কাছিমের মা

হারাণ সর্দারের বউ পুঁটিরানি। আট মাসের পোয়াতি। মাছ-মাংস শাক-সবজি যা মুখে দেয় তাই গন্ধ লাগে। বমি করে। মুখে রুচি নেই। তবে খুব মজা করে খায় দু’টো জিনিস। উঠোনে রান্না করার চুলার ভিতরের লাল লাল পোড়া মাটি আর টক টক আচার। আচার সে তেঁতুল, কদবেল বা জলপাই সবই তার কাছে অমৃত।
হারাণের জাত ব্যবসা বনজঙ্গল থেকে খরগোশ ধরা আর খাল বিল থেকে কাছিম ধরা। মাঝেমধ্যে গৃহস্থ বাড়িতে মাটি কাটার কাজ করে। তখন অন্য কিছু করার থাকে না তাই করে। এলাকায় সিগারেট তামাকের আবাদ শুরু হওয়ার পর থেকে গাছপালা ঝোপঝাড় সব উজাড় হয়ে যাচ্ছে। খরগোশ ধরার মতো জায়গা আর পাওয়া যায় না। কাছিম ধরার খালবিলও সব আবাদে উঠে যাচ্ছে। তারপরও চেষ্টা করলে হারাণ কাছিম ধরতে পারে। বাপ-দাদার পেশাটা সে ভালোমতোই রপ্ত করেছে। খালের ধারের মাটি দেখলেই সে বুঝতে পারে কোথায় খোঁচা দিলে কাছিম পাওয়া যাবে। আর বিলে পানির গন্ধ শুঁকেই বলতে পারে এই বিলে কী জাতের কাছিম আছে।
পুঁটিরানি ধানের চারা লাগাতে খুবই দক্ষ। সর্দার পাড়ার সব মহিলারাই মাঠের কৃষি কাজ করে। তবে পুঁটিরানির মতো দক্ষ কেউ না। গৃহস্থ পাড়ায় তাই তার অনেক কদর। দিনে সে একজন পুরুষ মানুষের থেকে অন্তত দেড় গুণ বেশি ধান লাগাতে পারে। এছাড়া পাটের নিড়ানি দেয়া, ধান পাট কাটা, পাটের আঁশ ছাড়ান, সব কিছুতেই তার জুড়ি মেলা ভার। পুরুষ চাষিরা যা কিছু করে সব কাজই সে করে একমাত্র হাল বাওয়া ছাড়া। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সিগারেট তামাক আবাদের কাজ। যখন মাঠের কাজ থাকে না তখন হয় ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান তোলে অথবা বন জঙ্গল থেকে খড়ি সংগ্রহ করে। তবে পোয়াতি হওয়ার পর থেকে পুঁটিরানির বিশেষ কদর কমেছে। এখন লোকে তাকে খুব একটা কাজে ডাকে না। যদিও বা কেউ ডাকে তবে টাকা দেয়ার সময় অন্যদের থেকে কম দেয়।
পুঁটিরানি ভাবে  জগতের নিয়মই বোধ হয় এ রকম । যতদিন তুমি দিতে পারবে ততদিন বাহবা পাবে। যখন তুমি দিতে পারবে না তখন সবাই তোমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। হয়তো স্বয়ং ঈশ্বরও তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়। কয়েক মাসে পুঁটিরানি তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। শুধু বাইরের জগতে নয় তার ঘরের অভিজ্ঞতাও একই রকম। ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামী হারাণ সর্দারও এখন মুখ ফিরিয়ে থাকে। তার মন পড়ে থাকে ফরিদপুর পদ্মার চরে সিএন্ডবি ঘাটের পাড়ার মহিলাদের কাছে। এখন ঘন ঘন কাছিমের চালান নিয়ে যায় ফরিদপুর। মহাজনের কাছে মাল বুঝিয়ে দিয়ে পাড়ায় ঢুকে পড়ে। সেখানেই রাত কাটায়। কোনো কোনো সময় একটানা দু’তিন দিন কাটিয়ে তবে বাড়ি ফেরে। তা নিয়ে পুঁটিরানির সঙ্গে যেমন ঝগড়া হয় তেমন মাঝে