জলছবি 

ভোর হলে, পাখির কলরবে ঘুম ভাঙে। কাঁধে লাঙল জোয়াল নিয়ে জমিতে চলে। হালচাষ শেষে বাড়ির দিকে ছুটে। খিদে পেটটা জ্বলছে। অমন করে চলতে থাকলে ব্যাধি হবে। কেউ যদি জমির কাছে নাস্তাটুকু নিয়ে আসতো। কত ভালো হতো। সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চললো। এতটা সময় না খেয়ে থাকা যায়! মতি মিয়া লাঙল জোয়াল রেখে, গরু দুইটা বেঁধে, উচ্চস্বরে বলে, বলি বাড়িতে কী কেহই নাই। কাম করতে গেছি, ঘুরতে তো যাই নাই। খাওনডা দিয়ালে কি হইতো। খিদায় পেটে আগুন জ্বলতাছে। মতির কথা শুনে তার সৎ মা বলে, অত চিল্লাও কে? একটা বিবাহ করার মুরদ নাই, হে আবার চিল্লায়। 

সৎ মার কথা শুনলে মতির ভেতরে একটা মুচড় দেয়। এই মহিলা কেমন জানি। বোন আম্বিয়া খাওন দেয়। মতি খেয়ে হাটের দিকে ছুটে। পথে ছোট বোন এসে বলে, দাদা আমার জন্য চুড়ি আনবা। সুফিয়া এসে বলে গুড়ের লাল জিলাপি আনবা। মতির চার বোন। এদের নাম আম্বিয়া, আছিয়া, সুফিয়া ও মুনিয়া। মুনিয়ার জন্মের পর আপন মা গত হন। কয়েক মাস যেতেই বাবা বিয়ে করে জামেলা খাতুনকে। বিয়ের প্রথম সপ্তাহে পানিতে ডুবে বাবা গত হন। বাবাকে মতি খুব ভালোবাসত। কিন্তু এখন বাবাকে মন্দ লাগে। যে পুকুরে ডুবে বাবা মারা গেছে সেই পুকুরপাড়ে মতি বসে থাকে। আর বাবাকে মনে মনে বকে। পানিতে ডুব দেয়, সৎ মায়ের অত্যাচারে বাবার মতো মরতে চায়। 

গাঁয়ের মানুষ মতিকে নানা কথা শুনায়। ঘরে চারটা বোন। সবার বিয়ের বয়স হয়েছে। দেখতে বেশ সুন্দরী। বোনদের  বিয়ে দেয় না কে?  মতি বোনেদেরকে খুব ভালবাসে। একেকটা বোন তার কলিজার টুকরা। বোনদের জন্য সে জীবনও দিতে পারে। হাট থেকে বোনদের জন্য গুড়ের জিলাপি নিয়ে আসে। মুনিয়ার জন্য চুড়ি আনে। এসব পেয়ে বোনেরা অনেক খুশি। মায়ের ডাক আসে মতির কানে। সে জামেলার ঘরে যায়। জামেলার খাটে মতিকে বসতে বলে। মতি দাঁড়িয়ে আছে। জামেলা বলে, কি হলো বহ।

মতি মেজাজ দেখিয়ে বলে, না আমার কাজ আছে। 

আমার জন্য কি আনছো।

জিলাপি আনছি, তুমিও খাও গিয়ে। 

না, আমার জন্য আলাদা ভাবে আনো না কে?

আমি যাই...

এই একপা নড়বা না কইতাছি। 

মতি দাঁড়িয়ে আছে। জামেলা পান খাচ্ছে। তোমাদের সংসারে আইসা আমার যৌবনডারে শেষ কইরা ফেলাইছি। তোর বাপটা না একটা বদমাইশ ছিল। তা না-হইলে আমার মতো একটা জোয়ান মাইয়া আইন্না পানিতে ডুইবা মরতে পারে!

মতি চোখ বড় বড় করে বলে, খবরদার আমার ফেরেস্তার মতো বাবাকে নিয়ে একটা বাজে কথা কইবা না।
হুম কি কইলে, তোর বাবা ফেরেস্তা! 

