একটা দুপুর মরে গেল

(দিব্যপ্রকাশ থেকে মাসুম বিল্লাহ-র প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ একটা দুপুর মরে গেল। তিনি হুজুকের লেখক নন। লেখাটা তাঁর যাপনের অংশ। আলোচ্য গল্পগ্রন্থের একটি গল্প ‘পারাপার’ ঘুংঘুর-এর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।)

পারাপার 

মাঝরাত্তিরে লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। মানুষের যখন বয়স বাড়ে, তখন ঘুম কমে। ঘুমের জন্য প্রাণপণ কাঁকুতি-মিনতি চলে রাতভর—আয় ঘুম আয়...! ঘুম আসে। ঘুম ভাঙে। ভোর আসে। রোদ হাসে। আবার রাত আসে...। আসছে পউষে তার বয়স সত্তর ছোঁবে। লোকটা ঘুম ভেঙে হাঁসফাঁস করছেন। বিছানায় উঠেন বসে একটা দীর্ঘ শ্বাস নেন। জানালার কপাট খোলা, শীত-বর্ষা যা-ই হোক—জানালা বন্ধ করা চলবে না, দম বন্ধ লাগে তার। তার স্ত্রীর আবার ঠান্ডার ধাত, গরমের দিনে কলের জলে শরীরে ঝিঁ-ঝি লেগে কাঁপুনি লেগে মরবার দশা। কিন্তু বাঙালি নারী স্বামীর সংসারে সব সয়ে নেন, লোকটার স্ত্রীও সয়ে নিলেন। লোকটার এই মাঝরাত্তিরে মনে হলো জরীর মায়ের সঙ্গে বিয়ে না হলে কবে কোথায় ভেসে যেতাম! নইলে কোন মেয়ের ঠেকা পড়েছে বেশি বয়সের বর পছন্দ করে, তারে আদর-সোহাগ করে...লোকটির ঠোঁটে হাসি ফুঁটে ওঠে রাতের আঁধারে, তার মনে পড়ে বিয়ের রাতের কথা...
লোকটির এক অভ্যেস—মাথায় বিলি কেটে না-দিলে রাতে ঘুম হয় না। বিয়ের রাতে নতুন বউয়ের হাত ধরে কথাটা টুপ করে বলে ফেললেন। শুনে নতুন বউ খলখল করে হাসল মিনিট দশ। তিনি বেশ বেকায়দায় পড়ে গেলেন—বলদামি আর কাকে বলে! মনে মনে গাল দিলেন, নিজের পশ্চাৎপদ লাথি মারা গেলে তাই মারতেন! নতুন বউ চমকে দিয়ে তাকে কাছে টানলেন। বালিশে মাথা রেখে তার চুলে বিলি কাটতে শুরু করে দেয়। তিনি বালিশের সঙ্গে সেঁটে রইলেন। তারপর কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়লেন—টের পাননি। ঘুম ভাঙল মাঝরাত পেরিয়ে। 
কত বছর আগের স্মৃতি মনে করে ভালোলাগায় ডুবে গেলেন। পরক্ষণে বুকের ভেতর হাহাকার টের পান। মানুষের চিরদিন এক রকম যায় না। দুপুরবেলা স্ত্রীর হাতের সুন্দর রান্না খেয়ে মনে হতো স্বর্গে যদি বউয়ের হাতের রান্নার ব্যবস্থা করা যেত! 
যৌবনে বুকের নদীতে জোয়ার এলে ঝড় তুলে তবেই শান্ত হতেন, তারপর তার শরীরের ওপর হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যেত স্ত্রী।... তারপর সংসার বড় হল, মাথার বালিশ বাড়তে লাগল, স্বামী-স্ত্রীর ভালো লাগা-মন্দলাগার ধরণ পাল্টাল...একদিন নদী মরে গেল, মন জেগে রইল। তারপর একদিন আবিষ্কার হল—দুইজন দুই প্রান্তে, ঘর আলাদা, বিছানা আলাদা। দিনে রাতে সবার ভিড়ে তাদের দেখা হয়, টুকটাক কথা হয়, কিন্তু কথাগুলো ঠিক দুইজনের ভেতরের কথা নয়—সংসারের নিত্য প্রয়োজনের কথা। দিন কাটে সংসারের ফাঁদে। রাত এলে বড় নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরে তাদের দুইজনকে। দুই বিছানায় ছটফট করেন তারা। তারা কেউই মনে করতে পারেন না—একই বাড়িতে কখন, কীভাবে তারা আলাদা হয়ে পড়লেন! এটা কী তাদের ইচ্ছায়, নাকি ঘরের অন্যদের চাওয়ায়? ঠিক বুঝতে পারেন না স্বামী-স্ত্রী দুইজন। লোকটির প্রায় রাতে ইচ্ছে করে স্ত্রীর বিছানায় পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। আবছা আলো ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখটা দেখতে। একটু বাড়াবাড়িও ইচ্ছে হয়—টুক করে একটা চুমু খেতে। নিজের একমাত্র স্ত্রী, এক্কেবারে আপন, এতদিনকার চেনা-জানা; ভয়টা কীসের! তবু পারাপারে সাহস হয় না লোকটির। মনে হয়, দুইজনের মাঝে যে দূরত্ব সেটুকু পার হওয়া আর তার কপালে নেই। 
আজ রাতে ঘুম ভাঙার পর থেকে জানালার লোহার সিকে ঠেস দিয়ে এ সব ভাবনা ভেবে রাত ভোরের দরজায় নিয়ে এলেন লোকটি। এ সময় রাতের করিডোর ভেঙে একটা ছায়ামূর্তি তার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। তার বুক জমে গেল। অস্পষ্ট স্বরে বললেন, জরীর মা, তুমি! 
বিছানায় উঠেন এসে স্বামীর হাতে হাত রাখলেন স্ত্রী। কীরকম শিরশির করে উঠল লোকটির শরীর।


  মাসুম বিল্লাহ, কথাশিল্পী, সম্পাদক, ঢাকা

menu
menu