দুঃখ জাগানিয়া নকশি

ইট ভাঙার সময় ডান পা ভাজ করে বসতে গেলে পেটের ভিতরে বাচ্চাটা নড়ে উঠল জান্নাতের।
আজ বাচ্চাটা বেশি নড়াচড়া করছে। হয়তো খিদে লেগেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল জান্নাত। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। এখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। পাশে খুপড়ি দোকানে এক কাপ দুধ চায়ে পাউরুটি ভিজিয়ে খেয়েছে কেবল। সেটা কখন হজম হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ক্ষুধা বোধ করে জান্নাত। বাড়িতে যাবার আগে রুটি-কলা কিছু একটা কিনে খেতে হবে। 
পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা কেন মেয়ে মানুষ সৃষ্টি করে পাঠালেন এই প্রশ্ন জান্নাতের মতো মুর্খের মনেও মাঝেমধ্যে জাগে। কাজ করতে করতে হাত ধরে আসে। ফাটা হাতে জ্বালাপোড়া হয়। কিন্তু কাজ থামানোর কোনো উপায় নেই। সমান পরিশ্রম করে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় মজুরি অর্ধেক। কিছু করার নেই। 
সামান্য পারিশ্রমিক নিয়ে বাড়িতে ফেরার সময় জান্নাত প্রতিদিন বাজার করে। মাংস কবে কিনেছে বলতে পারবে না। মাছ বলতে পচা সস্তার কিছু যদি থাকে। নয়ত শাক সবজি। তাও কি হাত দেয়া যায় ? বস্তির ঘরে গিয়ে চুলা জালিয়ে, তরকারি কুটে, রান্না করে তারপর খাওয়া। এরপরে আর শরীর চলে না। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ও। তবু রাতে স্বামী ফেরার পরে ভাত বেড়ে দিতে হয়। বেশিরভাগ দিন খাবার নাড়াচাড়া করে ফেলে দেয়। বলে খেয়ে এসেছে হোটেল থেকে। কিন্তু কোনোদিন খাবার দিতে দেরি হলে চুলের মুঠি ধরে কিল-ঘুষি চলতে থাকে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে উনিশ বছর বয়সী জান্নাত হাত বুলায় পেটে। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আকুল হয়ে বলে, বাবা তুই কবে পৃথিবীতে আসবি। তুই এসে আমার সব দুঃখ দূর করবি বাবা। 
বিয়ের সময় সবাই বলেছিল, রমজান হোটেলে চাকরি করে। ভালো বেতন পায়। তারপর প্রতিদিন হোটেলের বেঁচে যাওয়া খাবার তো আছেই। জান্নাত, তুই তো রাজরানির মতো সারাদিন শুয়ে বসে খাবি। গ্রাম থেকে বিয়ে করে রমজান ওকে নিয়ে ওঠে নিউ ইস্কাটন রোডের বস্তিতে। পাশেই সোনারগাঁ হোটেল। জান্নাত জানে না, আমেরিকা নামের এক দেশের সাবেক প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এই বস্তির কথা লিখেছিলেন তাঁর আত্মজীবনীতে। বস্তি থেকে বের হলে সব আলিশান বাড়ি। তারপর বড় রাস্তায় গাড়ি-বাস-রিক্সা সব চলে। এলাকাটা বেশ পছন্দ হয় জান্নাতের। বাড়িগুলিতে প্রচুর গাছপালা। এক বাসায় ঘর মোছা-কাপড় ধোয়ার কাজ জুটিয়ে দিয়েছিল পাশের ঘরের এক মহিলা। পেটে সন্তান আসার পরে সেই কাজ করতে পারেনি। 
মগবাজারে এক কমিউনিটি ক্লিনিকে ডাক্তার আপা বলেছেন, ভারি কোন কাজ না করার জন্য। ওখান থেকে কয়েক প্যাকেট ভিটামিন ট্যাবলেট দেয়া হয়েছে। জান্নাত সেসব খুব নিয়মিত খায়। মনে মনে বলে, মা হিসেবে সন্তানকে তাঁর কোনোভাবে অবহেলা করা যাবে না। এই সন্তান তাঁর। যত কষ্ট হোক, কেয়ামতের মাঠে আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে? যার এই সময় সবচেয়ে জান্নাতের প্রতি যত্ন করা দরকার, সেই রমজানের কোন মাথাব্যথা নেই সন্তানের জন্য। জান্নাত কিছু বললে শুনিয়ে দেয়, গ্রাম দেশে মা-খালারা ১৫/১৬ জন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আর তুই ঢাকায় এসে এখানকার মেয়েদের মতো হয়ে গেছিস? এত আহ্লাদ করবি না বুঝলি?
