সুড়ঙ্গ

‘তা হলে তুমি বলতে চাইছ, তোমার পেটে যে বাচ্চা সেটা তোমার স্বামী রফিকুলের, অন্য কারও নয়?’
কথাটা বলে চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালেব সমবেতদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি ঘোরায়, মাথাটা নিচু করে দুই ভ্রƒর মাঝখানটা বাম হাতের বুড়ো আঙুলে চেপে ধরে অর্ধনিমিলিত চোখে বসে থাকে কিছু সময়; এ সময় তাকে কিছুটা চিন্তামগ্ন মনে হয়।
নিরুত্তর নিলুফারের দৃষ্টি মাটির দিকে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে আসা রোদে জ¦লজ¦ল করে; সোনার নাকফুলটাও এ সময় জ¦লতে থাকে। আঁচলে ঘামেভেজা মুখ মুছে শান্ত গলায় নিলুফার বেগম মাটির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে, ‘আমি বলেছি আমার পেটে যে বাচ্চা তার বাপ আমার স্বামী।’

 বাজারের কিছুটা আগে ডান দিকে সড়কের ঢালু বেয়ে নেমে যাওয়া কাঁচা রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হলে প্রথমে রাস্তার দুপাশে জড়াজড়ি করে থাকা কয়েকটা ঘর চোখে পড়ে, আরও অগ্রসর হলে দেখা যায় রাস্তার এক দিকে সারিবদ্ধ সরুসরু তালগাছ, অপরদিকে বাতাসে নুয়েপড়া বাঁশঝাড়ের হালকা ছায়ার নিচে শান্ত কবরস্থান; এর পর রাস্তাটা হঠাৎ আরও সরু হয়ে ডান দিকে চলে গেছে; রাস্তাটা এতোটা সরু যে দুজনের পাশাপাশি হাঁটা দুষ্কর, উপরন্তু দুপাশ থেকে আনারস গাছের ধারালো পাতা এসে রাস্তার অনেকটাই দখল করে নিয়েছে। তাই রাতবিরাতে, এমনকি দিনের বেলাও এই পথ দিয়ে যেতে সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হয়। এই বিপৎসংকুল পথে দশ কি পনেরো মিনিট হেঁটে গেলে রফিকুলের বাড়ি; অবশ্য এটা সংক্ষিপ্ত পথ, বাজার থেকে চলে যাওয়া মোরামের রাস্তা দিয়েও যাওয়া যায় কিছুটা ঘোরা পথে।

বাড়ি বলতে একটা মাঝারি আকারের মাটির ঘর, সামনে এক চিলতে উঠান, উঠান শেষে রান্নার ঘর, পাশে গোয়াল ঘর, আম, জাম, কাঁঠাল, বাতাবিলেবু, মেহগনি, আকাশি গাছ ঘেরা বাড়িটা দূর থেকে দেখাই যায় না।  

রফিকুলের বাড়ির সামান্য আগে রাস্তার পাশে একটা মাঝারি ধরনের আমগাছের নিবিড় ছায়ার নিচে মুখোমুখি দুটো বাঁশের মাচা; তপ্ত গরমে এই মাছায় শুয়ে-বসে জিরিয়ে নেয়নি, কারণে অকারণে তর্ক-বিতর্ক করেনি, চলার পথে হঠাৎ নেমে আসা বৃষ্টিতে দৌড়ে এসে গাছের নিছে আশ্রয় নেয়নি-এমন  লোক কমই পাওয়া যাবে। এছাড়া ছোটখাটো শলাপরামর্শ, সালিস দরবারের জন্য আমতলা প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। রফিকুলের আব্বা বিল্লাল হোসেনের হাতে লাগানো চিরহরিৎ এই আমগাছটার জন্য, এর সুশীতল ছায়ায় জন্য রফিকুলের গর্ব হয়, বর্ষা শেষে হালকা সবুজ কচিকচি পত্রপল্লবে গাছটা যখন নিজেকে সুশোভিত করে তোলে রফিকুল তখন অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। বছর বছর ক্ষয়িষ্ণু বাঁশের পাটাতন পাল্টায় যতœ নিয়ে।
অনেক কিছুর সাক্ষী শ^শুরের হাতে লাগানো সেই গাছের নিচে নিলুফারের বিচার বসেছে। 