মাঝে গল্পও হয়। নতুন নতুন ব্যবসা আর নতুন নতুন মহিলাদের গল্প। ইন্ডিয়ার গরুর ব্যবসা থেকে শুরু করে হিরোইনের ব্যবসা, ইয়াবার ব্যবসা, অস্ত্রের ব্যবসা সব ব্যবসায়ীদেরই মাল পারাপারের ঘাট এই সিএন্ডবি ঘাট। অধিকাংশ ব্যবসায়ীরাই তাদের কাজ শেষে পাড়ায় রাত কাটায়। সেখানেই নানা রকম ব্যবসায়িক লেনদেন হয়। প্রথম প্রথম এসব গল্প শুনে পুঁটিরানিও বেশ মজা পেত। এখন তার ভিতরে ভয় বাসা বেঁধেছে। নানা রকমের ভয়। নানা রকমের আতঙ্ক। দিন দিন হারাণের ওই সিএন্ডবি ঘাটের পাড়ার মহিলাদের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। নেশার মাত্রা বাড়ছে। খরচ বাড়ছে। আরও বেশি আয় করার জন্য বেশি আয়ের ব্যবসার ফাঁদে পা দিতে চায়। কাছিমের ব্যবসা এখন আর তার ভালো লাগে না। অথচ কাছিমের ব্যবসা তার বাপ-দাদা তিন পুরুষের ব্যবসা।
হারাণের দাদা কাছিমের চালান নিয়ে যেত কলকাতায়। তখন ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়নি। সরাসরি ট্রেন চলত কলকাতা পর্যন্ত । মিরপুর স্টেশন থেকে সকালে ট্রেনে উঠত শিয়ালদা স্টেশনে নেমে বউ বাজারের মহাজনের কাছে মাল বুঝিয়ে দিয়ে রাতের ট্রেনে ফিরে আসত। হারাণের বাবা পলান সর্দার যখন ব্যবসা শুরু করে ততদিনে ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেছে। দর্শনা-গেদে বর্ডার হয়েছে। ট্রেন দর্শনা পর্যন্ত যায়। তারপর চোরাই পথে বর্ডার পার করতে হয়। সহজ সরল সৎ ব্যবসাটা নাম পাল্টে রাতারাতি হয়ে গেল চোরাচালান। হারাণের বাবা কলকাতার ব্যবসাটা কিছুদিন বন্ধ রেখে খুলনায় মাল পাঠাত। সেখানে কাছিমের চাহিদা কম। দাম পাওয়া যায় না। ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজারেও মাল পাঠাত তবে কুষ্টিয়া থেকে তখন ঢাকার যোগাযোগ এত ভাল ছিল না। তারপর আস্তে আস্তে চোরাচালানির গোপন রাস্তা-ঘাট জানাচেনা হয়েছে। হারাণ তার বাপের সঙ্গে কাছিমের বস্তা নিয়ে দর্শনা যেত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন পাকবাহিনীরা সর্দার পাড়া পুড়িয়ে দেয় তখন হারানের বাবাকে এলাকার রাজাকাররা জবাই করে হত্যা করে। কারণ সে হারাম জিনিসের ব্যবসা করত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হারাণ বাপের চেনানো দর্শনার পুরান রাস্তা দিয়েই ব্যবসা করত। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কতকিছুই পরিবর্তন হয়েছে। কাছিমের ব্যবসাও তার দিক পরিবর্তন করেছে। আগে বাংলাদেশ থেকে কাছিম যেত কলকাতায়। এখন ভারতের বিভিন্ন অন্চল থেকে বিভিন্ন জাতের কাছিম চোরায় পথে বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। তারপর তা ঢাকায় যায়। ঢাকা থেকে চলে যায় চীন, হংকং, থাইল্যান্ডের মতো বিভিন্ন দেশে। নদীপথে যায়, উড়োজাহাজে যায়। কাছিমের ব্যবসাও এখন জাতে উঠেছে। এই ব্যবসার সঙ্গে এখন আর শুধু