নিষিদ্ধ উত্তেজনা

আব্দুল হক সাহেব একজন সাধারণ মানুষ। সারাদিন পরিশ্রম শেষে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। বাতিগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানালা দিয়ে শহরের বিষাক্ত বাতাস হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভেতর ঢুকছে। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে স্বপ্নের রাজধানী ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে বসে সিগারেট ধরাতে গিয়ে পনেরো বছর বয়সে গ্রামের ভুট্টা ক্ষেতের আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরানোর মধ্যে অদ্ভুত এক সাদৃশ্য লক্ষ্য করলেন, আব্দুল হক সাহেব।
সোফাসেটের মাঝখানে সুন্দর একটি কাচের টি-টেবিল বসানো। টেবিলের উপর একটা ‘ক্যাপস্টন’ সিগারেটের প্যাকেট, তার একটু পাশেই কালো রঙের একটা লাইটার। অনেকক্ষণ ধরে তিনি সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। অনবরত তার হাত কাঁপছে। হাতের এমন কাঁপাকাঁপি দেখে অতীতের কিছু কথা মনে পড়ে গেল, এভাবেই একসময় হাত কেঁপেছিল এখন থেকে মোটামুটি বছর বিশ আগে সেই ভুট্টা ক্ষেতে বসে জীবনে প্রথমবারেরমতো সিগারেট ধরানোর সময়। এরপর, দীর্ঘ এ জীবনে অসংখ্যবার কাজটা করা হলেও আজকেরমতো কখনোই হয়নি।
আব্দুল হক সাহেব পঞ্চমবারেরমতো লাইটার ধরিয়ে মুখের কাছে আনতেই দেখতে পেলেন আগুনের জ্বলন্ত শিখাটা বাতাসের তাড়নায় অনবরত কাঁপছে। বিশ বছর আগের সেইদিনটার সঙ্গে আরও একটা ক্ষেত্রে মিল আছে আজকের দিনটার। সেদিন যেমন জীবনের প্রথম কোনো নিষিদ্ধ কাজ করার উত্তেজনায় হাত কেঁপে উঠেছিল আজও একই ব্যাপার। প্রায় সবার জীবনেই, নিষিদ্ধ কাজগুলো বোধহয় স্নায়ুগুলোকে শিথিল করে দেয়। মাংসের স্তূপাকৃতি এ দেহে প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যেতেই একটা অবসাদ এসে ভর করে পুরো শরীর জুড়ে।
আব্দুল হক সাহেব আপাতত সিগারেট ধরানোর ব্যর্থচিন্তা বাদ দিয়ে ঘুরে খাটের ওপরে বসা প্রমিলার দিকে তাকালেন। একটা মখমলের লাল-চাদর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। ‘হক সাহেব’ তাঁর দিকে তাঁকাতেই প্রমিলা, ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে শীতল একটা হাসি উপহার দিল। পরক্ষণেই ভদ্রমহিলা খাট থেকে নেমে পাশের রুমে চলে গেলেন। ‘হক সাহেব’ আবার সিগারেট ধরানোর চেষ্টায়  মন দিলেন। আশ্চর্য! এবার কোনো ধরনের কাঁপাকাঁপি ছাড়াই সিগারেটটা ধরাতে তিনি সক্ষম হলেন। বিশ বছর আগে অবশ্য এ সময়টাতে ‘থামস আপ’ কিংবা ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। আব্দুল হক সাহেবের ঠোঁটে এক চিঁলতে হাসি দেখা গেল, এরপর কষে একটা টান দিলেন সিগারেটে; শুকটান। এতক্ষণ ধরে, এই সামান্য কাজটা করতে না পারার সম্পূর্ণ রাগটা ঝাড়লেন এই ক্যান্সার তৈরি কারকের ওপর। তাঁর ধারণা প্রমিলার
উপস্থিতিই এতক্ষণ তাঁর স্নায়ুর ওপর বাড়তি চাপ ফেলছিল। ফলাফল হাত কাঁপাকাঁপি, আগুনের শিখা চঞ্চলভাবে দাপাদাপি করা। তিনি শোয়া থেকে উঠে গিয়ে কাঠের অ্যাশ-ট্রেতে ছাই ফেললেন। ঘরের যেখানে সেখানে ছাই ফেলা তার স্ত্রী মোটেও পছন্দ করেন না। হক সাহেবও তাঁর স্ত্রীর অপছন্দনীয় কোন কাজই মোটেও করেন না। তিনি একজন আদর্শ স্বামীর যোগ্য প্রতিচ্ছবি। তিনি সব স্বামীদের থেকে একটু অন্যরকম বৈকি! সেটা ঘর থেকে বের হলেই রাস্তা-ঘাট, অফিস-বাজার সব জায়গায় কিঞ্চিৎকর আঁচ পাওয়া যায়।
