ রাষ্ট্রের হিতে : সচিত্র খাদান সংবাদ। সাঁই সাঁই পুলিশগাড়ি, তার উপর বর্ষা, তার উপর ধর্ম। শ্যাম-রবিয়া ত মাফিয়া নয়, খুনখারাবিও করে না, পিস্তল দূরে থাক ছুরি পর্যন্ত নাই! ফুট কতক নিচে ইঞ্চি কতক কয়লায় তাদের অধিকার, কয়লা আবিষ্কারের আগে থেকেই। তাও ছিনিয়ে নেওয়ার মন্ত্রণা দিল আনন্দবাজার।
যখন গাঁড় মারিয়েছ, সতী সেজে লাভ কি? চৌরাশিয়া মার্সেলি ট্রাক দেখিয়ে বলে, ডেলি দুট্রাক মাল দে, পুলিশটুলিশ হামলোক দেখেগা। পোটাকশন তোহরা, ডেলিভারি হামারা।
শ্যামলাল আপত্তি করে : তুমি শালা চোদো, আমরা খিঁচাই। পুলিশ রুপয়ার । মাল যাবে বয়েলগাড়িতে। খায়েগা ত বাঁটকেই খায়েগা।
—তবে ল্যবড়া চুস! 
শ্যামলাল জানে না পর্যন্ত, তাদের পোঙায় ফির বাঁশটি দিয়েছে ২০ জুন ২০১২-র টেলিগ্রাফ : "Inferno engulfs Coal zone" হেডিংটি। সব ধুলোকে সাফ করে সিআইএসএফ আর বেঙ্গল পুলিশ আগে আগে ড্রোসার নিয়ে rat holeগুলিতে মাটি ফেলে বেকার করে দিল। জাতীয় রাজনীতির চরিত্র অনুযায়ী পারস্পরিক দোষারোপ আর অন্যের মাথায় দোষ দেওয়ার ভারতীয় প্রথায় ইসিএল ব্রিটিশদের, কংগ্রেস বিজেপিকে, বিজেপি জওহরলালকে, টিএমসি ৩৪ বছরকে, ৩৪ বছর টিএমসিকে, বাকিটা রাজ্য বিজেপিকে—এ কোট ও কোট না কোট করে দিল রবিয়াদের।  শ্যাম- রবিদেরও জাহাজের খবরে কাজ নাই। খাদান চলে গেল আরও দেহাতে। বঙ্গোপসাগরের লাগাতার ডিপ্রেশন পেটের ভাতটুকু ছিনিয়ে নিলে শ্যাম-রবি নতুন পথ খোঁজে। ততদিনে ওসিপির নোনা জোয়ার মহল্লা-বৃক্ষ-কয়লা তিনটিকেই উৎখাত করার যন্ত্র নামিয়েছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিলে ঢোকার মুখে খ্যাচরম্যাচর আওয়াজ শুনে শ্যামলাল ভিড়ের মধ্যস্থলে রোরুদ্যমানা নতমুখ একটি কামিনকে মধ্যে রেখে হেডক্লার্কের কলার পাকড়ে দুটো মাতালের ধুড়কিবাজি দ্যাখে। ইজ্জতহানি কেস।
—আভি ডেমারেজ দো! 
—হাম টাচ্ ভি করি নাই... 
—ভোসড়িবালে! ততক্ষণে চড়চাপড় পড়ে গেছে। হাওমাও করে কেঁদে ওঠে বুড়োধাড়ি : বিশবাশ  করো...
—আভি পুলিশ বুলাও! 
জোড়হাতের বুড়োধাড়ি নিজেই কানমলা খায় : মোলেশস্টেশন কেসে ফেকো না বাপ... মানইজ্জত বলে একটা কথা আছে...
—পচাশ হাজার ডেমারেজ দেনাই হোগা!... 
আরও কি সব বাতবাতিয়া থেকে রবিয়া টেনে নেয় শ্যামলালকে, আপাতত গন্তব্য ব্রিটিশ কাউন্সিল। আধঘণ্টার ব্যবধানে নিজ নিজ নিকেতনে নিজ নিজ বউয়ের মুখোমুখি হয়ে নিজ নিজ বক্তব্যের মতো যৌথ মন্ত্রণা উপস্থাপিত করে দুজনে : না মারিয়ে বেহত্তর ইনকাম... বুঝলি?
