ডুবেছিল চাঁদ নিশিন্দা বনে

সালাম মাস্টার টিউশনি শেষ করে সাইকেলে প্যাডেল মারতে মারতে আসছিল নিশিন্দা বনের ভিতর দিয়ে। হঠাৎ কেচ করে একটা শব্দ হয়। সাইকেলে চেইন পড়ে গেছে হয়তো। সন্ধ্যার আলো নিভে গেলে এ বনে ভৌতিক ভয়ের মতো শূন্যতা নেমে আসে। শরীরের ভেতর কোন এক অজানা কারণে কাটা দিয়ে ওঠে। লোকজনের চলাচলের জন্য বনের মাঝখান দিয়ে সরু একটা রাস্তা বের করা হয়েছে। এ রাস্তা দিয়ে বড়জোড় রিকশা ভ্যান আর সাইকেল চলতে পারবে। পথিক তার প্রয়োজনে ঠিকি পথ এঁকে নেয়। দেখবেন পিঁপড়েরাও যখন দল বেঁধে হাটে তাদের হাটার ভিতরেও একটা শৃঙ্খলা লক্ষ করা যায়। হয়তো তারা তাদের প্রয়োজনে পথ এঁকে নিয়েছেন। সালাম মাস্টার সাইকেল থেকে নেমে চেইন লাগাতে থাকে। হঠাৎ কোন একটা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভেসে আসে কানে। পাখিটি উড়ে গিয়ে চালতা গাছের উপরে বসে। অন্য কেউ হলে হয়তো ভয়ে কোকিয়ে উঠতো কিন্তু সালাম মাস্টার দুই যুগ ধরে এই পৌনে এক কিলোমিটার দীর্ঘ বনের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করছে। প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন, ছাত্র-ছাত্রীদের এসএসসি পরীক্ষা থাকলে হয়তো অনেক রাতেও বাড়ি ফিরেন। বনের প্রতিটি পাতা, ঠেলা মাটি, কাটা ঝোপ, বুনো শেয়াল, গেছো ব্যাঙ, গেছো আলু, বুনো চালতা ফুল সব কিছু তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে আন্দোলিত করে অহর্নিশ। তাই সে তার গল্প, কবিতা, উপন্যাসে লেখে এই বনের কথা। বনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া হিজল নদীর কথা। এসব ভাবতে ভাবতেই তার চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে। হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার উনি লেখেন তার স্মৃতিময় নিশিন্দা বনের কথা। এ বনের নামেই যে গ্রাম, সে গ্রামের মানুষের কথা, তাদের হাসিকান্না, রোগশোক, বিবাহ আচার, সংস্কার, কুসংস্কার সবই লিখে যান তার দিস্তাখাতার পাতা জুড়ে।

আজ বৃহস্পতিবার। মেয়ে শানু বাবার জন্য ভাত নিয়ে আসে। আনাজী কলা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল করেছে। কিরে মা নানুমনি ঘুমাইছে? শানুর মেয়ে স্নিগ্ধা ওর বয়স ছয় বছর। ওর বাবা সৌদি আরব থাকে। শানুর শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেই গত হয়েছে তিন বছর আগে। দুই মাসের ব্যবধানে দুজনেই স্বর্গযাত্রী হয়েছেন। শ্বশুরবাড়িতে আছে দেবর আর দেবরের বউ। বনিবনা হয়না তাই বাবার কাছে এসে থাকা। শানু স্টিলের থালায় ভাত বেড়ে দিচ্ছেন। চামচ আর থালের যোগাযোগে ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে । হ্যাঁ ঘুমাইছে। দেখ কী কাণ্ড করছে তোমার পাগলি নাতনি। কী করেছেরে মা। ছুলুম করে ভাতের লোকমা মুখে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে সালাম। তোমার জন্য একটা কাচের বোয়ামে কী ভরে রাখছে দেখো। সালাম হাসতে হাসতে বলে কী ভরে রাখছে? তোমার নাতনি তোমার মতোই পাগল হয়েছে। বিছানার কাঁথাটা সরালেই দেখতে পাবে। বলছে নানা ভাইয়ের জন্য সারপ্রাইজ। তুমি নিজে কাঁথা সরাবে। সালাম হাসতে হাসতে বলে আচ্ছা ঠিক আছে খাওয়া শেষ করি।

