ছায়া ও ছবি

স্বপ্নে তাকে দেখে কতবার যে ধড়ফড় করে জেগে উঠেছি, তার কোনো হিসেব নেই। সেই ফুলঝুরি বুবু কীনা জলজ্যান্ত আমার চোখের সামনে আজ। মাল্টিপ্লান সেন্টারের ঢোকার মুখেই আমাকে থামিয়ে সে বলল, 
‘দেখি, আপনার ব্যাগ চেক করবো।’ 
ইলেকট্রনিক শকড লাগায় মতো লাফিয়ে উঠলাম। তোতলাতে তোতলাতে বললাম, 
‘আ…প নি। মানে বুবু তুমি।’ 
‘কি অবাক হয়েছিস, তাই না? ঠিক আছে উপর থেকে ঘুরে আয়। তোর সঙ্গে আলাপ আছে।’ 
দক্ষ হাতে কথার ফাঁকে ফাঁকে ব্যাগ চেক করে ফুলঝুরি বুবু। আমি কাচুমাচু হয়ে ঘাড়টা একটু নিচু করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
ফুলঝুরি! যার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় ফারুক ভাইয়ের বরাত দিয়ে। খুব ছোট তখন আমি। নতুন নতুন গোঁফ গজিয়েছে। সঙ্গে লজ্জাও। কেউ কিছু বললেই লজ্জায় মাথাটা নিচে নেমে যেতো। সবকিছুতে শিহরণ জাগার বয়স। ফারুক ভাইয়ের পাহারাদার সেজে ফুলঝুরি বুবুদের বাড়িতে যেতাম প্রায়ই। একবার হলো কী, ফারুক ভাইয়ের একটা চিঠি দিতে গেলাম।ফুলঝুরি বুবু আমাকে দেখে সে যে কী চনমন করে উঠল। আমাকে জড়িয়ে ধরে তার বামস্তনের একটা কোমল ঘষা দিয়ে বলল, 
‘একথা খবরদার কাউকে বলবি না।’ 
কুমড়ো ফুলের মতো লজ্জায় নুইয়ে পড়েছিলাম তার আঁচলের নিচে। পুরো গা থরথর করে কেঁপে উঠেছিল সেদিন। এক দৌড়ে বাড়িতে এসে বালিশে মুখ গুঁজে শুষে নিয়েছিলাম ফুলঝুরি বুবুর শরীরের সবটুকু গন্ধ। বালিশ ও ফুলঝুরি বুবু দুটোয় একাকার। আলাদা করার প্রয়োজনও মনে করিনি। সুঠাম দেহের ফুলঝুরি বুবুকে আজ আরও সুগঠিত লাগছে। পোশাকটাতেও মানিয়েছে বেশ। কেমন দারোগা, দারোগা। মনটা আকুপাকু করছে। এখানে সে কেমন করে, কীভাবে এলো? সেইসব গল্প না জানতে পারলে পেটের ভাত হজম হবে না আমার।  
ব্যক্তিগত কিছু কাজ সেরে তাড়াতাড়ি লিফট বেয়ে শো করে নিচে নেমে এলাম। এসেই দেখি বুবু নেই। মুহূর্তে বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। এদিকওদিক হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম। একটার পর একটা অতীত ঘটনার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম আমি। এক চুঁইয়ে পড়া জোছনা রাত্রিতে ফুলঝুরি বুবুকে আমি ডেকে এনেছিলাম সরিষা ক্ষেতে। একপেয়ে একটা তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল ফারুক ভাই। তারাবিস্কুট ও বাতোসার লোভ দেখিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে আনা হতো প্রায়ই। তারপর ফুলঝুরি বুবুকে পেয়ে আমার হাতে ওগুলো ধরিয়ে দিয়ে ফারুক ভাই বলতো, ‘তুই যা, ক্ষেতের ওই ধারটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। কাউকে আসতে দেখলে ‘কু’ বলে ডাক দিবি।’ আমি বাধ্য ছেলের মতো তাই-ই করতাম। ফজরের আযান পর্যন্ত তারা গল্পে গল্পে সময় পার করতো। ওদিকে আমার কাহিল দশা। ঘুমিয়ে যেতাম আইলয়ের উপর মাথা রেখে। 
সরিষা ফুলের গন্ধে স্বপ্নে চলে যেতাম হলুদ পরীর দেশে। ঘুম ভাঙতো ফারুক ভাইয়ের ডাকে। টলতে টলতে দুজন বাড়ির দিকে হাঁটতাম। রূপকথা গল্পের রাজপুত্তের মতো দেখাতো ফারুক ভাইকে তখন। ওড়নায় মুখ ঢেকে এক দৌড়ে পালিয়ে যেত ফুলঝুরি বুবু। তাকে তখন হলুদ পরীর মতো লাগতো। যেন ডানা গজিয়েছে সদ্য। সরিষা ফুলের ডানা লাগিয়ে ফুলঝুরি বুবু উড়ে যেত চোখের সামনে দিয়েই। রাজ্যের কাড়িকাড়ি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম তার উড়ে যাবার দৃশ্য চোখে ধারণ করে। হাসিহাসি মুখ নিয়ে ফারুক ভাই বলতো তখন,
‘কাজ শেষ। চল্ এবার।’
পেছন থেকে ডাক দিল ফুলঝুরি বুবু। চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। সে আর আগের পোশাকে নেই। হাসতে হাসতে এসে আমার হাত ধরলো সে। আমার চোখে এখন শুধুই বিস্ময়! 