সর্দার শ্রেণির আদিবাসীরাই জড়িত নয়। এখন সাধারণ বাঙালিরাও কাছিমের ব্যবসা করে। সে সব নতুন নতুন জাতের কাছিম। যদিও হারাণ এখনো দেশি কাছিমেরই ব্যবসা করে। ভারত থেকে চোরাই পথে আসা কাছিমের ব্যবসা সে করে না। এখন রাস্তা ঘাটে বিজিবি পুলিশের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তারপর বাড়ির পাশে বিজিবির নতুন সেক্টর বসেছে। তবে কাছিমের ব্যবসার একটা বড় সুবিধা হল পুলিশ বিজিবি কেউই খুব একটা ঝামেলা করে না। সবাই ঘৃণার চোখে দেখে । বিশেষ করে কাছিমের বস্তা পুলিশ বিজিবির কেউই গাড়িতে তুলতে চায় না। কিছু টাকা গুঁজে দিলেই মাফ পাওয়া যায়। তারপরেও একবার তিন মাসের জেল খেটেছে। অথচ হিরোইন ইয়াবার ব্যবসায় একবার ধরা পড়লেই ক্রসফায়ার। এ জন্যই পুঁটিরানির যত আপত্তি এসব ব্যবসায়। অথচ হারাণের মাথায় এখন লোভ ভর করেছে। টাকার লোভ। সিএন্ডবি ঘাটের মহিলাদের লোভ। দেশি কাছিম বিক্রি করে মাঝে মাঝেই ভারতের ছোট ছোট কাছিম কিনে আনে খাওয়ার জন্য। হারাণ বলে ওগুলো খেলে নাকি মরদের শক্তি বাড়ে। তাই নিয়ে পুঁটিরানির সঙ্গে অশান্তি। পোয়াতি মানুষ। শরীর দুর্বল। তারপর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। কাজে যেতে পারে না। কাজে গেলে ঠিক মত মজুরি পায় না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘরের অশান্তি। তাই নিয়ে ঝগড়া হয়। সেদিন রাতেও দুজন ঝগড়া করেছে। ঝগড়া করলে পুঁটিরানির খুব কান্না পায়। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। তার কান্না দেখলে হারাণের মনটা নরম হয়। তখন তার জেদ কিছুটা কমে আসে। বুঝতে পারে পুঁটিরানি যা কিছু বলে তা সব কিছু তার ভালোর জন্যই বলে। সংসারের ভালোর জন্য বলে। তাদের একটা বাচ্চা হবে তার ভালোর জন্য বলে। সবকিছু ভেবে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু সব দিন তো একরকম হয় না। সেদিন পুঁটিরানি কাঁদে না। মাঝ রাত পর্যন্ত ঝগড়া চলতেই থাকে আর হারাণের জেদ বাড়ে। হারান সিদ্ধান্ত নেয় সে বেনাপোলের পুটখালী সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে কাছিম এনে বিক্রি করবে। এতে লাভ বেশি কিন্তু ঝুঁকি কম। তবে বিজিবি বিএসএফ’র গুলি খাওয়ার ভয় আছে। গত সপ্তাহে সিএন্ডবি ঘাটের চায়ের দোকানে বসে বাদলের সঙ্গে ভাব হয়েছে। ওর বাড়ি পুটখালী সীমান্তের বারপোতা গ্রামে। আগে ইন্ডিয়া থেকে কাছিম আনত এখন গরু আনে। মাঝে মাঝে গরুর সঙ্গে ফেন্সিডিল আনে। এসব ব্যবসায় পুঁজি লাগে না। মাল বর্ডার থেকে এনে ঘাটে পৌঁছে দিলেই টাকা পাওয়া যায়। এসব ব্যবসায় টাকা খাটায় বড় লোকেরা। তাদের অনেক ক্ষমতা। কাছিমের ব্যবসায় পুঁজি লাগে। কাছিম নিজের টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয়। হারাণ সকালে ঘুম থেকে উঠে পুঁটিরানির জমানো টাকাগুলো পকেটে নিয়ে রওনা হয়ে