সালাম খাওয়া শেষ করে বৈঠকখানা থেকে শোয়ার বিছানার কাছে যায়। বিছানার উপরে কাথামুড়ি দিয়ে আছে একটা কাচের বড় বয়াম। কাথা সরাতেই সালাম দেখতে পেল বয়ামের ভিতর প্রায় শ’খানেক জোনাক পোকা জ্বলজ্বল করছে। যেন আস্ত একটা নিশিন্দা বন পুরে দিয়েছে এই বয়ামের ভিতর। সালামের গোফগুচ্ছ জ্বলজ্বল করে উঠে জোনাকির আলোতে। বোয়ামের মুখায় ছোট একটা ছিদ্র করা আছে সে ছিদ্র দিয়ে একটা একটা করে প্রবেশ করানো হয়েছে জোনাকি পোকা। সালাম মাস্টার মিটি মিটি হাসে আর তার শৈশবের কথা ভাবে। সেও ছোটবেলায় এভাবেই বয়ামের ভিতর জোনাকি পোকা ধরে ধরে আটকে রাখতো। তবে আজ কেন যেন তার এ জোনাকি পোকাগুলোকে মুক্ত করে দিতে ইচ্ছে করছে। সে ঘরের বাতি নিভিয়ে জোনাকি পোকাগুলোকে ছেড়ে দেয়। মনে হচ্ছে সারা ঘরেই নেমে এসেছে এক অসীম গ্যালাক্সি। তার মনটা আনন্দে নেচে উঠছে যেন। আজ রাতে হয়তো গোটা পাঁচেক কবিতা হয়ে যেতে পারে। হয়তো আগামি সপ্তাহে কোন সাময়িকীর পাতায় তার নাম চলে আসবে—কবিতা নিশিন্দা সমাচার, নিচে নাম—সালাম মাস্টার। 

দুই
ঢাকা থেকে সালাম মাস্টারের কাছে একটা ফোন এসেছে। ফোনের হেতু কী তা সহকর্মীরা ঠাহর করতে পারেনি। সালাম মাস্টার একটু চাপা স্বভাবের লোক। সবার সাথে যেচে গিয়ে কথা বলেন না, বাড়ির লোক ছাড়া। তাই তিনি কোন কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আগে থেকেই কাউকে কিছু বলেন না। সে খুশিমনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। সাইকেলের চাকা থেকে ক্যার ক্যার শব্দ হচ্ছে মবিল মারতে হবে। জনাব আব্দুল মতিন দৈনিক জনবাণীর সাহিত্য সম্পাদক। এ পত্রিকার সাহিত্য পাতার একটা সুনাম আছে সুধীমহলে। গত মাসে পাণ্ডুলিপি আহবানের একটা বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। যে পাণ্ডুলিপিটি সেরা হবে সেটির লেখককে দেয়া হবে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরষ্কার, সাথে ক্রেস্ট। ধারাবাহিকভাবে ছাপবে সেটি পত্রিকায়। বইমেলায় বই আকারেও প্রকাশ পাবে। বিজ্ঞপ্তি দেখে একটা এ ফোর সাইজের খাকী খামে ঢাউস সাইজের একটা পান্ডুলিপি পোস্ট করেছিলেন। আজ পত্রিকার অফিস থেকে কল এসেছে এজন্য তার খুশির অন্ত নেই।

সালাম মাস্টার বাড়িতে পৌছেই নাতনিকে কোলে নেন। নাতনিতে হাল্কা আকাশের দিকে ছুড়ে ছুড়ে খুনসুটি করেন। মেয়ে উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে বলে কী হল বাবা এত খুশি কেন? সালাম নাতনিকে কোল থেকে নামিয়ে বলে জানিস মা আমার পাণ্ডুলিপিটা সিলেক্ট হয়েছে। স্নিগ্ধা নানাকে বলে—তুমি কী অনেক টাকা পাবে? সালাম মাস্টারের কম্পিত গোফের আড়াল থেকে হাসিমুখে বলে হ্যাঁ নানু। কাল আমি ঢাকা যাবো বল তোমার জন্য কী আনবো। স্নিগ্ধা থুতনিতে আংগুল চেপে বলে এই বেশি কিছু না একটা পুতুলবউ, একটা হাড়ি পাতিলের সেট, একটা পুতির মালা, একটা ছোট্ট আয়না আর একটা রং কাঠপেন্সিলের সেট। শানু ঝাড়ুটা ঘরের কোনায় রাখতে রাখতে বলে—এতো কিছুর পরেও বলছিস বেশি কিছু না। সালাম পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে বলে একটা মাত্র নাতনি আমার নানার কাছে আবদার করবেনাতো কার কাছে করবে। মা তুই আমার ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবিটা একটু ধুয়ে দে। কলসি থেকে জগে পানি ঢালতে ঢালতে শানু বলে- বাবা ওটা ধোয়াই আছে। ভাজ করে বিছানার তলে রাখছি। 