নিলুফার অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল পাশের লিকলিকে বেলগাছের সাথে ঠেস দিয়ে, পায়ের কাছে পাঁচ বছরের ছেলে শাহীন। সমবেত লোকজন, তাদের কথাবার্তা কোনো কিছুতে ভ্রƒক্ষেপ নেই ছেলেটার; কেবল কিছুক্ষণ পরপর দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরছে।
অভ্যাসবশত খোঁচাখোঁচা দাড়িতে বারকয়েক হাত বুলিয়ে শামসুল হক শক্ত মাটিতে হাতের লাঠি জোরে জোরে ঠুকে এবং সশব্দে কেশে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে বলে, ‘চেয়ারম্যান সাব, যার স্বামী দুই বছরের ওপরে পলাতক তার পেটে কার বাচ্চা...।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই সুরুজ মিয়াসহ কয়েকজন হেসে উঠলে চেয়ারম্যান কপট বিরক্তি নিয়ে সবার দিকে এক পলক তাকাতেই হঠাৎ নীরবতা নেমে আসে। হাসির জন্য অনেকে দায়ী হলেও চেয়ারম্যান রাগটা ঢেলে দেয় সুরুজ মিয়ার ওপর, কিছুটা বেশিই দেয় সভাটা নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবে।  
‘সুুরুজ মিয়া, মুরুব্বি মুরুব্বির মতো থাকবা, পোলাপানের মতো অকারণে হাসা ঠিক না।’ 
ভরা সভায় এমন আকস্মিক অপমানে কী করণীয় বুঝে উঠতে না পেরে দীর্ঘ শীর্ণ দাড়িতে আঙুলের বিলি কাটতে কাটতে অকারণেই ফোকলা দাঁতে হাসে সুরুজ মিয়া। সুরুজ মিয়া উপলক্ষ হলেও আক্রমণের তোপটা সমবেত সবারই প্রতি ।

চেয়ারম্যান, মেম্বার, মুন্সি, মৌলভী কারো প্রতি  ভ্রƒক্ষেপ নেই নিলুফার বেগমের। সমবেতদের সকলে জানে; নিলুফার বেগম আরও ভালো করে জানে তার বিপরীতে বসা কালো প্যান্ট সাদা শার্টের লোকটাই কলকাঠি নাড়াচ্ছে। নিলুফার আড় চোখে প্রচÐ ঘৃণা নিয়ে তার দিকে তাকায়, তবে যতোবার লোকটার দিকে তাকায় ততোবারই চোখাচোখি হয়, এতে সে নিশ্চিত হয় যে, লোকটা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। নিলুফার যতোটা সম্ভব শাড়ির আঁচল টেনেটুনে বুক-পেট আরও ঢেকে নড়েচড়ে বসে।

নিলুফারের পরিশ্রমী শরীর, তাই শরীরের কোথাও বাড়তি মেদ নেই। দুই বছর ধরে ছেলে, গরু-ছাগল, আনারস বাগানসহ পুরো সংসারটা একাই সামলে আসছে। পেটে বাচ্চা আসার পর স্বাভাবিক যে লাবণ্য মেয়েদের চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে নিলুফারের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে লম্বা গড়নের নিলুফারের লিকলিকে শরীরের কারণে সাত মাসের পেট কিছুটা বেশি স্ফীত মনে হয়। লোকটা তার খাড়া নাক দেখে, প্রশস্ত  কপাল দেখে, বড় বড় শান্ত দুটো চোখ দেখে, চিবুক দেখে, একসময় তার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় সূর্যের কিরণ পড়ে চিকচিক করা নাকফুলের দিকে; সোনার নাকফুল-কত দাম হতে পারে নাকফুলটার?  এ সময় হালিম মেম্বার বলে, ‘তোমার কথা মেনে নিলে এটাই দাঁড়ায় যে তোমার স্বামী রাতে রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার কাছে আসে। এছাড়া আর হিসেব মিলবে কীভাবে?’

আঁচলটা একটু টেনে নিয়ে স্ফীত পেট ঢেকে নিয়ে চোরা চোখে লোকটাকে একবার দেখে নিয়ে নিলুফার বেগম বলে, ‘আপনারা কিভাবে হিসাব মিলাবেন সেটা আপনাদের বিবেচনা, আমি এইটুকু বলতে চাই আমার পেটে আমার স্বামীরই বাচ্চা...।’
নিলুফারের কথা শেষ না হতেই বারেক মুন্সি অনেকটা লাফিয়ে ওঠে, এইসব নাফরমানি কথা শোনার জন্য এখানে এসেছি? কী বলেন আপনারা? তার চাইতেও আরও উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় কোমরের পুরনো ব্যথাটা চাগার দিয়ে ওঠায় সহসা চুপসে যায়। মুন্সির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার ইসহাক সরকার অত্যন্ত শান্ত গলায় ধীরে ধীরে বলে, ‘মৌলভী সাহেব কেন এতো উত্তেজিত হচ্ছেন বুঝতে পারছি না। থানা-পুলিশের ভয়ে রফিকুল পালিয়ে রয়েছে। স্ত্রী-সন্তানকে দেখতে সে লুকিয়ে-চুকিয়ে আসবে এর মধ্যে অন্যায় কী আছে? এই নিয়ে এখানে যে সালিসটা ডাকা হলো, একটা মেয়েমানুষের চরিত্রে কালি মাখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে-এসব কার স্বার্থে?