আব্দুল হক সাহেব, সকালের সূর্যের আলো ফোঁটার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে চলে যান। তাঁর স্ত্রীর রান্না করতে কষ্ট হবে বলে দুপুরের খাবার সকালে নেন না। দুপুরবেলাতে নিজেই এসে খেয়ে যান। তিনি অফিস থেকে কখনই দেরি করে ফেরেন না। প্রতিদিন বাসায় ফেরার পথে আইসস্ক্রিম, স্ন্যাকস নয়তো ফাস্ট-ফুড জাতীয় কিছু সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। বাসায় ফিরে বউয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে হিন্দি সিরিয়ালও দেখতে বসে যান। যখন সিরিয়ালের আবেগঘন কোনো দৃশ্য দেখে অনামিকা নাক ছিঁটকাতে থাকে তখন আস্তে করে রুমালটা বাড়িয়ে দেন তাঁর গুণবতী স্ত্রীর দিকে! কখনই তিনি তাঁকে কোনোকিছুতে নিষেধ করেন না। আব্দুল হক সাহেব নিয়ম করে প্রতি মাসের শুরুতে বেতনটা এনে সযতেœ তাঁর স্ত্রী-র হাতে তুলে
দেন। এর বিপরীতে বিক্রিয়ার উৎপাদ বলতে যে ‘হক সাহেব’ কিছু পান না তা কিন্তু নয় !
আব্দুল হক সাহেব পুরো মাসের খরচ-পাতি স্ত্রীর হাতে দিয়ে একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে যান। মন ভালো রাখার জন্য, সপ্তাহের একদিন নিয়ম করে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বের হতে পারেন। প্রেমিক প্রেমিকার মতো করে একজন আরেকজনের হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে পারেন। সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঢুকে পড়েন কোনো অভিজাত রেস্টুরেন্টে। কখনো কফির মগ, কখনো বা বার্গার, স্যান্ডউইচ, লাচ্ছি কিংবা অন্য কোনো কিছু সামনে নিয়ে একে অপরের চোখের দিকে অনেক্ষণ তাঁকিয়ে থাকতে পারেন। অনামিকাও নিশ্চয়ই সে সময়টাতে নিজের মনের মতো স্বামী পেয়ে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে। একজন আদর্শ স্বামী হয়ে ‘হক সাহেব’ তাঁর স্ত্রীর নিকট থেকে কম কিছু পাননি । বরং কী পাননি হিসেব করতে গেলেই তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। এখনও অনামিকা পতিপরায়ণা স্ত্রীর মতো তাঁর স্বামীকে ছাড়া খায় না। প্রতিদিনই খাবারের টেবিলে ‘হক সাহেব’ একটা না একটা পছন্দের খাবারের উপস্থিতি টের পান। রান্নার ক্ষেত্রেও যেকোনো মেয়ের ঈর্ষার পাত্রী, অনামিকা। ‘হক সাহেবের’ পূর্ব অনুমতি থাকলেও কোনো কাজ একা একা করেন না তাঁর স্ত্রী। সামান্য একটা আংটি কেনার আগেও অনামিকা, আব্দুল হক সাহেবকে চার-পাঁচবার জানিয়ে নেবেন। আজ পর্যন্ত তাঁদের মাঝে কখনো ঝগড়া হয়েছে কিনা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেন না ‘হক সাহেব’। অনামিকা নিশ্চয় বলতে পারবে। মেয়েটার দিন তারিখ মনে রাখার ক্ষমতা অসাধারণ। যেকোনো ভবিষ্যত কাজের কথা ওকে একবার তাঁকে বলে রাখলে আর সেটা নিয়ে কখনো ‘হক সাহেবকে’ টেনশন করতে হয় না। মোবাইলের রিমাইন্ডারের মতো ঠিকই সময়মতো মনে করিয়ে দেবে। এমন একটা মেয়েকে বউ হিসেবে পাওয়ার পর আসলে আর কিছু চাইবার থাকতে পারে না। এ যে বড় ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু, মানুষের জন্মগতভাবেই সৃষ্টিকর্তা রক্তের মধ্যে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। একারণে মানুষ যেটা থেকে একবার বাধা পায়, দ্বিগুণ উদ্যামে সেদিকেই ধাবিত হওয়ার চেষ্টা করে। মানুষের এ কু-প্রবৃত্তির কারণেই মানুষ আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে অবস্থান করছে।
আব্দুল হক সাহেবের মতে, নিষিদ্ধ কাজের সময় দেহে বাড়তি যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সেটাই মূল আকর্ষণ। মানুষ তার রক্তে বার বার অ্যাড্রোনালিনের ছড়িয়ে পড়াটা 
উপভোগ করতে চায়। নয়তো, অনামিকার মতো গুণবতী স্ত্রী থাকতে প্রমিলা দেবী কেন তাঁর শয্যার ভাগীদার হতে যাবে?