জামেলা একটানা অনেক কথা বলে। তোমার বাবারে দেখে এই সংসারে আসেনি। এসেছে তোমারে দেখে।

মতি গায়ে গতরে একটা পালোয়ান। কি সুন্দর। মতি এসব জানে। কেননা, জামেলা সময়ে অসময়ে জ্বালায়। মতির এই সব ভালো লাগে না। সৎ বলে কি হইছে। সেই তো মা। আর মা হয়ে ছেলের সাথে, ছিঃ ছিঃ! এসব ভাবলেও পাপ হয়। জামেলা কয়েকবার মতিকে ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে ধরেছে।


জমিতে ফসল ফলছে। আর কদিন বাদে, ফসল ঘরে তোলবে মতি। এই ফসল বেচে বোনদের জন্য অলংকার আনবে। এই ফসলের জন্য মতি কত কষ্ট করেছে। দিন রাত কাজ করেছে। মাথার গাম পায়ে ফেলেছে। ফসল দেখে মতি খুশির শেষ নেই। কিন্তু সব আনন্দ মাটি হয়ে যায় জামালার মুখ দেখলে। পায়ে আলতা, কোমরে রুপার বিছা পড়েছে জামেলা। দেখতেও অনেক সুন্দরী। মতি অন্য দিকে চলে যেতে চায়লে জামেলা দৌড়ে এসে মতিকে ধরে ফেলে। মতি সহজ ভাষায় জামেলাকে বলে, আচ্ছা মা তুমি এমন করো কেন? তুমি চায়লে আমি তোমাকে বিয়ে দিতে পারি। টাকা পয়সা যা লাগে আমি দেবো। জামেলা বলে, সে মতিকে বিয়ে করতে চায়। মতির মন খারাপ হয়ে যায়। এসব কথা বলা ঠিক না। এসব পাপ। মতির কথায় জামেলা শুনবে না। বোনদের বিয়ে দেওয়ার কথা বলে জামেলা। মতি রাজি নয়। বোনদের ছাড়া মতি থাকতে পারবে না। জামেলা রেগে বলে, তোর বাবার মতো তোর বোনদেরও আমি পানিতে ডুবাইয়া মারমো। মতির ভেতরটা ওলট-পালট হয়ে যায়। বাবাকে ঐ জামেলা মেরেছে ৷ তা না হলে একজন সুস্থ মানুষ পানি ডুবে মরে নাকি। আজ এই বিষয়টা পরিষ্কার হলো। 


মতি আর আগের মতো নেই। সে এখন ভেবে চিন্তে কাজ করে। তার আদরের বোনগুলোকে একটা একটা করে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেয়। মতি এখন একা বাড়িতে থাকে। সাথে আছে জামালা। এই জামেলাটা কীভাবে সরানো যায় সে বিষয় নিয়ে ভাবে মতি। বাবার কথা ভেবে চোখ ভিজে গেলো মতির। কতনা কষ্ট দিয়ে বাবাকে মেরেছে ঐ জামেলা। নিশ্চয় জামেলা যখন বাবাকে পানির নিচে চাপ দিয়ে ধরে রেখে ছিল, বাবা তখন বাঁচার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। বাবা, বাবা। মনে পড়ে, আম্বিয়ার কথা। সবসময় মতির প্রতি আলাদা নজর রাখতো। কোনো অসুখ বিসুখ হলো কিনা। কাজ কম করার কথা বলতো। মেজোটা আছিয়া বলতো, দাদা একটা ভাবি এনে দাও না। আমি ভাবির সাথে অনেক মজা করবো। সুফিয়া এটা খাবে ওটা খাবে। এই বায়না ধরতো। আর ছোট মুনিয়া শুধু সাজগুজ নিয়ে সময় কাটাতো। লাল ফিতা, আয়না চিরুনি, সাজের জিনিস হলেই চলতো। বোনেরা কতই না লক্ষ্মী ছিল। বোনদের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমে মগ্ন মতি। একটা শান্তির ঘুম দেয়। 

বাবাকে দেখে মতি। পানিতে ভাসছে। মতি বাবাকে ডাক দেয়, বাবা। বাবা পানির ভেতর অনেক কষ্ট পাচ্ছে। বাবা কাঁদছে। জলের ভেতরে চোখের জলটা আলাদাভাবে দেখা না গেলেও মতি বুঝতে পারছে বাবা কাঁদছে। মতি শুনতে পাচ্ছে, বাবা বলার চেষ্টা করছে, তুই পালিয়ে যা মতি। তুই আমার সরল পোলা। তুই পারবে না বাবা। মতি বলছে, আমি পারবো বাবা। আমি পারবো। বাবা যেন একটু হাসি দিলো। যেন বলছে, তুই জামেলার সাথে পারবি? বাবার কথা আর কিছু বুঝতে পারছি না। বাবার জলছবিটা আর দেখতে পারছি না। কে যেন জলে ডিল দিয়ে সব এলোমেলো করে দিলো। কে যেন ডাকছে আমায়। মতি মতি এই মতি...।