আজকের রাতটা বোধ হয় পূর্ণিমার রাত। তাই বাইরে জোছনায় মৌ মৌ করছে। সালাম মাস্টার জানাল খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে ঘুম নেই। তবুও মনের অজান্তেই ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শুনে শুনে তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে স্বপ্ন দেখে সে নিশিন্দা বনের ভিতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। সাইকেলের সামনে বসে আছে নাতনি স্নিগ্ধা। সে বলে নানা তুমিই সেরা। চালতার গাছের পাতার ফোকর দিয়ে পেঁচাটা তাকিয়ে আছে। চারিদিকে মুহুর্মুহু হাততালির শব্দ। তাকে উত্তরী পড়ানো হচ্ছে, ক্রেস্ট দেয়া হচ্ছে, ডেমো চেক দেয়া হচ্ছে, তার হাতে মাইক্রোফোন। তাকে কিছু বলতে বলা হলো। সে অনেক চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলো না। হঠাৎ সাইকেলের চেইন পরে গেলো। সালাম মাস্টার ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বসলেন। তার সমস্ত শরীরেই ঘাম ঝরছে। মসজিদে আজান কানে ভেসে আসছে আসসালাতু খাইরুন মিনান নাওম। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। তাকে ওযু করে মসজিদে যেতে হবে।

তিন 
সকাল ১০ টায় লঞ্চ। হিজল নদীর ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যাবে ঢাকায় আবার ফিরতি লঞ্চ রাত ১০ টায়। সকাল বেলার নাস্তা করে ছোট একটা কবি ব্যাগে লিও টলস্টয় এর ওয়ার এন্ড পিস এর মোটা বইটা ঢুকাচ্ছেন। শানু জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে ওরে বাবা এতো মোটা বই নিয়ে তুমি ঢাকায় যাবে? সালাম মাস্টার হেসে বলে ব্যাগের মধ্যে ভারী কিছু না নিলে কেমন হালকা হালকা লাগে। স্নিগ্ধা বিছানায় কোকিয়ে কোকিয়ে বলে—মা এদিকে আসো আমার যেন কেমন লাগতাছে। প্রতি রাতেই ওর হালকা জ্বর থাকে গায়ে, হাটুর গিরা ফুলে ওঠে, গলায় টন্সিল ফুলে যায়। গ্রামে ভাল ডাক্তার নেই তাই ভালো চিকিৎসাও পাচ্ছেনা। শানু বিষয়টা চেপে যেতে চায়। যাত্রা পথে বাধা পড়বে তাই। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে খারাপ লাগতাছে মা। তোর নানা ঢাকা থেকে টাকা নিয়ে আসলে তোকে ভালো ডাক্তার দেখাবো। সালাম নাতনিকে খুঁজতে খুঁজেছ ঘরের ভিতর চলে আসে। নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দেখে জ্বরে গা টা ফেটে যাচ্ছে। সালাম চিন্তামিশ্রিত মুখে বলে আমি বরং যাওয়া ক্যান্সেল করি। ওরে এই অবস্থায় রেখে যেতে মনে সায় দিচ্ছে না। শানু বাবাকে সাহস দেয়। তুমি যাও বাবা আমি দেখবোনে কী করা যায়। তুমি যাওয়ার সময় মজিদ মাস্টাররে একটু বইলা যাইও। কোন দরকার পড়লে যাতে একটু হেল্প করে। আচ্ছা ঠিক আছে। বিপদে আপদে মজিদইতো আগাইয়া আসে। 