এতে আহ্লাদের কি আছে বোঝে না জান্নাত। গ্রামের বাড়িতে অনেক ছেলে মেয়ে থাকলেও বড় পরিবারে দেখাশোনা করার অনেক মানুষ থাকে। এখানকার মতো দুইজনের সংসার না। শরীর প্রচণ্ড খারাপ হলেও রান্না করতে হয়। নিজেকে বেড়ে খেতে হয়। রমজানের হোটেলের খাবার কোনোদিন খাওয়া হয়নি ওর। আর খাবে কীভাবে? রমজান তো হোটেলের ডিউটি শেষ করে কখনো সরাসরি বাসায় ফেরে না। হোটেলের দরজা-জানালা আটকে জুয়া খেলতে বসে। মাসের বেতন প্রায় পুরোটাই সেখানে খরচ হয়ে যায়। বস্তির এই ঘরের মালিক চান্দুর মা মাঝে মধ্যে জোর করে ভাড়ার টাকা রেখে দেয়। নয়তো সংসারে কোন খরচই করতে চায় না রমজান। 
বিয়ের পরে বস্তির এই ঘরে এসে জান্নাত পেয়েছে একটা তক্তপোষ। তাতে ময়লা ছেড়া চাদর। কাপড় রাখার কোন আলনা নেই। জিনিসপত্র রাখার মিটসেফ নেই। জান্নাতরা গরিব হলেও সারা জীবন চৌকিতে ঘুমিয়েছে। এখন মাটিতে শুতে গিয়ে শরীরে ব্যথা হয়। মশা-পিঁপড়ার আক্রমণ তো লেগে আছে। একটা মানুষ যে কতখানি বাদাইম্যা হতে পারে রমজানকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। আয়ের প্রায় পুরো টাকাটা সে জুয়ার পিছনে উড়িয়ে দেয়। কি মারাত্মক নেশা! নিজের অনাগত সন্তানের জন্যেও কোনো মায়া-মমতা নেই। ছোটবেলা থেকে জান্নাত শুনেছে এই সময় মেয়েদের অকারণ মন খারাপ থাকে। অল্পতে বিরক্ত হয়। বমি করা-মাথা ঘোরা তো লেগেই থাকে। এই সব সমস্যার কথা কাকে বলবে? কেউ কি আছে ওর কথা শোনার!
জান্নাতের কেবল চোখ ফেটে পানি আসতে চায়। তার জীবনটা এরকম কেন হল? সে তো খারাপ চরিত্রের মেয়ে নয়। মানুষ খারাপ কর্ম করলে, তার কর্মফল পায়। জান্নাত কি করেছে এই জীবনে ? যে কারণে এত কষ্ট পেতে হবে তাকে? সিনেমাতে দেখেছে নায়িকা সন্তান সম্ভবা হলে তাকে নিয়ে নায়কের মতো মাতামাতি। নায়ক আলমগীর সন্তান হবার খুশিতে নায়িকা শাবানাকে একদম কোলে তুলে নিয়েছিল এক সিনেমায়। 
আর তার স্বামী একবার জিজ্ঞাসা করে না, তার কেমন লাগে? সন্তানটা পেটের মধ্যে কত লাফালাফি করে, ইচ্ছা করে রমজানের হাতটা নিয়ে পেটের ওপর রাখে। সেই ইচ্ছাপূরণের পরিবর্তে উল্টো লাথি-ঘুষি খেতে হয়। সামান্য ছলছুতোয় মারধর শুরু করে রমজান। যেদিন জুয়াতে গোহারা হেরে আসে সেইদিন কথাই নেই। মার খাওয়ার সময় জান্নাত চেষ্টা করে একটু ঝুঁকে থাকতে। যাতে পেটে লাথি না লাগে। ওর সন্তান যাতে ব্যথা না পায়। 
বিষ খেয়ে মরে যেতে ইচ্ছা করে জান্নাতের মাঝেমধ্যে। কিন্তু একটি নিষ্পাপ সন্তানকে মেরে ফেলতে মন চায় না। মাঝেমধ্যে মন ভালো থাকলে আশা জাগে, এই সন্তান একদিন বড় হয়ে ওর কষ্ট বুঝবে। অনেক টাকা পয়সা আয় করে মাকে আরামে রাখবে। 
কমিউনিটি ক্লিনিকের ডাক্তার আপা অনেক কিছু খেতে বলেছেন। দুধ কেনার সামর্থ্য নেই তাই মাঝেমধ্যে কনডেন্স মিল্ক দেয়া দুধ চা কিনে খায়। সঙ্গে সবরি কলা। যেদিন হাতে একটু টাকা থাকে ডিম এনে সেদ্ধ করে মরিচ পোড়া দিয়ে ভর্তা করে খায়। মনের মধ্যে খা খা করে। সন্তান সম্ভবা একটা মেয়েকে কি এভাবে দিন কাটাতে হবে একাকী!
