সংক্রমণ
কোনোরকম পূর্বাভাস না দিয়েই হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর আর খিঁচুনি উঠল আনারুলের মায়ের। কাজ সেরে রাতে আনারুল ঘরে ফেরার পরে মা ভাত বাড়তে বাড়তে মাথা ঘুরে পড়ে গেল, ধরাধরি করে মাথায় পানি ঢালার পর সে থেকে থেকে গুঙিয়ে গুঙিয়ে খিঁচিয়ে উঠল। তীব্র কাশির দমকে ধনুকের মতো বেঁকে যেত লাগল দুর্বল মানুষটা। বেচারা আনারুল! দাসের বাচ্চা! সারাদিন যে ভ্যানে করে ইট বালু টেনে বেড়ায় সেই ভ্যানের উপরে চটের বস্তা বিছিয়ে তার ওপর মা কে তুলে নিয়ে সদর হাসপাতালে রওনা হলো।
কেউ ধারে কাছে ঘেঁষল না। একটা স্ট্রেচার এগিয়ে দিল না কেউ। আনারুল মা কে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ভেতরে গেল। কোরিডোরের কোণায় একটা স্ট্রেচারে রাখল তাকে। এক নার্স এসে জানতে চাইল রোগী সেই ছোঁয়াচে রোগটায় আক্রান্ত কিনা। আনারুল বলল—নাহ, আমার মা তো ভালাই আছিলো। অহনি অজ্ঞান হইয়া গ্যাছে।
দাসী মায়ের সেই মুহূর্তে প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। তড়পাতে লাগল খাবি খাওয়া মাছের মতন। নার্স কি করবে কি না করবে তা না বুঝেই দৌড়াদৌড়ি শুরু করল অথচ কিছুই করল না। আনারুলের মা হঠাৎ একটা লম্বা হেঁচকি তুলে দুম করে মরে গেল।
আনারুলও কী করবে প্রথমে তা বুঝতে পারল না। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ব্যাটা শোকের চেয়ে ভয় পেয়েছে বেশি। সকাল থেকেই ওর গলার কাছে খুসখুস করছিল। হঠাৎ করে কাঁদতে গিয়ে কাশি শুরু হলো ওর।
কিছুক্ষণ পরে আগাগোড়া সাদা রেইনকোট ধরনের জামাকাপড়, বড় বড় চশমা, রাবারের হাতমোজা পরা গোটা তিনেক মানুষ এসে আনারুলের মা কে একটা লাশ তোলা ব্যাগের মধ্যে ভরে ফেলল। আনারুলের মায়ের যে সেই ছোঁয়াচে রোগটাই হয়েছে সেটা আশঙ্কা করে তাদের দুজনেরই নমুনা নেয়া হলো। তারপরে তারা লাশ দাফনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। শহরের উত্তর প্রান্তে যে গোরস্থান দাঁড়িয়ে আছে মৃতদের খেয়ে ফেলার জন্য, সেখানে নিয়ে যাওয়া হল লাশ। সাত-আট জন মিলে শেষকৃত্য সম্পন্ন শেষে আনারুলকে তারা সকালে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। বলে গেল, চৌদ্দ দিন ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না।
হায় ঘর! একে কি ঘর বলা যায়? বাঁশের চটার সাথে পলিথিন বেঁধে তৈরি করা দেয়ালের ঘুপচি অন্ধকার এই খুদ্র আয়তক্ষেত্রকে কবর বলাই শ্রেয়। আর বস্তির এই লাইন ধরে শত শত বিষণ্ন লাগোয়া আয়তক্ষেত্রের সারিকে গোরস্থান বলতে হবে যা কিনা জিন্দা দাসের দলকে গিলে খাওয়ার জন্য উদ্ধত দাঁত মেলে দাঁড়িয়ে আছে। আনারুল কাঁদতে কাঁদতে কাশতে কাশতে ঘুমিয়ে গেল।
দুপুর পেরিয়ে ঘুম ভাঙল ওর। চোখ বুজেই মা কে ডাক দিল ও। ওর খেয়াল নেই যে ওর মাকে—আজ ভোরে দাফন করে এসেছে। সম্বিত ফিরে পেতেই লাফিয়ে উঠে বসল ও। শূন্য ঘরের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে চিৎকার করে কান্না শুরু করল। পাশের ঘরের মানুষজন কেউ ঘরে ঢুকল না। ছোঁয়াচে রোগের ভয়ে ওরা বাইরে থেকেই সাত্বনাবাণী উচ্চারণ করে যার যার কফিনের ভেতরে সেঁধিয়ে গেল।