সালাম মাস্টার মজিদকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। দশটা বাজে লঞ্চ ভুউ-উ-উ করে সাইরেন ও ঘণ্টা বাজিয়ে স্টার্ট দেয়। লঞ্চ চলছে। ছোট নদীর ভেতর দিয়ে লঞ্চ যাওয়ার ফলে বড় বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। যার ফলে নদীর দুইদিকের কূল ভাঙতে থাকে। মাটির ঢেলা ভেঙে ভেঙে নদীতে পতিত হয়। লঞ্চ আস্তে আস্তে ছোট নদী অতিক্রম করে বড় নদীতে প্রবেশ করে। নদীর নাম পদ্মা। এ নদীকে অনেকে সর্বনাশা নদী বলে থাকে। যত বড় নৌযানই হোক না কেন। পদ্মা নদী তাকে একটু বাজিয়ে দেখবেই। একটু হালকা ঝাঁকুনি। ওপর থেকে নিচে নামাবে। হৃদপিণ্ডটাও যেন উপর থেকে নিচে নামে তখন। দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে গেল। বইয়ের কয়েকটা পাতা নেড়ে চেড়ে ব্যাগের ভিতর রেখে দিল সালাম মাস্টার। পড়ায় মন নেই তার। নাতনির জন্য মন খারাপ লাগছে। একটু আগেই ফোন এসেছিল জ্বর নাকি বেড়েছে আরো। মজিদ মাস্টারকে সাথে করে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে শানু। এদিকে ক্ষুধায়ও পেট চো চো করছে। মেয়ে তাকে আসার সময় খই, গুড়, নাড়ু আর হাসের মাংসের সাথে চালের রুটি দিয়ে দিয়েছেনে একটা পুটলিতে বেঁধে। পুটলির ভিতরে দুইটা টিফিন বাটি হুক দিয়ে লাগানো।সেটি আবার পলিথিনে মোড়ানো। সালাম টিফিন ক্যারিয়ার খুলে হাসের মাংস দিয়ে চালের রুটি খেলেন। দেখতে দেখতেই লঞ্চ ঘাটে চলে আসলো। রিকশা করে যাবেন মতিঝিল। গন্তব্য দৈনিক জনবাণীর অফিস। 

দৈনিক জনবাণীর অফিসে বসে আছেন সাহিত্য সম্পাদক আব্দুল মতিন। সামনের চেয়ারে বসে আছেন। সালাম মাস্টার। মতিন চশমার ফাক দিয়ে পাণ্ডুলিপির পাতা উলটে উলটে দেখেন। আর বলেন তো আপনিই সালাম মাস্টার। সালাম মাস্টার একটু হেসে বলে—জ্বী লোকে তাই বলে ডাকে। দেখুন আপনার লেখাটা আমরা পড়েছি। জুরিবোর্ড আপনার লেখাটা পছন্দ করেছে। উপন্যাসের নামটা ভালো দিয়েছেন ' ডুবেছিল চাঁদ নিশিন্দার বনে'। ক্রিয়াটা আগে চলে গিয়েছে চাঁদ ডুবেছিল নিশিন্দার বনে হতে পারতো। ব্যাকরণগতভাবে এটাইতো হয় নাকি? সালাম মাস্টার এবার একটু সোজা হয়ে বলেন—দেখুন ডুবেছিল চাঁদ নিশিন্দার বনে এই কথাটা শুনে আপনি যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন, চাঁদ ডুবেছিল নিশিন্দার বনে এই কথাটা শুন তেমনটা পাবেন না। যা কিছু ছন্দের মতো কানে বাজেনা তাকি সাহিত্য হতে পারে। আব্দুল মতিন চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে বাহ! বলেছেন বেশ। আমার গল্পের নামে আপত্তি নেই। আপত্তি আপনার নাম নিয়ে। নামটায় একটু কবি সাহিত্যিকের ভাব আনেন। সালাম মাস্টার এটা কোন লেখকের নাম হতে পারে? সালাম মাস্টার চা খাওয়া শেষ করে বলে—দেখুন আপনি মরণ চাঁন এর মিষ্টি খাচ্ছেন। নামটা হচ্ছে মরণ চাঁন। আপনি তার নামের জন্য মিষ্টি খাচ্ছেন না। বরং তার মিষ্টি ভালো বলেই তার নামটা বিখ্যাত হয়েছে। আমার নামের চেয়ে আমার লেখার গুরুত্ব বেশি। আমার লেখা ভালো হলে আমি কালাম না সালাম তা ম্যাটার করেনা। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে একজন লোক প্রবেশ করে। সুটেড বুটেড, গা থেকে দামি পারফিউম এর ঘ্রাণ আসছে। আব্দুল মতিন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে আসেন স্যার। পরিচয় করিয়ে দেই- ইনিই সেই নিশিন্দা বনের লেখক সালাম মাস্টার।

