নির্ণিয়া

আমি নির্ণিয়া। আকাশতলে নিবাস। আমি প্রস্তুত হচ্ছি। লড়াইটা সহজ নয় তবে অসম্ভবও নয়। মায়িক নামের গ্রহের বাসিন্দা, এমন এক প্রজাতির প্রাণি আজ বিপন্ন বোধ করছে। তাদের অনেকেই আমাকে প্রাণপণে খুঁজে বেরাচ্ছে  কিন্তু আমি ধরা দিচ্ছি না। প্রকৃত অর্থে ধরা দেয়ার মতো অবস্থায় আমি পৌঁছাতে পারিনি। এ অবস্থায় আমার আচরণ ওদের আহত করতে পারে কিন্ত আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া আমি আর কোনো উপায় দেখছি না। ওদের আরো অনেক কিছু বুঝতে হবে, নিজের মূল্যায়নের পাশাপাশি অন্য প্রাণিদেরও মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে। ওদের হাবভাব দেখে সেটা সহসা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাছাড়া আমি নিজে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারিনি। এ অবস্থায় আমাকে দিয়ে ওদের খুব একটা উপকার হবে না। এ সত্যটা ওরা বুঝতে চাইছে না। কোভিড-১৯ নামের একটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওরা আমাকে এক যোদ্ধাবাহিনীর প্রধান হিসেবে পেতে চাইছে। যার কাজ সম্মুখ সমরে লড়াই নয় বরং দূর্গের রক্ষক হিসেবে নিরলস কাজ করে যাওয়া। আমাকে বাগে আনতে ঐ গ্রহের সেই উন্নত প্রাণিরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

অবশেষে গ্রহটির উত্তরাংশের একটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে আমার নবজন্ম হলো। আমাকে ক্লোন করে আমার আরো পাঁচ জন সহোদরা-সহ এখন মায়িক নামের গ্রহটিতে আবিস্কৃত হলাম আমরা ছয় জন নির্ণিয়া। লড়াইয়ের শুরুতে আমাদেরকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছ মায়িক গ্রহটির বিভিন্ন অঞ্চল হতে এখানে জড়ো হওয়া এ বিপন্নপ্রায় প্রাণির ছয় জন এককের শরীরে। প্রাণিগুলো দেখতে অদ্ভূত, তার চেয়ে অদ্ভূত তাদের আচরণ। এই প্রাণিগুলোকে ওরা নাম দিয়েছে মানুষ। এরা সবাই মানুষ হলেও এদের মাঝে জাতিগত তারতম্য আছে। আমাদের কাজ হবে দূর্গের পাহারাদারের মতো কোভিট-১৯ নামের ভাইরাসটির আক্রমণ থেকে এদের শরীরকে রক্ষা করা। ভাইরাসটিকে প্রতিহত করা এত সহজ হবে না। কারণ আমাদের সাফল্য কেবল আমাদের দক্ষতার ওপরই নির্ভর করছে না। এখানে আরো অনেকগুলো বিষয় বিবেচ্য থাকছে। যেমন, যাদের শরীরে  আমাদের ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে—তাদের শারীরিক, মানসিক, ভৌগলিক ও সামাজিক গঠন বৈশিষ্ট্য যার দ্বারা প্রভাবিত হবে আমাদের কার্যকারিতা। তাদের মানসিক গতিবিধি, আচরণও অনেকটা দায়ী থাকবে আমাদের সফলতা বা বিফলতার জন্য। কাজেই বোঝা যাচ্ছে পরীক্ষাটি ভেরিয়েবল।

