ইকবাল আনোয়ারের অণুগল্প

দুঃখী মানুষ সুখ সইতে পারে না

আমার চাচির বারান্দায় তিন দিন না-খাওয়া, একটা কৃশকায় মানুষ বসে আছে। তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। আমি চাচিকে গিয়ে বললে, তিনি এক টুকরা ইলিশ, গাঢ় ডাল, ভাত উঁচা করে একত্রে একটা থালে দিয়ে, এক মগ পানিসহ আমাকে পাঠায়। লোকটা ঘাড় কাত করে চকচকে চোখে দেখে, এত সুখ দেখে কেঁদে দেয়। তারপর মগের সামান্য পানি খরচ করে বারান্দার কোণে হাত ধোয়। তারপর ভাতের সাথে ডাল মাখে। লবণ চেয়ে নিয়ে শিল্পীর মতো তা মিশায়। লোকটা একটা আলুর টুকরা দিয়ে ভাত খেয়ে ইলিশের টুকরাটা আনাম রেখে দেয়। সবার শেষে আয়েশ করে নিরালা ইলিশ খেতে শুরু করে।

পাশে চাচির চামড়া ছোলা কুকুরটা অপেক্ষায় ছিল। লোকটা চাবিয়ে ইলিশের কাটাও খেয়ে ফেলে। কুকুরটা নিরাশ হয়ে যেই না উঠে পরবে--লোকটা তখনই বমি করে দিল। তার দুটি চোখ ভাঙা মার্বেলের মতো ঘোলা  হয়ে গেল। যদিও তার জিহ্বা খেতে পারার নির্জলা সুখ পায়, কাফফারা বেশিই হয়।

সে কাত হয়ে নিথর পড়ে থাকে, আর কুকুরটা সব খাবার খায়। লোকটার মুখে লেগে থাকা বমিটুকুও চেটে খায়।

 

ফুল ফুটতে দেরি

তারপর এতো বেলায় এসে, একটা আশ্চর্য ফুল ফুটল। রং তার সাদা কিংবা লাল।

শৈশব যখন ফুটেনি, কৈশোরেও জুটেনি! তখনো তো মানুষ ছিলাম! ছোট হলেও পুষ্ট একটা মন ছিল! বলি কি, তখনকার মনটাই ছিল রিষ্ট, মাসুম তৃষ্ণায় তাতানো।

মাসীমার গন্ধ শুকার সৌভাগ্য হতো, পড়া পারলে, বুকে টেনে নিতেন, কেমন মদিরে মাড় দেয়া, আর ছেলেদের গন্ধ একটু ঘেমো, ঝাল চানাচুর, মেয়েদের টক দই, কম টক, বই-এর গন্ধ, নুতন হলে, মিষ্ট, এখন হলে বলতাম, মদ- মিষ্ট। টাকার গন্ধ এমনি, তবে, নেশায় ঘুম নিয়ে আসা। গন্ধ শুকার মনের শিকার হতে যখন তোমরা, না মানে তুমি। সেই ফুলটা, নাকি ফলটা! একের থেকে অপরের প্রকাশ, ফল হলে বলতে পরি, অকালের কাঁঠাল যেমন মিষ্টি হয়, তেমনি।

আমি শিহরণে শিহরণে বনরুই। এক মুষ্টি আনন্দ, বাউল বাতাস হয়ে উড়ে গেলো জিসমান থেকে রুহান।

ক্লাসে মার খেলে, তুমি ফিল করতে, সমবেদনা অথবা টিটকারী, তাতে কি! ফিল করতে তো! পিকনিকে, তুমি যতো চঞ্চল, আমি ততো কুনো আর ভিতু, কাতুকুতু দিলেও হাসবো না, এমন তুবড়ানো। আমলকী রং চাঁদোয়ায় আমার ভালোলাগা বিছানো থাকতো, যতদূর চোখ যায়, যতটুকু ছড়ানো যায়। না, তোমাকে কেবল না, সব কিছুকে, এমনকি ঘিণ ধরা কেঁচোকেও ভালো লাগে কেবল তোমার জন্য, সব সুন্দরের শৈশবে, সকল সুন্দর থেকে তোমাকে এক পদ এক পদ দিতে চেয়ে আমি বহুদূর চলে এলাম, কোথায় জানি না!

তারপর এতো বেলায়, তুমি, হঠাৎ ভুল পথে দেখা হলে, বললে, হ্যাঁ, তোমাকে চিনি তো। তুমি না স্কুলে, প্রথম হতে পড়ায়, আমি গানে!

তুমি প্রিয় ছিলে সবার!

--তোমারও কি?

বলার আগেই একটা ফুল ফুটে যায় লাল অথবা সাদা। রঙে কিবা আসে যায়, ফুল তো ফুটেছে! ফুল না ফুটে পারে না!