—মারলেই কি, মারুক! যেই মারুক, নিজের মাল নিজের কাছেই রাখছে। শুখা কেস! শ্যামলালের পঞ্চমতম গৃহিনীর উন্নত মেধা, স্তনের ভাঁজে রাখা কনডোম দেখায়। 
ঝাড়াঝাড়ি হয়েছে বোধহয়, রবিয়া বউকে নিয়ে ঢোকে : ভাবির বাত শোন। টাচই হচ্ছে না, ত ইজ্জতহানি! কেবল হাওমাও করবি, রিটান হবি, ব্যাস! চম্পাকে বোঝায় চামেলি। লোকার্নো সেক্স ক্লাবের অভিজ্ঞতা ঝাড়ে : পুঁজি আছে বাজারে ফেক মাগি!
চম্পাচামেলি পার্টি যাবার সাজে সন্ধ্যা ৯টার লোকালে শ্যাম-রবির হাত ধরে গেল আসানসোল, ফিরল ১১টায়।
সবাই বললো, বেশ্যাগিরি।
শ্যামলাল বলল, সতীলক্ষ্মীগিরি।
রবিয়া ব্যাখ্যা করলে, এটা আসলে ইজ্জত রক্ষার কারবার।
নিজের নিজের ইজ্জত রক্ষায় আপাতত দু সতীলক্ষ্মী দুদিকে; যেখানটায় গাছ বেশি, স্ট্রিট লাইট অকেজো-দরুন অন্ধকার, দূরে হেডলাইট, সামনে স্পিড ব্রেকার, গাড়ির গতি কম, অসহায়ার হস্ত আন্দোলন, মানবিক আবেদনে সাড়া দেওয়া—ঠিক তারপরই ইজ্জত-রক্ষার আর্তনাদ; অসহায়া  নারীর পাশে সমাজসেবী পুং; 'ক্যা হুয়া, কৌন হ্যায়' বলার আগেই ভাগ্যবিড়ম্বিত পরোপকারী মোটরসাইকেল চালক লহমায় প্রলেতারিয়েত। কিম্বা ডিক্লাশড্।
শ্যাম-রবির মিশনের পঁদ খাল করে দিল এবার লোকাল নিউজ পেপার। "দৈনিক লিপি"। 'আসানসোলে রাত দশটার পর অভিনব কায়দায় বাইক আরোহীদের সর্বস্ব লুট করছে মহিলারা'— এমন পোঙামারা হেডলাইন দিলে মহিলারা ইজ্জতরক্ষা না করে ইজ্জত হারাতে থাকবে, তখন শালা সাংবাদিক? তুমি গাড়িওলাদের হিত দেখছো, গাঁড়ওয়ালির হিত দেখবে না?

হাওয়া বলছে এমন বেকার সময়ে ভোট এসে গেছে। রাস্তায় যে দলটার মিছিল জাবদা, বুথে পুলিশ যাদের খাতির-আত্তি করে, শ্যাম-রবি তাদের দলে। শ্যামরবির দলবদল সচিত্র-নিউজ হতে পারে; উঠতে বললে ওঠে , বসতে বললে বসে—এমন একটি অসহায় সংঘ আছে তাদের। যে-কোনো দল  করার কিম্বা পতাকা বহন করার নৈতিক অধিকার আছে শ্যাম-রবিদের—তারা প্রকৃত  প্রলেতারিয়েত। দারিদ্র তাদের সম্পদ, দরিদ্র দলেরও সম্পদ। দল লহমায় সম্পন্ন হয়ে যায়। গাঁড়চোদারা অ্যাকশানেও মাহির, সমর্থনেও উদ্দাম, দলত্যাগেও নৈতিক। গরিবি হঠাওতেও, মহান জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে, উন্নয়নে, আচ্ছে দিনেও তারা গিনিপিগ।
গত দুটি ইলেকশনে শ্যাম-রবি যারপরনাই পর্যুদস্ত। ভরপেট মাংস পোলাওয়ের পর মেজাজ শরীফের আরক টেনে, বেলা তখন আড়াইটে, শ্যাম-রবি চললো বুথে। লোকাল লিডার ধমকে ওঠে :এই বাঞ্চোত, বস! ভোট না দিয়েছিস ত পদ্মতে মারে আয়।
—ছাপ্প ভোট?  
লোকাল লিডার পোঙায় তুলাভরা সিগারেট ছোঁড়ে : কোই জরুরত নেই। ফ্রেস পোলিং হোনে দো।
—তবে বাল জিতবে! 
