হিমঘরের গল্প
আরেকটু পর আমরা কে কোথায় যাবো কেউ জানি না। আমার শেষ না করতে পারা গল্পটার জন্য খুব মায়া হচ্ছে। আসার সময় স্ত্রী সন্তানের মুখ না দেখতে পেরে যতটা না আফসোস হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে সেই শেষ না করতে পারা গল্পটার জন্য। এমন সময় খুব গুরুগম্ভীর গলায় কোনো এক ভদ্র মহোদয় বলে ওঠলেন, গল্পের কি কোনো শেষ আছে? ভদ্র মহোদয়ের অবলীলাময় প্রকাশ ভঙ্গিতে আমার ভঙ্গিমাও বদলে ফেলি। আরে তাই তো! এতক্ষণ এই বিষয়টা মাথাতেই আসেনি। আসবে কী করে! সেই যে অচেনা জ্বরের টেম্পেচারটা এখনো মাথা থেকে যায়নি। ভদ্র লোকের মিথে মিল লাগিয়ে বললাম, আপনি ঠিক বলেছেন। গল্পের কোনো শেষ নেই। এই যেমন—আমরা এক গল্প থেকে বেড়িয়ে আরেক গল্পের ভেতর ঢুকে পড়ছি। ঢুকেই যখন পড়েছি, তাহলে চলুন বের হয়ে আসা গল্পগুলো থেকে শেষ মুহূর্তে আরেকবার বেড়িয়ে আসি। গুরুগম্ভীর গলায় সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে ভদ্র মহোদয় বললেন। এতক্ষণে পিনপতন নীরবতা ভেঙে সকলেই অদ্ভুতভাবে নড়েচড়ে নিজ নিজ স্থানে ঠিকঠাক হয়ে বসলাম।
কোনো এক বিজ্ঞানী আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললো, ভাইসব—পাপ-পুণ্য বলে কিছু নেই। আগুন অথবা শান্তিগাঁথা কেবল এক ধরনের প্রহসন। মৃত্যুই আমাদের মুক্তি। জীবনের শেষ স্তর। এর পরে কোনো শৃঙ্খল নেই। কোনো জন্ম নেই।
বিজ্ঞানীর বিবৃতিতে তীব্র প্রতিবাদ করে আরেকজন চেঁচিয়ে ওঠলো, অনন্তর যাত্রা এই তো শুরু। যেখানে আমরা যাচ্ছি। তোমরা হিসাব-নিকাশের জন্য তৈরি হও। আগুন অথবা শান্তির ফায়সালা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। লোকটার গলা থেকে ফাঁসির দাগ এখনো মুছে যায়নি। মাথার টুপিটা ফাঁসির পরেই জল্লাদরা খুলে হয়তো কোনো ডাস্টবিনে ছুঁড়েছে। জিকির আজগার করতে করতে বোধ হয় ফাঁসির মঞ্চে ওঠেছিলেন। এখনো সেই বিশ্বাসের কম্পনটা শরীর ও স্বরে লেগে আছে। আমি লোকটাকে বললাম, আমরা প্রত্যেকের গল্প শুনবো। আপনারা যখন আপনাদের গল্প বলবেন—তখন একটু সংক্ষেপ করবেন। যাতে আমরা আরেকজনকে সুযোগ দিতে পারি। লোকটা হাত তুলে বললো যে, তার গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। আমরা তাকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে চেয়েও পারি না সময়ের পায়ে বেড়ি দেখে।
আরেকজন বলে ওঠলো, এসব ভয়ের কারণেই আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। বাঁচার জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাচ্ছিলাম দালালদের যোগসাজশে। ইতালি গিয়ে ইউরো রোজগার করে আয়েশে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ইতালি নৌবাহিনী আমাদের ট্রলার ফিরিয়ে দিলে ভূমধ্যসাগরের অতলান্তে ডুবতে ডুবতে পঁচতে হয়েছে। আরে তাই তো! ওর শরীর থেকে এখনো পঁচাটে গন্ধ ভেসে আসছে। বলেই নাকমুখ চেপে ধরে পাশের জনকে তার গল্পটা বলতে ইশারা করি।