যেহেতু আমরা এখন সংখ্যায় ছয় জন, যেহেতু আমাদের আলাদা কোনো নাম নেই তাই অন্তত নামের সাথে একটা করে সংখ্যা জুড়ে দিয়ে আমাদের আলাদা করে চেনার সুযোগ রাখা যেতেই পারে। তাই আমরা এখন থেকে নির্ণিয়া-১, নির্ণিয়া-২ এভাবে যথাক্রমে  পঞ্চম জন নির্ণিয়া-৫ নামে বা ৬ষ্ঠ জন নির্ণিয়া-৬ নামে পরিচিত হবো। আমাদেরকে মায়িক গ্রহের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বেচ্ছায় নিয়োগকৃত বিভিন্ন জাতির ছয় জন মানুষের মাঝে ঢুকিয়ে দেয়ার যে প্রক্রিয়া এবং এর সাথে যে আনুষঙ্গিক তথ্য জড়িত সেই ফাইলগুলো রক্ষণাবেক্ষণে গভীর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়েছে। কারণ এ পরীক্ষা  বিশ্বজুড়ে বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদীতাকে উস্কে দেয়ার মতো যথেষ্ট ঝুকিপূর্ণ। 

নির্ণিয়া-১ যার শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো তার নাম রাইন। রাইন একজন নারী, বয়স চৌত্রিশ এবং পেশায় ডাক্তার। সে এসেছে স্পেইন থেকে। এখানে যে এলাকায় গবেষণাগারটি অবস্থিত সে এলাকাকে এরা বলছে নরওয়ে। এখানে বেশ ঠান্ডা, এমনটা ওরাই বলছে। আমার নিজের ঠান্ডা বা গরম বোঝার অনুভূতি নেই। এ ব্যাপারে আমি প্রচণ্ড অভিযোজনশীল। যেকোনো তাপমাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে নেবার অদ্ভূত ক্ষমতা আছে আমার যা পরবর্তী সময়ে কোভিট-১৯ এর সাথে লড়াইয়ে আমাকে সাহায্য করবে। 

রাইনের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সে একজন আর্য বংশভূত ককেশীয়। ওঁর পূর্ব পুরুষগণ এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপ এবং এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ত্বক উজ্জ্বল বর্ণের, আইভরি সাদা। চাঁদের আলো যখন তার গায়ে ঠিকরে পড়ে তখন রাতের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য একাই ধারণ করে সে মুক্তোর মতো মিটিমিটি জ্বলতে থাকে। তার নাসিকা উন্নত এবং চোখ দুটো স্বর্গীয় প্রশান্তি টেনে ধরার মতো প্রসারিত, ভূমধ্যসাগরের সমস্ত নীল সেখানে গভীর বিষাদ নিয়ে থিতু হয়েছে। তার স্বামী ডিউক পেশায় যিনি নিজেও ডাক্তার ছিলেন; মাত্র সতেরোদিন আগে 'রোম' নামক একটি প্রাচীন শহরে কোভিট-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে—নিজেও আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং মাত্র সাত দিনের লড়াই শেষে কফিনে আশ্রয় নিয়েছেন। মোবাইল ফোনে তাঁদের মাঝে শেষ যেদিন কথা হলো সেদিন রাইন কথা দিয়েছিল—এই অচেনা শত্রুর সাথে লড়াইটা সে জীবন দিয়ে হলেও জারি রাখবে। আজ তাই মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও সে নির্ণিয়া-১  কে ধারণ করেছে নিজের শরীরের ভেতর। 

নির্ণিয়া-২ এর ঠাঁই হয়েছে সেবাতের শরীরে। সাতাশ বছরের টগবগে যুবক সেবাত এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে। তার পূর্বপুরুষ সেমেটিক ককেশীয়। শিরায় তার বইছে ক্যানাইত বেদুইনের রক্ত। ব্যাবিলনীয় ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার গোড়াপত্তনে অত্যন্ত মেধাবী এই ক্যানাইত উপজাতির অবদান অনস্বীকার্য। প্রাচীন আরবদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য,  মানসিক গতি ভঙ্গি আজও সেবাত বহন করে চলেছে তার রক্তে, জীনে, মেধায় ও মননে।  বর্তমানে সে তার জাতি গোষ্ঠীর শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যবিমুখ ভোগ বিলাসী জীবন মেনে নিতে পারে না। তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয়, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু করার সুযোগ সীমিত। মানব কল্যাণে অবদান রেখে কিছু একটা করে দেখানোর তাগিদ উষ্ণ প্রস্রবণের মতো তার অন্তরে টগবগ করে ফুটছে সেই কৈশোর থেকেই। কোভিট-১৯ এর বিরুদ্ধ যুদ্ধের ময়দানে লড়াইয়ের নিমিত্তে এন্টি ভাইরাস নির্ণিয়ার জন্য একজন আরব পোষক খোঁজা হচ্ছে। এমন হাই কনফিডেনশিয়াল বা গোপন তথ্য যেন তার তৃষ্ণার বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। সুঠাম দেহী গৌরবর্ণের সেবাত তার ঘন কৃষ্ণ চুলের রহস্যময় কঙ্গো অরণ্যে ঢেউ তুলে রওয়ানা দেয় নরওয়ের উদ্দেশ্যে।
 
