দাতা 

দাতা 
রাইয়ান জহির

চৈত্রের তপ্ত দুপুর, ব্যস্ততায় ভরপুর শহর ঢাকা আজকাল অনেকটাই ফাঁকা। শহর জুড়ে লকডাউনের মধ্যেই অনেকে নানা অজুহাতে বের হচ্ছে। অজুহাতে পরিপক্ব জনগণকে ঘরে ফেরাতে ঘাম ঝরছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ফজলে তুহিন টানা তিনদিন ঘরবন্দী, তিনদিন আগে একবার বাজারে গিয়েছিল। এরপর আর বের হওয়া হয়নি। এক কামরার টিনশেড বাসায় টিভি, ইন্টারনেট বা কোনো প্রকার বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকলেও দিন খারাপ কাটছে না তুহিনের। নীলক্ষেতের ফুটপাত থেকে অতি সস্তায় কেনা অনেক উপন্যাস ও গল্পের বই কেনা আছে তার। এগুলো পড়ে আর পড়ন্ত বয়সের বিধবা মায়ের সঙ্গে লুডু খেলেই দিন পাড় হচ্ছে তার। মায়ের সঙ্গে লুডু খেলার আলাদা মজা আছে, সদা সন্তানের মঙ্গল কামনা করা, ছেলের জয় চাওয়া মা কীভাবে খেলায় তার প্রতিপক্ষ হয়ে তাকে হারানোর ধান্ধায় ব্যস্ত থাকে, তা ভেবে হাসি পায় তুহিনের। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর তুহিন যখন মায়ের কাছে হেরে যায়, বিজয়ী মা তখন ভুবন ভুলানো যে হাসিটা দেয় তা বারবার দেখার জন্য—ইচ্ছে করেই ভুল চাল দিয়ে হেরে যায় তুহিন। তবে কালেভদ্রে তুহিন জিতে গেলে মায়ের মুখখানা হয় দেখার মতো, যেন লুডু খেলায় হেরে যাওয়ার কারণে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল দেশ শাসনের ভার পেয়ে গেলো। লুডু খেলায় হেরে যাওয়া মায়ের মলিন মুখ পরের খেলায় জিতে গিয়ে হাসিতে ভরে উঠে। কিন্তু জীবন খেলায় হেরে যাওয়া মা ও ছেলের সামনে বিজয়ী হাসি হাসার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পর থেকেই পূর্ণ বেকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স তৃতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি কোচিং সেন্টারেও কয়েকটি বাসায় গিয়ে স্টুডেন্ট পড়াতো সে। টিউশনির টাকা মাস শেষে পেলেও ক্লাস নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পকেটে টাকা গুঁজে দিতো কোচিং সেন্টারের মালিক। নিজের আয়ে মা ছেলের সংসার অনায়াসে চলে যায় বলে আজীবন মানুষের বাসায় কাজ করা মায়ের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে তুহিন।