যায় ফরিদপুর সিএন্ডবি ঘাট। কথামতো দেখা পায় বাদলের। বাদলের সঙ্গে রওনা হয় পুটখালীর উদ্দেশ্যে। পরদিন সন্ধ্যায় বর্ডার পার হয়ে ওপারে বনগাঁর জেলে পাড়া থেকে কাছিম কেনে। বাদলের গরুর চালান ছিল। অন্ধকার ঘন হলে তারা বর্ডার পার হয়ে যখন বাংলাদেশে ঢোকে তখন হঠাৎ করেই বিএসএফ গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। হারাণ রাস্তা চেনে না। বাদলের পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকে। হঠাৎ পায়ে কিসের যেন একটা আঘাত লাগে। হারাণ মাটিতে পড়ে যায়। প্রথমে বুঝতে পারেনি। মাটি থেকে উঠতে গিয়ে দেখে পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরচ্ছে। হাঁটুর নিচ থেকে বেশ কিছুটা মাংস খাবলা হয়ে ছুটে গেছে। হারাণের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পুঁটিরানির চেহারাটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কানে বাজতে থাকে পুঁটিরানির কথা, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। হারাণ ভাবে আমি কি তাহলে মারা যাচ্ছি! মাজা থেকে গামছা খুলে বেঁধে ফেলে গুলি লাগা জায়গাটা। দূরে কয়েকটা টর্চ লাইটের আলো দেখতে পায়। বুঝতে পারে আলো তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বাদলের কোন খবর নেই। তার পরিচিত এলাকা। সে ঠিকই পালিয়ে গেছে। কিন্তু হারাণকে তো বাঁচতে হবে। পুঁটিরানি তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। পুঁটির পেটে তার বাচ্চা। হারাণ দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ে জমিতে সেচ দেয়া একটা ক্যানেলের মধ্যে। তারপর ক্যানেল ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে। মাথার মধ্যে তখন একটাই চিন্তা তাকে বাঁচতে হবে। বিজিবির হাতে ধরে দেয়া যাবে না কিছুতেই। ক্রসফায়ারের ভয় না থাকলেও এর আগে একবার পুলিশের হাতে মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা তার আছে। তাছাড়া কাকে কখন কোন কেসে ফাঁসিয়ে দেয় তা কে জানে। হারাণ আগাতে আগাতে একটা রাস্তার নিচ দিয়ে যাওয়া বেশ লম্বা চওড়া একটা সিমেন্টের পাইপের ভিতরে ঢুকে পড়ে। লাইটগুলো তখন তার আশপাশের জমির উপরে খোঁজাখুঁজি করে এক পর্যায়ে ফিরে যায়। পাইপের ভিতরে বাইরে তখন ঘন অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হারাণ বুঝতে পারে তখনো তার পা দিয়ে রক্ত ঝরছে।
ভোর রাতের দিকে একটু আবছায়া আলো ফুটলে দেখে তার পাইপের মধ্যে দু’টো কাছিমের বাচ্চা। প্রথমে বাচ্চা দু’টোকে দেখে হারাণের হাসি পায়। পরক্ষণেই অন্য একটা ‌অনুভূতি তার মাথার মধ্যে খেলা করে। এই বাচ্চা দু’টোও তো কোনো একটা কাছিমের বাচ্চা। ওরাও হয় তো আমার মতো বিপদে পড়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। ওদেরও তো বাঁচতে ইচ্ছে করে। শুধু দু’টো পয়সার জন্য