নির্ণিয়া প্রকল্পকে সফল করার জন্য সব ধরনের সম্ভাবনাকে যাচাই বাছাই করে—এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে  নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতার ভিত্তিতে পোষকদল বাছাই করা হবে। অত্যন্ত ধূর্ত অণুজীব কোভিট- ১৯ বহুবার তার জীনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে তার বহুরূপিতার প্রমাণ দিয়েছে। এখন প্রয়োজন উল্টো তাকে বিভ্রাম্ত করা। এই প্রকল্পের আওতায় নির্ণিয়া নামের এন্টি ভাইরাসের কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য তাই বাছাই করা হয়েছে; জিনগত ভিন্নতা অর্থাৎ নৃতাত্ত্বিকভাবে একে অন্য থেকে ভিন্ন এমন ছয় জনের পোষকদল।  শুধু তা-ই নয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভিত্তিগুলো একে অপরকে অতি নির্ণয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে এই বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে এন্টি ভাইরাসের পোষকদল নির্বাচন করা হয়েছে মায়িক নামক গ্রহটির ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে। যারা আর্থ-সমাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগলিক অবস্থা, কৃষ্টি,  জীবন-যাপন পদ্ধতি পারিবারিক আবহ, খাদ্যাভাস সব কিছুতেই একে অপর হতে ভিন্ন।

রেশমি কালো চুল, চ্যাপ্টা নাক, ছোট চোখের শিন জিমিনের গায়ের রঙ হালকা বাদামি। চোখের দু'প্রান্ত তার ভাঁজ করা।  দক্ষিণ কোরিয়ান নাগরিক শিন জিমিন এসেছেন বোসানের একটি ছোট গ্রাম থেকে। পেশায় তিনি শিক্ষক। মঙ্গোলীয় গোত্রভুক্ত শিন জিমিনের পূর্বপুরুষেরা মধ্য এশিয়ায় পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। চীনে তারা প্রায় সাত হাজার বছর আগে কৃষিপত্তন ঘটিয়েছেন। তিন হাজার বছর আগে তারা উন্নত বর্ণমালা আবিষ্কার করেন। শিন জিমিনের বয়স এখন আটান্ন বছর, দেখায় চল্লিশের কোঠায়। তার পূর্বপুরুষদের নদী-মানবও বলা হতো। তাদের হিংস্রতার অনেক গল্প শোনা গেলেও নির্ণিয়া প্রজেক্টের শিন চঞ্চলা নদী স্রোতের মতোই হাসিখুশি ও নরম মনের মানুষ। তার বাঁশি বাজানোর অসামান্য দক্ষতার জন্য তাকে ভালো না বেসে কেউ পারে না। বিপত্নীক শিনের দুই পুত্রই পড়ালেখা শেষ করে বোসান শহরে থিতু হয়েছে। সেবাতের মতো শিনও যখন এই করোনাকালে মানবসভ্যতার কল্যাণের জন্য কিছু করার তাগিদ বোধ করছিলেন তখনই সরাসরি না হলেও ঘুরপথে নির্ণিয়া প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রস্তাব পান। তাতে সম্মতি না জানানোর কোনো কারণ তিনি খুঁজে পান নি। তারই ধারাবাহিকতায় নির্ণিয়া-৩ এর আশ্রয় হয় তার শরীরে।