‘আপনারা বলেন গত এক বছরে আপনারা কেউ রফিকুলকে দেখেছেন?’-প্রশ্নটা সমবেতদের প্রতি ছুড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় কিছুসময় কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকে মুন্সি। সবাই না সূচক মাথা নাড়ে। আপনারা কেউ দেখেননি, পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না-মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখিয়ে-ওনারাও তার টিকিটি খুঁজে পাচ্ছে নাম, আর আপনি বলছেন লুকিয়ে বউয়ের কাছে আসে!  
‘হা হা হা, হাসালেন মুন্সি? যে-লোক লুকিয়ে আসতে চাইবে সে কি পুলিশের সামনে দিয়ে আসবে? আপনাদের কাÐজ্ঞান দেখে আর কী বলব?’
আপনি ঠিকই বলেছেন মাস্টার সাব, গভীর রাতে যদি রফিকুল ঘরে আসে আর কাকডাকা ভোরে চলে যায় সেটা কারো জানার কথা নয়। আচ্ছা, বাচ্চাটাকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারি।

নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ের উপস্থিতিতে ভিড় বাড়তে থাকে, নিলুফারের কঠিন শাস্তি হতে যাচ্ছে এই রকম একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করার মতো ঝাঁঝালো অভিজ্ঞতা থেকে কে বঞ্চিত হতে চায়?
চারদিকে উপেক্ষার একটা অদ্ভুত প্রাচীর তৈরি করে নিলুফার; উৎসুক নারী-পুরুষের জটলা, মাস্টার মুন্সির বাদানুবাদ, চেয়ারম্যানের আস্ফালন, কালো প্যান্ট-সাদা সার্টের ক্রুর দৃষ্টি কোনোটাই তাকে স্পর্শ করে না; সে নিবিড় মনযোগ দিয়ে কম্পমান পাতার ছায়া দেখে, পিঁপড়ার সারি দেখে, কচি হলুদপাতা দেখে-এই যেন সবই নতুন, সবই প্রথম দেখা। এই সময় হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় সারিবদ্ধ একদল পিঁপড়ার দিকে; একদল মুখে করে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে, আরেক দল তা নিয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখে। এই দৃশ্য আগে দেখেনি তা নয়, কিন্তু এই সত্যটা চোখেই পড়েনি কখনো। মানুষের জীবনে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে যা সাদা চোখে যা দেখা যায় তার চাইতেও বেশি কিছু দেখতে সহায়তা করে। 
পাটোয়ারী ছেলেটাকে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে চেয়ারম্যানের সামনে দাঁড় করায়। 

‘তোমার নাম কী?’
‘শাহীন’
তুমি কী রাতে কখনো তোমার আব্বাকে দেখেছ? তোমার আব্বা গভীর রাতে বাসায় আসে, জানো? 
শাহীন মুখে কোনো কথা বলে না, কেবল মাথা নেড়ে না-সূচক উত্তর দেয়। 
ঠিক করে বলো দেখেছ কি না। 
পাটোয়ারীর চাপাচাপিতে শাহীন এমনভাবে মাথা নাড়ে, এতে হ্যাঁ-না কিছুই বোঝা যায় না।
তোমার হাতের এই খেলনাটা কে কিনে দিয়েছে?

অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকলেও এবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না মাস্টার।
‘আহা পাটোয়ারী সাহেব, আপনি কী করছেন? একটা মাসুম বাচ্চাকে জেরা করছেন পুলিশের মতো?’ 
পাটোয়ারী ছেলেটাকে ছেড়ে চেয়ারম্যানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ঝাঝালো গলায় বলে, ‘আপনি কিছু একটা করেন। আজ রফিকুলের বউ করছে, কাল আরেকজনের বউ করবে। কেবল রফিকুলই নয়, পাঁচ পাঁচটা লোক এই গ্রামের পলাতক। এর দেখাদেখি তাদের বউরাও অনাচারে নেমে পড়লে তখন কী করার থাকবে? একেবারেই অনাচারে ছেয়ে যাবে গ্রামটা। আমাদেরও ঘরে বউ-ঝি আছে, আমাদেরও এই গ্রামে থাকতে হবে, না কি?’
নির্বাচন অত্যাসন্ন, নিজের দলের মধ্যে বিরোধও চরমে, এই পরিস্থিতিতে হুজুরের উস্কানিতে এই ধরনের একটা সেনসেটিভ বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে চাইছে না চেয়ারম্যান; তাকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। মাস্টারকে সব বিষয়ে পছন্দ না হলেও তার কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করাকে কৌশল হিসেবে অধিক নিরাপদ মনে করে চেয়ারম্যান। অত্যন্ত শান্ত গলায় চেয়ারম্যান বলে, ‘মাস্টারের বক্তব্যটা শুনি, দেখি মাস্টার কী বলেন?’
‘আমি কী বলবো? বিচার যদি করতেই হয়, রফিকুল আজ দুই বছর কী কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেটা আগে বের করেন। কেবল রফিকুল নয়; সোনা মিয়া, সাইদুল, নিতাই, মিনহাজ পালিয়ে বেড়াচ্ছে না? গোটা এলাকার মানুষগুলোকে কারা ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলল? দুধেল গাইটা নিয়ে যাওয়ার পরের দিনই মোহন সাধু যে হঠাৎ মরে গেল, তার বিচার কে করবে? আগেও অভাব-অনটন ছিল, এমন অশান্তি কখনোই ছিল না। যারা এই অশান্তি নামিয়ে এনেছে পারলে তাদের বিচারটা আগে করেন।’ 

হঠাৎ চেয়ারম্যান সামান্য গলা খাকারি দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে নিচু গলায় বলে, ‘রফিকুলের বউ, তুমি এখন যাও।’ 
মাথা নিচু করে ধীরপায়ে নিলুফার সভাস্থল ত্যাগ করার পর সমবেতদের উদ্দেশে চেয়ারম্যান বলে, ‘আপনারাও যান। আমরা পরে আবার বসব।’
উৎসুক জনতা চলে গেলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘শুনেন পাটোয়ারী সাহেব, মুন্সি আপনিও শুনেন, একেবারে নিশ্চিত না হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। দিনকাল বড়ই খারাপ, এইসব অতীব সেনসেটিভ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবেচিন্তে, উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে গেলে থানা-পুলিশ আমাদের ছেড়ে দেবে না। সালিশদারদের কোমরে দড়ি পড়ার খবর কাগজে দেখেননি!’

আগত নারী-পুরুষরা অনেকটা আশাহত হয়ে ফিরে যায়, সাত মাসের একটা পোয়াতি মহিলাকে চুল ধরে হেঁচকা টানে মাটিতে শুইয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হচ্ছে, কিংবা মাথার চুল ফেলে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো হচ্ছে, কিংবা মাঝারি ধরনের মেহগনি গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে সমস্ত  শরীরে লাল পিঁপড়া ছেড়ে দেয়া হয়েছে, শতশত পিঁপড়ার কামড়ে মহিলার চিৎকারের করুণ শব্দ দূরে বহু দূরে ছড়িয়ে পড়ছে-এই রকম শিহরণ জাগানো দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে না পেরে অনেকে ভেতরে  ভেতরে ক্ষুব্ধ।

