তাওয়া 

গল্পটা এক উপত্যকার। হরিদ্রাভ উপত্যকার উপরে বিছানো ছিল নীলাভ আকাশ আর সেই নীল মাঝে মাঝে সুরমা রঙে বদলে যেত। উপত্যকায় থাকত ষোড়শী, অষ্টাদশী মেয়ে। আমার গল্পটা তাদের মধ্যে এক সতের বৎসরের মেয়ের। যে তার চারপাশের প্রকৃতি আর গুচ্ছ গুচ্ছ গল্পের কবিতার বই ছাড়া অন্য কিছু চোখেই দেখেনি। সে থাকত উপত্যকার এক পাহাড়ের উপরে তার ছোট ছিমছাম পরিবারের সঙ্গে, হাঁটু অব্দি তার চুল আষাঢ়ের ঘন মেঘের মতো, স্বর্ণচাঁপার মতো গায়ের রং, দিঘির মতো টলটলে তার চোখ। গল্পের বই পড়তে ভালোবাসত খুব, যে সময়ের কথা বলছি তখন তার বয়েসটাই ছিল তেমন, বই পড়তে পড়তে তার চোখের মাঝে কার যেন ছায়া এসে পড়ত, তারপর বই থেকে মনটা উদাস ঝিম ধরা দুপুরের মেঘের সঙ্গে কোথায় কোথায় হারিয়ে যেত... ভাবতো তার ভালোবাসাটা বাবা-মায়ের মতো আটপৌরে হবে, সাধারণ কিন্তু ভারি মজবুত। সন্ধ্যার আলোছায়ায় ধীরে ধীরে এমনি অনেক না বলা গল্প জমতে জমতে জমা হতেই থাকে। ...বুনতে বুনতে জমে স্বপ্ন... গুনতে গুনতে কাটে দিন।
মেয়েরা দল বেধে বিনুনি দুলিয়ে কলকল করতে করতে কলেজ যায়, একদল উঠতি কবি বসে থাকে কলেজের মোড়ে চায়ের দোকানে, চা আর সিগারেটের ধোঁয়ায় মিশে আলোচিত হয় গালিবনামা, জিবরান কিংবা তাব্রিজ । শুক্র শনিবার কলেজ বন্ধ, কবিদের আড্ডা জমে না , বিক্রি হয় না চা সিগারেট। গালিবনামা ঘুমায় বইয়ের তাকে। রোজ স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হয় উঠতি কবিদের কবিতা বা কবিতাগুচ্ছ, মাঝে মাঝে কারো কারো লেখা জাতীয় পত্রিকায়ও ছাপা হয়। মেয়েরা হুড়োহুড়ি করে পত্রিকায় চোখ রাখে। সে এক কৌতূহল! সুন্দর কথা আসলে ভীষণ ছোঁয়াচে, সব মেয়েরা ওই কথাগুলো, কবিতার লাইনগুলো নিজের বলে দাবি করে নিজের কাছেই রাখতে চাইত, সুন্দরী মেয়েরা যেমন কবিতায়, গল্পে কিংবা মহাকাব্যে বেঁচে থেকেছে কিংবা বাঁচতে চেয়েছে অনন্তকাল।
সব মেয়েরাই বোধহয় চায় তার নামে শুধু তার জন্যই লিখিত হোক একক কবিতা যুগ উত্তীর্ণ পংক্তিমালা, সে কবিতা হবে অমর অনেকটা ‘বনলতা সেনের’ মতো, যা যুগ যুগ ধরে ছেলেদের কণ্ঠে কণ্ঠে আবৃত্তি হবে, কোনো ছেলে তার প্রথম প্রেমকে পাঠাবে সে কবিতা , সেই কবি কি ভীষণ জনপ্রিয় হবেন, সংসারী হবেন, তাকে বিভিন্ন সভায়, ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করা হবে কোন নারী ছিল কবির অনুপ্রেরণা? কবি তার উপত্যকার গল্প বলবেন সংক্ষেপে, চোখ দুটো একটু উদাস হবে, পলকে সামলে নিবেন। কিন্তু নাম থেকে যাবে রহস্যের আড়ালে। 