চার
জনাব হাইসান আলি সালাম মাস্টারের সাথে করমর্দন করে চেয়ারে বসে। আব্দুল মতিনের দিকে চোখ ইশারা করে বলে- ওনাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলেছেন। জ্বি স্যার সে বিষয়েই আলাপ শুরু করেছিলাম। আচ্ছা আপনি যদি বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হন তবে আমি বলছি। আমার হাতে সময় কম। মেয়ে অপেক্ষা করছে মায়ের সাথে মার্কেটে, এখনই বেড়িয়ে যেতে হবে। গলার টাইটা একটু ঠিক করে হাইসান আলি বলে। দেখুন জনাব সালাম মাস্টার আপনার লেখাটা মতিন সাহেব পড়েছে। লেখার ঘটনাটা আমাকে বলেছেন। আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি লিখে আনন্দ পান, কিন্তু এখন অবদি বই প্রকাশ হয়নি আপনার। আবার টাকা পয়সারও দরকার। দেখুন আল্লাহ আমাকে কী দেয়নি। টাকা, পয়সা, বাড়ি গাড়ি সব দিয়েছে শুধু একটা জিনিস দেয়নি লেখালেখির ক্ষমতা যেটা আপনার আছে। আমি লেখক না হয়েও এ যাবৎ বারোটি বইয়ের রচয়িতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। সমাজে লেখক হিসেবে বাহবা পাচ্ছি। এই আপনারা পাণ্ডুলিপি দেন বলেই এই অধমেরা সমাজে বই টই ছাপিয়ে টাপিয়ে সম্মান টম্মান পেয়ে থাকি। পুরস্কার ছিলতো পঞ্চাশ হাজার আমি আপনাকে এক লাখ দিব। আপনি শুধু পান্ডুলিপিটা আমাকে দিন। সালাম মাস্টার রাগে ও ঘৃণায় গর গর শব্দ করছে কিছু বলতে পারছে না। হাইসাম চেয়ার থেকে উঠে বলে কী মশাই রেগে গেলেন বুঝি। এই রইলো আমার ভিজিটিং কার্ড। ভাবার সময় দিলাম। সালাম মাস্টার কোন কথা না বলে পান্ডুলিপিটা ছো মেরে সম্পাদকের হাত থেকে নিয়ে হনহনিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন।

সালাম খোলা আকাশের নিচে হাটছেন।  বিকেল বেলার সূর্য ঢলো ঢলো। পার্কের  ভিতরে নানা রঙের মানুষ নান কাজে ব্যস্ত। হাটতে হাটতে পার্কের বেঞ্চের উপর ঢেলান দিয়ে বসে পড়েন সালাম। সে খুব ক্লান্ত। অনেক পড়ে উড়ে আসা উড়ন্ত অতিথি পাখির ক্লান্তি ভর করে তার দু’চোখে। সমুখে ধোয়াচ্ছন্ন একদলা মেঘ এসে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে তার সমস্ত শরীর। সে পার্কের বেঞ্চিতে এলিয়ে দিতে চায় তার শরীর। এমন সময় নিশিন্দা গ্রাম থেকে কল আসে শানুর। শানু কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায় স্নিগ্ধার হার্টের ভাল্ব নষ্ট হওয়ার পথে। জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করাতে হবে। তাই ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। অনেক টাকা প্রয়োজন প্রায় লাখ দেড়েক। মজিদ মাস্টারের কাছ থেকে পঁচিশ হাজার ম্যানেজ করা গেছে আরো টাকা প্রয়োজন। সালাম মাস্টারের কণ্ঠ আটকে আসে। মৃদু স্বরে সে বলে তুই নানুমনিকে নিয়ে এম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় চলে আয়। এদিকটা আমি দেখছি। 