****

চারদিক নীরব স্তব্ধ, রাত কত আন্দাজ করতে পারে না। ছেলেটা আনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে দুধের ফেনার মতো ধবধবে সাদা জোছনা হাতছানি দিয়ে ডাকে। নিলুফার একবার ভাবে দরজা খুলে উঠানে এসে জোছনা দেখে। পরে ভাবে পোয়াতি মানুষ এত রাতে একা বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। তার ওপর শত্রæর অভাব নেই। ঘরের মানুষ ঘরে না থাকলে চারপাশের চেনা চোখগুলো কেমন অচেনা হয়ে যায়; কিছু দিন থেকে তা-ই দেখে আসছে। বেড়ার ছোট-বড় নানান জাতের ফাঁক দিয়ে আসা রহস্যময় চাঁদের আলোর কারুকাজ দেখতে থাকলেও তার কান খাড়া থাকে চকির নিচের দিকে। 
কিন্তু চকির নিচ থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসে না। নিলুফার অনাগত সন্তানের কথা ভাবে, ভাবে ভবিষ্যতের কথা। একটা মানুষ দুই বছর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে; গভীর রাতে সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘরে ঢুকে কয়েক ঘণ্টা থেকে আবার চলে যায়, এনজিওর লোকটা হায়েনার মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে, তদুপরি তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে মুন্সি মৌলভীকে-কত দিন এভাবে পালিয়ে থাকা যায়!   
সুড়ঙ্গের কথা মনে পড়লে আনমনে হাসে নিলুফার। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাওয়ার ছয় মাস পর একরাতে এসে হাজির রফিকুল, মাথায় এলোমেলো চুল, মুখভর্তি খোঁচাখোঁচা দাড়ি, শরীরজুড়ে খুনখুনে গন্ধ; কোমরে শক্ত করে বাঁধা ময়লা গামছা; গামছার ভাঁজ খুলে টাকা বের করে মাথা নিচু  করে-নিলুফার একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ‘একটা তাগড়া জোয়ান মানুষ এই কয়দিনে অর্ধেক হয়ে গেল। স্বামীর চিন্তায় সারারাত নির্ঘুম কেটে ভোরের দিকে তন্দ্রা গভীর হলে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে নিলুফারকে তুলে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পরিকল্পনার কথা বলে। ঘুমে, ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়া নিলুফারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রফিকুল বলে, ‘একটা সুড়ঙ্গ খুদলে কেমন হয়? পিছনের আনারস বাগান থেকে ঘরের মেঝে অবদি? সুড়ঙ্গ দিয়ে রোজ রাতে তোকে আর ছেলেটাকে এসে দেখে যাব।
‘সুড়ঙ্গ দিয়ে আসা যাওয়া করবে? কী বলো এগুলা, তোমার মাথা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে।’-ঘুমঘোরে জড়ানো গলায় কথাগুলো বলে নিলুফার আবার শরীর এলিয়ে দেয়। 
‘হ্যাঁ, সুড়ঙ্গ দিয়েই আসা-যাওয়া করবো। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ কত কী করছে! এ তো সামান্য সুড়ঙ্গ।’ 
দিনের বেলা তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের কথা নানাভাবে ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও রাতের নিবিড় নিঃসঙ্গতায় ক্ষণে ক্ষণে তা মনে পড়ে। চোখের সামনে যে মুখগুলো ভেসে ওঠে সেগুলোও মানুষেরই মুখ; যখনই মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখনই ঘৃণায় অপমানে শরীর রি-রি করতে থাকে। সামান্য স্বার্থের মোহে মানুষ এভারে হায়েনা হয়ে গেলে সমাজে মানুষ বাঁচবে কীভাবে?  
ঠক ঠক ঠক। হঠাৎ চকির নিচে তিন টোকা পড়ার শব্দ-রফিকুল এসে গেছে। চকির নিচে উপুড় করে রাখা সিমেন্টের গামলাটা প্রাগৈতিহাসিক কাছিমের মতো একটু একটু করে সরে যেতে থাকে। 
গায়ের মোটা জামা খুলে বেড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে নীরবে নিলুফারের মাথার কাছে এসে বসে রফিকুল। 
রফিকুলের উপস্থিতিতে নিলুফারের ধূমায়িত অভিমান দুচোখ দিয়ে ঝরতে থাকে নীরবে, তবু রফিকুল টের পেয়ে যায়; কিন্তু স্থবির রফিকুল একটা কথা বলারও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
রফিকুল সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে গিয়ে দাঁড়ায়, একটা বিড়ি ধরায়, বেড়ার সঙ্গে গেঁথে রাখা দা বের করে আঙুলের ডগায় ধার পরখ করতে করতে ঘরে পায়চারি করে আর বলে, ‘ওই পিচাশ রাশেদই মুন্সিকে দিয়ে সবাইকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।’ 
দায়ের ধারালো অংশ চাঁদের কিরণ পড়ে চকচক করে, এই দৃশ্য দেখতে দেখতে নিলুফার বলে, ‘এই অপমান আমার কপালে ছিল, ধন-সম্পদের মতো অপমানের বিষয়টা মানুষের কপালে লেখা থাকে-এর প্রতিকারে তোমার কী সাধ্য আছে! মেম্বার চেয়ারম্যান মুন্সি মৌলভী কী করেছে এই নিয়ে আমি ভাবছি না, আমার গায়ে কলঙ্ক দেয়ার চেষ্টা হয়েছে সেটা নিয়েও বিচলিত হইনি, মাত্র কয়দিন পর একটা বাচ্চা দুনিয়ার আলো দেখবে, আরেকটা বাচ্চা বড় হচ্ছে। আমি কেবল তাদের কথাই ভাবি।’ 