বিনুকে মা চুলে ভালো করে তেল লাগিয়ে বেণি করে দিয়ে বললেন দাদিকে বিকেলের চা বিস্কুট দিতে। বিনু ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই ওদের গেইট খুলে ছুটতে ছুটতে এলো একটা বাচ্চা ছেলে, ‘আপা আপনার বই’, কে পাঠিয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই যেভাবে এসেছিল ওভাবে দৌড়ে চলে গেল। মা জানতে চাইলে, বিনু এই প্রথম কিছু না ভেবেই মা'কে উত্তর দিলো ‘নিতু বই পাঠিয়েছে মা’, মেয়েদের মধ্যে বই দেওয়া নেওয়া তো একটা রোজকার ব্যাপার, মা স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। দাদিকে কোনোভাবে চা বিস্কুট দিয়ে, হাতের কাজ শেষ করেই তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে এসে ধীরে ধীরে বইটা খুলল, ‘শের-ই শায়েরি’, ভেতরে চারভাজ করা নীলচে রঙের একটা কাগজ, তাতে শুরুতেই লিখা—
তোমার কোনো উপমা নেই... তারপরও আমি উপমা খুঁজি, জানি তুমি চোখ খুললেই উপত্যকায় ভোর হয়, তাই তোমাকে ভোর বলে ডাকি। আমার বাড়ির উপর যখন মেঘ ছেয়ে যায় সে মেঘ নয় যেন তোমার ভেজা চুল। তোমাকে বলি কুন্তলা হাওয়ায় হাওয়ায় সমস্ত উপত্যকায় দিনমান ভাসতে থাকে তোমার সাথে আমার কাল্পনিক কথোপকথন। সব প্রজাপতি তোমার কাছ থেকে রঙ নিয়ে উড়তে থাকে, আমি অপলক তাকিয়ে থাকি... আমি তিতলি তিতলি বলে ওদের পেছনে ছুটতে থাকি, ছুটতে ছুটতে রাতের তারারা তোমার কপালের টিপ হয়ে স্থির হয় আমার চোখে। আমার স্বপ্নের মধ্যে তুমি চুপচাপ বসে থাকো দিনমান। শুধু তুমি হে রূপকথা! যখন বৃষ্টি নামে তখন কি তোমার মন খারাপ থাকে? কারণ আকাশের মন খারাপ হলেই বৃষ্টি হয়, তুমি যে আমার অনেকদিন হারিয়ে যাওয়া আকাশ।  আমার আকাশটা কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে রূপকথা? আকাশহীন আমার দমবদ্ধ লাগে, সত্যি বলছি হে প্রিয়তমা, এইটুকুই শুধু চাই তোমার কাছে এক আকাশহীন চুপকথা। তোমার নাম যদি বলি খুশবু, কম বলা হয়। 
সেই চিঠিটা বিনু একবার বারবার পড়ল। চিঠির মতো নয় কবিতার মতো। কবিতার মতোও ঠিক নয় কি এক সম্মোহনী শক্তির মতো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল, নিজের চুলের ঘ্রাণ নিলো এত মিল কেন চিঠির প্রতিটা শব্দের সঙ্গে! এটা কি চিঠি নাকি বিনুর আয়না? নাকি বিনুর রঙিন ছবি? নাম না জানা কোনো শক্তিশালী ক্যামেরাম্যান বিনুর অগোচরে তুলে পাঠিয়ে দিয়েছে । রাত জেগে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে বিনু একটা চিঠি লিখল উত্তরে, কিন্তু কলেজ যাওয়ার পথে সেই ছোট ছেলেটাকে কোথাও দেখতে পেল না। চোখে পরল কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে! তার কোটরে পরা উজ্জ্বল চোখ, এলোমেলো ফিনফিনে চুল, মিষ্টি একটা প্রশ্রয়ের হাসি ঝুলে আছে ঠোঁটে। চায়ের দোকানে আসা যাওয়ার পথে বিনু দেখেছে এই তুমুল কবিকে। হঠাৎ করে ঋজু ভঙ্গীতে কবি হন হন করে হাঁটতে শুরু করল, বিনুর সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বাড়ছে, চোখের সামনে থেকে যেন দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে দুর্লভ কিছু, ইতস্তত বিনু, আর পারল না ! নিজের অজান্তে ডাক বেরিয়ে এল—' শুনুন... প্লিজ শুনুন '