দরজার খোলার শব্দে আব্দুল হক সাহেব পেছন মুড়ে তাকিয়ে দেখেন, প্রমিলা বেরিয়ে এসেছে পাশের রুম থেকে। প্রথমেই, হক সাহেবের চোখ পড়ে গেল প্রমিলার কপালের মাঝখানটায়। টকটকে লাল রঙের টিপটা ঠিকমতো বসাতে পারেনি। একদিকে সরে পড়েছে। আব্দুল হক সাহেবের মনে পড়ে গেল, ও ঘরটাতে তো কোনো আয়না নেই। তিনি প্রমিলাকে টিপটার কথা বলার প্রয়োজন  বোধ করেন। প্রমিলার পরনে টকটকে লাল রঙয়ের একটা শাড়ি। একটু আগে যেটা পড়া ছিল সেটাই। কিন্তু তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেন, মাত্র বিশ মিনিট আগেও এই শাড়িতে জড়ানো অবয়বটা তার কাছে যতটা আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, সে আকর্ষণের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। কেন হয় এমনটা? কাক্সিক্ষত বস্তুটাকে পেয়ে যাবার প্রতিক্রিয়া? 
নাকি নিষিদ্ধ বস্তুগুলো এভাবেই দ্রæত তার আকর্ষণ হারায়? ‘হক সাহেব’ নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর বের করে, এই বলে নিজের মনকে শান্ত করেন যে, খাট-কাঁপানো ভালোবাসা এজন্যই পঁচিশ কিংবা ত্রিশ মিনিট স্থায়ী হয়। প্রতিদিনের সবজি তরকারি একদিন, দু’দিন কিন্তু তিনদিনের দিন সেটার প্রতি সত্যিই বিতৃষ্ণা জন্মে যায়।
‘আমি আজ চললাম’  হক সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শাড়ি ঠিক করতে করতে প্রমিলা বললো। প্রমিলার মাঝে বর্তমানে একটা সন্ত্রস্ত ভাব। একটু আগের প্রমিলার কণ্ঠ এখন বেমালুম গায়েব!
‘সবসময়টা এমনই হয়!’ -হক সাহেব মনে মনে বললেন। কিন্তু, মুখে মুখে বললেন, হ্যাঁ, এখন যেতে পারো, অনামিকারও বোধহয় আসার সময় হয়ে গেছে।
প্রমিলার লাল লিপিস্টিকের ঠোঁটে একটা মৃদু হাঁসি ফুটে উঠলো। প্রমিলা দেবী আর দ্বিতীয় কোনো শব্দ না করে সোজা দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
‘বাইরে বের হওয়ার আগে দরজার ফুঁটো দিয়ে ভালোভাবে দেখে নিও’-গলা চড়িয়ে বলে দিলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, মহিলাকে দরজা পর্যন্ত বোধহয় এগিয়ে দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু, ‘হক সাহেবের’ এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না। প্রমিলার কোনো উত্তর এলো না। পরক্ষণেই দরজা খোলার শব্দ। হয়তোবা মাত্র দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। একটু পরই পাশের ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ পেলেন হক সাহেব।