আমরা পৃথিবী থেকে ওদের বংশ ধ্বংস করে দিচ্ছি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় বেঁচে থাকলে সে আর কাছিম ধরার কাজ করবে না। পাইপ থেকে বেরিয়ে একটু সামনে এগিয়ে যেতেই বাদলের দেখা পায়। গরু কাছিম সব হারিয়ে দু’জনেই খালি হাতে বাড়ি ফেরে। বাদল হারাণকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আঁটকে দেয়। বলে, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত একদম বাইরে বের হওয়া যাবে না। বিজিবি খবর পেলে অনেক ঝামেলা হবে। বাদল গ্রামের একজন ডাক্তার ডেকে আনে। সে দু’টো ইন্জেকশন দেয়, গুলি লাগা জায়গাটা ভালোমতো পরিষ্কার করে সাদা পাউডার ছিটিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়।
হারাণের বাড়ি থেকে বেরোনোর সাতদিন পর পুঁটিরানি হাট থেকে সবজি আর গাছের চারা বিক্রি করা টাকা ঘরে এনে রাখতে গিয়ে বুঝতে পারে তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। হারাণ তার জমানো সমস্ত টাকা নিয়ে গেছে। কতদিন থেকে তিল তিল করে করে সে প্রায় দশ হাজার টাকা জমিয়েছিল। সামনে তার কত রকমের খরচ। বাচ্চা হওয়ার খরচ, বাচ্চার দুধ, খাবার, পোশাক কত স্বপ্ন তার মনে। হারাণের ইচ্ছা বাচ্চা হওয়ার সময় হাসপাতালে নিয়ে যাবে। পুঁটিরানির ইচ্ছা বাড়িতে দাইমার কাছে বাচ্চা হবে। কারণ বাচ্চা হওয়ার জন্য হাসপতালে গেলে সেখানে পুরুষ ডাক্তার থাকে। এটা ভাবলেই পুঁটিরানির লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করে। আজ তার সব স্বপ্ন, সব আশা ভরসাই অবান্তর মনে হয়। হারাণ এরকম একটা কাজ করতে পারবে সে কোনো দিন ভাবতেও পারেনি। তার শরীরের এমন অবস্থায় হারাণ বাড়ি ছাড়া। তার ওপরে সংসারের সমস্ত সঞ্চ নিয়ে লাপাত্তা। পুঁটিরানির বড় অসহায় লাগে। হাউ মাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। দাইমা বলেছে পোয়াতি হলে মন খারাপ করতে নেই, কান্নাকাটি করতে নেই। সব সময় আনন্দে থাকতে হয়। অথচ তার জীবন আজ নিরানন্দে ভরা। তাই তো আজ রাতের ভাত খাওয়ার পর ঘরের বারান্দায় বসে একটা সিগারেট ধরায় পুঁটিরানি। দাইমা’র কথা মতো আজ প্রায় ছয় মাস হলো সে সিগারেট খায়নি। বাচ্চাটার ক্ষতি হবে বলে দাইমা নিষেধ করেছে সিগারেট খেতে।
অনেক দিন পরে সিগারেটে টান দিয়ে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়। হঠাৎ মনে হয় আবছায়া অন্ধকারের মধ্যে একটা মানুষের অবয়ব রেললাইনের দিক থেকে এগিয়ে আসছে। মানুষের আকারটা তার খুব চেনা কিন্তু হাঁটার ধরনটা তার খুবই অপরিচিত। হারিকেনটা একটু উঁচু করে ধরে। মানুষটা আর একটু কাছে আসতেই বুঝতে পারে সে হারাণ।
—কুনু রকমে জানডা লিয়ে ফিইরে আইচি রে বউ। তুই আমাক বাঁচা।
কথাটা বলতে বলতে হারাণ বারান্দার খুঁটিটার সঙ্গে ঠেস দিয় বসে পড়ে। পুঁটিরানির হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে দু’টো টান দেয়।