আকাশপাতাল প্রেমে পড়লো বিনু। এরপর দুজনের মধ্যে শুরু হলো চিঠি ও বই দেওয়া নেওয়া। কখনো কবিতা, বইয়ের ভেতর কখনো চিঠি, কখনো চিরকুটের লেনদেন। বর্ষা পার হয়ে শরৎ এলো, শরতের মেঘেদের ওড়াউড়ির সঙ্গে সঙ্গে প্রজাপতি ঘটকদের আনাগোনা বাড়ছে বিয়ের যোগ্য মেয়ে আছে এমন বাড়িতে। একদিন বিনুর অস্থির এক চিঠি এলো কবির দরোজায়... প্রিয় ফরহাদ,  কড়া মেজাজের গোলগাল চেহারার একজন আমলার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, উনি আমাকে প্রথম যে প্রশ্নটা করেছেন সেটা হলো এসএসসি-তে আমি ইংরেজি গ্রামারে কত নম্বর পেয়েছি এবং দ্বিতীয়ত বলেছেন লম্বা চুলের যত্ন নিতে অনেক সময় নষ্ট হয়, এত সময় একজন শিক্ষার্থীর নষ্ট করা উচিত নয়। আমার মামারা আজ সন্ধ্যায় এসে পৌঁছাবেন কারণ এত ভালো সম্বন্ধ আমার বাবা-মা হাতছাড়া করতে রাজি নয়। বাসায় বাবা-মার হাবেভাবে বুঝতে পারছি রাতেই হয়তো কাবিন করে রাখবেন। আমি ওই কাটখোট্টা লোককে বিয়ে করতে পারব না যিনি আমাকে নেড়া মাথায় ইংরেজি গ্রামার পড়াবেন। তুমি আজ রাতেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও প্লিজ। না হলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া অন্যকোনো উপায় থাকবে না। তোমার বিনু। কবি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর লিখল—
ও আমার রূপকথা, এই প্রথম তোমাকে লেখার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। তবুও বলি বাস্তবতা হলো আমার চাকরি নেই, টিউশনি করে চলি, তোমার বাবা মা'র পছন্দ করা পাত্রের সামনে আমি এই মুহূর্তে একজন খুব অযোগ্য পাত্র, তাই উনারা আমার সাথে তোমার বিয়েতে কিছুতেই রাজি হবেন না। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কি করব! তোমাকে কী উপদেশ দেব? তোমার সাথে দেখা করতে পারলে দুজনে বসে কিছু একটা ঠিক করা যেত। শুধু জেনে রাখো তোমাকে হারানোর ভার আমি বইতে পারবো না। যদি পার প্লিজ একবার দেখা কর আমার সাথে। তোমার চুপকথা ফরহাদ। 
সেদিন সন্ধ্যা বেলাতেই দাদির জায়নামাজে বসে থাকার আর বাসার সবার ব্যস্ততার সুযোগে বিনু ব্যাগ গুছিয়ে নিল। ফরহাদের সঙ্গে সে একবারেই দেখা করবে। আর আসবে না ফিরে, ধনেখালি সবুজ শাড়িটা আর দাদির দেওয়া রুপার কানপাশাটাই শুধু নিল প্রচণ্ড এক ঘোরের মধ্যে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানের সামনে আসতেই দেখল ফরহাদ দাঁড়িয়ে আছে, দুজন হনহন করে স্টেশনের দিকে হেঁটে গেল—ওখানে কোনো এক ফাঁকা বেঞ্চে বসে কথা বলা যাবে। কিন্তু স্টেশনে যখন ওরা ঢুকল তখনই একটা ট্রেনও এসে ঢুকল, চারদিকে হইচই দৌড়াদৌড়ি, কথা বলার কোনো উপায়ই নেই। বিনু ফরহাদের হাত ধরে ট্রেনে উঠে গেলো নাকি ফরহাদ বিনুর হাত ধরে ট্রেনে উঠে গেলো সে কথা আজ আর বিনু মনে করতে পারে না।
