চাঁদনী পসর

ছোট্ট একটি সাদা দ্বিতল বাড়ি। চারপাশে আম নারকেল আর কাঁঠাল গাছ। এরকম আবাসিক এলাকায় গাছগাছালি বেষ্টিত আর কোন বাড়ি নেই বললেই চলে। এই জমিভিটে আমার ঠাকুর্দার ছিল পরে টিনশেডের বাড়ি ভেঙে সেটিকে দোতলা করেন বাবা, আমরা সকলেই বৃক্ষ ভালোবাসি বলে সে সময় গাছগুলো নির্মম কুঠারের শিকার না হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজ পায়ে। শেকড় ছড়িয়েছে ইচ্ছেমতো। চার দিদির পরে আমি বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম, স্কুল কলেজ পেরিয়ে চান্স পেয়ে ইঞ্জিনিয়ারি-এ ভর্তি হলাম। চোখে স্বপ্নের ভিড়। পাশ করে উঁচুপদের চাকরিতে যোগ দিয়ে পাড়ি দিলাম মুম্বাই। বিদেশি কোম্পানি, বিজাতীয় পদস্থ কর্মকর্তা, চারপাশে বিশেষ খাবার, পানীয়ের ছড়াছড়ি। কাজ করি আর বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি। একের পর এক কোম্পানি বদল হয় অর্থ ও মানের ধাপ উঁচু থেকে উঁচুতর হয়, রঙেরও বদল ঘটে।

বাড়ির কথা মনে পড়ে না। হ্যাঁ মায়ের কথা, পাতলা কুয়াশার চাদরের মতো দোল দিয়ে যায়। বছরে একবার গিয়ে মাকে দেখে আসি। তখনো বাবা বেঁচে তিনি বলেন-হ্যাঁরে, অতদূরে না থেকে কাছাকাছি কোথাও চাকরি করা যায় না! আমার কানেই ঢোকে না। বাবারা এমন বলেই থাকেন...

আমি তখন পুনে, দিল্লি মুম্বাই করে বেড়াচ্ছি। এরই মাঝে মুম্বাইতে একজন নজরে এলো। থমকে গেলাম, দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দর,  ফটফট করে চোস্ত  ইংরেজি বলে। তার চাকরি চলে গিয়েছে। আমরা দুজনে জড়িয়ে গেলাম, ঠিকুজি এক নয়, ভাষা এক নয় তাতে কি! বাঁধা কোথায়! আধুনিক বিশ্বে সবাই যে যার মতো স্বাধীন, যদিও স্বাধীনতা শব্দটি একটি ধারণামাত্র। আরেক পার্বতী-দেবদাস কাহিনীরচিত হবার সুযোগ না দিয়ে আমরা নীড় বাঁধলাম। ভালোবাসার নীড়, যেখানে সবকিছু উচুগ্রামে বাঁধা। প্রথম বছর মহা জৌলুসে খাদ্য পানীয় ছিটিয়ে অ্যানিভার্সারি পালন করলাম। ততোদিনে বন্ধু, বাড়ি, দিদিরা সবাই অনেক দূরে সরে যেতে শুরু করেছে। তাঁরাই কি সরে যাচ্ছিল? দ্রæতগামী ট্রেনের পেছনের সবকিছু যেমন অদৃশ্য হতে থাকে তেমনি তারাও আমার জীবন থেকে অদৃশ্য হতে থাকে। পরের দু/তিনটে অ্যানিভার্সারি করলাম সাদামাটা ভাবে, পরেরটা তো করাই হলো না।  এরপরে আর কোনো অ্যানিভার্সারি আসেনি আমাদের যুগল জীবনে। আমার বাবা  হবার ইচ্ছে হলো। কিন্তু আমার একার ইচ্ছে হলে তো আর হবে না, অন্যপক্ষের মা হওয়ার ইচ্ছে নাহলে আমার ইচ্ছে তো ইটচাপা ঘাসের মতো মরে যাবেই। নানা ইচ্ছের মৃত্যু হতে হতে একসময় আমাদের ইচ্ছেরা নিজ নিজ রাস্তায় প্রকটভাবে চলা শুরু করল। চির ডানপিটে আমি কেমন যেন ঝিমিয়ে গেলাম।