মার্চ মাসের ১৭ তারিখ থেকে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ দেয়ার পর টিউশনির বেতন আর পায়নি সে। এক বাসা থেকে শুধু অর্ধেক বেতন পেয়েছিল আর কোচিংয়ে তো কোনো বকেয়া নেই। হাতে যে কটা টাকা ছিল তা দিয়ে প্রায় একমাস কাটিয়েছে তারা। তিনদিন আগে বাজার করে ফেরার পথে রিক্সা ভাড়াও বাঁচেনি। সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবে এই চিন্তায় ঘুম আসে না তুহিনের। তুহিনের মা অবশ্য কয়েকবার বলেছে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ দিচ্ছে, উনি গেলে কোথাও না কোথাও কিছু পেয়ে যাবেন। কিন্তু তুহিন তো জানে ষাটোর্ধ্ব মায়ের বাসা থেকে বের হওয়া এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপুর্ণ। অগত্যা মেইন রোডে ত্রাণ দিবে এই খবরে তুহিন নিজেই ত্রাণের আশায় বের হলো। ট্রাকের সামনে লম্বা লাইন, লাইনের একেবারে শেষ মাথায় ঠাঁই হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর। ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরও লাইন একচুলও নড়েনি। কারণ কাউন্সিলর সাহেব না আসা পর্যন্ত ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমে দরদর করে ঘামা মানুষের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে লাইন আস্তে আস্তে এগুতে লাগলো। ট্রাকের খুব কাছে এসে লাইন থেকে বের হয়ে গেলো তুহিন। উৎসাহী কিছু লোক অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাইনে দাঁড়িয়ে শেষ মুহূর্তে রণে ভঙ্গ দেয়ার কারণটি তারা খুঁজে পাচ্ছে না। রাস্তার উল্টো পাশে গাছের ছায়া ঘেরা ফুটপাতে বসা মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোকের পাশে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বসল তুহিন। ভদ্রলোকের চেহারায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট, মাঝ দরিয়ায় ঝড়ো বাতাসে পাল ছিঁড়ে যাওয়া নৌকার মাঝির মতো অবস্থা অনেকটা।গল্প,আলাপে ভদ্রলোকের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাতে চায় তুহিন। এরপর ছবি তোলার হিড়িক শেষ হলে আরেকবার লাইনে দাঁড়ানোর ইচ্ছে আছে তার। ভদ্রলোকের দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে,

—আঙ্কেল, এই ভরদুপুরে এখানে কী করেন? 
ম্লান একটা হাসি দিয়ে খালেক উদ্দিন জবাব দেয়,

—তুমি যা করো আমিও তাই।   

—আঙ্কেল আমি তো বসে আছি ত্রাণের জন্য, ফটোসেশন শেষ হলেই আবার লাইনে দাঁড়াবো। 

—লাভ নাই ভাতিজা, ছবি না তুলে ওরা ত্রাণ দিবে না, লাইনে আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম, ছবি তুলে বলে লাইন ছেড়ে চলে এসেছি। আমি মাস্টার মানুষ, অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আছে আমার। এই ছবি সামাজিক বা গণমাধ্যমে গেলে আমার সম্মান থাকবে? পরিস্থিতির কারণে রাস্তায় বের হয়েছি। অথচ সরকার বলেছিল ফোন দিলে গোপনে বাসায় ত্রাণ পৌঁছে দিবে, কতবার ফোন দিলাম কাজ হয়নি। পকেটে রিক্সা ভাড়া নেই, অনেক দূর হেঁটে এসেছি, আবার যেতেও হবে হেঁটেই তাই একটু জিরিয়ে নিচ্ছি।

—ছবি ছাড়া ত্রাণ দিবে না কেন? 

—ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওরা বলেছে অনেক জায়গায় ত্রাণ চুরি হচ্ছে তাই নিজেদের স্বচ্ছ রাখার জন্য ওরা প্রতিটি গ্রহীতার ছবি তুলে ত্রাণ দিচ্ছে। এছাড়া সাংবাদিক তো আছেই।

এরপরও কিছু কথা হয়েছে তাদের মধ্যে। আলাপ সালাপে জানা গেলো তিন মেয়ের বাবা খালেক উদ্দিন একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। স্কুল থেকে যে বেতন পেত তা দিয়ে বাসা ভাড়াও হয় না, স্কুলের পাশাপাশি কিছু ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে কোনোরকমে দিন কেটে যেত তার,ব্যাংক ব্যালেন্স কিছু করতে না পারলেও মানুষের কাছে হাত পাততে হয়নি কখনো। কিন্তু গতমাস থেকে স্কুল, ছাত্রছাত্রী সবার দেয়া বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কঠিন বিপদে পড়েছে এই শিক্ষক মানুষ। খালেক সাহেবের কথা শুনে নিজের দুরাবস্থার কথাও বলেছে তুহিন। দুজনের বিপদ এক হওয়ায় একে অন্যের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছু করার ছিল না তাদের। দুজনের চোখ আকাশ পানে,যেন নির্বাক দৃষ্টিতেই অনেক কথা বলে নিচ্ছে স্রষ্টার সঙ্গে।