গভীর রাতে জামেলার ডাকে ঘুম ভাঙে মতির। মতির মাথায় বুদ্ধি আটলো। জামেলাকে আর রাগানো যাবে না। দরজা খুলে, জামেলা মতিকে ধরে তার গৃহে নিয়ে যায়। দেরি নয় মতি খাটে বসে আছে। জামেলা তার পরনের কাপড় খুলে। মতি আস্তে করে জামেলার কাঁধে হাত রেখে বলে,  এত তারা কিসের,  আমি আছি তো। মতির কথা শুনে জামেলা আকাশ থেকে পরে। আজ তোমার জীবনের স্বাদ মেটাবো। জামেলা মতির কথা শুনে মতিকে জড়িয়ে ধরে। মতি জামেলার কানে মুখ নিয়ে বলে চলো পুকুর ঘাটে যাই। জামেলা বলে, এত রাতে পুকুর ঘাটে কেন? দুজনে এক সাথে স্নান করে মা-ছেলে সম্পর্কের ইতি দেবো। পরে সারারাত তুমি আমি মজা করবো। জামেলা আর দেরি করতে চায় না। দুজনে এক সাথে পুকুর ঘাটে আসে। চাঁদনী রাত। পৃথিবী একেবারে ফকফকা পরিষ্কার। সবকিছু দেখা যায়। জামেলা অর্ধেক উলঙ্গ। বুকের কাপড়টা সরে গেছে। এই চাঁদের আলোতে জামেলার সুন্দর্য আরও অধিক সুন্দর হয়ে গেছে। মতি পানিতে নেমে গেছে। জামেলা ঘাটে বসে আছে। মতি জামেলাকে ডাকছে। আসো, আসো, আসো জামেলা।

হঠাৎ জামেলার ভেতরে একট মুচড় দিলো। মতির বাবা জামেলাকে এই ভাবে ডেকেছিল। জামেলা মতির বাবাকে চুবিয়ে মেরেছে। আজ তার ছেলে আমাকে ঠিক একই ভাবে ডাকছে। এই প্রথম সে আমাকে মা থেকে নাম ধরে ডাকছে। এই ডাক তার ভালো লাগার কথা।  কিন্ত কেন জানি জামেলার একটুও ভালো লাগছে না। জামেলা চলে যাবে বলে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই মতি জামেলার আঞ্চল ধরে টান দিলো। মতি বলে, কোথায় যাচ্ছো জামেলা? মতির কথার কোনো জবাব দিলো না। যেতে চায়লে যেতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত পানিতে নামে জামেলা। মতি জামেলাকে জড়িয়ে ধরে। মতির ছুঁয়াতে জামেলার ভালো লাগছে। এত সুখ কপালে সইবে কি! মতি বলে, এখন আমরা পানির নিচে মজা করবো। জামেলাকে নিয়ে মতি পানির গভীরে  যাচ্ছে।  জামেলা যেতে চায়ছে না। জোর করে নিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রথম জামেলা দেখতে পাচ্ছে মতির বাবাকে। ওগো তুমি। মতির বাবা বলে, হে আমি। তোমাকে নিতে এসেছি। মতি জামেলাকে পানিতে ডুব দিয়ে ধরে রাখে। জামেলার ঘাড়ে শক্ত করে পানির নিচে চাপ দিয়ে ধরে রাখে। জামেলার পানির নিচে ছটফটিয়ে নড়াচড়া করছে। জামেলার মনে পড়ছে মতির সেই কথা। আজ তোমার জীবনের স্বাদ মেটাবো। এই হলো জীবনের স্বাদ। জামেলার বুঝতে পারছে মৃত্যু তার খুব কাছে চলে এসেছে। মতির বাবাকে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলছে, তুমি কেমন নারী? মা হয়ে ছেলের সাথে সঙ্গম করতে চাও। এখন কেমন লাগছে। ছেলের আদর ভালো লাগছে তো। জামেলা সুন্দর দেহটা কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মৃত দেহ হয়ে গেলো। সবকিছু নীরব। মতি ঘাটে বসে আছে। চাঁদের আলোতে মতির প্রতিচ্ছবি পানিতে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ দেখে তার বাবাকে। বাবা হাসছে। জলের ভেতরে বাবার হাসি মাখা মুখটা দেখে মতির খুব ভালো লাগছে। এই জলছবির দিকে মতি তাকিয়ে আছে। 


• ক্রাঞ্জি, সিঙ্গাপুর 

menu
menu