জান্নাতের পেট এখন ফুঁলে ফেপে উঠেছে। বসে থাকতে পারে না। পা ফুলে গেছে। ইট ভাঙার কাজের জন্যেও তো শক্তি লাগে। শরীর খুব খারাপ লাগাতে ওইদিন রিক্সায় করে বস্তির ঘরে ফেরে জান্নাত। বাজার করা-রান্না করা কিছুই হয় না। খেয়ে না খেয়ে ঘরে অচেতনের মতো পড়ে থাকে। অনেক রাতে স্বামী ঘরে ফিরে ওকে ডাক দেয়। দুর্বল কণ্ঠে উত্তর দেয় ও। তারপর রমজান খাবারের খোঁজ করে। দেখে হাড়ি-পাতিল সব খালি। কোনো প্রশ্ন না করে জান্নাতের মুখে ময়লা স্পঞ্জ পরা পা দিয়ে লাথি মারে রমজান। চিৎকার করে জানতে চায়, কোন্ ভাতারকে ডেকে খাওয়াইসস তুই ? 
কোন উত্তর দিতে না পেরে জান্নাত অচেতনের মতো পড়ে থাকে। তাতেও ওর ওপর অত্যাচার কমে না। শেষ পর্যন্ত ও জোরে চিৎকার করে গোঙাতে থাকে। অনেক দিনের অবরুদ্ধ আবেগ ভেঙে পড়ে কণ্ঠ থেকে। ঘরের সামনে কুপি হাতে ভিড় করে বস্তির অন্যরা। সবাই অবাক। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে এমনভাবে পেটাতে পারে মানুষ ? 
এই ঘরের মালিক চান্দুর মা বলে, মানুষ তো পেটে বাচ্চা থাকলে কুত্তা-বিলাইয়ের গায়ে লাথি দেয় না। আর তুই নিজের সন্তানের অসুস্থ মাকে এভাবে মারছিস? তুই কি মানুষ? 