—ছাপ্পা ভোট সিপিএমের জমানায় হতো... জনগণের আশীর্বাদে...দিদির অনুপ্রেরণায়... 
—আমাদিকে সিপিএম শিখাবি না। সিপিএমের বাল সাফ করে আভি টিএমসি। 
—তবে ত এসপাট তোরা!...আভি টিএমসির বাল তোড়। 
চারিদিকে একটোর গায়কদের মতন বাবুল সুপ্রিয়, গায়ক যখন, জিতে গেল। আসানসোলের প্রেস্টিজ পাংচার করে দোলা সেনও রাজ্যসভায় এমপি, শ্যাম-রবিও ঝুঁকে গেল বিজেপির দিকে।
মরবি তো মর একটা দশাসই বাঁদর হঠাৎ ট্রেন ও বাসের যুগ্ম চক্রান্তে দিকবিদিক ঠিক করতে না পেরে বিজলির তারে বাঁদরবাজিতে অমরধাম যাত্রা করলো শ্যামলালের চোখের সামনে। সেই মৃতদেহ, শ্যামলাল ও তার সঙ্গীসাথীরা সারা মহল্লা ফুল ও জয় শ্রীরামজি চিৎকার অন্তে নিয়ে এলো যুগীধাওড়ার মাঠে, যেখানটায় এক দেহাত-বিহারি ক্ষেতি করে পেট চালায়, সম্প্রতি একটি সেকেন্ডহ্যান্ড টেম্পুর মালিক, তার মাঝলাবেটা শ্যামলালের কাছেও ভাড়া আদায় করেছে—সেই  জমিটার মাঝখানটায় গোর দিল রামলালার চেলাকে। টেম্পুর ভাড়া লে বাঁড়া! দশদিন চলল রামনাম, ক্ষেতির গুষ্টি তুষ্টি। বাস আটকে চাঁদা, স্বেচ্ছায় বাহুবলে গৃহস্থ পথচারীর দানখয়রাতের মোচ্ছব আসানসোল পর্যন্ত পৌঁছালে শোকসভায় প্রথমে এলেন টিএমসির নেতা। নিজের দলের চেলাদের ডেকে বললেন, বিজেপি করা হচ্ছে?
—রাম কি কারো বাপের, না হনুমান কারো দাপের? 
বিজেপির ঝান্ডা বিনাই জয় শ্রীরাম—সিপিএমের মতে কালিপাহাড়ির বিজেপি-অনুপ্রবেশ  টিএমসির মদতেই।

সেই শ্যামলাল, সারদা-নারদার ঝাপটায় শুনশান সিপিএম অফিস যখন জেগে উঠছে, লোকজনও ভালো হচ্ছে মিটিং মিছিলে, মার্কসবাদের ভারে গম্ভীর কমরেডের সমীপে শ্যামলাল বলল, আমরা সিপিএম।
—জানি তোমরা ভুল করে চলে গেছলে। সর্বহারার শেষ আশ্রয়... 
—ভুল আবার কি বাঁড়া? সব ঠিক। বলতে দিলে তো কমরেডকে, পদনা টেবল থাবড়ায়, আজ  থিকে ক্যালা আমরা সিপিএম। সোবাই। জিন্দাবাদ! ইনকিলাব!!
পার্টি অফিসেই বিপ্লব হয়ে গেল ছোটামোটা।
মিছিলের আগে আগে সবচেয়ে বড়ো ঝান্ডা নিয়ে শ্যামলাল, সবচেয়ে জোরে জিন্দাবাদ হাঁকায় রবিয়া। প্রায় মুখ্যমন্ত্রি হয়ে গেছে গণশক্তির পাতাজোড়া সূর্যকান্ত। ভোটের ফলে দেখা গেল দিদি একাই একশো। শ্যামলাল ফির টিএমসি। বিজয় মিছিলে আবির মাখা রবিয়া নেতার কাছাকাছি, শ্যামলাল পাশে : হাম পহলেই ভবিষবাণী কিয়ে দিদিই জিতেগা।
—তুই এঁড়ের গ্যাদে জ্যোতিষ... ডরে ফির হামলোককা সাথ! 
—ডর বোলকে কোই চিজ হ্যায়ই নেহি ইন্ডিয়ায়। দিদি... 
—তুই বালের ইন্ডিয়ার কি জানিস? 
—জানি নাই? উসবার বাস লিয়ে মথুরা বিন্দাবন অযোধ্যা ... কোন গিয়ে? 
—ফির বিজেপি বাঞ্চোৎ! 