 

খুঁড়িয়ে হাঁটা বালকের শালিক

আমার শালিকের খুব সখ ছিল। স্বপ্ন ছিল ভাত শালিক। খয়েরি রং। কি চঞ্চল। হলদে ঠোঁট আর পা। হা করলে হলুদ একটা বর্ডার ঠোঁটের সবটায় ধরা পরে। কিন্তু কোথায় পাব! আর চটে শালিকের স্বপ্ন দেখা তো একদম বারণ। ওটাতো অধরা। ভাত শালিকই মেলে না। চটে নাকি ময়না সম। কথা বলে। দেখেছি দুরন্ত যুবক, অথবা ডাকু দোকানদার পালে। কলা দেয় খেতে। গো শালিক প্রচুর পাই। গোপাটে কেবল তাদেরই দেখা মিলে। বাসায় বাচ্চা ও দেখেছি। জামের মৌসুমে এদের বহু দেখা যায়। দু একটা ভাত শালিকের বাসা মগ ডালে দেখি। কে পেরে দেবে! আমি সামান্য বালক।

আর কিনা হঠাৎ চটে শালিকই হলো আমার। সে এক অমল ধবল সময়। যে কটা দিন শালিকটা ছিল, ততদিনই জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন।

--কীভাবে এ শালিক আমার হলো?

একদিন, ঘরে, উড়ে এলো অধরা। দরজা জানালা বন্ধ করে, ওটাকে ধরার চেষ্টায় পুরো পরিবার। শালিকটা বেদম উড়ছে। ভাতের ডেকচি উল্টে দিল, ভাতগুলো নষ্ট, আমার প্রিয় খেলনা, কাগজের, ঝুলানো ছিল, ছিঁড়ে ফেললো, তারপরও ওটা ধরতে হবে, চটে শালিক বলে কথা। দৌড়াতে গিয়ে এখানে বসে, ধরতে গেলে ওখানে চলে যায়। এবার, আলমারির উপরে ছিল, হ্যারিকেনের চিমনি, ওটা  ভেঙে ফেলল। হায় একি তাণ্ডব। আমরাও বেপরোয়া হয়ে যাই। যেকোনো মুল্যে এটা ধরা চাই। এবার ঘটলো সবচেয়ে বড়ো দুঃখের ঘটনা। আমাদের ঘরের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস, সে নীল নকশা করা কাচের পেয়ালাটা ভেঙে ফেললে। আমাদের মন ভীষণ খারাপ হলো, এ ক্ষতি পূরণ হবার না। অবশেষে শালিকটা ধরলাম। একটা মামুলি খাঁচা জোগাড় করে পালতে লাগলাম শালিকটাকে।

একদিন, পাড়ার মস্তান এসে দাবি করে, এটা তার, খাঁচা থেকে পালিয়ে এসেছে।

দিয়ে দিতে হলো শালিকটাকে। ভাঙা পেয়ালার কাচে আমার পা বিদ্ধ হয়েছিল। সেই থেকেই খুঁড়িয়ে হাঁটা ।

 

ঝলকন, ধাঙ্গড় বন্ধু আমার

ঝলকন, ধাঙ্গড় আমার বন্ধু, পোদ্দার পুকুরের ওপারে রানির বাজারের পেছনে মেথর পট্টিতে থাকতো। মিশ-কালো পেটানো গতর, কুঁকড়া চুল, তার সঙ্গে খেলতাম, ঝগড়া করতাম। উদাম গায়ে একবার মারামারি করাতে, আম্মা জেনে ফেলেন, ফলে আমাকে রাতে গোসল ছাড়া ঘরে জায়গা দেয়া হয়নি, সোনা রুপার পানিতেও গা ধুয়ে দেয়া হয়।

ঝলকনের মাও চাইতো না, সে আমাদের সঙ্গে খেলুক, মা বাবা চাইতো, সে তো ডাঙর হয়েছে, কিছু কাজ টাজ করুক, কাজটা বুঝে নিক। পুকুরেরও পাড় থেকে তার মা ডাকতো-কাহারে ঝলকইন্যা, জালদি আ না রে, কিতা হইলো রে, মুইলা ঢালার সুময় চইলা যায়। তাদের পালা নেড়ি কুকুরটাও তার মায়ের চিৎকারের সাথে সমানতালে শাসাতো।

ঝলকনের বাবার পাকানো মোচ, ভালো তো ভালো, হঠাৎ দেখা গেল, খেয়ে ভূত, টলতেও পারে না আর, একদম ঢলে পরে নুনাবাদের গেইটের পারে, চিৎ হয়ে গাল পারছে-তে সাহেব হইয়া যাইবো, হুগাত গু নাই এক ছটাক, জিলিপি বানাইবো! জিলাপি শব্দটা এলে বহু কষ্টে বা হাতের আঙুলটাকে পুরানো কলের গানের মতো ঘুরাতো, তেজপাতা রং মোচের, ময়লা সাদা খেটো ধুতি নিমা পরা বুড়োটা।