****

বিল্লালের দোকানের ভেতরের দিকের রুমে মুখোমুখি বসে আছে রাশেদুল আর কিবরিয়া; বাইরে লোকজন অনেক। একটু উঁচু তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা রঙিন টিভিতে চলছে ইন্ডিয়ান বাংলা ছবি, বাইরের দিকে যারা বসে আছে তাদের সবার দৃষ্টি টিভির দিকে। ছোট একটা মামুলি ধরনের বাজার, যার বেশিরভাগই চায়ের দোকান। হাতে সকাল থেকে রাত অবধি জাল হতে থাকা একেবারে বিস্বাদ তেতো চায়ের কাপ, মুখে জর্দা দেয়া পান, জ¦লন্ত বিড়ি-এসব ছাড়া এই বাজারের লোকজনকে কমই  দেখা যায়। পান বিড়ি চা, বাংলা সিনেমা, রাত জেগে তাসের আড্ডা, কাঁঠাল, আনারস, সকাল-সন্ধ্যা জমাট আড্ডা-এসব নিয়েই এখানকার মানুষের স্থবির নিস্তরঙ্গ জীবন। আনারসের নেশা ধরানো গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো আড়মোড় ভেঙে, দীর্ঘ আলস্য ঝেড়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠে; কাদা পানি ভেঙে রাস্তা দখল করে আনারস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, দালালের সঙ্গে খেয়োখেয়ি, ট্রাকে মাল বোঝাই-তার পর আবার কয়েক মাসের ঝিমুনি। খাসকামরার মতো ওই  ঘরটা বরাদ্দ এনজিও এবং বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ক্লান্ত-শ্রান্ত বিপণন কর্মকর্তার মতো বিশিষ্টদের জন্য। তাদের ব্যাপারে বিল্লাল সবসময় সতর্ক। 
অভ্যাসবশত তেতো চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে কিবরিয়ার দিকে লাইটার এগিয়ে দেয় রাশেদুল। কিবরিয়া সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘রিকভারি করতে পারছেন না? এটাই সমস্যা?’
‘হ্যাঁ, এটাই সমস্যা।’
‘এটা এমন আর কী সমস্যা, মাঠে ঋণ থাকলে রিকভারির সমস্যা কমবেশি থাকবেই।’
‘অফিস থেকে সাফ বলে দিয়েছে তিন মাসের মধ্যে রিকভারি করতে না পারলে চাকরি থাকবে না। এদিকে বাসায় আব্বা প্যারালাইসিস হয়ে পড়ে আছে, ডিভোর্সের পর বড় বোনটাও এসে উঠেছে বাড়িতে-তার মানসিক অবস্থা ভালো নয়। এই পরিস্থিতিতে চাকরি চলে গেলে সবাইকে নিয়ে ¯্রফে না খেয়ে মরতে হবে। আপনি বলছেন কোনো সমস্যা না!’ 
‘বললাম সমস্যা জটিল না, কেবল আঙুলটা বাঁকা করতে শেখেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কয়টা কেস?’
‘কেস অনেক, পাশের গ্রামেই সাতজন, কোনোভাবেই বাগে আনতে পারছি না। দুজন পালিয়ে বেড়াচ্ছে ট্রেস করা যাচ্ছে না।’
একটু দম নিয়ে কিবরিয়া বলে, ‘মামলা করেছেন?’ 
‘না।’
‘মামলা ঠুকে পুলিশ লেলিয়ে দেন, দেখবেন পুলিশের দৌড়ানি খেতে খেতে হাঁটু ঢিলা হয়ে গেছে। টাকা দেবে না মানে? সুদে-আসলে সব টাকা দেবে, উপরন্তু মামলার খরচও কোর্টে দিয়ে আসবে। একটাকে ধরে টাইট দেন, বাকিগুলো এমনি এমনি সোজা হয়ে যাবে। নতুন চাকরি তাই এই সব বুঝতে পারছেন না।’
চোখের ইশারায় রাশেদকে কাছে আসতে বলে কিবরিয়া রাশেদের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বলে, ‘একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন যে এলাকায় যাবেন প্রথমে একজনকে টার্গেট করবেন, তাকে যে করে হোক জেলে ঢুকিয়ে দেবেন। দেখবেন ফিল্ড একেবারে পরিষ্কার। এর পর বরশিতে গাঁথবেন আর ঋণ গেলাবেন।’ 
‘এতটা নিষ্ঠুর হতে পারছি না, সেটাই সমস্যা।’