‘তুই তো অনেক বড় হয়ে গ্যাছিস রে। কেমন নাদুসনুদুস দেখাচ্ছে তোকে।’ অবিকল সেই আগের মতো হেসে হেসে বলল বুবু। 
প্রতিউত্তরে আমি, 
‘তুমিও তো কম যাওনি বুবু, কেমন চকচক করছে গালটা তোমার।’ 
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বুবু আমার হাত টেনে ধরে বলল, 
‘আজ তুই আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবি, বুঝলি।’ 
‘বাব্বা কী স্মার্টভাবে কথা বলছো বুবু।’ 
‘আরে ঢাহায় থাকি বলে কথা।’ 
বলেই গায়ের ওপর ঢলে পড়ে ফুলঝুরি বু। আজ প্রায় তের বছর পর তার সঙ্গে আমার দেখা। বুবুর চোখ-মুখ চনমন চনমন করছে। আকুপাকু লাগছে আমারও। অনেক কালের কথা জমে আছে ভেতরে। ১ বছর, ২ বছর, ৩ বছর নয়, তেরোটা বছর মস্তিষ্কে গেঁথে আছে ফুলঝুরি বুবুর রোমাঞ্চেভরা স্মৃতি। আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো একটার পর একটা পর্দা ভেসে ওঠে। সরিষা ক্ষেত, ন্যাড়া তালগাছ, ফারুক ভাই। পলিথিনে প্যাচানো একটা প্যাকেটে লাঞ্চ নিয়ে আমাকে ডাকল সে, ‘নে চল, শুরু করি। এই খাবার দুজন ভাগ করে খেতে হবে। কি পারবি তো ?’ ‘হু...হুম। খুব পারবো।’ 
টিফিন বক্স থেকে খাবার বের করে বুবু। আমার চোখদুটো তখনো তার মুখের দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি তাকে। এই অবস্থা দেখে বুবু আমাকে ধমকে দিয়ে থামায়, ‘আরে পরে দেখিস। আমি তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছি না। খাওয়াটা আগে শেষ কর।’ তাড়া খেয়ে আমি খাওয়া শুরু করি। খাওয়ার একফাঁকে ফুলঝুরি বুবুকে জিজ্ঞেস করি, ‘বুবু ফারুক ভাই কেমন আছে?’ বড় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বুবু। চোখ তার ছলছল করে ওঠে। আমি পুনরায় তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস করলাম না। কিছু সময়ের জন্য কারও মুখে কোন কথা বের হল না। খাওয়া শেষে বুবু বলল, 
‘আজ আর ডিউটি করতে ভালো লাগছে না। চল, বাড়ি যাই।’ 
আমি যেন এক জাদুকরি আয়নায় বন্দি হয়ে আছি। না-হ্যাঁ করতে করতে বুবুর সঙ্গ নিলাম। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে বুবু সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলল। এই এক ঘণ্টা একগাদা স্মৃতির ভেতর হাবুডুবু খেতে খেতে সময় কখন ফুরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। মার্কেটের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে সায়েন্স ল্যাব থেকে একটা রিকশা নিয়ে উঠে বসি আমি ও বুবু। রিকশায় উঠেই রাজ্যের সব কথা খলবলিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। একে একে গ্রামের সবার কথা আগ্রহভরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় বুবু। বড্ড অভিমানী মেয়ে। এতোবছর হয়ে গেল তবু সে গ্রামে ফিরল না। অথচ গ্রামের প্রত্যেকের নাম মনে রেখেছে। আমার দাদি মারা গেছে শুনে খুব কষ্ট পেল। 
‘আহারে তোর দাদির হাতে বিচিকলা রান্না যে খেয়েছে, সে জিন্দিগিভর মনে রাখবে।’ 
একেকজনের কথা উঠছে আর ফুলঝুরি বু’র চোখ একই সঙ্গে জ্বলজ্বল ও ছলছল করছে। এভাবে বকবক করতে করতে একসময় রিকশা থেমে যায়। রূপনগর আবাসিকের ২১ নম্বর রোডের পেছন দিকের বস্তিটাতে থাকে ফুলঝুরি। টিনের ছাপড়া দিয়ে ঘেরা একটা ঘরে নিয়ে যায় আমাকে। দরোজাটা ঠেলা দিয়ে ঢুকতেই ফারুক ভাইকে দেখে ফুলঝুরি বুবুকে দেখার থেকেও দ্বিগুণ চমকে উঠি। হুইল চেয়ারে বসে আছে ফারুক ভাই। আমাকে দেখে প্রথমে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি নিজেও কাঁদতে লাগলাম ফারুক ভাইয়ের বুকের মধ্যে।সঙ্গে ফুলঝুরি বুবুও। আমাদের কান্না দেখে পাশের বাড়ি থেকে লোকজন এসে জিজ্ঞেস করে,
 ‘কী হয়েছে রে ফুলঝুরি। এতো কাঁদছিস কেন? ছেলেটা কে?’ 