এক ভরা পূর্ণিমার রাতে আমি ছাদে গেলাম, সিগারেট নিয়ে। এগন্ধ সে সহ্য করতে পারে না। এতদিন  ব্যালকনিতে বন্দোবস্ত  ছিল আজকাল ওর সেটাও সহ্য হয় না। থালার মতো বিশাল আর গোল চাঁদ। ফকফকা রাতে আম, কাঁঠাল ও নারকোল পাতার ছায়া মাটিতে দোল খায় সে ছায়া এত অপূর্ব আগে চোখে পরেনি।  ফকফকা চাঁদনী রাতে পাতার ছায়াময় খেলাখেলতে থাকে আমার মস্তিষ্কে... আর আমি! এক জীবন্ত শব বোম্বের এক নির্জন কংক্রিটের ছাদে হতাশার মহাসমুদ্রে ভাসতে থাকি। আমি কি তবে সমুদ্রের পাশে! যার নোনা স্বাদ! মাতৃগর্ভই তো মানুষের প্রথম মহাসমুদ্র... নিজেকে টালমাটাল শূন্য অনুভূতির ভারসাম্যহীন অদ্ভুত কোনো জীব মনে হয়।

ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে, চাঁদের অমিয় আলোর দিকে তাকিয়ে একেবারে হঠাৎ কওে একটা প্রলম্বিত জানা/ অজানা, চেনা/ অচেনা ডাক হু হু ঢুকে যায় আমার অস্তিত্বে। বাড়ির জন্য, মায়ের জন্য, আমার ফেলে আসা সেই আজন্ম গাছ গাছালির ঠাস বুনট জায়গাটির জন্য এমনকি আমার মরে যাওয়া পোষা বিড়ালটির জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। আমি সিগারেট ধরাতে ভুলে গেলাম, ভোর পর্যন্ত আমি সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মাত্র ৬মাস আগে বাবা চিতায় ছাই হয়ে গেছেন। আমি গিয়ে তাঁর সৎকার করে এসেছি, সময় কোথায় যে মার কাছে থাকব কিছুদিন! চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্য বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল, আর চেয়ে থাকা মা! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। যেভাবে আমি জীবনের সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

মা আমাকে দেখে হতবাক! তার চোখমুখ আনন্দ জলে মাখামাখি, বিশ্বাস হতে চায় না, তাকে আর একা থাকতে হবে না, আত্মজকে হাত বাড়ালেই স্পর্শ করতে পারবে। আমার ভেতর বাহির কি জলহীন! মরুভূমি! আহা কত বছর পর আমি মার দিকে এমন গভীরভাবে তাকালাম। মায়ের বয়স আরও বেড়ে গিয়েছে, চোখের নিচে ব্যাগ, গালের দুপাশ ঝুলে গেছে, চশমার কাচ আরও পুরু হয়েছে, হাঁটতে গেলে হাঁটু বিদ্রোহ করে, মার জন্য এক অব্যক্ত মমতায় আমার বুকের ভেতরটা পাথর পাথর লাগতে লাগল। বেশ কিছুদিন মায়ে পোয়ে একাত্মা হয়ে রইলাম সেই মাখো মাখো কাঁচামিঠে সময়েরমতো। মা যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেছে, তার আর কিছু চাইবার নেই। এক অপার্থিব প্রশান্তি চোখেমুখে নিয়ে প্রতি রাতে  ঘুমাতে যায় আর প্রতি সকালে ঘুম থেকে জাগে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি, মনে হয় কেন আমরা ছুটে বেড়াই! কিসের পেছনে! কি পাওয়ার আশায়! কি হয় এত এত অর্জন দিয়ে! যদি তা মায়ের থেকে দূরেই সরিয়ে রাখে! এর চেয়ে বড় পাওয়ার আর কি আছে! এই-ই আমার পরম পাওয়া।