আনারুল সেভাবেই শুয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর উঠে কলসি থেকে পানি ঢেলে পান করল। গতরাতের অসম্পূর্ণ খাবার পঁচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। আনারুল সেগুলোতে পানি ঢেলে বাইরে বের হল। খিদেয় ওর শরীর কাঁপছে। বাইরে বেরিয়ে শহরের দামি রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসল সে। গরুর ভুনা মাংস অর্ডার করে দুই প্লেট ভাত হাঁকিয়ে দিয়ে পানি পান করার পরে একটা তৃপ্তির প্রশান্তি ছড়িয়ে গেল অবসাদগ্রস্ত শরীরে।
তৃপ্তির ডিনারের বিল এলো তিনশো টাকা। আনারুল পকেট হাতড়ে দেখে সর্বসাকুল্যে টাকা আছে দুইশো সামথিং। আনারুল সব টাকা ক্যাশিয়ারের টেবিলে রেখে বলল—আর টাকা নাই, বাকি টাকা পরে আইস্যা দিয়া যামুনে।
একেতো ছোঁয়াচে রোগের দাপটে কাস্টমার নেই, আনারুলের মলিন বদন বাকির বায়না শুনে রাশভারি ম্যানেজার চোখ পাকিয়ে বলে উঠল—বান্দির পুত, টাকা নাই তো জিভ নাচায় নাচায় খাইলি ক্যান? টাকা বাইর কর।
আনারুল ভয় পেয়ে গেল। কাচুমাচু করে বলল—ভাইজান আমি দিয়া যামুনে, আমি পাশের বস্তিতেই থাহি, ঐ বড় আঠারো তালা বিল্ডিংয়ে কাম করি।
ম্যানেজার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আনারুলের ঘাড় খামচে ধরে ধাক্কা দিয়ে বাইরের দিকে ঠেলা মেরে বলল—বাইর হ হালার পো। কাইল টাকা দিয়া যাবি।
আনারুল ফিরে এল ঘরে। পঁচা গন্ধে মাদকতাময় অন্ধকারে চৌকির ওপরে গা এলিয়ে দিল। ভরা পেটের শ্রান্তি আবার ঘুম পাড়িয়ে দিল তাঁকে।
পরদিন কাজে গিয়ে কাজ পেল না সে। ছোঁয়াচে রোগে যার মা মরে গেছে, তারও রোগটা হতে পারে, তাকে কাজে রাখা যাবে না, এই ছিল ওপরের নির্দেশ। আনারুল চেষ্টা করেও দায়িত্বরত স্যারের সাথে দেখা করতে পারল না।
ভ্যান নিয়ে বেলাদুপুরে ফিরে আসার পথে ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধের জন্য ভিড় নিয়ন্ত্রণকারী লাঠিয়াল ভীড়ের শুরুতে থাকা আনারুলের ভ্যানের চার্জিং মেশিনে ভারি একটা আঘাত কষে দিল। মেশিনটা ভেঙে গেল। ভ্যানের পিক আপ কাজ করল না আর। আনারুল রাস্তার মাঝখানে বসে পড়ে হাহাকার করতে লাগল। কয়েকজন তেড়ে এসে আনারুল সমেত ভ্যানটাকে ঠেলে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল।
ভ্যানটা ফেলে রেখেই আনারুল উদ্দেশ্যহীন হাঁটা শুরু করল। শালা দুইদিনের মধ্যেই জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। আনারুল খেই হারিয়ে ফেলল যেন। কী করবে, কোথায় যাবে কিছুই ভাবতে পারল না সে। হাঁটতে হাঁটতে দূরে অনেক মানুষের লম্বা লাইন দেখতে পেল সে। এ হচ্ছে সাহায্যের লাইন। অসহায় দরিদ্র মানুষের কাছে সাহায্য সামগ্রী পৌঁছে দিতে বিশালাকার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে লাইনের প্রান্তে। আনারুল লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু মানুষের ভিড় এত বেশি আর লাইন এত লম্বা যে আনারুল হিসেব করে বের করতে পারল না যে—সাহায্যের সেই চকচকে ব্যাগটা হাতে পেতে ওকে ঠিক কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