ভ্রƒ সংকুচিত করে কিবরিয়া বলে, ‘নিষ্ঠুর কাকে বলছেন আপনি, এটা হলো সিস্টেম; সিস্টেমে ফেলে দেবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। দুনিয়াটা চলছে সব সিস্টেমের ওপর। ওই যে ফ্যামিলির কথা বলছেন, ফ্যামিলি বাঁচাতে হলে, চাকরি বাঁচাতে হলে নিষ্ঠুর কিছুটা হতেই হবে।’
‘রফিকুল না কাকে নিয়ে ঝামেলায় আছেন বললেন সেদিন।’
‘হ্যাঁ, ব্যাটা দুই বছর থেকে পালিয়ে আছে। তবে ধরা তাকে দিতেই হবে। বউ সাত মাসের  প্রেগনেন্ট। তার মানে শালা চুরি করে বাড়িতে আসে। কত দিন রাতে পাহারা দিয়েছি, ধরতেই পারছি না, একেবারে শেয়ানা মাল। মুন্সিকে দিয়ে চাপ দিয়েছি, কিন্তু ওই মাস্টার সব গুবলেট পাকিয়ে দিল, চেয়ারম্যানও তেমন গুরুত্ব দিল না। উল্টো আমার বিরুদ্ধে...।’ 
কথা শেষ না করতেই দেখে মোটরসাইকেল থেকে নেমে ওষুধ কোম্পানির দুই কর্মকর্তা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল।
‘কী খবর কিবরিয়া ভাই, চাকরি কেমন চলছে?’
বিল্লাল দৌড়ে এসে টেবিল মুছে দিয়ে মাথা নিচু করে চা বানাতে লেগে যায়। 
আপনাদের কী খবর?-পাল্টা প্রশ্ন করে কিবরিয়া। 
‘আমাদের অবস্থা আর বলবেন না। আমাদের চলছে ম্যাসেজ আতঙ্ক, হেড অফিস থেকে ম্যাসেজ এলেই কলিজাটা শুকিয়ে যায়। শহীদুল মরে যাওয়ার পর এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আহা রে, লোকটা অমায়িক ছিল।’ 
‘কোন শহীদুল?’
‘মার্কেটিং অফিসার শহীদুল, আপনি ভালো করেই চিনেন, এখানে কতোবার চা খেলাম!’ 
‘কালোমতো পাতলা লোকটা?’
‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন?’
‘কী হয়েছে? কীভাবে মারা গেল?’
‘ঢাকা থেকে ম্যাসেজ এলো সব হিসাব ক্লোজ করে হেড অফিসে পাঠিয়ে দিন। ব্যস, ম্যাসেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোক করে মারা যায় শহীদুল।’ 
চা খেতে খেতে ওষুধ কোম্পানির দুই কর্মকর্তা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে কিবরিয়া ও রাশেদ আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসে।  
কিবরিয়া বলে, ‘রাশেদ সাহেব, শুনলেন তো দুনিয়াটা কত নিষ্ঠুর। এই জন্য বলছি প্রথমে একজনকে টাইট দেন, পরে বাকিগুলো সোজা হয়ে যাবে। কেবল টাইট দিয়ে বসে থাকলে হবে না, ঋণও গেলাতে হবে। না হলে টার্গেটে পৌঁছাবেন কীভাবে?’
হালকা করে দীর্ঘশ^াস ছেড়ে কিবরিয়া আবার বলে, ‘আমাদের চাকরিটাই হচ্ছে টার্গেটের পাগলা ঘোড়াকে বাগে আনতে প্রাণপণ দৌড়ানো, যাকে কখনোই ধরা যাবে না। যেই একটা টার্গেটের কাছাকাছি পৌঁছাবেন অমনি আরও বড় একটা টার্গেট আছড়ে পড়বে আপনার ঘাড়ের ওপর। দৌড়াতে দৌড়াতে জীবন পার হয়ে যাবে, কিন্তু টার্গেট পূরণ হবে না।’-এই বলে শব্দ করে হাসে কিবরিয়া। 
রাশেদ বলে, ‘এখানকার মানুষগুলো হতদরিদ্র, একেবারেই গরিব।’
টেবিলে আঙুলের টোকা মেরে, একগাল ধোঁয়া ছেড়ে কিবরিয়া বলে, ‘কাম টু দ্য পয়েন্ট; গরিব বলেই তো ঋণের দরকার। মানুষ গরিব না হলে ঋণের ব্যবসাটা জমাবে কিভাবে? আপনি এতো দিনেও বিষয়টা বুঝলেন না? দেখবেন যেখানে গরিব বেশি সেখানে ক্ষুদ্রঋণের কারবারও বেশি। আপনাকে পছন্দ করি তাই এতো কথা বললাম, আপনি শক্ত হোন, না হয় টিকতে পারবেন না। আজ উঠি।’

