রাবেয়া
নিকষ অন্ধকারে নির্জন রুমে আমি একা। তীব্র এক আর্তনাদ দলা পাকিয়ে উঠে আসে বুকের গহিন থেকে। ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠে। সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো মনে হলো। আজকের পত্রিকা বড় বড় হরফে রাবেয়া সুলতানাকে নিয়ে লিখেছে! সেই রাবেয়া! দপদপ করে জ্বলে উঠে স্মৃতির প্রদীপ।
রাবেয়াকে পেয়েছিলাম স্কুল জীবনের শুরু থেকে। স্কুলের প্রথমদিকের দুই/তিন ক্লাস পর্যন্ত পড়ায় একদমই মন ছিল না আমার। পেছনের বেঞ্চিতে মাথা নিচু করে অনেকটা পলাতক আসামির মতো বসে থাকতাম। ক্লাসে পড়া না পারার শাস্তি স্বরূপ প্রায় সময় বারান্দায় তীব্র রোদে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। টিফিন পিরিয়ডে আমায় নিয়ে অন্যরা হাসাহাসি করতো। টিটকারি মারতো। রোজ ঘুম ভেঙে এক ভয়ংকর আতঙ্ক নিয়ে দিন শুরু হতো। স্কুল মানেই ভীতিকর এক কারাগার মনে হতো। প্রায় দিনই পেট ব্যথার ভান করতাম। নানান অজুহাত তৈরি করতাম স্কুলে না যাওয়ার জন্যে। এতে যে নিস্তার পেতাম তা কিন্তু নয়। আমি কেন অন্যদের মতো পড়ায় মন বসাতে পারি না? তীক্ষ্ণ এক কষ্ট খেলে যেতো মনে। নিজের ওপর রাগ হতো। নিজেকে অপাঙক্তেয় মনে হতো। প্রতিদিনই লজ্জায়, ক্ষোভে মরে যেতে ইচ্ছে হতো। নিজেকে তুমুল বর্ষণের তোড়ে ভেসে যাওয়া বিপন্ন এক ছোট্ট কাগজের নৌকা মনে হতো। সেইসব দুর্বিষহ দিনগুলোতে মরতে মরতে বেঁচে উঠি রাবেয়ার কারণে। বলা চলে রাবেয়ার মায়ার টানে, সহানুভূতিতে। অনেকটা ডুবে যাওয়ার আগে হাত ধরে টেনে তীরে তোলার মতো। কোন এক দুর্বোধ্য কারণে আমার হয়ে সে অন্যদের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হতো। আমার ওপর অবিচারের প্রতিবাদ করতো। আমিও তাতে একটু একটু করে ভরসা পেতাম। সাহসী হয়ে উঠতাম। পড়াশোনায় মনোযোগী হতে আগ্রহী হয়ে উঠতাম। প্রাইমারি শেষে একই হাইস্কুলেও আমরা জানের দোস্ত ছিলাম।
একবার ঈদের দিন অনেক অনুরোধ, আব্দার করে রাবেয়া তাদের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যায় আমায়। আব্বা আম্মা অনুমতি দেন নাই। বন্ধু মলিনার বাসায় যাবার নাম করে বাসা থেকে বের হই। মলিনার বাবা নামকরা ডাক্তার। আমাদের মফঃস্বল শহরের সকলে তাকে বিশেষ সমীহ করে চলে। সম্মানের চোখে দেখে। এমন সম্মানী মানুষের বাসায় যেতে আব্বা কোনোদিনই বাঁধা দেন নাই। বরং উৎসাহিত করেন। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিলাম।
বৈশাখ মাস। চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল দিন ছিল সেদিন। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। প্রথমবারের মতো রাবেয়াদের বাসায় গিয়ে রীতিমতো ধাক্কাই খাই বলা চলে। মাটির ঘর। মরচে ধরা টিনের চাল প্রায় মাথার উপরে ঝুঁকে আছে। ওই একটিই ঘর। রুম বলতে আলাদা কিছু নেই। আমি বিস্ময়ে ঘরের এ কোণ ও কোণে চোখ বুলাই। চারপায়া একমাত্র চৌকিটি ঘরের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে। সেখানেই রাবেয়ারা তিন বোন, বাবা-মা চাপাচাপি করে একসঙ্গে ঘুমায়। পাশেই মেঝেতে মাটির চুলা। সেই ঈদের দিনে আমিই ছিলাম ওদের একমাত্র অতিথি। আমার আগমনকে ঘিরে ওদের নিজেদের উঠোনের এককোণে ছোট্ট খোঁয়াড়ে পালিত মুরগি ধরে এনে জবাই করা হয়েছে। রান্না হয়েছে। যেন এমন সম্মানিত অতিথি ওদের ঘরে আর কোনোদিন কেউ আসেনি। রাবেয়ার মা গভীর মমতায় মুরগির রান দুটি তুলে দেয় আমার পাতে। রাবেয়াদের তিনবোনের পাতে গলা, পাখনা আর মুরগির ঠ্যাং এক টুকরা করে আলুসহ তুলে দেয়। ওরা তা-ই দিয়ে নুনের সঙ্গে মাখিয়ে তৃপ্তি নিয়ে ভাত খায়। টিনের গ্লাসে ঢক্ঢক্ করে পানি গিলে। সেইসময় আচমকা আকাশ আঁধার করে ঝুম বৃষ্টি নামলে রাবেয়া দৌড়ে গিয়ে ঘরের এখানে ওখানে হাড়ি-পাতিল রাখে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি টিনের চালের ফুটো দিয়ে টপাটপ পানি পড়ে হাড়িগুলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।
সেদিনের পর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ হতে থাকে আমার ভেতরের একাংশ। হতদরিদ্র রাবেয়া কেমন করে আমার বন্ধু হয়! রাবেয়ার আর আমার সামাজিক মর্যাদা, অবস্থানে বিস্তর ফারাক। আব্বা কেনো রাবেয়ার সঙ্গে আমার মেলামেশাকে ভালোভাবে নিতে পারতেন না, বুঝতে আমার আর বাকি রইল না। আমি তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করি। জীবনটা গণিতের মতো, হিসেব মিলিয়ে চলতে হয়। ক্লাসে রাবেয়া আমার পাশে বসলে আমি নানান অজুহাতে সামনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসি। মলিনার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলি। টিফিনের সময় মলিনা আর আমি স্কুল মাঠের এককোণে বসে টিফিন ভাগাভাগি করে খাই। কখনোবা গেটের সামনে থেকে নিমাই’দার চালতার আচার কিনে খাই। রাবেয়া দূর থেকে দেখে। আমি তার দৃষ্টিসীমায় বোঝার চেষ্টা করি ঠিক কোন দিকে আসছে। রাবেয়া কাছে এগিয়ে আসে। কিছু বলতে চায়। আমরা জায়গা বদল করে মাঠের অন্যপ্রান্তে গিয়ে বসি। তবুও একদিন স্কুলের পিছনের লিচু গাছের তলায় আমায় একলা পেয়ে রাবেয়া এগিয়ে আসে। নিরুত্তাপ কণ্ঠে জিগ্যেস করে, ‘ রুমানা, আমার কী কোথাও কোন ভুল হয়েছে রে ? ভুল হলে মাফ করে দিস।’ আমি মুখে কিছু বলি না। স্থান ত্যাগ করি। সে কাঁদলো না মন খারাপ করলো সেটা আমার কাছে অবান্তর। মনে মনে বলি, তোর ভুলভাল আমি থোড়াই কেয়ার করি! কেমন করে এতদিন তুই আমার বন্ধু ছিলি !
ক্লাস এইটের শুরুর দিকে বেশ কিছুদিন রাবেয়া স্কুলে আসেনি। তারপর যখন এলো, যেনো আমূল বদলে এলো। হাতে মেহেদি। লাজুক চেহারা। সংকোচে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এ কান ও কান ঘুরে ক্লাসের সকলেই জেনে যায়, রাবেয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। এলাকার মুদি দোকানদারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বাবা-মা’র চাপে। রাবেয়ার মত ছিল না যদিও। গরিব ঘরের মেয়েদের বেশিদূর লেখাপড়া করতে নেই। আরো দুইটা ছোটবোন আছে। তাদের কথাও তো ভাবতে হবে !