এত মানুষের গালাগালির জবাবে কিছু না বলে মাথা নিচু করে ঘর ছাড়ে রমজান। তারপর আর সে ফেরে না। জান্নাত শুনেছে হোটেলের মেঝেতে অন্য বয়দের সঙ্গে ঘুমায়। জান্নাতকে সে তালাক দেবে বলে জানিয়ে দেয়। বস্তির সবাই চাঁদা তুলে জান্নাতকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চান্দুর মা সারারাত ছিলেন। পুরো একটা দিন প্রসব ব্যথা সহ্য করে আসরের আজানের পরে পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় জান্নাত। রমজানকে খবর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে আসেনি। বরং যে খবর নিয়ে গিয়েছিল, তাকে আজে বাজে কথা বলে পাঠিয়ে দিয়েছে। রাত হলে তাকে জুয়ার নেশায় ধরে। 
জান্নাত ছোটবেলায় মায়ের কাছে একটা কথা প্রায়ই শুনতো, রাখে আল্লা মারে কে! ওর এই বিশ্বাসটা ছিল। না খেয়ে নবজাতককে নিয়ে মরতে হবে না। জান্নাত ওর ছেলের নাম রাখে সাকিব। ওর প্রিয় নায়কের নাম। ছোটবেলা থেকে সিনেমার পোকা জান্নাত।
চান্দুর মা এই দুঃসময়ে আপন আত্মীয়ের মতো আগলে রাখেন দুইজনকে। বাবা বেঁচে নেই। মা বেঁচে থাকলেও ভাইদের সংসার থেকে আর কি করতে পারেন? তবু তিনি চাল-ডাল সামর্থ্য মতো গ্রামের একজন লোককে দিয়ে পাঠান মাঝেমধ্যে। 
বস্তির পাশেই এক চার তলা ভবনের তিন তলায় এক ভাড়াটে এসেছে বছর খানেক। সাকিবের জন্মের দুইদিন পরে তাদের পরিবারে এক সন্তান এল। অপরিপক্ব শিশুটি জন্মের সাতদিনের মধ্যে মারা যায়। ওই শিশু সন্তানের মা সব পোশাক আশাক-উপহার আর খাবার দাবার পাঠিয়ে দিয়েছে জান্নাতের ছেলের জন্য। শুধু তাই নয় নিয়মিত টাকাও পাঠান তিনি। কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে জান্নাত শুধু আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করে, কোল খালি হয়ে যাওয়া মাকে একটি সুস্থ সন্তান দেন তিনি। 
সাকিবের জন্মের দুই মাসের মাথায় বিয়াম স্কুলের পাশে একটি গার্মেন্টসে চাকরি পায় জান্নাত। এই গার্মেন্টসে শিশুদের রাখার ব্যবস্থা আছে। কাজের ফাঁকে জান্নাত ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়ায়। চার মাস হবার পর থেকে দুধ দিয়ে সুজি খাওয়ানো শুরু করে। ছেলেটা বেশ নাদুসনুদুস হয়েছে। চান্দুর মা কাজল দিয়ে বড় টিপ দিয়ে দেন সাকিবকে। ভ্রু একে দেন। চোখে কাজল দিয়ে দেন। আর রমজানকে গালিগালাজ করেন। জান্নাতের মনে এখন আর কোনো ক্ষোভ নেই। ও তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছে রমজানকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এই ভেবে যে, রমজান কোনো সমস্যা করেনি সাকিবকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ওর রাত কেটে যায়। মনে কোনো কষ্ট নেই। না পাওয়ার হাহাকার নেই আগের মতো। মনে হয় একটা দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে ও। 
তবু কি জান্নাত সুখী? একটা পুরুষকে পাশে পাবার বাসনা কি ওর নেই ? ওর হালকা পাতলা গড়নের মধ্যে এক ধরনের আলগা শ্রী আছে। গার্মেন্টসের পুরুষ কর্মীরা ওর দিকে প্রায়ই বেশ গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। আগে ওর কাপড়চোপড় ছিল ময়লা, পুরনো। এখন বেতনের টাকায় সুন্দর ছাপা থ্রিপিস কিনেছে কয়েকটি। ওকে বেশ সুন্দর লাগে সেই পোশাকে। গার্মেন্টসের সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে নিয়মিত আসে একটা লোক। গোফ অলা বেশ লম্বা দেখতে।