দোকান থেকে ডেনিশের টিনে না ছোঁয়া উপায়ে তারা চা নেয়, বাইরে বসে পরোটা ভিজিয়ে খায়, মেয়েদের উদাম বুকে তখন শিশুরা দুধ চুষে, এক জন কানে গুজা আধ খাওয়া বিড়িতে আগুন ধরিয়ে উদাস টান দেয়, আর দূর পানে ঘোলা চোখে তাকায়, আরেক জন কান খোচায়, মাগিরা সেই সকাল থেকেই যার যার নাগরে বুদ হয়ে থাকা সুলতানি সুখ থেকে টেনে তুলে কাজে যাবার তাড়া দেয়, ফলে মদ্দারা বউদের উদ্দেশ্যে জন্ম জন্মান্তরের অভিশাপ দেয়-কতো লোকের মরণ হয়, তোর হয় না কেনে!

ঝলকনের মনে বড়ো ঘিণ লাগে। সে এ পেশা বর্জন করবে, এ কোন্ জাতে তার জন্ম! সে তার জাতকে অস্বীকার করে নুতন জাতক হবে! তাই সে বাজারের পাশে একটা সাইনবোর্ডের দোকানে কাজ নেয়। তার হাত পাকে, অল্পদিনে ছবি আঁকতে শিখে। একদিন তাদের ঘরে গিয়ে দেখি, তার আঁকা দেবীর মূর্তি। ঘর পরিষ্কার, কাঁচা ঘরের কোণে ডেক ডেকচি ঝকঝকে, ভেতরে ভাত মাদুরে শুকাতে দেয়া, জানলা গলিয়ে রোদ সাদা রং মোটা ভাতের সৌরভ ভাপ দিয়ে পাকিয়ে তুলছে বাতাসে। আলাদা ছবি আঁকার দোকান দিল ঝলকন। তারপর একদিন ভিন্ন পরিচয়ে মানুষ হতে সে চলে গেল না বলে। দূর কোন শহরে ছবি আঁকার দোকান দিয়েছে বলে খবর পেলাম। কিন্তু না, জাত পরিচয় ছিন্ন করতে পারেনি সে। সে কাহিনি ভিন্ন। সে ফিরে এসেছিল, ফিরে আসতে হয়েছিল। ঝলকান আমাদের সাথে আর মেশেনি, আমিও নিরাপদ থেকেছি, যেন চিনতাম না কোনো কালে।

অবধারিত নিয়মে ঝলকনও জোগাড় করলো ডেনিশের খালি টিন, হাতে তোলে নিলো চুয়ানির ঘোলা বোতল আর মুখে তোলে নিল ক্ল্যাসিকেল খিস্তি খেউড়।

 

বিনিময়

এক দল খুদে মৌমাছি আম গাছে বাসা বানায়। এ কোনো নির্জন পুকুরপাড়ের জঙ্গলা পরিবেশ নয়, এ হলো জলন্ত উনুনের শহর। যেখানে রাত-দিন হল্লা হয়। তবে মৌমাছিদের জন্য এটাই বাসা বানানোর উপযুক্ত পরিবেশ। তখন গাছে আমের বোল ছিল। তবে জুত হলো না মৌপোকাদের। একদল দস্যি বালক ঢিল ছুঁড়ে মারে। বড়োরা খোঁচায়, খুঁচিয়ে দৌড় দেয়, মৌমাছি পেছন নেয়। এটা একটা খেলা। বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। মানুষের এ আচরণ তার কাছে ঘৃণিত মনে হয়। সে মৌচাক রক্ষার দায়িত্ব নেয়। যখনই কেউ তাদের উৎপাত করে, সে ঘেউ ঘেউ করে হামলে আসে। মৌমাছিরা নিশ্চিন্ত। তারা তাদের পরিশ্রম বাড়িয়ে দিলো। টইটুম্বুর হলো মৌচাক। এদিকে গাছে আম হলো। ভারি হলো ডালটা। এক ঝড়ের দুপুরে আমের ভারে মৌচাকসহ ডালটা ভেঙে গেলো। মৌমাছিরা ভয়ে রাগে ছোটাছুটি করে। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে আফসোস করে। কিন্তুু মৌমাছিদের সকল রাগ-কেন জানি কুকুরটার ওপরে গিয়ে পড়ে। কুকুরটা কিছুতেই নিস্তার পায় না। মৌমাছিরা এমনভাবে হুল ফুটায়, এখন তার মরণ দশা।

অলংকরণ : ইকবাল আনোয়ার

menu
menu