দশ মিনিটের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে গেল হুইসেল বাজিয়ে। হুইসেলের বিকট শব্দে হুহু করে উঠল বিনুর বুক। হাউমাউ করে কান্না পাচ্ছে, বাবার চিন্তিত অপমানিত মুখ ভেসে আসছে চোখে, দাদিকে, মাকে, ছোট ভাইবোনকে মনে পড়ছে। ফরহাদ উঠে টিকেট মাস্টারের কাছ থেকে বেশি দামে টিকেট কিনল, বিনুর দুই চোখ দিয়ে জলের ঢল নামছে। ফরহাদ গম্ভীর হয়ে বসে আছে, একসময় ফিসফিস করে ফরহাদ বিনুকে বলল, ‘যাত্রীরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, তুমি চাইলে আমরা পরের স্টেশনে নেমেই ফিরে যেতে পারি।’ কিন্তু যে সময় একবার বয়ে যায় সেই সময়ের তো আর ফেরা হয় না। সে সময় গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে মংলায় থামে। মংলায় এসে রিকশা করে ফরহাদের চাচাতো বোনের বাড়ি, উনি অবাক হলেন কিন্তু সামালে নিলেন। কাজী এল , বিয়ে পড়ানো হলো, ক’দিন চাচাতো বোন শিউলি আপা’র বাসায় থাকার পর মুবিন দুলাভাই একটা ছোট চাকরি ঠিক করে দিলেন ফরহাদের জন্য। ওরা আপার বাসার ছেড়ে এক রুমের এক ভাড়া বাসায় উঠল।
ফরহাদ প্রতিদিন একটু একটু বদলে যাচ্ছে হয়তো নিজে জেনে হয়তো না জেনে কিন্তু যাচ্ছে । বিনু টের পায়। মনকে সান্ত্বনা দেয় সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কি নিয়তি! কবির লেখার সঙ্গে কবির শব্দের সঙ্গে উপমার সঙ্গে ফরহাদের কোনো মিল নেই! ফরহাদ ও কবি দুজন যেন দুই মেরুর দুই মানুষ। দুই ভুবনের বাসিন্দার মতো। অন্তত বিনু অনেক চেষ্টা করেও মিলাতে পারে না বিয়ের আগের ও পরের ফরহাদকে। ফরহাদের প্রতিটা বদল চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিনুর চোখ ভিজে যায়। ঘোরের মধ্যে ফেলে আসা বাড়ির জন্য মন আকুল হয়ে ওঠে, উঠতেই থাকে। একদিন আর পারল না। মাকে ছোট করে একটা চিঠি পাঠাল বিনু , শুধুই কুশল বিনিময়। ফরহাদ বাজার করে ফিরেছে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত। বিনু চা বানাতে বানাতে পরিস্থিতি হালকা করার জন্যে বলল, ‘আমি খেতে চাই ডালমুট তুমি আনো বিস্কুট।’ কিসের থেকে কি হয়ে গেল বিনু বুঝে উঠার আগেই ফরহাদ বাজার থেকে আনা সব জিনিস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল...! বিনুর মনের মধ্যে অতি যত্নে সাজানো একজন প্রেমিক কবির ছবিটা মুহূর্তেই মুছে গিয়ে ফরহাদের যে ছবি বিনু নিজের চোখের সামনে দেখতে পায় তা এক অতি সাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি। না কবি, না প্রেমিক। বিনু তবুও ফরহাদকে বুঝাতে চায় ও