—আমাক এক ঘটি জল দে। গলাডা শুকায়ে কাট হয়ি গিইচে, বড্ড জল খাতি মন চাচ্চে। 
পুঁটিরানি কি বলবে আর কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। যখন জলের ঘটিটা হাতে দেয় তখন হারাণ পুঁটিরানির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘কাওরি কোবি না, পুটখালী বডারে কাচিম আনতি গিয়ি এই দ্যাক বিএসিপির গুলি খাইচি। অল্পের জন্যি জানে বাঁইচি গিইচি।’
পুঁটিরানি হঠাৎ হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে। হারাণ পুঁটিরাণীর মুখে হাত চাপা দেয়। বলে, ‘বাইচি যখুন আসিচি তখুন ট্যাকার চিন্তা করিস না। আবার আমারা ট্যাকা জমাতি পাইরবো’। পুঁটিরানি ঠিক বুঝতে পারে না কেন সে কাঁদছে। কিন্তু তার বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে কান্না বের হয়ে আসছে। কিছুতেই থামাতে পারছে না। এ কান্না তার টাকার শোকে নয়। এ কান্না হারাণ ফিরে আসার আনন্দেও নয়। এ কান্না হারাণের হারিয়ে যাওয়া বা গুলি খেয়ে মরে যাওয়ার আতঙ্কেও নয়। হারাণ খাওয়া দাওয়া শেষে শুয়ে পড়ার পরও পুঁটিরানি তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। ইদানীং রাতে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যায়। বাচ্চাটা পেটের ভিতরে অতিরিক্ত নড়াচড়া করে। মাঝে মাঝে উদ্ভট সব স্বপ্ন দেখে।
ঘরের মাঝে কয়েকটা জোনাক পোকা ঢুকে পড়ে। অন্ধকার ঘরের এখানে ওখানে পুট পুট করে আলো জ্বলতে থাকে। আলোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মনে হয় আকাশের তারারা সব ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। পুঁটিরানির পেটের মধ্যে চিন চিন করে ব্যথা করতে থাকে। ব্যথা বাড়তে থাকে। পেটের মধ্যে মোচড় দিতে থাকে। এমন ব্যথা সে কখনো অনুভব করেনি। জোরে চিৎকার করে হারাণকে ডাকতে চায় কিন্তু ডাকতে পারে না। গলার মধ্যে কিসের যেন একটা দলা আঁটকে গেছে। কিছুতেই শব্দ বেরচ্ছে না। হঠাৎ পেটে মোচড় দিয়ে কি যেন একটা বেরিয়ে এল। পুঁটিরানির শরীর ঘেমে বিছানা ভিজে যাচ্ছে, নাকি রক্তে বিছানা ভিজে যাচ্ছে পুঁটিরানি ঠিক বুঝতে পারে না। ফিসফাস করে কারা যেন কানের কাছে কথা বলছে। মনে হচ্ছে ঘর ভর্তি মানুষ। পাড়ার সব মহিলা, ছেলে, বুড়ো সবাই তার ঘরের মধ্যে। পুঁটিরানি সবার চেহারা চিনতে পারে না। কেমন যেন সবকিছু আবছায়া অন্ধকার। হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একজন চিৎকার করে বলছে, তোমরা সবাই দেখে যাও পুঁটিরানির পেট থেকে একটা কাছিমের বাচ্চা হয়েছে। আবার হাসির শব্দ। কেউ একজন বলছে, দেখো দেখো কী সুন্দর কাছিমের বাচ্চা। কেমন একটা গুঞ্জন উঠছে চারিদিক থেকে।
—মানুষের পেটে কাছিমের বাচ্চা! কালে কালে কত কিছুই না দেখতে হবে। এত কাছিম মারলে পেট থেকে কী আর মানুষ জন্মাবে? 
