গল্পের রোজনামচা

গল্পের রোজনামচা
ঝর্না বিশ্বাস

গল্প সেদিন বারান্দায় বসে ঝিমোচ্ছিল। মায়ের আওয়াজ এলো স্পষ্ট।
—কি রে আর কতক্ষণ, সন্ধ্যা হয়ে এলো।
গল্প হাসল মনে মনে। এখন কি সন্ধ্যা, কি রাত—সবই তো এক।  এই কোভিড উনিশে শুধু এ ঘর আর ও ঘর করতে হবে। ফাঁক পেলে একটু আধটু যা আসা এই বারান্দায়। টবের গাছ দুটোতে নতুন কুড়ি এসেছে। গোলাপি জবা, খুব শিগগিরই ফুটবে।
ঘরে শাঁখ বাজল একবার-দুবার-তিনবার। গল্প প্রণাম ঠুকল মনে। আর ওর ভেতরে একটু একটু করে বাড়তে থাকা এক মিনি গল্প তখনই নড়াচড়া করে উঠল।

এখন কোনো ডাক্তারও নেই। বিসর্গবাবুর চিন্তা বলতে একটাই ছেলেটা দূর দেশে আটকে, আবার গল্পও যদি এই সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে খুব মুশকিল। উনার কাজ বলতে একটাই, বন্ধু বান্ধবদের কল করে কোভিড সমাচার নেওয়া। আর একমাত্র জামাই ডাক্তার, তাকে কল করে গল্পের সমাচার দেওয়া... ওপাশ থেকে তিনিও, 
—হ্যাঁ, আয়রনের ওষুধটা কন্টিনিউ করতে হবে... বাকি দরকার পড়লে ভিডিও কল। কোনো মতেই বাইরে পা বাড়াবেন না।

২.
লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল ফ্ল্যাটের খোপে খোপে বাকিদের মতো ঢুকে গেল গল্প ও তাঁর পরিবার। গেটের মেইন দরজাখানা অল্প খোলা রেখে পাকানো গোঁফওয়ালা দারোয়ানও সেদিন থেকেই সটান বসে রইল পাহারায়। নোটিশ বোর্ডে বাইরের কেউ আসা নিষিদ্ধ, এমনকি নিজেকে বেরোতে হলেও রেজিস্টার করতে হবে।
গল্পের এই সময়টায় কতকগুলো অনলাইন বুকিং করার ছিল, কিন্তু এখন সব বন্ধ। তাই অগত্যা অ্যামাজনে জমা হতে থাকল পয়েন্টস... কোভিড ১৯ শেষ হলে একসঙ্গে কত কাজ!... 
গল্প সারাদিনের হিসেব করে। কী কী হলো আজ। সকালের খবরটার পর থেকেই ভীষণ মন খারাপ। এত তাড়াতাড়ি তো মানুষটার যাওয়ার কথা ছিল না! মনে পড়ে লাঞ্চ বক্স, পিকু-র রানা, করীব করীব সিঙ্গল-এর শায়র যোগি-জি... নেটফ্লিক্স-এ আঙুল চলে যায়... 
গল্পের নতুন মা ঠিক তখনই বাটিতে স্যুপ নিয়ে আসে। স্যুপি নুডলস্ খেতে খেতে ওর মনে হয়, রেসিপিটা একবার নিজেরও ট্রাই করতে হবে। 

৩.
অন্ধকার গাঢ় হবার সঙ্গে সঙ্গে যে যার মতো সময় বেছে নেয়। বিসর্গবাবু-র সামনে টিভিতে এক একটা রিপিট সিরিয়াল আর মায়ের মোবাইলে নিশা মাধুলিকার রেসিপি—অঙ্গিরা পনির  মাখানি থেকে শুরু করে পাত্রা... 
গল্প তখন নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে দেয়। বিসর্গ বাবুর ছেলে ফোন করবে রাত ন-টায় তাই হাতে এখনো পাক্কা দু ঘণ্টা... এই দু ঘণ্টা গল্পের একার। তাই ও চেয়ার টেনে বসে ল্যাপটপ চালু করে... স্ক্রিনে খিলখিলিয়ে ভেসে ওঠেন গণপতিজি... আর গুচ্ছ ফাইলে ডেস্কটপ ভর্তি হতে হতে তার মুখটাও আবছা হয়ে যায়। 
ওর মনে পড়ে আজ বুধবার, দু জায়গায় লেখা জমা দেওয়ার শেষ দিন। কিন্তু কি-বোর্ডের অক্ষরগুলো সেইদিন থেকে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। গল্প জানে এর কারণ, ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশিত বিজয়ী লেখকদের লিস্টে ওর নাম ছিল না। মাত্র ৫০০ শব্দের লেখালেখিতে এবারও পারলে না তুমি!  
গল্প প্রশ্ন করে নিজেকে, আর বরাবরের মতো হতাশ হয়ে ভাবে—এইটাই শেষ, এরপর লেখালেখি ছেড়ে দেব।  
তাই আবারও কি-বোর্ড টেনে নেয়। অক্ষরমালা সাজাতে থাকে পরতে পরতে...