 জান্নাতকে দেখলেই হাসে। গার্ডরা বলেছে, লোকটার নাম বাদশা। পাশে এক অ্যাপার্টমেন্টে গার্ডের চাকরি করে। জান্নাতকে চা খাওয়াতে চায়। বেশ পুলক লাগে ওর মনে। রাতে ছেলেকে বুকে নিয়ে ঘুমানোর আগে বাদশার হাসি মুখ মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। তবে কি লোকটার প্রেমে পড়েছে ও। সাকিবের কথা ভাবতে মনটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। যদি ওই লোক ছেলেটাকে মেনে না নেয়। তাহলে ? এই একটা ব্যাপারে আগে কথা বলে নিতে হবে। ছেলের জন্য কোনোভাবে ছাড় দেয়া যাবে না। 
বাদশার গোঁফওয়ালা চেহারা জান্নাতের মনে সারাক্ষণ উঁকি দেয়। এই প্রথম জীবনে যেন প্রেমের স্বাদ পায়। গার্মেন্টসের সিকিউরিটি গার্ড নুর মিয়ার আকারে ইঙ্গিতে প্রায়ই জান্নাতের কাছে বাদশার কথা বলে। শুনতে খুব ভালো লাগে ওর। সাকিবকে চান্দুর মায়ের কাছে রেখে এক শুক্রবার ছুটির দিন বিকালে বাদশার সঙ্গে মগবাজারে এক রেস্টুরেন্টে দুইজন কাবাব-নান রুটি খায়। এভাবে কয়েক শুক্রবার কেটে যাবার পরে বাদশা বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আগেই সাকিবের বিষয়টা পরিষ্কার করে নেয় জান্নাত। বাদশা কথা দেয়, সাকিবকে সে নিজের ছেলের চেয়েও বেশি মায়া মমতা দিয়ে মানুষ করবে। 
খুব বেশি দূরে নয়। আগে ছিল যে বস্তিতে ছিল সেখান থেকে এক রাস্তা ঘুরে বিয়াম স্কুল পার হয়ে আরেক বস্তিতে আসে জান্নাত। পানির ওপরে বাঁশের ভাসমান ঘরে নতুন সংসার পাতে দুইজন। না তিনজন। সাকিব এখন অনেক কিছু বুঝতে পারে। জান্নাতকে মা ও বাদশাকে আব্বু বলে। দিনের বেলা বাদশা সারাদিন প্রায় শুয়ে বসে কাটায়। রাতে ওর ডিউটি থাকে। জান্নাত গার্মেন্টসে গেলে সাকিবকে দেখে রাখে। এখন সে হাঁটতে শিখেছে। বাবার খুব ভক্ত হয়েছে। বাপও ছেলেকে চিপস-চকলেট কিনে খাওয়ায়। 
বস্তির ঘরগুলি ঘিঞ্জি হওয়াতে সবাই গা ঘেষাঘেষি করে থাকে। সাকিবকে কোলে নেবার লোকের অভাব হয় না। জান্নাত সকালে রান্না-বান্না করে স্বামীর জন্য খাবার রেখে যায়। নিজেও টিফিন বক্সে করে খাবার নেয়। বাদশা বাজার সদাইয়ের ব্যাপারে খুব উদার। জান্নাতের নিজেকে খুব সুখী মনে হয়। প্রতিদিন মাছ, মাঝেমধ্যে মাংস বিয়ের আগে গ্রামেও কি খুব বেশি পেয়েছে! ওর মনে হয়, এই হলো আসল জীবন। যে জীবনের স্বপ্ন ও ছোটবেলা থেকে দেখেছে। এই জীবনে সমস্যা যে নেই তা নয়। তবে ছোট খাট সমস্যাগুলি ও ভুলে যায় অনেক বড় কিছু পাওয়ার আনন্দে। 
বাদশার মদ খাওয়ার নেশা আছে। কখনো নেশাটা মাত্রা ছাড়ায়। মাতলামি করে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙে। অনেক শখ করে কেনা কাপ-পিরিচ, গ্লাস ভাঙার পরে জান্নাত সতর্ক হয়েছে। হাতের নাগালের মধ্যে কিছু রাখে না। সাকিবকে অবশ্য কখনো কিছু বলে না। তাছাড়া মধ্যরাতে বা ভোরবেলা যখন বাদশা মদ খেয়ে বাসায় ফেরে, তখন জান্নাত ঘুমিয়ে থাকে। 

বিয়ের প্রায় দুই বছর পরে জান্নাত আবার গর্ভবতী হল। প্রথম দুই মাস সে টের পায়নি। বোঝার পরে বাদশা বাচ্চা নষ্ট করার জন্য চাপ দিতে থাকে। জান্নাত বুঝতে পারে না কী করবে? ওদের দুইজনের ভালোবাসার ফসল কেন সে ইচ্ছা করে নষ্ট করবে বোঝে না। দ্বিধাদ্বন্দ্ব করতে করতে গর্ভপাতের সময় পার হয়ে যায়। ‘আল্লাতায়ালার উপহার’ নানা কথা বলে বাদশাকে ও বোঝানোর চেষ্টা করে। কোন লাভ হয় না।