আমাদের মাতৃভূমি থেকে বের করে দেয়া হয়। কারণ আমরা সংখ্যালুঘু ছিলাম বলে। পরে আমরা পৃথিবীতে নিজেদের দেশ হারিয়ে শরণার্থী নামে পরিচিত হয়ে ওঠলাম। কাঁটাতারের বেড়ির উপর আমরা যেন শরণার্থীগোলাপ। আপনাদের নামে যেসব খাদ্য ও ওষুধ সামগ্রী আসতো—সেসব কোথায় যেতো? মাঝখানে ড্যাস চিহ্নের মতো বলে উঠি আমি। লোকটা আবার শুরু করে। হয়তো তার দশ ভাগ আমাদের ক্ষুধা ও রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যয় করা হতো। এতে না মিটতো আমাদের ক্ষুধা আর না নিরাময় হতো আমাদের রোগ। ফলত ক্ষুধা ও রোগের কাছে হেরে যায় আমাদের জীবন। কিন্তু আমরা জিততে চেয়েছিলাম এই যুদ্ধে। বুকের খাঁচাটা তার এখনো দেখা যাচ্ছে। দেহে মাংস বলতে কোনো কোষ নেই বললেই চলে। কেবল জীর্ণশীর্ণ হাড্ডিসার কোনো এক কঙ্কাল যেন বিরবির করছে আমাদের ভেতর।
আমি এবার আমার সামনের জনকে সুযোগ দিই। হ্যাঁ, আপনি বলুন। বোমায় তার ডান হাতটা উড়ে গেছে। বাঁ হাত দিয়ে কোনোরকম রেলিং ধরে বসার জায়গাটা ঠিকঠাক করে বলা শুরু করে দেয়। ফাজিল পাস করেও কোনো চাকুরি পাচ্ছিলাম না। মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করেছি বলে হয়তো এরকম সমস্যা হচ্ছিল। বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃসময় কাটাচ্ছিলাম। ওরা জঙ্গি ছিলো বোধ হয়। আমাকে বললো—একটা বোমা ছুড়তে পারলেই এক লাখ। আমি ওদের চিনি না—জানি না। তবু রাজি হয়ে গেলাম। কারণ আমরা বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি জঙ্গি ছিলাম না। আমি জঙ্গি নই। কেবল টানাপোড়েনে পড়েই...। ডান হাত হারানো লোকটার গল্প শেষ না হতেই অনুমতি ছাড়াই পেট চেপে ধরে থাকা একজন ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, ও! তাহলে তুমি আছিলা ওই বোমাবাজিতে। আমি রিকসাটা লইয়া খালি বাসা থাইকা বার হইচি। মোড়টা ঘুইরলেও মাংলামটর। অমনি বুম কইরা খালি একখান আওয়াজ হুনলাম। হ্যারপর অর কিচু কইতে পারি না। নাড়িভুড়ি বের হইয়া আইতে চাইতাচে বারবার। তয় পেটে হাত দিয়া চাইপা রাখচি। বাসায় বউডা অহনও মনে অয় আমার ফেরনের লাইগা না খাইয়া রইচে। আমরা জঙ্গিবাজকে ধিক্কার দিতে পারলাম না এই জন্য যে, সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। ভেতরে ক্ষোভানল থাকা সত্ত্বেও উসকে না দিয়ে আমরা তার দিকে বিনীত দৃষ্টিতে তাকাই।
আমাদের মাঝে দুজন ভদ্র মহিলা ছিলেন। আমি এবার তাদের একজনকে তার গল্প বলবার জন্য অনুরোধের আঙুল তুললে বুক ও মুখের ক্ষতগুলো ওড়নায় আড়াল করবার চেষ্টা নিয়ে বলে, আমিও বাঁচতে চেয়েছিলাম। খুব নাম করা ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। কদিন পরেই কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিলাম। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেলো বুঝতে পারছি না। সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। রাত হলে নাকি শহর মেয়েদের হাত ফসকে পুরুষদের হয়ে যায়—জানতাম না। যখন জানলাম—তখন ওরা আমার বুকের উপর কুত্তার মতো বসে আমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি ঘুপচি গলির ভেতর। তারপর আমাকে টুকরো টুকরো অবস্থায় বুড়িগঙ্গার তীরে আবিষ্কার করি। শরীরটা বস্তা দিয়ে জড়িয়ে আছি বলে বোঝা যাচ্ছে না যে, আমি কোনো এক জীবনের টুকরোটাকরা। সমবেত সকল পুরুষ লজ্জায় লাউপাতার মতো মেয়েটার সামনে নুয়ে পড়ি।