দুষ্টামি করেছে, শুধু একটা কথার ছলে ছড়া কাটার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ফরহাদের চিৎকার থামে না। পাশের বাড়ির বাচ্চাটা চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে থাকে, ওর মা এসে বাচ্চাটাকে সরিয়ে নিয়ে জানলা বন্ধ করে দিলেন। কি লজ্জা কি লজ্জা! অপমানে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে মন চাইল বিনুর, ওর বাবা মা কে কখনো ঝগড়া করতে দেখেনি ও। এমনি রোজ কিছু না কিছু ছোট খাটো ঘটনা নিয়ে দু’জনের সম্পর্ক টালমাটাল হয়ে উঠতে লাগল, দূরত্ব বাড়তে লাগল দুজনের।
বাইরে পূর্ণিমা, চাঁদের আলো ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে পথঘাট, কবি জুঁই ফুলের মালা নিয়ে এলেন, বিনুর মনটা খুশিতে ভরে গেল, চুলে জুঁই ফুলের মালাটা পড়ল... জানলার পাশে বসল দুজন, বিনু তার প্রিয় গানটা গুন গুনিয়ে গাইল, ‘তুমি খুব সুন্দর গাও বিনু, গলা খুলে গাও ...’ বিনু গলা খুলে গাইতে শুরু করলে, পাশের রুমের ভাই ও ভাবি জানলায় এসে দাঁড়ালেন। 

‘মনে হয় বাতাসের ঐ দিলরুবাতে,
সুর মিলিয়ে আলাপ ধরি।
দেখো ওই ঝিলিমিলি চাঁদ,
সারারাত আকাশে সলমা-জরি
এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে,
এসো না গল্প করি।

এই রূপসী রাত আর ঐ রূপালী চাঁদ
বলে জেগে থাকো
এ লগন আর কখনো ফিরে পাবে নাকো।
মখমলের ঐ সুজনি ঘাসে,
বসলে না হয় একটু পাশে
মনেহয় মহুয়ারই আতর মেখে,
তোমার কোলে ঘুমিয়ে পড়ি
দেখো ওই ঝিলিমিলি চাঁদ,
সারারাত আকাশে সলমা-জরি
এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে,
এসো না গল্প করি,
ও.. এসো না গল্প করি।’

দুজনের মনটা ভালো থেকে আর ভালো হয়ে ভাসতে লাগলো বিনুর ফিরিয়ে দেওয়া কবির হারিয়ে যাওয়া আকাশে। বিনু সাহস করে বলল, ‘একটা জিনিস চাইবো দেবে?’ —কী? —আমি এখানে কলেজে ভর্তি হতে পারবো? আমার খুব পড়তে ইচ্ছে করে। আর বাবারও খুব ইচ্ছে ছিল...
এবার হবে না বিনু, ঠিক মতো সংসার চলাতেই পারছি না, আজ অব্দি তোমাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে পারিনি... ফরহাদের গলা ধরে আসে। মুহূর্তে চারিদিক সুনসান নীরব হয়ে গেলো, ফরহাদ বলল, ‘কবিদের সব কথা বিশ্বাস করতে হয় না বিনু।’ কবির যে ছবিটি তোমরা কল্পনায় ভাবো, বাস্তবে কিন্তু দেখো কবি মোটেই সে রকম নয়। অতি সাধারণ একজন মানুষ। রোমান্টিসিজম শুধু লেখকের লেখায় থাকে, ব্যক্তি জীবনে সঙ্কটে থাকা মানুষ একদমই রোমান্টিক নয়। তেল নুনের হিসাবের সঙ্গে রোমান্টিসিজম মানায় না। যেখানে বাঁচার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ সেখানে রূপকথা অমূলক। মুহূর্তরা চুপ, বিনু জানে না কি করবে! মাকে, দাদিকে মনে পড়ছে , শুধু ভালোবাসা পাবার আশায় বিনু এ কি করল? 