সংসারের প্রতি বাদশার টান কমতে থাকে। প্রথম সন্তানের সময়ের মতো অত করুণ দশা হয় না জান্নাতের। কারণ ও এখন গার্মেন্টসে চাকরি করে। বাদশা বাড়ি ফেরা কমিয়ে দিলেও মাঝেমধ্যে বাজার করে এনে সাকিবের সঙ্গে গল্প করে।  অনাগত সন্তানের কথা একবারও তোলে না। রাতে জান্নাতের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ওর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে। এতদিনে জান্নাত বুঝতে পারে, বাদশার কাছে ওর শরীরটাই ছিল আসল। সেটা পাওয়ার জন্য ভালোবাসা ছিল। ওর শরীরে ভারী হতে আরম্ভ করলে বাদশার বাড়িতে আসা কমে যায়। এক সময় সেটা নাই হয়ে যায়। 
জান্নাতের দ্বিতীয় সন্তান জন্মাবার সময়ও তার বাবা ছিল না পাশে। বস্তির অনেকে এই নিয়ে ফিসফাস করে। দুই বস্তি কাছাকাছি হওয়াতে জান্নাতের সব ঘটনা এখানকার সবাই জানে। দ্বিতীয় সন্তান হয় মেয়ে। এক কথায় ফুটফুটে দেখতে। বাদশার মতো চোখমুখ আর জান্নাতের গায়ের রঙ পায়। খুব আশা ছিল জান্নাতের মেয়েকে দেখতে অবশ্যই আসবে বাদশা। কিন্তু ও আর আসে না। জান্নাত মেয়ের নাম রাখে পূর্ণিমা। জান্নাতের প্রিয় নায়িকার নাম। মেয়ে হবার পরে তিন মাসের বেতন দিয়ে গার্মেন্টস থেকে বিদায় করে দেয়া হয় ওকে। 
ওই টাকাতে তিন-চার মাস টেনেটুনে কোনক্রমে চলে তিনজনের সংসার। এরপর আবার সেই একবেলা খেয়ে না খেয়ে থাকার দিন শুরু হয়। হাজেরা নামে এক ভিক্ষুক মহিলা থাকে বস্তিতে। সে নিজেই একদিন এসে জান্নাতের ছোট্ট মেয়েকে ভাড়া হিসেবে নিতে চায়। বাংলামটর মোড়ে জান্নাতের মেয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করে হাজেরার কোলে। ভাড়ায় সন্তানদের না দিয়ে জান্নাত নিজেই ভিক্ষায় নেমে পড়ে। দুই সন্তানকে সামলে কোন কাজ নেয়া সহজ নয়। ভিক্ষুকদের কোনো টাইম টেবিল নেই। কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না। আত্মসম্মানে কিছুটা লাগলেও ধীরে ধীরে এই পেশায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে জান্নাত। মাঝে মধ্যে লজ্জা লাগে এই ভেবে যে হঠাৎ যদি বাদশার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। জান্নাতের করুণ দশা দেখে টিটকারি মারবে না তো? বাদশাকে এখনো মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ও।
তবে একদিন একজন এসে ঠিক  অনেক কথা শুনিয়ে যায়। অসম্ভব সুন্দর এক মেয়ে। জান্নাতের তাকে খুব চেনা চেনা মনে হয়। পরদিন বাংলামটর থেকে যাবার সময় ওই মহিলা ১০০ টাকা দেয় জান্নাতকে। এভাবে ভর দুপুরে বাইরে ঘোরাঘুরি না করে বাসায় গিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে রান্না বান্না করে খেতে বলে। জান্নাত তাই করে। মাঝেমধ্যে ওই মহিলার সঙ্গে ওর দেখা হয়ে যায়। প্রতি বার মহিলা ওকে ১০০/২০০ টাকা দেয় আর ওই কথা বলে। একদিন গাড়ি থামিয়ে একটা ঠিকানা দিয়ে বলে সেখানে আসার জন্য। জান্নাত সামান্য লেখাপড়া জানে। পড়ে দেখে এটা একটা বাসার ঠিকানা। ইস্কাটনে গাউসনগরে বাসা। ঠিকানা অনুযায়ী খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে ওনার বাসায় গিয়ে হাজির হয় জান্নাত। বাসায় ঢুকে ওর মনে হয় এতো আলিশান ব্যাপার স্যাপার! 