—সরি সরি! শ্যামলাল লজ্জিত হয়, যারপরনাই। 
শ্যামলাল এখন কর্পোরেশনের সাফাইকর্মী, রবিয়া একটু বাবুগোছের বলে ট্রাফিক ভলেন্টিয়ার পুলিশ। দুজনেই ভেতরে ভেতরে বড়ো অশান্ত। নির্বিবাদ জীবন চে-রও পছন্দ ছিল না। রাইফেল তুলে নিয়ে বেঘোরে মরাও শান্তি। বেঁচে থাকার ইয়ার্কিতে শ্যামলাল ক্রুদ্ধ, রবিয়াও ক্রুদ্ধ। কতবারের দেখা, তবু এই প্রাচীন পিলারটি, বুকে ১৮৮৭, একদা ধোওয়া ওড়াতো, ক্রুদ্ধ শ্যামলাল লক্ষ্য করলো একটি ইঁট খসে পড়ে গেছে। ইঁটটি পাতলা, ধারে ধারে শতাব্দী প্রাচীন ক্ষীণ চুনসুরকি, শতাব্দী প্রাচীন কোনো বিলুপ্ত পাখির গুয়ের আরো ক্ষীণ অবশেষ-চিহ্ন, ঠিক বাবরি মসজিদের ইঁটের ন্যায়। পান্ডেবাবুদের কাচবন্দি চমকিলা শো-কেসে একটি ইঁট বড়ো সমাদরে রক্ষিত। রবিয়ার বউ পান্ডেদের ঘর মোছার কার্যক্রমে শো-কেসটি মুছতো এবং এই রকম মোছামুছির মধ্যে সে মালকিনির কাছে জানতে চায় ইঁটটির ইতিবৃত্তান্ত। গর্বিত মালকিনি ইঁটটিকে প্রণাম করে জানায়, যাঁহা রামলালাকা মন্দির বনেগা, ইঁটা ওহিকা মসজিদকা। পান্ডেজি খুদ্দে তোড়কে লায়ে।
বড়ো সবিস্ময়ে রবিয়াকে বলে চম্পা : উ লোক পণ্ডিত, হিন্দুর ঘরে মসজিদের ইঁট? পরণাম ভি!
লহমায় শ্যামলাল খাড়াই টাওয়ারটিকে উত্থিত লিঙ্গ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারল না। মোরগ ছাড়া আর কোনো পাখির ডাক শুনতে পাবে না, মনে হল। নুনিয়া নদীর জল কেমন অনিচ্ছায় অন্য খাতে বয়ে যাচ্ছে কেঁদেকুটে, মনে হল। কুমারডিহার জঙ্গলটা কেমন দুখবুড়া শুকিয়ে যাচ্ছে, মনে হল।
যা ভাববার কথা নয়, মনে হওয়ার নয়, তাই মাথায় পুরে বহুদিন পর ব্রিটিশ কাউন্সিলে চিন্তিত মার্কস-এঙ্গেলস।
—বলছিস, সীতা মাইয়ার পয়দাথান তোড়ফাড় করে শালা আংরেজ—শালা খেরেস্টান?  
—তোড়ফাড় কি বে, সীতামাইয়াকে চুদে ফাঁক করে দিচ্ছে শালারা। বাঁড়ার খাড়াই দেখ! 
—তব? 
—উসকো তোড়না হোগা। 
—বহোত জাদা পিলার হ্যায়। কটা তোড়বি? নয়া নয়া পিলার ভি ত বনছে? 
—সুরুয়াৎ ত কর। 
—হাম দোনো সেকেঙ্গে? 
—মায়ের চোদন সইবি? শালা বেজন্মা হবি? 
রবিয়ার কলার ধরে ঝাঁকায় শ্যামলাল, সইবি? বল? সইবি?
বেবাক থাকে রবিয়া কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ উঠে হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে চিৎকার করে : চোদনা পাটি দূর হটো। ওসিপি নেহি চলেগা, নেহি চলেগা। সীতামাইয়া জিন্দাবাদ!
দুটি পিয়ক্কড় লাফান্ডু, প্রায়শই যা করে, উদমা চিৎকারে পথ ভাঙছে : 
বালের টাওয়ার তোড় দো
তোড় দো তোড় দো
সীতামাইয়াকে চোদে কৌন
ওসিপি আবার কৌন *
* ওসিপি : ওপেন কাস্ট প্যাচ


 কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

menu
menu