তারপর দিন সকালে কলতলায় পাশের বাড়ির ভাবি এগিয়ে এসে কথা বললেন, আগেও উনি কথা বলেছেন, টুকটাক কুশল আর গৃহস্থালি কথা। ভাবি বললেন আপনার গলা এত মিষ্টি আর কি দরদ আপনার গায়কিতে, প্লিজ গানটা ছাড়বেন না। বিনু বলল, আমি কখনো গান শিখিনি, মায়ের কাছে টিভি রেডিওতে শুনে শুনে এই যা একটু আধটু। ‘তাহলে এখন শুরু করুন’ ভাবি বললেন। কি হলো বিনু নিজেও জানে না, ঝরঝর করে দু’চোখে জল চলে এল, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কোনো রকমে উচ্চারণ করল, ‘কলেজে ভর্তি হতে পারছি না। তা আবার গান শেখা...’ ভাবি শঙ্কিত চোখে এদিক ওদিক তাকালেন, জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনার কর্তা কোথায়?’ বিনু বলল, বেরিয়ে গেছে , টিউশনি শেষ করে অফিস যাবে।’
ভাবি বিনুর কাঁধে হাত রাখলেন, ‘চলুন দুজনে বসে চা খাবো।’ চা খেতে খেতে বিনুর কান্না কমে আসছে, ভাবি এর মধ্যে যা জানার জানলেন। বললেন আপনাদের বাড়িটা আমি চিনি, আমার মেজ মামির বাড়ি ওখানে। উনার ছোট বোন নিতু’র বিয়ে হলো মাস দু’য়েক আগে, দাওয়াত পেয়েছিলাম কিন্তু আমার কর্তা ছুটি পেল না বলে যাওয়া হয়নি। নিতু! আমার বন্ধু নিতু? ওর বিয়ে হয়ে গেছে? ও আমার খুব প্রিয় বান্ধবী, আপনার মামি কি নাজু আপা? বিনু জানতে চাইল। দেখুন কি কাণ্ড! পৃথিবী অনেক ছোট। ঘুরে ফিরে সবাই সবার পরিচিত হয়ে যায়। আপনি চাইলে বিনুর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারব। বান্ধবীর সঙ্গে কথা বললে আপনার মনটা কিছুটা স্থির হবে হয়তো। নিতুর সঙ্গে কথা হয় বিনুর, ভাবির ফোন থেকে। নিতু জানালো বিনু বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াতে ঘটক প্রস্তাবটা নিতুর জন্যে নিয়ে যায়, এক সপ্তার মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় নিতুর। নিতু এখন ঢাকায় থাকে, ইডেন কলেজে ভর্তি হবে, ভদ্রলোক কবিতা পড়েন, রোজ অফিস থেকে ফিরে নিতুকে পরিপাটি দেখতে চান, হাতে অনেক রকমারি চুড়ি আর ফুল বা মালা উনি কিনে আনেন, দুজন বেড়াতে বের হন, শুধু গাড়িতে ঘুরাঘুরি, লঙ ড্রাইভ বা বাসায় বসে অনেকক্ষণ রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে। ফোনের এপাশ থেকে বিনু ঠিক বুঝতে পারল নিতুর শুধু আনন্দ আর সুখ। নিতু জানালো বিনুর মা দীর্ঘদিন কান্নাকাটি করে বিছানায়, বিনুর বাবা অনেকদিন অফিস কামাই করেছেন, দাদি শুধু বিনু কোথায় জানতে চাইছিলেন। নিতু আদুরে গলায় জানতে চাইল তুই কখনো বলিসনি তো তোর সঙ্গে কবির এমন লাইলি মজনু প্রেম? ক্লাসে এমনকি সেকেন্ড ইয়ারের আপারাও কেউ জানত না তোর প্রেমের খবর! বিনু জানালো... আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল ফরহাদ। পরের ঘটনা যতদূর সম্ভব বলে গেল—
নিতু বলল, ‘বই পোকাদের এমনি হয়, ফরহাদ ভাই আমাকেও চিঠি দিয়েছিলেন, পড়ে আমিও একটু প্রেমে পরেছিলাম উনার। কিন্তু যখন জানলাম আমাদের ক্লাসের অনেকে একই চিঠি পেয়েছে তখন হাসি পেয়েছিল খুব। আসলে জানিস ওটা চিঠি ছিল না, ওটা ছিল একটা কবিতা, উপত্যকার সব উঠতি বয়সের মেয়েদের নিয়ে লেখা। বিনুর আর সাহস হলো না জিজ্ঞাসা করে কী ছিল কবিতায়? 