দুএকজন ইতোমধ্যেই ব্যাগ হাতে পেয়ে খুশি মুখে হন্তদন্ত হয়ে চলে যাচ্ছে, আর সেই উত্তেজনায় সাপের মতো লাইনটা আঁকাবাঁকা তাড়নায় দুলে উঠে উঠে ফণা পাকিয়ে ছোবল দিল বিশালাকার ট্রাকটার ওপরে। জটলা ভেঙে মানুষের দল ছুটে গেল তার দিকে। আনারুল সেই স্রোতে ভেসে গিয়ে অনেকের সাথে ট্রাক বেয়ে উঠে পড়ল উপরে। আর বিছিয়ে থাকা ব্যাগগুলো তুলে তুলে ছুড়ে দিল দুহাত উঁচিয়ে থাকা শত শত মানুষের কোলাহলের মাঝখানে। অতি উৎসাহী আর বুদ্ধিমানেরা নিজের পক্ষে যতগুলো সম্ভব ব্যাগ বগলদাবা করে নেমে যেতে থাকল। উত্তেজিত কয়েকজন ট্রাকের ড্রাইভারকে টেনে বের করে ফেলে দিল রাস্তায় যাতে ট্রাক চালিয়ে ভেগে যেতে না পারে। এভাবে কয়েক মিনিটে খালি হয়ে গেল ট্রাক। বহু মানুষ খালি হাত তুলে চিৎকার করতে থাকল। দূর থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক দল ছুটে এলো, মানুষকে হটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকল। মানুষ আর করবেটাই বা কি, একেতো ব্যাগ জোটেনি কপালে, তার ওপর এসব উটকো তাড়া খেয়ে তারা কিলবিল করতে করতে জায়গা ফাঁকা করে চলে যেতে থাকল।
আনারুল গোটা তিনেক ব্যাগ নিয়ে আগেই সটকে পড়েছিল। কিন্ত এ ব্যাগ নিয়ে সে কী করবে? সে তো রান্না করতে জানে না। ঘরের দুর্গন্ধময় পঁচা খাবারই সে পরিষ্কার করতে পারেনি এখনো। ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করল না ওর। উল্টো ভারি ব্যাগের বোঝা বইতে কষ্ট হচ্ছে ওর। হঠাৎ দুজন চ্যাংড়া ছেলে এসে জাপটে ধরল ওকে। পেটের সাথে ছোট্ট একটা ধারালো ছুরি ঠেকিয়ে ওর কাছ থেকে ব্যাগগুলো কেড়ে নিয়ে মিনিটের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল ওরা। তবে তাড়াহুড়োয় ওদের ছুরিটা পড়ে গেল রাস্তায়। আনারুল সেটা তুলে নিল।
সন্ধ্যা নেমেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। আনারুলের থেকে থেকে বেজায় কাশি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কাশির সাথে বুকের খাঁচাসহ ছিঁড়ে যাচ্ছে। একটা গলির ধারের ফুটপাতে বসে খানিকক্ষণ একনাগাড়ে কেশে নিল। দোকানপাট বন্ধ। ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করল সে। একটা ঔষধের দোকানের মুখে গিয়ে আর দাঁড়াতে পারল না। আবার বসে কাশি শুরু করল। দোকানদার এগিয়ে এসে ওর হাতে একটা কাশির ট্যাবলেটসহ পানির বোতল দিল। বলল—আপনি হাসপাতালে যান।
ঔষধটা খেয়ে আনারুল খানিকটা সুস্থ বোধ করল। কিন্ত হাসপাতালে কীভাবে যাবে সে? তার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই। ভীষণ রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় রি রি করে কেঁপে উঠল সে। অবদমিত ক্ষোভে ছুরিটা বের করল পকেট থেকে। তারপর দোকানদার লোকটাকে কোনো কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই তার গলায় আমূল বসিয়ে দিল। লোকটা গলা চেপে ধরে পড়ে গেল। আনারুল ক্যাশবাক্স খুলে টাকা গুলো খামচি দিয়ে পকেটে তুলে নিয়ে দৌড় দিল।
নিরাপদ দূরত্বে চলে এসে হাটু ধরে হাঁপাতে লাগল সে। রাস্তায় সুনসান নীরবতা। আনারুল হাঁটছে। ওর ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কাশির খিঁচুনিতে বুকের ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। ওর মায়ের মরা মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। রাস্তায় বসে পড়ল সে। ল্যাম্পপোস্টের আলোর দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। পকেট থেকে টাকার তোড়াটা বের করে উর্ধ্বে ছুড়ে দিল। উড়ন্ত টাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনারুলের চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো...
• ময়মনসিংহ