নির্ণিয়া টিমের সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপক মানুষটি হলেন অনুভা অজউইন যার শরীরে নির্ণিয়া-৪ এর অনুপ্রবেশ ঘটানো হলো। অস্ট্রালয়েড গোত্রভুক্ত অনুভা এসেছেন দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার কোগালা শহর থেকে। জেলে পরিবারের সন্তান হলেও বর্তমানে তার জীবিকা হলো পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য স্টিল্ট ফিশিং বা রণপা জুড়ে দিয়ে মাছ ধরা। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছ ধরার এ ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি এখন কেবল পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তীব্র খাদ্য সঙ্কট ও অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে—মাছ ধরার ডিঙি নৌকা কেনার সামর্থ্য না-থাকায় হতদরিদ্র ধীবর গোষ্ঠী আবিস্কার করে মাছ ধরার এই অভিনব কৌশল। রণপা বানিয়ে তাতে ভর করে মাছ ধরার জন্য জেলেরা চলে যেতো—তীর হতে দূরে সমুদ্রের ততটা গভীরে  যতটুকু গেলে আবার ফিরে আসা সম্ভব। স্টিল্ট ফিশারম্যান অনুভার পর্যটকদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় প্রান্তিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও টিমের অন্য সদস্যদের সাথে মিশে গিয়েছেন সহজেই। গভীর কালো চোখ আর কোঁকড়া চুলের অনুভার চেহারায় দীর্ঘ কপলাঙ্ক আর ভারী চোয়ালের কারণে একটা দৃঢ়তার ভাব ফুটে ওঠে। মানুষটা কেবলই জেদের বশে কোভিট-১৯ এর বিরুদ্ধে এই অনিশ্চিত লড়াইয়ে শামিল হলেন। তার পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে এই কোভিট-১৯। মাত্র পঁচিশদিনের ব্যবধানে প্রথমে হারালেন মাকে, এর ঠিক দশদিন পরেই তার হৃদয়কে তীব্র হাহাকার ছুঁড়ে দিয়ে কোভিড-১৯ কেড়ে নিলো তার একমাত্র কন্যাকে। তখনই মনে মনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই অসুরের সাথে লড়াইয়ে যেকোনো মূল্য তিনি দেবেন। নরওয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার ঠিক দুদিন আগে সৎকার করলেন ছোট ভাইয়ের করোনা পজেটিভ (কোভিট-১৯ দ্বারা আক্রান্ত রোগী) মৃতদেহ।

কাগিসো ফুনানী এসেছেন সাউথ আফ্রিকার  নাটাল প্রোভিন্স থেকে। জুলু সম্প্রদায়ের এই মানুষটি পেশায় একজন এনজিও কর্মী, বয়স পঁয়ষট্টি। অত্যন্ত সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী কাগিসো চিরকুমার। নাটালে তিনি শিশুস্বাস্থ্য ও তাদের মানসিক বিকাশ বিষয় নিয়ে কাজ করেন। সম্প্রতি তিনি পূর্ণ অবসরে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন এমন সময় তারই সহকর্মী মারফৎ কোভিড-১৯ বিরোধী এই প্রজেক্ট সম্পর্কে অবহিত হন। অচিরেই তার মনে হতে থাকে জীবনকে অর্থবহ করতে হলে এই প্রজেক্ট অংশগ্রহণ করা তার জন্য জরুরি এবং ঈশ্বরই তাকে এ কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য এমন যোগাযোগ ঘটিয়েছেন। অতএব নির্ণিয়া-৫ নিজের শরীরে ধারণ করা বলতে গেলে পরম ঈশ্বরেরই ইশারা। 