—হারাণ যখন ঘরে থাকে না তখন তো পুঁটিরানি কাছিম নিয়েই শুয়ে থাকে। এই জন্যই তো পেট থেকে কাছিমের বাচ্চা হয়েছে।
কে যেন একজন টিপ্পনী কাটছে। আবার হাসির শব্দ। পুঁটিরানি কানে হাত চাপা দিতে চায়। কিন্তু হাত নড়াতে পারে না।
কারা যেন ঘরের মাঝে আলোর ঝিলিক দিচ্ছে। ছবি তুলছে। বড় বড় ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে। সেবার পুঁটিরানির বাড়ির পাশে বাস এক্সিডেন্ট হয়েছিল তখন এ ধরনের বড় বড় ক্যামেরা এসেছিল। সেই ছবি রাতের বেলায় মণ্ডল বাড়ির টেলিভিশনে পুঁটিরানি দেখেছে। আজ তার ছবিও টেলিভিশনে দেখাবে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে পুঁটিরানির। এমন সময় আবার একটা গুঞ্জন উঠল।
—ওই যে, ওই যে নড়ছে। শুঁড় বের করেছে। ওই তো হাঁটছে। হাঁটাতে হাঁটতে পুঁটিরানির বুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
পুঁটিরানি বুঝতে পারে কাছিমটা তার গা বেয়ে বুকের কাছে উঠে আসছে। বুকের উপরে সুরসুরি লাগে। বুঝতে পারে কাছিমটা তার বুকের দুধ খাচ্ছে। পুঁটিরানির বাচ্চাটার জন্য খুব মায়া হয়। সে দু’হাত দিয়ে বাচ্চাটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে আদর করতে চায়। ঠিক সেই সময় ঘুম ভেঙে যায় হারাণের। সে বাচ্চাটাকে পুঁটিরানির হাতের ভিতর থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায়। পুঁটিরানি, ‘আমার বাইচ্চা, আমার বাইচ্চা’ বলে চিৎকার দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। তার চিৎকার শুনে হারাণ ঘুম ভেঙে বুঝতে পারে যে পুঁটিরাণী স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। তার শরীর ঘামে ভেজা। হারাণ তার হাতের কাছের জলের ঘটিটা পুঁটিরানির মুখের কাছে ধরে। জিজ্ঞাসা করে, কি স্বপ্ন দেকিচিস ?
—আমার পেট থিকি এট্টা কাচিমির বাইচ্চা হয়িচে। সত্যি কি মানুষির পেট থিকি কাচিমির বাইচ্চা হয়?
—কাচিমির স্বপ্ন দেখা তো ভালো। তোর ছেলির আয়ু হবি দুইশো বচর।
হারাণ পুঁটিরানিকে আশ্বস্থ করার চেষ্টা করে। পুঁটিরানি হারাণের হাতটা ধরে তার পেটের উপরে রাখে।
—দ্যাক, নড়তিচে। খুব জ্বালাতন করে। ও তুমার মতো এট্টা দুষ্টু ছেলি হবি। ওরে ইশকুলে পড়াবো। ওরে আমি কাচিম মারতি দেবো না।
—আমি জানি, ও মেয়ি হবি।
—মেয়ি হলিউ আমি ওরে ইসকুলি পড়াবো। মাঠে কাজ করতি দেবো না। ছেলি হলি নাম রাইকপো  কাচিম সর্দার। কথাটা বলে পুঁটিরানি মুখ টিপে হাসে।
—তাহলি তুই হবি আমার কাচিমির মা।
—তুমি হবা কাচিমির বাবা। তা হলি তুমি কতা দ্যাও আর কুনুদিন কাচিম মারবা না। 
হারাণ বালিশ থেকে মাথা তুলে পুঁটিরাণীর মুখের ওপর মুখ রেখে বলে, ‘আর কুনুদিন কাচিম মাইরবো না। এখুন আমার এট্টাই কাজ কাচিম আর কাচিমির মা-কি আদর সোহাগ করা।
পুঁটিরানির মুখটা লজ্জায় লাল হয়।  জানালার ফাঁক দিয়ে তখন ভোরের আলো এসে পড়েছে তার মুখের ওপর। পুঁটিরানির কাছে দিনটাকে অন্যরকম মনে হয়। আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে।


• কথাসাহিত্যিক ও কৃষি বিশেষজ্ঞ, যুক্তরাষ্ট্র। 

menu
menu