সালাম আব্দুল মতিনকে কল দিয়ে হাইসান আলীর বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে তার বাড়িতে যায়। সুনসান ডুপ্লেক্স বাড়ি কুকুরের গলায় চেইন বাধা। জার্মান সেফার্ড, অনেক দামি কুকুর হবে হয়তো। কুকুর দেখে সালাম খানিকটা ভয় পেলেও। ভয় না পাওয়ার ভান করছেন। সালাম মাস্টারকে বাড়ির কেয়ারটেকার ড্রইংরুমে বসতে দেয়। হাইসান আলী এখনো মার্কেট থেকে ফেরেনি। তাকে ফোন করা হয়েছে এখনো দুঘণ্টা লাগবে ফিরতে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও সালাম মাস্টার ঘামছেন। নাতনির সরল ও চঞ্চল মুখটা তার সামনে ভাসছে। সে টেনশন দূর করতে টি টেবলের উপর রাখা দৈনিক পত্রিকাটি হাতে নিয়ে পড়ছে। কাজের মেয়ে কফি, বিস্কুট দিয়ে যায়। কফি খেতে খেতে তার মনে হয়। হায় জীবনে অনেক কিছুই দেখা বাদ রয়ে গেলো। কী করলাম জীবনে। শুধু কল্পনার ঘোরে থেকে থেকে জীবনটাকে পার করে দিলাম। টাকা উপার্জনের তাড়নাটা যদি একটু থাকতো তাহলে হয়তো আজ নিজের স্বত্তাকে এভাবে বিকিয়ে দিতে হতো না। পুরো পত্রিকাটাই পড়া শেষ হয়ে যায়। দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ। হাইসান আলী মেয়ে আর বৌকে নিয়ে গৃহে প্রবেশ করলেন। হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। কাজের মেয়ে ব্যাগ নিয়ে উপরে চলে যায়। হাইসান হাসতে হাসতে পকেট থেকে চেকের পাতা বের করে বলে—আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল আপনি আসবেন। সালাম মাস্টার বলে—আসলে আমি দুঃখিত, আমার নাতনির অপারেশন এর জন্য দেড় লাখ টাকা লাগবে। তাই বাধ্য হয়ে আসা। কী হয়েছে আপনার নাতনির? আমার সুমুন্দি ঢাকা মেডিকেলের বড় ডাক্তার আমি ফোন করে দিচ্ছি। সোজা গিয়ে ভর্তি করিয়ে নিবেন কোন সমস্যা হবে না। সিট পেয়ে যাবেন। হাইসান লোকটার জন্য এই মুহূর্তে  খানিকটা ঘৃণা প্রশোমিত হয় সালামের।

নাতনির অপারেশন সফল হয়। দশদিন পর সালাম মাস্টার নাতনি ও মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। নিশিন্দা বনের ভিতর দিয়ে তিন চাকার ভ্যান চলছে। চালতা গাছ থেকে কয়েকটা পাতা খসে পড়ছে। সাদা সাদা চালতা ফুলগুলো বাতাসে দুলছে। ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে সালামের। তার চোখের সামনে দিয়ে একটা ঘুঘু পাখি উড়ে যায়। ঘুঘুর পাখাগুলোকে তার মনে হয় যেন বইয়ের শুভ্রপাতাগুলো ডানা ঝাপটে ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে। তার কানে ভাসছে মুহুর্মুহু হাততালির শব্দ, তাকে উত্তরী পড়ানো হচ্ছে, ক্রেস্ট দেয়া হচ্ছে, তার হাতে মাইক্রোফোন কিন্তু সে কথা বলতে পারছে না। সালাম হঠাৎ ভ্যান থামিয়ে বলে শানু তুই বাড়ি যা। স্নিগ্ধাকে কাঁধে তুলে নেয় সালাম। সামনে ভ্যান এগুচ্ছে। বিজয়ী ট্রফির মতো স্নিগ্ধা নানুর কাঁধে চেপে থাকে। খুশিতে হাততালি দেয় আর বলে নানু ইউ আর দ্যা গ্রেট। নিশিন্দা বনের প্রতিটি গাছের পাতা যেন  খুলে রাখা বইয়ের পাতার মতো ঝড়ো বাতাসে দাপাদাপি করে।


 • স্বপঞ্জয় চৌধুরী, কবি, কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক। ঢাকা।

menu
menu