আম গাছের পাশে একটি পেয়ারাগাছ সেটাতে থোকায় থোকায় পেয়ারা ধরে, পাকলে যার ভেতরটা নারীদের সিঁথির সিঁদুরের মতো লাল হয়ে যায়। সেটার পাশেই একটি কাগজি লেবুর ঝোপ... ঝোপে লেবু ধরে, অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ আর স্বাদ। ওপাশে কোনায় ৪টি নারকোল গাছের সারি, আজকাল আর কেউ ডাব পারে না সব ঝুনো হয়ে যায়। আগে দিদিরা কচি থাকতেই নামিয়ে নিত, এখন নামাবে কে! আর জল পান করবে কে! সময়ে কচি সবুজ ডাব ঝুনো নারকোল হয়, ইঁদুর কেটে দেয় পচে যায় বা মাঝে মাঝে দিদিরা কেউ এসে লোক ডাকিয়ে গাছ পরিষ্কার করে নেয়। গাছেরা যেন নীরবে আমার কাছে অভিযোগ করে আর তোমরা আমাদের কাছে আসো না, আমরা কি আর তোমাদেরকে ভালোলাগা দিতে পারি না! আমরা কি আর ফল ফুল ছায়া দিতে পারি না! আমাদের শাখারা আর কি তোমাদের দোলনার ভার বইতে পাওে না! বুকের ভেতর নড়েচড়ে যায় আমার বড্ড ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সেই ফড়িংবেলা! সেই পুজো, ভাসান, স্কুলের পিকনিক... কিন্তু পা শুধু সামনে বাড়ানো যায় পেছনে নয়। কী নির্মম এই সত্য! বুকে কেবল ক্যাকটাসের কাটা হানে, অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হয়।

এখানে আমি আবার চাকরি পেয়েছি। আগের মত ঝাঁ চকচকে নয়, তাতেকি! আমার আর তো তেমন অর্থ ব্যয় নেই। মায়ের চাহিদা বলতে কিছুই নেই, তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সবদিক থেকে মায়ের গুছানো সংসার, আমার উপস্থিতি মায়ের আনন্দ ও বেঁচে থাকার স্পৃহা বাড়ায় কিন্তু মা আমাকে তেমন কোন দায়িত্ব দেয় না। এতদিনের অর্জিত যাকিছু সব আমি তাকেই দিয়ে এসেছি, আমার কাছে যার প্রধান চাহিদা এসবই ছিল।

মাতাপুত্রের জীবন একেবারে ড্রামেরবিটে নাহোকরাগ ভৈরবী বা বেহাগের ছন্দ লয়ে তিরতির চলতে থাকে। রাতের খাবারের পর, মাকে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে আমি ছাদে বসে থাকি। ছাদে বসার জন্য চমৎকার একটি ছাউনি এবং কিছু সিমেন্টের চেয়ার তৈরী করিয়েছি, জায়গাটি ফুলের টব, লাইট দিয়ে সুসজ্জিত করলেও আমি বসে থাকি অন্ধকারে। সময়ে অন্ধকার ফিকে হয়ে চারপাশ স্বচ্ছ ওঠে। দিদিরা বা ভাগ্নে ভাগ্নিরা এটাকে ভীষণ পছন্দ করে। এটা নাকি তাদের বারবিকিউয়ের জন্য উপযুক্ত হয়েছে। ওরা এলে বেশ হৈ হৈ করে কেটে যায় কটা দিন।

ছুটির দিন, আকাশ মেঘলা, বসে আছি ছাদে, বাড়ির সামনের একটু ফাঁকা জায়গার পরেই মিতালি দিদিদের বাসা। মিতালি দিদির ছোটবোন মনালি এখন পাগল।