‘প্রমিলা তাহলে ভালোভাবেই বাসায় ফিরতে সক্ষম হয়েছে’-বিড়বিড়িয়ে বললেন আব্দুল হক সাহেব। প্রমিলা দেবী তাঁর পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। একই ফ্লোর। স্বামী বিদেশে থাকেন। প্রমিলা দেবীর সঙ্গে শুধু ওর অন্ধ বৃদ্ধা শাশুড়ি থাকেনি। রীতিমতো দজ্জাল টাইপ মহিলা। তাঁর কারণেই প্রমিলা অবশ্য এখনো বাজারের সস্তা মাল হিসেবে পুরোপুরি উচ্ছনে যায়নি।       রাচেল ক্রিস্টিয়ানা। উপরের ফ্লোরে থাকে। স্বামী সবসময় ব্যবসার কাজে ব্যস্ত  থাকায়, বুনো জন্তুর স্বভাব পেয়েছে অল্পবয়স্ক মেয়েটার। যেখানে সেখানে নিজের আভিজাত্য প্রকাশ করে বেড়ায়। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও চেহারায় চটুলতার ছাপ স্পষ্ট। খুব ভালো ছলাকলা করতে জানে মেয়েটা। আব্দুল হক সাহেব ওকে প্রথম  লিফটে দেখে। দেখাটা তখন শুধু দেখাই ছিল। সেটাকে অন্য কিছুতে রূপান্তরিত করার কথা তখনো ভাবেননি, এখন অবশ্য ভাবতেন না। অনামিকার মতো বউ ফেলে সেটা ভাবাটা অন্যায়ও বটে। আজকের ঘটনাটা ¯্রফে সাময়িক একটা উত্তেজনার আকাক্সক্ষা থেকে ঘটে গিয়েছে। সেটার জন্য, আব্দুল হক সাহেবের কাছে অবশ্য নিজেকে এখন খুব লজ্জিত মনে হচ্ছে।
‘আমি কি আদৌ অনামিকার ওপর থেকে ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি?-হঠাৎ ‘হক সাহেবের’ মাথায় অদ্ভুত প্রশ্নটা এলো। তাঁর মাঝে আরও কয়েকটা প্রশ্নের উদয় হলো,  অনামিকার সঙ্গে সংসার করতে করতে কি আমি এখন ক্লান্ত?
উত্তরগুলো মোটেও সোজা নয়। বেশ কঠিন। শুধুমাত্র সাময়িক উত্তেজনার লোভে কখনোই স্ত্রীর বিশ্বাসের জায়গাটাকে ময়লার আস্তাকুড়ে পরিণত করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? তবে এটাও ঠিক অনামিকাকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারি না। আর প্রমিলা, ক্রিস্টিয়ানা এদেরকে ভালবাসার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এইসব, মেয়েদেরকে শুধু ব্যবহারই করা যায়, ভালোবাসা যায় না। আচ্ছা, প্রমিলা দেবীকে নিয়ে আমি যেমনটা ভাবছি অনামিকাকে নিয়েও এমনটা ভাবেনা তো কেউ?
ওহ আল্লাহ! ছিঃ ছিঃ-এসব আমি কি ভাবছি? সম্ভবত একঘেয়ে নীরস জীবন যাপন ধীরে ধীরে  আমার মানসিক বিকৃতি ঘটাচ্ছে। আব্দুল হক সাহেব ঘরের সবগুলো লাইট জ্বেলে দিলেন। আলোর ঝলমলানিতে তাঁর চিন্তাটা মাথা থেকে কিছুটা হলেও উবে গেল। দুঃচিন্তাটা তবুও শেষ হলো না। জানালার সামনে দাঁড়াতে ‘হক সাহেব’ নিজের ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে থাকলেন। কয়দিন পরই দেখা যাবে, গভীর রাতে তিনি এক হাতে চকচকে ছুরি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। রাস্তাঘাটে কামুক-যৌবনা মেয়ে দেখলেই ধর্ষণ করার পর বুক চিঁড়ে হৃদপিÐটা  বের করে নিচ্ছেন। লন্ডনের সেই কুখ্যাত রহস্যময় সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপারের মতো। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রতিদিন সর্বশেষ শিরোনাম আসবে, ‘বাংলাদেশে নতুন জ্যাক দ্য রিপারের আবির্ভাব, নৃশংসতার নতুন এক অধ্যায় উত্থাপন হবে!’
