অণু অথবা পরমাণু গল্প
করোনা কলি
একটা ভিক্ষুক প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে আর্তস্বরে কাকুতি মিনতি করছিল। সদর রাস্তা থেকে নেমে গলিটা কানা হয়ে গেছে যেখানে, সেখানে চারটা পাশাপাশি ফ্ল্যাট। একটা দশ তলা। বাকি তিনটা ছ তলা করে। এটা হলো ছোট এ গ্রাম্য শহরের সবচাইতে বনেদি এলাকা। সবচেয়ে ধনী লোকের আবাস। তখন বেলা বারোটা। কারনাকাল। ভিক্ষুকটি ডাকছিল এ চারটা বহুতল দালানকে উদ্দেশ্য করে।
ভিক্ষুকটার আর কোনো পথ খোলা নেই। বিকল্প নেই। পুরো শহরে হেঁটে হেঁটে আর ডাক পারতে পারতে সে এখন ক্ষুধার তাড়নায় বেহুস হতে চলল। মুত্যুর আগে যেমন মাছ শক্তিশালী হয়ে শেষ দাপাদাপি করে, তার অবস্থা তেমন।
পথে মানুষজন কম। এখানে যার যার ফ্ল্যাটে পরিবারগুলো পর্যাপ্ত মজুত করে নিয়ে লকডাউন পালন করছে।
যারা আগে দান দক্ষিণা করতো তারাও এখন কেমন যেনো কিপ্টে হয়ে গেছে। ফলে ভিক্ষুকটার একটানা আর্তনাদ কোনো ফল বয়ে আনতে পারছে না।
একটি ফ্ল্যাটে এক বুড়ো বিগত ছয়টি বছর যাবৎ স্ট্রোক পরবর্তী প্যারালাইসিসে শয্যাশায়ী। বৃদ্ধের বয়স নব্বই। আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না তার। রোজ রাতে নীরবে অশ্রুপাত করে করে তার দুটি চোখ কেতুরে ভরা। তিনি রিটায়ার্ড সরকারি চাকুরে। আবহাওয়া পরিদপ্তরের প্রাক্তন সহকারী পরিচালক। তার বড়ো পুত্রের খরিদকৃত ফ্ল্যাটে তিনি বাধ্যগত বাসিন্দা। পুত্রের বড়ো চাকরি। ছোট শহরের কোনো দপ্তরের বড়ো কর্তা। দপ্তরের নাম বলা থেকে বিরত থাকছি।
যদিও প্রশাব পায়খানা করতে হয় বিছানায় তবু বৃদ্ধের গিলে খাবার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তার গলা দিয়ে ঘিন্নায় ভাত ঢুকে না। ছেলের বউটির অপমান ভরা কথা হজম করা কোনো রকমে চলে—তবে ছেলের কালো করে রাখা মুখ তাকে এতো পীড়া দেয় যে, তিনি প্রাণভরে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করেন।
ভিক্ষুকের কাতর ডাক তার মরমে গিয়ে লাগে। তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন কখন এতোগুলো পরিবারের মধ্যে অন্তত কোনো একটি পরিবার থেকে তার আর্জি কবুল হয়। কিছু পেয়ে শান্ত হয় ভিক্ষুকের মন। কিন্তু না। কেউ যেনো কিছুই শোনে না।
এ আর্তি ভরা কান্না বৃদ্ধের মনে বেদনার বন্যা বয়ে দেয়। বৃদ্ধ কামনা করেন, থেমে যাক এ ডাক, অথবা তিনি এমন কোনো পৃথিবীতে স্থানান্তরিত হন, যেখান এ কান্না নেই।
যতোই নিদারুণ আর্ত ডাকটি কানে আসতে থাকে ততই বৃদ্ধ মানুষটি জীবন্ত এক বেদনা ভরা শক্তি অনুভব করতে থাকেন । এ মানবিক শক্তি দেহের মধ্যেও ক্রিয়া করতে থাকে। প্রতিটি করুণ ডাক তাকে ক্রমান্নয়ে কাঁপাতে থাকে। শেষে প্রবল ঝাঁকুনি দেয় একটা।
হঠাৎ বৃদ্ধ উঠে বসেন বিছানায়। কি আশ্চর্য। বিগত ছয়টি বছর তার কেটেছে এ বিছানায়। কখনো মলে কখনো স্রাবে পরে রয়েছেন তিনি। যতক্ষণ না কাজের ছোকরাটি দয়া করে সাফ না করে দেয় এসব। আজ এ শক্তি কোথা থেকে তবে এলো!