নির্ণিয়া প্রজেক্টের সর্বশেষ সদস্য হলেন সোহরাব হাসান। তিনি দক্ষিণ এশীয় বদ্বীপ অঞ্চল খ্যাত বাংলাদেশের নাগরিক। বয়স বত্রিশ। দেশটির সার্বিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি যারপরনাই হতাশ। হতাশা তার স্বজাতির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাই তার এই হতাশাকে অত্যধিক গুরুত্ব না দিলেও চলে। শংকর জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সোহরাব পেশায় একজন সাংবাদিক। ভাটি অঞ্চলের মানুষ সোহরাব কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হলেও নিত্য নতুন কর্মোদ্দীপনায় তার বিরাম নেই। পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি ইতিমধ্যেই করোনা সৃষ্ট দুর্যোগে দুস্থদের পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণ বিতরণ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন। দেশে বিদ্যমান  বাম রাজনীতির সাথে তার কিঞ্চিত সংশ্লিষ্টতা আছে। তিনি দলের একজন সক্রিয় কর্মী। নির্ণিয়া প্রজেক্টে অংশগ্রহণ তার রাজনৈতিক দলেরই সিদ্ধান্ত।  পুরো প্রজেক্টে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি অন্যের ইচ্ছায় এই প্রজেক্টে অংশ গ্রহণ করেছেন।

আজ মে মাসের দশ তারিখ। উত্তর গোলার্ধে একটি দেশে এখন রাত, আকাশ রহস্যময়তায় ঘেরা। নির্ণিয়া প্রজেক্টের জন্য ব্যবহৃত শহরতলীর এই ল্যাবরেটরিতে  এখন সুনসান নীরবতা। ছয় জন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে একটু পরে উড়ে যাবে নরওয়েজিয়ান সরকারের বিশেষ বিমান। উড়ে যাবে পৃথিবী নামক গ্রহটির নানা প্রান্তে। যে গ্রহটিকে নির্ণিয়া নামের অণুজীব চেনে 'মায়িক' নামে। এই ছয় জন স্বেচ্ছাসেবক জানে না তাদের ভাগ্যে কী আছে। আদতে এ গ্রহের ৮০০ কোটি মানুষের মাঝে কেউই জানে না তাদের ভাগ্যে কী আছে। স্বেচ্ছাসেবকদের ফিরে যেতে হবে যার যার জায়গায়। কিন্ত এই যাওয়া কোনোভাবেই তাদের পুরনো জীবনে ফিরে যাওয়া নয়। জীবন নিয়ে বলতে গেলে একরকম জুয়া খেলাই হলো। শরীরে এন্টিভাইরাস নিয়ে তারা এখন নিয়োজিত হবেন কোভিট-১৯ অধ্যুষিত এলাকায় রোগীর সেবায়। সেটা বড় বিষয় নয়, তাদের বলা হয়েছে মিশন সফল হলে তারা কিছু দিনের মধ্যেই পৃথিবীকে একটা সুখবর দিতে পারবেন। আর ব্যর্থ হলে মাস খানেকের ভেতরই তাদের যেতে হবে সেখানে, যেখানে হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা গিয়েছেন পৃথিবীর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে। কিন্তু এই ছয় জনের যাওয়া হবে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। একে একে অকেজো হতে থাকবে তাদের  দেহ পরিচালনাকারী মূল অঙ্গগুলো। যকৃত, পিত্তথলি, ফুসফুস,  হৃদপিণ্ড-সহ একে একে স্তব্ধ হবে ঘড়ির সকল কাঁটা। এ যাওয়া সুস্থির নয় সহজও  নয়, ধীরলয়ের, যন্ত্রণা দেবে, দেবে না সহজ মুক্তি। 

পৃথিবীর ছয়টি ভিন্ন অঞল থেকে আসা ভিন্ন ভাষাভাষীর ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ছয় জন মানব-মানবীকে একটি অণুজীব কেমন একই সুতোয় বেঁধে ফেললো! ধীরে ধীরে তারা বিমানে উঠছে, তাদের গমন পথে ছড়িয়ে পড়ছে সভ্যতার মুক্তিপণ। বিমান উড়লো, দূর অন্তরীক্ষে কোথাও একটা তারা জ্বলে উঠলো।


• লালখানবাজার, চট্টগ্রাম

menu
menu