৪.
সকালগুলো এখন বেশ অন্যরকম হয়... স্কুলে যাওয়ার বালাই নেই, ঘড়ি দেখা নেই। অ্যালার্মও দিব্যি ঘুমিয়ে থাকে মোবাইলের মধ্যে গুটিসুটি মেরে। তবে গল্পকে উঠতে হবে অনলাইন ক্লাস...
এই ক্লাসগুলো বেশ মজার হয়। তারে তারে জুড়ে যায় ছাত্র ও শিক্ষক... আর চোখের সামনে ঝুপ্পুস করে খুলে যায় জানালা। ওতে চক ডাস্টারের বালাই নেই... নেই কোনো ব্ল্যাকবোর্ড। সামনে ঝকমারি স্ক্রিন, লগইন করে পড়ানো শুরু... এভাবেই পর পর ক্লাস হয়। সিলেবাস সম্পূর্ণ করতে গল্পদি ও ছাত্রছাত্রীরা মিলে তুমুল তিন ঘণ্টা যুদ্ধ-র পর এক এক দিন ক্লাসের রিপোর্ট জমা করতে হয়। হেডদি চশমা নাকে গুঁজে তা দেখেন ও হ্যোয়াটস অ্যাপে নীল টিক দেখে গল্পেরও শান্তি হয় সেদিনের মতো।
সারাদিন টিভিও, ভালো লাগে না... আর কিই বা দেখবে তাতে। চতুর্দিকে খারাপ খবর। ওর কাছে জমানো চারটে বই। এখনো দুটো পড়া বাকি... এসব ভাবতে ভাবতেই খুলে যায় গুগল ক্রোম—তে প্রিয় বাংলা সাইটের নীল পাতায় আজ জমা পড়েছে প্রচুর কবিতা,গল্প ওতেই মন লাগায়। 

৫.
“আরোগ্য সেতু অ্যাপ”এ খবর আসে কাছাকাছি সাবধান... এমনিতেই গুটিয়ে আছে মানুষগুলো...
গল্পের ভয় হয়... নতুন প্রজন্মের জন্য এ এক বড়সড় চ্যালেঞ্জ...
গল্প ফোন করে সায়নী, অদিতি ও মনিদীপাকে... সবাই যে যার মতো ব্যস্ত... সায়নী আবার গান ঝালিয়ে নিচ্ছে... আলমারির মাথা থেকে নেমে গেছে কাঠের বড় হারমোনিয়াম আর তাতেই নাকি মেয়ের সাথে “সা রে গা মা পা”...  অদিতি টোটাল হাউজ ওয়াইফ হয়ে মস্ত কাটাচ্ছে দিন রাত... ইন্সটাতে আজকের পোস্ট চিজ অমলেট। 
মনিদীপা বাসন ধোয়, ও নিয়ম করে গাছে জল দেয়... গল্প-র ওসব কিছু নেই... রোজকার রান্না, খাওয়া, ঘুম তো লেগেই থাকবে... বাকি যে পৃথিবীটা খোলা পড়ে আছে ও তাতে মন বসায়... ভার্চুয়াল পাতা ঘুরতে ঘুরতে পড়া হয়ে যায় কত গল্প, আলোচনা যা সবাই বহু যত্নে লিখে রেখেছে... এসবের পরেও ওর ডেটা প্যাকের দু জিবি তাও শেষ হতে চায় না... 
এভাবে আর কতদিন! ভাবতে ভাবতে সকাল থেকে সন্ধ্যে হয়। এর পর আবারও সূর্য ওঠে... ক্যালেন্ডারে মাস বদলে যায়... আর স্যানিটাইজার ও মাস্কের যুগলবন্দীতে লকডাউনের দিনগুলোও বাড়তে থাকে—আরো আরো... 

মুম্বই, ভারত

menu
menu