তিনি দিব্বি দাঁড়িয়ে যান এবং মনে করতে পারেন যে, ছয় বছর আগে যখন তিনি এ বিছানায় নিজেকে সঁপেছিলেন, সে দিন তার পাঞ্জাবির বুক পকেটে একটি পাঁচশো টাকার নোট ছিল। তিনি হেঙ্গারে ঝুলে থাকা ময়লা পাঞ্জাবির পকেটে সেই টাকাটা পেয়ে যান এবং দ্রুত দরজা খোলে বাইরের বারান্দায় আসেন।
ততক্ষণে ডাক থেমে গেছে।
লক ডাউন। পাড়াটা যেনো ঘুমন্ত । তিনি চিৎকার করে ডাকেন ভিক্ষুকটিকে। না, কোন সাড়া মেলে না।
আমরা জাইগা আপনারা ভালা থাকেন
পরশু আমরা ফ্ল্যাট ছাইরা দেমু। এইডার কতা খুব মনে পড়বে। আমরা সবচে উচাত ছিলাম। গরম বেশি লাগতো। তবে যখন তখন ছাদে যাইতে পারতাম। সেখান থেইক্কা কুমিল্লা শহরটা দেখা যাইতো। কতো সুন্দর কুমিল্লা। বাসা ভাড়া দেওনের অবস্থা মারার আর নাই। খাওনের টাকাও নাই।
আব্বায় বহু দেনা কইরা বাহরাইন গেছিল। ধার শোধ করতে করতে এতদিনে সুখ আইছিল। আব্বা সেখানে সমুদ্রের ভিতরে একটা হোটেলে কাম করতো। ছোট কাম। বেতন বেশি না। তবু আমরারে ভালা লেখাপড়া শিখানোর জন্য আম্মারে কইলো কুমিল্লা শহরে একটা বাসা ভাড়া কইরা ভালা স্কুলে ভর্তি করাইতে। তিন বছর আমরা কুমিল্লায় ছিলাম। আমার ছোট ভাইএও স্কুলে পড়তো। অহন আমরা আবার গ্রামে চইলা যামু।
আব্বার চাকরি নাই। তিনি যে বাসায় থাকেন, সেখানে মেলা লোক, কুমিল্লারও আছে। করোনা ধরছে তাদের বাসার একজনেরে। আব্বারও বলে জ্বর। তার খাওনের টাকা নাই। ঔষধ কিনবো কি! এইডা আমি আম্মার লগে কতা কওনের সময় লুকাইয়া শুনছি।
আমরার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে আব্বার কথা হইছে, ইমুতে। ছোট ভাইটা কান্দছে। আব্বায় কয়—করনা গেলে আবার তোমরা আইবা। ছোট ভাইটা কয়—হু করনা আর গেছে!
করনা আমরারে স্কুল থেইক্কা বাইর কইরা দিলো! আব্বার মন খারাপ হইবো বইলা আম্মা আমারে কানতে মানা করছে। আমি কই আব্বা তোমার মাস্ক আছে? ঐ লোকটা থেইক্কা দূরে থাকবা। তোমরা তারে লুকাইয়া রাখছ কেন?
আমি আমার স্কুলের পোশাক সঙ্গে নিতাম না। দেখলে কষ্ট হইব। ভাইয়েরে কই, ভাই, তরটাও রাইখ্যা যা, ছাদে, পতাকার মতন। ভাই কয়কি, কয়—না আমি আবার আমু।
আইছ্ছা আমার একটা কতা। পৃথিবী এমন নিষ্ঠুর কেন? করনা কি আন্ধা! এ জগতে শিশুর কি অপরাধ! আমার স্কুলের প্লাস্টিকের গোল ব্যাজটা, ড্রেসটার বুকে হেঙ্গারে। সেইটা চোখে পড়তেই হঠাৎ অনেক পানি চইলা আসছে। আর লেখতে পারুম না। খাতা ভিজ্জা গেছে।
• কুমিল্লা