আব্বা-আম্মার কানেও খবরটি পৌঁছাল। তাদের কড়া নিষেধ রাবেয়ার সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না। বিবাহিত মেয়েদের সাথে মিশলে লোকে অকালপক্ক ভাববে। সত্যি বলতে কী, আমার আর কষ্ট করে রাবেয়াকে এড়িয়ে চলতে হয়নি। নিজেই চুপসে গিয়েছে। বছর না ঘুরতেই কন্যার মা হলো সে। নিজে থেকেই আর কাছে ঘেঁষতে সাহস পেতো না। এসএসসি এর পর আর কোন খবর জানি না। আমরা সব বন্ধুরা কলেজে ভর্তি হই। এইসএসসি শেষ করে মফস্বলের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। চুটিয়ে প্রেম করি। মধুর ক্যান্টিনে, টিএসসিতে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমাই। মাস্টার্স শেষে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ি। বড় ডিগ্রিধারী হই। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দিন, মাস, বছর পেরোয়। পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে আমিও বিদেশে স্থায়ী হই।
এক গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে বেড়াতে যাই। যেন চোখের নিমিষে একমাসের ছুটি ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। কেনাকাটা শেষ হয়নি। আমেরিকার বন্ধুদের জন্যে গিফট কেনা বাকি। নিজের ব্লাউজগুলো বানানো শেষ হয়নি। রাজ্যের ব্যস্ততা। বসুন্ধরা শপিং মলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে বাঁ দিকের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলাম দ্রুতপায়ে। সঙ্গে আমার নয় বছরের একমাত্র কন্যা রিয়ানা আর ওর বাবা। কেউ একজন ডান দিকের সিঁড়ি থেকে ডেকে উঠে, রুমানাআআআ...। যে কারো কাছে মনে হবে সুদূর অতীত থেকে ভেসে আসা কোন স্বর! খুব কাছের কেউ না হলে তো এমন করে ডাকার কথা নয়। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশস্ত দৃষ্টিতে তাকাই। সাদাকালো চুলের সাদামাটা এক মধ্যবয়সী নারী। পরনের ছাপা সুতি কাপড় আঁচল টেনে কাঁধের অন্যপাশে এনে রাখা। মাথার চুলগুলো কেমন ধূসর বর্ণের দেখাচ্ছে। দীর্ঘদিনের অযত্নে যেমন হয়, ঠিক তেমন। পান খাওয়া মুখ। সঙ্গে যুবতী কন্যা। হাত দুটি ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় গাঢ় ছায়া। আমি কি চিনি? অপ্রস্তুত আমি। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঝড়ের বেগে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে ঘর্মাক্ত শরীরে। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। বহুদিন পর আপনজনকে দেখলে যেমন অনুভূতি হয়, তাকে ঠিক তেমন মনে হচ্ছিল। আমি ভ্রূর কুঁচকে তাকাই।
‘কিরে, চিনোস নাই আমারে ? আমি রাবেয়া। কতদিন পর দেখা ! তুই সেই আগের মতোই আছিস। আমার মেয়ে এইটা, বিয়ে দিসি এক বছর হয়, নাতি হইসে কয়দিন আগে, কাপড়চোপড় কিনতে আসছি’... হরহর করে একনাগাড়ে বলে গেলো সে। আমি অস্বস্তি নিয়ে সায় দেই, ‘ ওহ্ ! খুব তাড়া আছে, অনেক কাজ বাকি, কাল বাদে পরশু ফ্লাইট, পরে সময় করে কথা হবে’... বলে আমি দ্রুতই স্থান ত্যাগ করি। রিয়ানা কিংবা ওর বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম না। রিয়ানার বাবা জানতে চাইলো, কে উনি? তোমার পরিচিত? খানিক বিরক্তিতে বললাম, ‘ হুম’। আমার ক্লাসমেট কন্যা বিয়ে দিয়ে নাতি-নাত্নির নানী হয়ে গেছে, এ কেমন কথা ! আমি কী এতো বুড়িয়ে গেলাম নাকি! তার নিজেরই বিয়ে হয়েছে ক্লাস সেভেন পাস শেষে। মা হয়েছে বালিকা বয়সে। আবার কন্যাকেও বিয়ে দিয়েছে এতোটুকুন বয়সে! এদের আর কোনো পরিবর্তন হলো নাহ্ !