***

সুড়ঙ্গ দিয়ে রফিকুল যখন ঘরে প্রবেশ করে তার কিছু সময় আগে নিলুফার সন্তান প্রসব করে। ঘুমন্ত ছেলেটাকে হালকা চাদরে ঢেকে দিয়ে তার মাথার কাছে বসে দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে রফিকুল। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে দেখার চেষ্টা করে। কুপির কম্পমান আলোয় কেবল নিলুফারের ফ্যাকাশে করুণ মুখটা দেখতে পায়; শরীরের আড়ালে থাকায় সন্তানকে দেখা যায় না। নিলুফারের চোখেমুখে প্রসববেদনার ধকলের ওপর সামান্য প্রশান্তি; সেটা ভোরের আলোর মতোই ¯িœগ্ধ। 
প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলুফারের মা রফিকুলের কোলে যখন সদ্যোজাত সন্তানকে তুলে দেয় ততোক্ষণে চারদিকে কুয়াশাভেজা ভোরের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। 
‘আপনি মেয়ে চেয়েছিলেন, আল্লাহপাক আপনার কথা শুনেছে। এখন থেকে টাকা জমান, মেয়ে বিয়ে দিতে অনেক টাকা লাগবে?’-শান্ত গলায় কথাগুলো বলে রফিকুলের শাশুড়ি। 
ঋণের দায়ে ফেরারি, বউ-ছেলেমেয়ের নিরাপত্তায় ব্যর্থ একজন মানুষ; অনিশ্চয়তার হতাশায় হাত-পা সেঁধিয়ে যায় রফিকুলের। সদ্যোজাত শিশুকন্যার মুখের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মুহূর্তে সব গøানি কেটে গেলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার মনে হয় নিষ্পাপ শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। 
‘আম্মা, শাহীনের আব্বাকে বলেন, দেরি না করে এখনি চলে যেতে, ওই পিচাশটা টাকার জন্য পাগল হয়ে আছে; কোনো বিশ^াস নাই যখন-তখন পুলিশ নিয়ে হাজির হতে পারে।’-বেড়ার ওপাশ থেকে নিলুফারের ক্ষীণকণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে।  
নিলুফারের কথায় রফিকুলের বুকের ভেতরটা সহসা মুচড়ে ওঠে; সত্যি তো, তার ঘরও এখন তার জন্য নিরাপদ নয়।
নিলুফারের আম্মা রফিকুলের কোল থেকে শিশুটিকে নিয়ে নিলুফারের পাশে শুইয়ে দেয়ার পরও স্থবির হয়ে বসে থাকে রফিকুল।
রফিকুল বেড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা মোটা খাকি জামাটা গায়ে দিতে যাবে এ সময় শাশুড়ি নীরবে এসে সামনে দাঁড়ায় আঁচলে মাথা ঢাকতে ঢাকতে। আশ্চর্য স্তব্ধতায় দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে, কারও মুখ থেকে একটি কথাও বের হয় না। হঠাৎ মিহি কণ্ঠে শাশুড়ি বলে, ‘এর একটা বিহিত করেন, মেয়েটা একা একা কীভাবে সামলাবে? আপনার শ^শুর বিছানায় পড়ে আছে, আমারও চলে যেতে হবে।’

আগে থেকেই অদ্ভুত বিষাদে রফিকুলের মুখ ছেয়ে যায়; ধীরপায়ে সুড়ঙ্গের দিকে এগিয়ে গিয়েও কী মনে করে আবার ফিরে এসে দরজা খুলে বাইরে পা বাড়াতে বাড়াতে শাশুড়িকে উদ্দেশ করে বলে, ‘চিন্তা কইরেন না আম্মা, নামার জমিটা বিক্রি করে ঋণ শোধ করে দেব।’
ভোরের শরীর জুড়ানো বাতাস, উঠানে এক পা দিয়ে রফিকুল চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ^াস নেয়। কত দিন নিজের উঠানে দাঁড়িয়ে নিশ^াস নেয়নি। চোখ খুলে সহসা দেখতে পায় উঠানের কোনে যে কাঁঠালগাছ দাঁড়িয়ে আছে তার নিচে দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে হ্যান্ডকাফ হাতে, পিছনে এনজিওর সেই অফিসারটা; অফিসারের ঠোঁটের কোণে রাজ্যজয়ের হাসি; পুলিশের উপস্থিতি, হ্যান্ডকাফ, জেল-জুলুম এসবের চাইতেও এই হাসিটা তার কাছে আরও বেশি নির্দয় ও নিষ্ঠুর মনে হয়; একটা নিঃশব্দ হাসিও যে এতোটা ক্রুর হতে পারে জীবনে আর কখনো দেখেনি সে।

menu
menu