ভালোবেসে বিয়ে করেছিল যাকে একটি কন্যা সন্তান হবার পরে সে চলে গেছে আর কোনোদিন ফেরেনি। যাবার দিন মনালি তাকে বিদায় দিতে স্টেশনে গিয়েছিল, সেই থেকে আজো সে সময় অসময়ে স্টেশনে যায়, কান্নাকাটি করে, বিড়বিড় করে স্বামীর নাম ধরে ডাকে। প্রতিবেশীদের কারও হাত পা ধরে মনালির বৃদ্ধা মা ওকে স্টেশন থেকে আনানোর ব্যবস্থা করে। মনালির মেয়েটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, বাবার কীর্তি মায়ের এই অবস্থা প্রজাপতি মেয়েটাকে ¤্রয়িমাণ করে রাখে। আমি কয়েকদিন ওকে ডেকে কথা বলেছি, কিন্তু সে কেমন একটা ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। সাবলীল হয় না। আমার খুব বাবা হতে ইচ্ছে করলেও হতে পারিনি, আবার এত চমৎকার একটি মেয়েকে ফেলে এক বাবা কীভাবে এমন নিষ্ঠুর হতে পারে! আমার সত্যিই বোধগম্য হয় না।

মনালিকে যখন ছেলেরা ধরে আনে ওকে দেখে আমার অসম্ভব কষ্ট হয়। আমরা একসঙ্গেই বড় হয়েছি, পুজোয়, বৈশাখে, দোলে, দিদিদের বিয়েতে একত্রে আনন্দ হুল্লোড় করেছি। অথচ আজ আমরা নিজ নিজ দুঃখ শূন্যতায় বন্যার্ত হয়ে নাক বাঁচিয়ে থাকি। ইচ্ছে করলেও কেউ কাউকে ছুঁতে পারি না। সমস্যা একই কেবল সমস্যার হাতপাগুলো ভিন্ন ভিন্ন। মনালির প্রেমিক স্বামী কী চেয়েছিল? কেন সে এভাবে স্ত্রী কন্যাকে ফেলে চলে গেল! আর গেছেই যখন সেই পাষাণ মানুষটির জন্য মনালি একেবারে ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়ে গেল! মানুষের পাগল হতে কতটা আঘাতের দরকার হয় প্রকৌশলীরা জানে না। মনালি ওর আত্মজার কথা ভাবল না! সন্তানও মায়ের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারল না! ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা এতটাই শক্তিশালী!

আমি-ই বা কি চেয়েছিলাম! যা চেয়েছিলাম এবং পেয়েছিলাম তা কি কেবলই মোহ ছিল! সুস্মিতাও কি তাহলে আমাকে ভালোবাসেনি! কেবল আমার ঝাঁ চকচকে ক্যরিয়ারকে ভালোবেসেছিল! সে যা কিছুই হোক আমি তাকে ভালোবেসেছি তাহলে আমি কেন চলে এলাম! আমার কি আরও সময় নেয়া উচিত ছিল!      আমাদের নিচতলা ভাড়া দেয়া আর উপরের পুরোটা নিয়ে মাতাপুত্রের বাস। আমার পাশের ঘর আমি লাইব্রেরি করেছি। প্রচুর বই আছে সেখানে, মুভি দেখা বা গান শোনার উত্তম ব্যবস্থা রেখেছি, ছাদে অর্কিড লাগিয়েছি অসংখ্য, একেবারে বসন্ত বাতাসের মতো মোলায়েম জীবন ব্যবস্থা... তারপরও ভাবনারা আমায় কুরে কুরে খায়। আমি ভাবনাদের কুরে কুরে খাই... কিন্তু কোনো সত্য মীমাংসায় পৌঁছানো ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোরমতো কঠিন মনে হয়।

কেবল অসংখ্য সিগারেটের ধোঁয়ায় চারপাশ ভরে ওঠে।

menu
menu