দেশ থেকে ফিরেছি এখনো বছর গড়ায়নি। এরই মাঝে বিশ্ব কাঁপিয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। থমকে গেছে একে একে অনেক দেশ। ইতালির অগণন মানুষের মৃত্যুর খবর পড়ে আতঙ্কিত আমরা। এরই মাঝে নিউইয়র্কের অবস্থা তারচেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। দেশেও খুব ধীরে করোনা তার ভয়াল থাবা বসাচ্ছে। নানান চিন্তা ভর করে থাকে অবচেতনে। মৃত্যুভয় তাড়া করে ফিরে। ঘরবন্ধি হয়ে সময় পার করছি স্বামী, সন্তানসহ। বন্ধি জীবন নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করি। রোজ সন্ধ্যায় নিয়ম করে অনলাইনে নিউজপোর্টালগুলো দেখি। মনোযোগ দিয়ে দেশের খবর পড়ি।
চোখ স্থির হয়ে রইল প্রথম পাতার খবরে।
‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেষ অব্দি করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন নার্স রাবেয়া সুলতানা ...’। তাঁকে যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করা হবে ‘ বীর শহিদ’ কবরস্থানে।’ খবরের পাশে রাবেয়ার সাদাকালো ছবি। সেই দিকে তাকিয়ে আছি আমি। অস্ফুটে ডেকে উঠি রাবু ! আমাদের রাবু ! রাবেয়া ! নাহ্ চিনতে একদমই কষ্ট হচ্ছে না ! আমার স্কুল জীবনের শুরুর দিকের বন্ধু ! চিরকালই তেল চপচপে চুলে আঁটসাঁট দুই বেণি করে স্কুলে আসতো মেয়েটি। বেশ পরিপাটি চুল। আমাদের মতো যখন তখন কপালে, চোখে অবাধ্য চুল এসে যেতো না বেহায়া বাতাসে। মফস্বল শহরের স্কুল, নীল কামিজ, শাদা পাজামা, শাদা ভাঁজ করা ওড়না, স্কুল মাঠে সকালের নরম রোদে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, লেফট-রাইট পিটি করা ... ওহ্ আর ভাবতে চাই না। কখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নেমে এসেছে চার দেয়ালের মাঝে, টের পাইনি। পিনপতন নিস্তব্ধতা। সড়কের শেষ বাসটি চলে যাবার পর যে নিস্তব্ধতা নেমে আসে শহরে, অনেকটা তার সাথে তুলনা দেয়া চলে।
নিকষ অন্ধকারে নির্জন রুমে আমি একা। মধ্যরাতের শান্ত ঢেউয়ের মতো ধীর। তীব্র এক আর্তনাদ দলা পাকিয়ে উঠে আসে বুকের ভেতরের একাংশ থেকে। যেনো তীক্ষ্ণ কোনো ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে দগদগে ক্ষত করে দিয়েছে কেউ। নিজের ওপর নিজেরই অভিমান হয়। দূরের কোনো ছায়াপথের শেষপ্রান্তে নীল রং এর স্কুলের পোশাকে মাথায় দুই বেণি বাঁধা বালিকা রাবেয়াকে বিষণ্ণ বদনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। অস্পষ্ট ...। অন্ধকার দেয়ালে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় বিমর্ষ এক কণ্ঠস্বর, ‘ রুমানা, আমার কী কোথাও কোন ভুল হয়েছে রে? ভুল হলে মাফ করে দিস’...
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র