একজন লোক জান্নাতকে বারান্দার এক কোণে বসিয়ে রেখে ভিতরে খবর দেয়। বেশিক্ষণ বসে থাকতে হয় না। বিশাল লম্বা একটা রুমে ঢোকার নির্দেশ দেয়। জান্নাত পরে জেনেছে এটাকে লিভিং রুম বলে। সেই রুমে একটা চমৎকার দোলনায় পুতুল কোলে বসেছিলেন তিনি। চারপাশে দেয়ালে ঝোলানো তাঁর ছবি। জান্নাত এবার চিনতে পারে। বাংলাদেশের এক নম্বর সিনেমার নায়িকা মহুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ও। বাদশার সঙ্গে এই নায়িকার সিনেমা কয়েকবার দেখেছে হলে গিয়ে। জান্নাতের মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো দশা হয়। শরীরে চিমটি কেটে বোঝার চেষ্টা করে সত্যিই কি ও এই নায়িকাকে দেখছে, নাকি পুরোটাই ওর কল্পনা? সিনেমা দেখতে বসলে যে দিন রাত ভুলে যায়, সেই জান্নাত একজন সত্যিকারের নায়িকার সামনে! 
জান্নাতের অভিব্যক্তি দেখে মহুয়া হাসে। ওকে পাশে রাখা মোড়ায় বসতে বলে। দই-মিষ্টি খেতে দেয়। 
অনেকক্ষণ সময় দেয় সেই নায়িকা জান্নাতকে বলে, তোমার বয়স তো খুব বেশি নয়। আমি বরং তোমার চেয়ে বয়সে বড় হব। আমার এক সন্তান আছে। এটা অনেকে জানে না। তুমি এভাবে দুই সন্তানকে নিয়ে রাস্তার মোড়ে ভিক্ষা কর, এটাতো ওদের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ওদের অসুখ হতে পারে। আর পরিশ্রম করার মতো ক্ষমতাও তোমার আছে। 
দুই সন্তানকে বাসায় রেখে আসলে দেখার কেউ নেই বলে জান্নাত জানায়। ওর জীবনের কাহিনি সংক্ষেপে বলে। শুনে মহুয়া উত্তর দেয়, তোমার বাড়িতে কেউ নেই, মা কিংবা বোন? 
মায়ের কথা বলে জান্নাত। ভাইদের সংসারে ভালো নেই মা। তাকে আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু নিজেদের পেট চলে না যেখানে, সেখানে মাকে এনে খাওয়াবে কী?
মহুয়া বলে, জান্নাতকে টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ওর বাসায় কাজ করবে জান্নাত। ভালো বেতন পাবে। সেই টাকায় মাকে ঢাকায় এনে রাখতে পারবে। 
এত ভালো খবর নিয়ে বস্তিতে ফিরে জান্নাত দেখে ভয়াবহ অবস্থা। পুরো বস্তি পুড়ে ছাই। আকাশে ধোয়া উঠছে। সবাই বুক চাপড়াচ্ছে আর পাগলের মতো নিজেদের জিনিসপত্র খুঁজছে। জান্নাতের মাথা ঘুরে যাবার মতো দশা। সাকিব আর পূর্ণিমা কোথায় গেল? ওরা কি পুড়ে মারা গেছে?  ভয়ে-আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে জান্নাতের। নিজের ঘরের দিকে ছোটে ও। বেশি সময় লাগবে না ভেবে এক বছর বয়সী পূর্ণিমাকে চার বছর বয়সী ভাইয়ের কাছে রেখে গিয়েছিল। 
জীবনে বহুবার প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছে জান্নাত। কিন্তু কোনোটাই আজকের কষ্টের মতো ভয়ংকর ছিল না। ওর মনে হলো, ছেলেমেয়েদের খুঁজে না পেলে ও নিজেই গায়ে আগুন লাগিয়ে দেবে। নিজের ঘরে যেতে পারে না জান্নাত। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ওকে যেতে দেয় না। ওখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ও তবু যাবেই। ওকে কেউ থামাতে পারবে না। সবার অবস্থাই পাগলের মতো। তবু তার মাঝে জান্নাতকে থামাতে এগিয়ে আসে কেউ কেউ। ধস্তাধস্তিতে জ্ঞান হারায় জান্নাত। 
