উই লাভ ইউ শেলী

শেলী ভর্জেস। জন্ম আর বড় হওয়া আরিজোনায়। জন্মে ছিলেন ১৯২৫ সালে। বড় হয়ে ৫০ সালে বছর তিনেক ছিলেন শিকাগোর নামকরা এক নার্সিং কলেজে। পিতা মাতার একমাত্র সন্তান হওয়াতে কোর্স শেষ করে ফিরে এলেন নিজ বাড়িতে। স্থানীয় এক প্রাইভেট নার্সিং হোমে শিক্ষানবিস হিসেবে প্রবীণদের সেবার কাজ শুরু। সেখানে পরিচয় তরুণ রায়ানের সঙ্গে। রায়ান ভর্জেস। নিউইয়র্কের লাগোয়া রাজ্য কানেকটিকার বাসিন্দা। হোমের পরিচালক। কাজের ফাঁকে ডাইনিং রুমে কফি পানের পর্বে আলাপ ও চেনাজানা। ধীরে ধীরে প্রণয় পর্বের শেষে বিয়ে। 

তখনো বাবা ও মা দুজন বেঁচে ছিল। ছেলে অস্টিনের জন্ম হয় চার বছর পর। অস্টিনের ১২ তম জন্মবার্ষিকীর পর মাত্র দু মাসের ব্যবধানে মা ও বাবা দুজন চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কাজের শেষে বাড়ি ফেরার কালে চেনা পথ অচেনা লাগে। বয়স্ক যুগলদের দেখলে বাবা মা দুজনের কথা বেশি করে মনে পড়ে। কষ্ট আর দূঃখের ছায়া যেন পিছু ছাড়তেই চায় না। মনে বইতে থাকা এই কষ্টের ঝড়কে থামাতে শেলী হুট করে চলে এলেন কানেকটিকায়। রায়ান খুশি হলেও অস্টিন ছিল অনেকদিন মনমড়া। অস্টিন কলেজ গেলো। 

শেলী আর রায়ান যোগ দিলো নার্সিং সেবায়। তবে এবার দুজন একসাথে নয়। শেলী কানেকটিকায় রায়ান নিউইয়র্কে। নার্সিং সেবার পাশাপাশি শেলীর সখ ছিল সেলাই করার। সুযোগ পেলেই বসে যেতো মা এর দেয়া শত বছরের পুরাতন সিঙ্গার সেলাই মেশিন নিয়ে। বাসার সব টুকটাক সেলাই, রায়ান আর অস্টিনের প্যান্ট শার্টের রিফুর কাজ। আরেকটি সখের কাজ করতো মিলি। নার্সিংহোমের সিনিয়রদের উপহার দিতো নানা সূচিকর্মের কাজ। উপহার হাতে পেয়ে সিনিয়র দের স্বর্গীয় হাসি দেখে মনে হতো স্বর্গে বসে তার বাবা ও মা বুঝি হাসছেন। 

১৯৮৫ সালের ক্রিসমাস ডে ছিল, শেলীর শেষ কর্মদিবস। হোমের সিনিয়র, নার্স আর পরিচালকদের ফুলেল শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ নিয়ে রায়ান আর অস্টিনের ভাড়া করা লিমোজিনে বাসায় ফিরলেন শেলী। এরপর দিন অনেক গড়িয়ে গেলো। রায়ান চির বিদায় নিলো ২০০২ সালে। ছেলে অস্টিন আর সংসার করলো না। অধ্যাপনার পেশাকে ভীষণ ভাবে আকড়ে ধরে মায়ের পাশেই রইলো। দিন ও সময় কেটে যায় স্রোতের মতো। হাঁটা চলায় বাঁধা না থাকায় কখনো ছেলে অথবা সিটির সিনিয়র রাইড সুবিধা নিয়ে পাশের শপিং সেন্টারে যান। কখনো চলে যান শহরের একমাত্র প্রবীণ ক্লাবে। বাকি সময় কেটে যায় টিভি দেখে আর বিশ্রামে। গেলো মাসের শেষ শুক্রবার অষ্টিন বাসায় ফিরল চিন্তাগ্রস্থ হয়ে। খাবার টেবিলে বসে জানালো পিলে চমকে উঠা খবর। মা কে বারবার সাবধান করে দিলো বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না। ক্ষতি হতে পারে বড় রকমের। ভয়ঙ্কর এক ভাইরাসের কবলে গোটা আমেরিকা। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা নিউইয়র্কের।

টিভিতে খবর শুনতে বসে শেলী জানলো নিউইয়র্কের হাসপাতালে নানা সংকট। করোনায় আক্রান্ত হাজার হাজার রোগীদের সেবা করতে গিয়ে ডাক্তার,নার্স সহ সবাই হিমশিম খাচ্ছে। বেড নেই ভেন্টিলেটর নেই। ভয়ঙ্কর এ রোগের ওষুধ পর্যন্ত নেই। তার চেয়েও যে খবর শেলীকে বিচলিত ও অস্থির করে দিল,তা হলো নার্স আর চিকিৎসকদের নেই প্রয়োজনীয় মাস্ক। অবিশ্বাস্য। দুনিয়ার মহা পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকা। সেই দেশের হাসপাতালে মাস্ক নেই। 

৯৫ বছর বয়সী শেলী ঠিক করলো। না এভাবে বসে থাকলে চলবে না। করোনার বিপক্ষে সম্মুখ সারিতে লড়াকু স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য কিছু একটা করতেই হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন পুরাতন সেলাই মেশিনের সাহায্যে মাস্ক তৈরি করবেন। ছেলে অষ্টিন বলে, মা তোমার জন্য আমি গর্বিত। আমি আছি তোমার সঙ্গে। 

ছোট্ট শহরে ছড়িয়ে খবরটি গেলো। শেলীর সঙ্গে যোগ দিলেন আরো শ খানেক স্বেচ্ছাকর্মী। ১৫ দিন পর শহরের মেয়র দশ হাজার মাস্ক তুলে দিলেন নিউইয়র্কের সবচেয়ে সংকটাপন্ন এক হাসপাতালে। জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে আগত এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, কোথায় সেই কিংবদন্তির নারী যিনি এই ক্রান্তিকালে নিউইয়র্কে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। মেয়র দু হাত জুড়ে বিনয়ে আর শ্রদ্ধায় হাটু মুড়ে যার সামনে বসে রইলেন তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন, ৯৫ বছর বয়সী আরিজোনা কন্যা শেলী বর্জেস। উপস্থিত উৎসুক জনতা তখনো চিৎকার করে বলছে,শেলী উই লাভ ইউ। শেলী, উই লাভ ইউ। 


• জ্যামাইকা, যুক্তরাষ্ট্র

menu
menu