আমাকে একটু চুপচাপ দেখে ভদ্র মহোদয় আমার ডান পাশের যুবকের দিকে ইশারা ছুড়লেন। যার শরীর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার একশো আটটা পদ্মের মতো নীল আভা ধারণ করে ছড়িয়ে আছে সমবেতদের মাঝে। যুবকটার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছিল না সহজে। সেজন্য সে সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তার গল্প শুরু করল। গলাটা বিষে জ্বলে গেছে বলে আমার কথা বলতে অসুবিধে হলেও আপনাদের নিরাশ করবো না। মেহেলেখা নামের কোনো এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেয় বাবা-মা। কিন্তু বিয়ের রাতেই মেহেলেখা পালিয়ে যায় তার পুরাতন প্রেমিকের সঙ্গে। এই লজ্জায় বিষের ভেতর জীবনকে ডুবিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম—মেহেলেখার জন্য আমার ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না। বিশ্বাস করুন, মেহেলেখার বুকে আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। বলেই বুকটা পুড়ে যাচ্ছে চিৎকারে সকলকে আরেকবার ব্যাকুলতায় ভাসিয়ে দেয় নীলাভ যুবক।
ভদ্র মহোদয় যুবকের নীল মেঘ ভেদ করে আরেকজনের কাছে যান। হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। কোনো লজ্জা পাবেন না। এখানে আমরা পরস্পরের প্রতিবেশীই তো। তাই না? হ্যাঁ, ভাই। এতক্ষণে মুখের মৌনতা সড়িয়ে তার গল্প শুরু করে। লোকটার মাথাটাই নেই। ক্ষেপণাস্ত্রে উড়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা উড়ে কোথায় গেছে বলতে পারি না। আমাদের কোনো অপরাধ ছিলো না। তখন সকাল বেলা। আমি ছেলেমেয়েদের জন্য নাস্তা বানাচ্ছিলাম। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ওরা আমাদের শহরে অতর্কিত হামলা চালালে আমরা দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করি। তারপর আর কিছু বলতে পারি না। ছেলেমেয়েদের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। লোকটা শ্রাবণের মুষলধারে কেঁদে ওঠে। তার মাথা না থাকায় আমরা তার কান্না বুঝতে পারি না।
এবার আমার পালা। সবাই এবার আমার দিকে তাকায়। আমি কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। কোথা থেকে শুরু করবো তাও না। জীবনে কখনো এমন হয়নি। বানিয়ে বানিয়ে কতো গল্প লিখেছি বেঁচে থাকতে। একবার ভাবলাম—কিছু একটা বানিয়ে নিজের গল্পটা বলবো। আরেকবার ভাবলাম—ওরা যদি বিশ্বাস না করে। কারণ ওরা সবাই গল্প লেখার সুবাদে কিছুটা হলেও আমাকে চেনে। অতএব আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও কিছু লুকাতে পারবো না। লোকজন বিরক্তবোধ করে। তাড়াতাড়ি বলুন। আমাদের হাতে সময় খুব কম। একটু পর আমরা বিচ্ছিন্ন হবো। কে কোথায় যাবো কেউ জানি না। তাড়াতাড়ি করুন। আমি আমার গল্পটা বলতে যাবো অমনি অদৃশ্য টান অনুভব করি। কারা যেন আমার পিপি পরিহিত শরীরটাকে ক্রেনে করে কোনো এক অন্ধকার সুঁড়ঙ্গে ছুড়ে দিচ্ছে। আমার গল্পটা আর বলা হয় না।
• রংপুর
অলংকরণের আলোকচিত্র : সকাল রয়