বিয়াম স্কুল ছাড়িয়ে ছোট মাঠে জ্ঞান ফিরে আসে ওর। একটু পরে টের পায় মাথায় কার যেন ছোট হাত। গর্ভবতী থাকার সময় এইরকম পেটের ভিতর আলতো হাতের স্পর্শ পেত। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সাকিব আর পূর্ণিমা পাশে বসে আছে। আগুনের তাপে মেয়ের ফর্সা গাল কালো হয়ে গেছে। 
ধড়মড় করে উঠে জান্নাত জড়িয়ে ধরে দুই সন্তানকে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্না যেন আর থামে না। ওর ঢাকা জীবনের সমস্ত সঞ্চিত সম্পদ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কি? ওপরওয়ালা ওর দুই সন্তানকে রেখে গেছে ওর বুকে। অনেকক্ষণ কেঁদে কেটে বুক হালকা হয় জান্নাতের। জীবনের প্রথম চাহিদা খাদ্যের কথা মনে হয়। মনে একটু খুশির ঝলক লাগে ওর এই ভেবে যে, ওর শাড়ির আচলে ৫০০ টাকা বাধা আছে। নায়িকা মহুয়া দিয়েছিল আসার সময়। জান্নাত সেই টাকায় খাবার কিনে নিজে খায়, ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়। বস্তির অন্য শিশুদেরও খেতে দেয়। 
ছোট পার্কে খোলা আকাশের নিচে এক রাত কাটানোর পরে দিলু রোডের আমবাগানের বস্তিতে গিয়ে ওঠে জান্নাত। নায়িকা মহুয়ার বাসায় গিয়ে খবর দিয়ে রাখে। বিয়ামের পাশের বস্তি পোড়ার ঘটনা টিভিতে দেখেছে সবাই। জান্নাতকে দুইদিনের ছুটি এবং এক হাজার টাকা দেয় মহুয়া। জান্নাতের চোখ ভিজে ওঠে কৃতজ্ঞতায়। পা ধরে সালাম করে নায়িকাকে। 
আমবাগানের বস্তিতে একদম নতুন করে সংসার পাতে জান্নাত। রমজান আর বাদশার সংসারের সব চিহ্ন নষ্ট হয়ে গেছে। এক দম না হলে চলে না, এমন কয়েকটা জিনিস কেনে কাওরানবাজারে গিয়ে। ভাইকে মোবাইলে ফোন করে মাকে গ্রামের বাড়ি থেকে আনায়। ভাই খুশি মনে মাকে দিয়ে যায়। এখন ছোট দুই শিশুকে দেখে রাখে ওর নানি। ঢাকা শহরে এসে মেয়ের সঙ্গে স্বাধীনভাবে থাকতে পেরে জান্নাতের মাও খুশি। 
সাকিব স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ভোরে ওকে স্কুলে দিয়ে জান্নাত নায়িকা মহুয়ার বাসায় কাজে যায়। সাকিব নিজেই অন্য ছেলেদের সঙ্গে বস্তির ঘরে ফেরে। জান্নাত সারাদিন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কাজ করে নায়িকার বাসায়। সব দিন ওর সঙ্গে মহুয়ার দেখা হয় না। যে ব্যস্ত থাকেন উনি। মা সব রান্নাবান্না করে রাখে বলে জান্নাতের ঘরে ফিরে তেমন কিছু করতে হয় না। মনের কথা বলার মতো একজন মানুষও আছে। পৃথিবীতে মায়ের মতো তো আর কেউ হয় না। নায়িকা মহুয়ার বাসায় চাকরি করে বলে বস্তির সবার কাছে জান্নাতের গুরুত্বই আলাদা। উঠতি বয়সের ছেলেরা বলে ওরা নাকি বিনা পয়সাতে এই চাকরি করত। টিকেট না কেটে নায়িকাকে দেখতে পাওয়া কি সহজ ব্যাপার। নিজেকে খুব গর্বিত মনে হয় জান্নাতের। 


• কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্র।

menu
menu