আব্দুল হক সাহেবের মনে হলো বোধহয় তিনি সত্যি সত্যিই ম্যানিয়াকে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁর ডাক্তারের পরামশ প্রয়োজন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, আজই শেষ। নিষিদ্ধ উত্তেজনার খোঁজ তিনি আর কখনোই করবেন না। অন্যায় আর নৃংসতার এ অধ্যায় তিনি শুরু করেছেন তিনিই শেষ করবেন। প্রমিলা চলে যাবার প্রায় ঘণ্টাখানেক পর অনামিকা বাসায় চলে এলো। ও বাসায় ঢুকা মানেই বাসার মধ্যে এক ঝাঁক পাখি ঢুকে পড়া। প্রচুর কথা বলতে পারে মেয়েটা। ভালোই লাগে শুনতে। মেয়েটা প্রায়ই তাঁর মার বাসায় বেড়াতে যায়, এবারও বেরিয়ে আসলো। বাসায় পা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে চা তৈরির জল গরম করতে করতে বললো, ‘মা বারবার অনেক করে খেয়ে আসতে বলেছিল আমাকে। আমি বললাম তাই আবার হয় নাকি? তোমাদের জামাই বাসায় একা একা কী খাবে?’
মা অবশ্য বলেছিল, ‘তুমি যাওনি কেনো?’
আমি বলেছি, ‘তোমাদের জামাইয়ের শরীর খারাপ তাই আসতে পারেনি। ভালো বলেছি না, বলো?’
‘হুমমমম, তুমি অনেক ভাল বলেছ। আমার বউ বলে কথা!’
মনে মনে ঘণ্টা খানেক আগের কথা চিন্তা করে হক সাহেব বললেন, ‘কতটা যে ভালো করেছ সেটা তুমি নিজেও জানো না!’
‘এখন এই চাটা খেয়ে বলো রাতের জন্য কী করবো ? আমি কিন্তু এই রাত করে বেশি ঝামেলা করতে পারব না। চিকেন বিরিয়ানি করি?’
অনামিকার কথা শুনে হক সাহেব হেসে ফেললেন। আমার পাগলিটা বলে কী?
পেছনদিক থেকে অনামিকাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বিরিয়ানিটা তাহলে কী?’
‘আমি কিন্তু বোঝাতে চেয়েছি বিরিয়ানির সাথে আর কিছু করতে পারব না। বুঝতে পেরেছেন জনাব?’
‘জ্বী মহারানী, বুঝতে পেরেছি। যদি বিরিয়ানিটা ভাল হয় তাহলে বড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ দেব তোমাকে।’
‘আপনি তাহলে সারপ্রাইজ দেবার জন্য রেডি থাকুন। বিরিয়ানিটা অবশ্যই ফার্স্ট-ক্লাস হবে।’
‘তাড়াতাড়ি ইনশাল্লাহ্ বলো।’
‘ওকে মশাই, ওকে। ইনশালল্লাহ্। আমি তাহলে রান্না বসিয়ে দিয়ে আসি, কেমন।’
এরপর তোমাকে শারমিনের বিয়ের ভিডিও দেখাব।
‘শারমিনটা যেন কে?’
‘আরে ওই যে, আমার কলেজের বান্ধবী ছিল। সেদিন ওদের বিয়েতে গেলাম না? তুমি তো জরুরি মিটিং-এর কারণে আসতে পারলে না। বাসায় ছিলে’
‘ও আচ্ছা, মনে পড়েছে। আচ্ছা তুমি রান্না চড়িয়ে দিয়ে এস এরপর তোমার বিয়ের ভিডিও দেখব।’
অনামিকা কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালো। তারপর, ঘুরে এসে চেচিঁয়ে বলল, ‘ওরে আমার ফাজিল! ন্যাকা যেন, আমার বিয়ের ভিডিও না? দাঁড়াও আজ বিরিয়ানিতে এমন ঝাল দিবো!’