কোলাহল থেমে গেছে, ত্রাণের ট্রাক চলে গেছে, অভাবী মানুষের লম্বা লাইনও আর নেই। কেবল মাথার উপরের ছাতিম গাছটায় কর্কশ গলায় কা কা করে চলছে দুটো পাতি কাক। যেন খালেক ও তুহিনকে তারা এই করোনাকালে রাস্তা ছেড়ে ঘরে ফেরার তাগাদা দিচ্ছে। নিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যৎ এর মালিক দুজন একেবারে নির্বিকার। যেন কিছু বলার নেই, কিছু করার নেই, এমনকি কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাদের। যেন অনন্তকাল এখানেই বসে থাকবে তারা।

—ছার গো একটা কতা কইয়াম? 

অপরিচিত শব্দে সম্বিৎ ফিরলো খালেক ও তুহিনের। সামনে দাঁড়ানো দুজন ভিক্ষুক। দুজনের হাতেই একটা করে ত্রাণের ব্যাগ। দুজনেই মলিন মুখে শুষ্ক হাসি দেয়, আর মনে মনে ভাবে,

—আমাদের কাছে আর কি পাইবা? আমরা তো তোমাদের চেয়েও ফকির। 
এরমধ্যেই  ভিক্ষুকদের একজন আবারো কথা বলে উঠে,

—ছার এই ব্যাগ দুইডা আফনেরা রাহেন। 

নিজের কানকে বিশ্বাস কতে পারে না ওরা। ভিক্ষুকেরা বলে কি? তুহিন ক্ষেপে যায় অনেকটা, নিজেদের দারিদ্রতাকে পুঁজি করে ভিক্ষুকরাও ওদের করুণা করবে তা মানতে পারে না সে। বেশ রাগ নিয়েই উঠে দাঁড়ায় বেশ কয়েকটা কড়া কথা শোনাবে তাদের। বয়সে অনেকটা এগিয়ে থাকা দৃঢ়, স্থির খালেক উদ্দিন হাতটা চেপে ধরে তুহিনকে নিবৃত্ত করে, তারপর  নরম স্বরে বলে,

—তোমাদের জিনিস আমাদের দিবা কেন মিয়া? যাও বাসায় গিয়া রান্নবারা করে বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে খাও।

—কিছু মনে লইয়েন না গো ছার, গত কাইলকা আমরা মেলাডি তিরান পাইছি। কয়দিন হেইগুলা দিয়াই চইল্যা যাইব। আফনেগোরে দেহলাম ফডু তুলে দেইহা লাইন ছাইড়া দিছেন, হের লাইগ্যা আমরা আফনেগোর লাইগ্যাই লাইনে খারাইছিলাম গো ছার। হারা জীবন তো আফনেগোর কাছ থাইক্যা ভিক্ষা কইরাই চলি গো ছার। আইজক্যা নায় আফনেগোর লাইগ্যা একটু কষ্ট করলাম ছার। 

কথা শেষ করেই ব্যাগ দুটো রেখে ভিক্ষুক দুজন ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করলো, যেন তুহিন ও খালেকের কাছ থেকে ভিক্ষা পেয়ে খুশি মনে চলে যাচ্ছে তারা। কিছু বলতে চেয়েও থেমে যাওয়া তুহিন ও খালেকের দৃষ্টি খুব শিগগিরই ঝাপসা হয়ে গেলো, না চোখে কোনো সমস্যা হয়নি, চোখের কোণে নেমে আসা পানি খানিকটা ঝাপসা করে দিয়েছে তাদের দৃষ্টিকে।   

দক্ষিণখান,ঢাকা 

menu
menu