শের-এ বৈরাগী
‘শেয়ের’ শব্দটা আরবি। এর বাংলা ব্যুৎপত্তি হলো কবিতা। উর্দু-ফারসি সাহিত্যে ‘শেয়ের’ এর জনপ্রিয়তা অত্যন্ত তুঙ্গে। মীর্জা গালিব-হাফিজ প্রমুখ কবিগণ ‘শেয়ের’ রচয়িতা হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। আঠারো শতকের মধ্য থেকে উনিশ শতকের মধ্য পর্যন্ত হিন্দি-উর্দু-আরবি-ফারসি ভাষার মিশ্রণে মুসলিম কাব্য রচয়িতাদের বলা হতো ‘শায়ের’। অর্থাৎ দোভাষী পুঁথিকারকদের বলা হতো ‘শায়ের’। কবি সৈয়দ হামজা ‘আমীর হামজা’ কাব্যের শুরুতে একে ‘শায়েরি পুঁথি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
যেহেতু এই পদগুলোতে আরবি-ফারসি-হিন্দি-উর্দু শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে, তাই এই পদগুলোকে ‘শেয়ের’ বলাটা যথাযথ মনে করি। এই ‘শেয়ের’ হঠাৎ খেয়ালের বশে রচনা নয়। আমার দীর্ঘ দীর্ঘ কালের লালিত নার্সিসিজমের ধারণা থেকে আমার ভেতরে জন্ম নিয়েছে এক ধরনের আত্মবাদ, আত্মপ্রেম, আত্মগর্ব, আত্মশ্লাঘা ও আধ্যাত্মবাদের বৈশিষ্ট্যাবলী। এই কবিতাগুলো সেই চেতনারই ক্ষুদ্র নির্যাস মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী কুচক্রিগোষ্ঠীর হামলার শিকার হয়ে জীবনমৃত্যুর লড়াইয়ে টিকে থাকা কালকে আমি বলি আমার দ্বিতীয় জীবন। এই জীবনে আমি হয়ে ওঠি প্রবল নাসির্সিস্ট। আত্মপ্রেম, আত্মকেন্দ্রিকতার বলয় থেকে আমি শিখেছি জীবন ও দারিদ্রতা অবজ্ঞা করতে। আবার আমার মনচৈতন্যে পুষে রাখি আত্মহননের অভিলাষও। তাই এই ‘শেয়ের’ গুলোতে আমি নিজেকে ফোটাতে চেয়েছি নার্সিসাস ফুলের মতো।
কলবে অমর্ত্য সুবাস
১.
যদি ডাক আসে যেতে হবে মোহময় মর্ত্য ছেড়ে অমর্ত্যলোকে।
২.
বেখেয়ালে যায় চলে দিন আমার অপেক্ষা সীমাহীন।
৩.
অমর্ত্যলোকে বসে আছেন এক রাজাধিরাজ
হুকুম তামিলে প্রস্তুত সেপাই সেনা বরকন্দাজ।
৪.
কলবে যদি খোদা না থাকে তবে
লোক দেখানো নামাজে কী হবে।
৫.
ভেকধারী পোশাকে যদি হয় ইমানদার
মজলুম আশেক কয় খোদার নামে ভ-।
৬.
গাউস কুতুব জপ করিতো নীরব গোপনে
এখন দেখি লকব লাগায় আগে নিজের নামে।
৭.
সাধু-সন্ত-পির মাশায়েখ খেতো এক পাতে
কলিকালে ফতোয়ার নামে বিষ তীর গাঁথে।
৮.
আলো-বাতাস-জল ভোগে বিভেদ নাহয় খোদার
কেমন মুসল্লি-পূজারি হাতে তীর ধনুক তলোয়ার।
৯.
ওহে ইমাম খুতবায় খুঁড়ো অন্য ধর্মের কবর
জুমার হজ্ব নষ্টের জন্যে নবিজি করেননি মিম্বর।
১০.
মত্ত সাগর দিয়েছ পাড়ি সামনে পুলসিরাত
ইমান আমল রক্ষা করে পড় প্রভুর আয়াত।
১১.
মরণ ডাকের সিগন্যাল পড়ছে প্রস্তুতি নাও কবরের
বেখায়ালে থাকো যদি দোষ কি তবে আজরাইলের।
১২.
ভব দরিয়ায় সাঁতার কেটে নাপাই কুল কিনার
গাউস-কুতুব-অলিকুল তরাই করো তরি নবীর।
১৩.
পরস্পরের বোমা তলোয়ারের আঘাতে মানুষই না থাকে দুনিয়ায়
খোদার গুণ কীর্তন জিকির আজগর কেরামতি কে চিনাবে হায়।
১৪.
দেহের সনে কলব ঘরে কলরবে বসত করেন খোদা
তলোয়ার জোরজবরদস্তি স্বরে বলো না শান্তির কথা।
১৫.
ক্ষণিকের বাদশাহ তুমি ছোট্ট দেশের
বড়াই করো না জীবন কিন্তু ক্ষণিকের।
১৬.
জরাগ্রস্ত জীবন নরকের নামান্তর
করো খোদা মর্ত্যলোকে দেশান্তর।
১৭.
কোলাহল কলরবেও তোমায় ডাকি খোদা
নামাজ কালাম নাহোক ঠিক তোমারি বান্দা
হাসরের ময়দানে স্বাক্ষী দিবেন রাসুলে খোদা।
১৮.
শরাবের উপাদান আছে ফুল-ফলে
আছে কত লতাপাতা গম-জব-চালে।
মানুষ যদি না জানে স্বাদ আহারে ও পানে
খোদার কেরামতি বান্দা বুঝিবে কেমনে?