‘তাহলে কিন্তু তুমি তোমার সারপ্রাইজ মিস করবে।’
‘আমি জানি, সারপ্রাইজ তুমি আমাকে এমনিতেই দেবে।’
‘তা অবশ্য খারাপ বলোনি’-আব্দুল হক সাহেব মৃদু হেসে অনামিকাকে বললেন। আব্দুল হক সাহেব অনামিকার গালে একটা ছোট্ট হামি খেলেন। অনামিকা মিষ্টি একটা হাঁসি দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সেদিকে তাঁকিয়ে ‘হক সাহেব’ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাক তাহলে, প্রমিলা দেবীর ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি অনামিকা! কিছুক্ষণ পর অনামিকা যখন রান্নাঘর থেকে বের হয়ে, পোশাক চেঞ্জ করে বেডরুমে ঢুকলো তখন হক সাহেব আনমনে টিভি দেখছিলেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে একটা ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছে। হক সাহেবের অতি প্রিয় অনুষ্ঠান। তবে অনুষ্ঠানের চাইতে অনুষ্ঠানের দৃশ্যপটটা তাঁর কাছে বেশি প্রিয়। বন, জঙ্গল, নদী সব মিলিয়ে রূপকথার এক স্বপ্নজগৎ। ডকুমেন্টারি দেখতে দেখতে হক সাহেবের মনে হলো, প্রতিটা সংসারই যেন টিভিতে দেখানো জঙ্গলের মতো এক একটা বুনো জঙ্গল। আর প্রতিনিয়ত সেই জঙ্গলের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে একেকজন স্বামী-স্ত্রী। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।
অনামিকা সুগন্ধিযুক্ত নতুন জামা-কাপড় পড়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলো। কালো নাইটি। খুব আকর্ষণীয় লাগছিলো অনামিকাকে। ফর্সা চেহারা বলে খুব সুন্দর মানিয়েছে ওকে। এরপর, ওয়্যারড্রবের ওপর থেকে ওর মুভি ক্যামেরাটা নামাল। গতবছর বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ওটা ওর এক জার্মান প্রবাসী বন্ধু উপহার হিসেবে দিয়েছিল। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি কি আমার ক্যামেরাটা কোথাও নিয়েছিলে?’
‘না তো। কেন কি হয়েছে?’-হক সাহেব আনমনে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না তেমন কিছু হয়নি। আমি সন্ধ্যার সময় বাসা থেকে বের হবার আগে ফুল চার্জ দেখে গিয়েছিলাম, অথচ এখন দেখি একটুও চার্জ নেই।’
‘দেখো, হয়তোবা ব্যাটারিতে প্রবলেম।’
অনামিকা ক্যামেরাটা টি-টেবিলের একপাশে রেখে উঠে গিয়ে, বেডরুম থেকে স্পেয়ার ব্যাটারিগুলো নিয়ে এলো। ব্যাটারি লাগিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে খুট খাট করে বলল, ‘তাই তো আমি বলি এমনি এমনি চার্জ শেষ হয় কীভাবে? দেখ না, আমি কী বোকামিটাই না করেছি। বাসা থেকে বের হবার আগে ভুলে ভিডিও চালু করে গিয়েছিলাম। ঘণ্টা দুয়েক ভিডিও হবার পর চার্জ ফুরিয়ে ক্যামেরাটা একা একাই বন্ধ হয়ে গেছে। হায়রে...’
‘ডিলিট করে দাও, কি আর করবে। অন্যমনস্ক হয়ে কথাটা বললেন মি. হক সাহেব। ঠিক তখনই তার মাথায় যেন বাজ পড়ল। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল ক্যামেরাটা ওয়ারড্রোবের ওপর রাখা ছিল। ওখান থেকে পুরো রুমের ভিউ পাওয়া যায়। তার মানে একটু আগের ঘটনাটা...। আব্দুল হক সাহেব ঝট করে পেছন ফিরলেন। অনামিকার দিকে এগোতে গিয়ে দেখেন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ওর মুখভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। চেহারায় ফুটে উঠেছে তীব্র অবিশ্বাস, বিস্ময় আর একরাশ বেদনা। বিষাদের ছায়ায় হলদে ফর্সা মুখের অবয়ব মুহূর্তেই নীল হয়ে গেছে। ঘণ্টাখানেক পর... রাত তখন বেশ গভীর হয়েছে। ঝিঁঝিপোকারা অবিরাম ডেকে চলেছে। ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি বাড়ি থেকে একটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল রাস্তায়। একটু আগ পর্যন্ত বাড়িটার খ-৬৪ই ফ্ল্যাট থেকে প্রচÐ ঝগড়া ঝাঁটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে সব নীরব, নিস্তব্ধ এবং নিথর! ছায়ামূর্তিটা বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে ছন্নছাড়া ভাব নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। রাতের অন্ধকার কুয়াশায় মিলিয়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে তার হাতে ধরা ছুড়িটা থেকে টুপ করে এক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ল। একসপ্তাহ পর দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রধান শিরোনাম, ‘বাংলার নতুন জ্যাক দ্য রিপারের আবির্ভাব, নৃসংতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা...
 

menu
menu