আমি নির্বাক। মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘এ কী হলো বুবু? কেমন করে হলো?’ কান্নাভেজা কণ্ঠে বুবু বলল, ‘আমরা যখন ঢাকাতে দু’জন পালিয়ে এলাম। তার দুই দিন পরেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হলো। আমরা উঠেছিলাম গুলিস্তানের এক হোটেলে। তো তোর দুলাভাই বলল, বিশাল বড় একটা জনসমাবেশ হচ্ছে। যাই একটু জননেত্রীকে দেখে আসি। বঙ্গবন্ধুকে তো আর দেখিনি। আমার বহুদিনের শখ তাঁর মেয়েকে দেখবো। বলেই হোটেল থেকে বের হয় সে। তারপর বুঝতেই তো পারছিস। বুবু জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। কান্না থামলে সবকিছু স্বাভাবিক হলে আমি ফারুক ভাইকে বললাম, 
‘আচ্ছা ভাই, তুমি ইচ্ছে করলে তো দল থেকে সাহায্য নিতে পারতে? কতলোক এভাবে বড় লিডারও হয়ে যায়।’
ফারুক ভাই হাসতে হাসতে বলল, ‘ধুর পাগল! আমি কি দল করি? আমি তো গিইলাম জননেত্রীকে দেখতে।’ 
এমন এক সাদাসিদে সহজ সরল মানুষকে দেখে ভেতরটা কেমনজানি নরম হয়ে ভিজে ওঠে আমার। 
কল্পনার পালা খতম। এবার গল্পের মূল জায়গায় আসি। ফুলঝুরি বুবুর সঙ্গে অ্যালিফেন্ট রোডে মাল্টিপ্লান মার্কেটে ১৩ বছর পর দেখা। সেখানকার চেকার সে। এখানেই দাঁড়িয়ে পড়ুন। তারপরের বিষয়গুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। তবে হ্যাঁ, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথাটা মাথায় রেখেন। গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে গুলিস্তানের পাশেই জনসভার কাছাকাছি এসে জননেত্রীকে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করে না ফারুক ভাই। কিন্তু গ্রেনেডের আঘাতে বাম হাতটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার। কিন্তু ভাগ্য তার ওপর যেন রহমতের মতো বর্ষিত হয়। অনেক নেতার ভীড়ে তাকেও নেতা হিসেবে মেনে নেয় দলের লোক। সেও সায় দেয় তাতে। এরপর সিনেমার মতো বদলে যেতে থাকে তার জীবন। পুনর্জন্ম ঘটে তার। ফুলঝুরি বুবুকে মুছে ফেলে জীবনের ব্লাকবোর্ড থেকে।এমন কী তার অতীতকেও। সবকিছু অস্বীকার করে সে। তরতর করে সাফল্যের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে পড়ে সে।নিয়মিত টিভিতে টকশো করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। গ্রামের লোক হাজার চেষ্টা করেও তার নাগাল পায় না। গ্রামের সবার কাছে সে এখন বেঈমান ফারুক নামে পরিচিত। আর দলের লোকের কাছে সাধারণত কারও অতীত তেমন বিবেচ্য বিষয় নয়। 
আমিও তার কাছে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। কিন্তু মনে মনে ফুলঝুরি বুবুর কথা প্রায়ই বুকে খচখচ করে বাজতো। সেই বুবুকে পেয়েছি আজ। তাই ভাবলাম গল্পটা বলার সময় এসেছে। তবে হ্যাঁ, বেঈমান ফারুকের সঙ্গে আমার শেষ দেখাটার কথা বলে গল্পটার ইতি টানবো। কোন এক হরতালের দিন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। আমি লেক পার হয়ে রাস্তায় উঠতে যাবো ঠিক তখন দেখি একট মিছিল আসছে। সাদা পাঞ্জাবি গায়ে ফারুক ভাইকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম তার অবশিষ্ট ডান হাতে রিভলবার। এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে সেখান থেকে। এইমাত্র সে একজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়াতে পাশের চামচাকে বলল, চল্। কাজ শেষ। মাথার মধ্যে ধাঁ ধাঁ করে ফ্লাসব্যাক হতে হতে ১৩ বছর আগে ফিরে গেলাম আমি। সেই ভোরবেলা। সরিষাক্ষেত। একপেয়ে তালগাছ। আমার চোখের সামনে থেকে গাড়ি স্টার্ট নিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। একটু দূরে ককটেল ফোটানোর ধোঁয়ার মধ্যে দেখি, হলুদ শাড়ি পরে হাসতে হাসতে ফুলঝুরি বুবু উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আর আমাকে যেন বলছে, একথা কাউকে বলিস না যেন।


মিলন আশরাফ, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক, ঢাকা

menu
menu