বিনু ফরহাদের টেবিল ঘেঁটে সব কবিতায়, সব খসড়ায় বিনু নিজেকে খুঁজল, নিতুর কথাই ঠিক, বিনু কোথাও নেই, লিখাগুলো অন্যকোনো, বিনুর অজানা কাউকে নিয়ে। কবি এলে বিনু জানতে চাইল... তুমি আমাকে যে প্রথম চিঠিটা লিখেছিলে ওটা আর ক’জন কে লিখেছিলে? কবি বললেন , তুমি খুব অভিমানী বিনু , অভিমান কম থাকা ভালো, আমার চা টা দাও ।
কবি এড়াতে পারলেন না বিনুর বিরামহীন প্রশ্ন... বিনু কবিকে মিথ্যেবাদী ডাকল, কবি খুব ধীরে বলল, ‘ওটা চিঠি ছিল না, ওটা ছিল একটা কবিতা। উপত্যকার অনেক মেয়েকে আমি পাঠিয়েছিলাম শুধু দেখতে কবিতাটা কি প্রভাব ফেলে উঠতি বয়সের মেয়েদের মনে, তুমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিবে আমি বুঝতে পারিনি। আমি তোমাকে অসম্মান করতে চাইনি। চাইনি বলেই তোমাকে সম্মান করে তোমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বয়স বাড়লে তোমার মোহ কেটে যাবে। আমার মতো এক চালচুলোহীনকে ভুলতে তোমার সময় লাগবে না। কিন্তু কিসের ভেতর কী হয়ে গেল! লেখকদের সব কথা বিশ্বাস করতে হয় না বিনু। বিনুর সমস্ত সাহস কর্পূরের মতো উড়ে গেল। মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ক্রমাগত ও মাটির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু বিনুর তো তলিয়ে গেলে চলবে না। জীবন বিনুর। ওকেই সব সমস্যার সব প্রশ্নের সমাধান করতে হবে। এই তিন মাস সে অনেক কিছু শিখেছে যা ফেলে আসা উপত্যকার জীবনে ও জানতো না বুঝত না । ও ভেবেছিল জীবন বইয়ের গল্পের মতো। আসলে তো তা নয় জীবন জীবনের মতো, হয়তো কোথাও অঙ্কের মতো। নিতুদের মতো অঙ্ক। বিনুর গল্পের সঙ্গে নিতুর অঙ্কের কোনো মিল নেই। থাকে না। তবুও বিনু জানতে চাইল।
তুমি কেন মিথ্যা লিখেছিলে আমাকে? কবি চুপ করে থেকে বলল—কবিদের পথ শব্দ খেলার পথ। এ শব্দ নিয়ে খেলার পথ সহজ পথ নয় বিনু, অনেক কষ্ট করেই এখানে এসেছি। আমার ফেলে আসা পথটা এত সহজ ছিল না আর সামনের পথটাও আরও চড়াই উতরাইয়ে ভরা যা শব্দ সৈনিক মাত্রই জানে। আমি জানি না কি আছে সামনে, চাল আর নুন যোগাড় করতে আমার দিন চলে যাচ্ছে , আমি এ জীবন চাইনি। বিশ্বাস কর বিনু আমি চাইনি। তুমি নিজে থেকে এসে জড়িয়ে গেছ আমার জীবনে। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ আমি আমার আর্থিক অক্ষমতায় জর্জরিত হই, যে তোমাকে আমি শব্দে শব্দে এত এত যত্ন করেছি প্রতিদিন নতুন করে সাজিয়েছি, সেই তুমি যখন আমার চোখের সামনে কষ্ট পাও আমি সহ্য করতে পারি না। আমি জানি না আমি আর কতদিন এভাবে চালাতে পারবো... একটাও লিখা শেষ করতে পারছি না আজ কতদিন! সৃষ্টি করতে না পারার অসহ্য যন্ত্রণায় আমি একদিন ঠিক মরে যাবো। মরে যাবো বিনু মরে যাবো... ফরহাদ বেরিয়ে যেতেই বিনু রান্না চাপাল। খুব যত্ন করে ফরহাদের জন্য রান্না করল। ফরহাদের কাপড়, এলোমেলো বই কলম সব গুছিয়ে রাখল। ওর হাতে খুচরো কিছু টাকা ছিল। কবির বইয়ের নিচে ফরহাদকে একটা চিরকুট লিখে বিনু নিয়তির হাত ধরে বাসে উঠে বসলো ওর আজন্ম চেনা উপত্যকার দিকে।


• কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসক, যুক্তরাজ্য। 

menu
menu