সাবওয়ের ১০ কবিতা
কবিতার চর্চা আমাদের দেশের তুলনায় আমেরিকায় কম কি বেশি সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে নিউইয়র্কে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে লোকজন যেভাবে চলতে চলতে বই পড়ে, তা থেকে এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে এখানে পাঠক সংখ্যা বেশ ভালোই। সেই সঙ্গে অনেকেই মোবাইল কিংবা আইপ্যাডে পড়ছেন আমাজনের কিন্ডল-এ। সেই সঙ্গে পাঠ করার মতো কবিতাও সেঁটে দেয়া আছে সাবওয়ে মানে পাতাল ট্রেনের দেয়ালে। লন্ডনে একটি অনুরূপ একটি প্রোগ্রাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯২ সালে শুরু করে ‘পোয়েট্রি ইন মোশন’ নিউইয়র্ক সিটি ট্রানজিট এমটিএ। শুরু থেকেই এমটিএ এবং পোয়েট্রি সোসাইটি অব আমেরিকার প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় সিরিজের কাজগুলি নির্বাচিত হয়েছিল। প্রথম চারটি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে প্রোগ্রামটি শুরু হয়। প্রথম নয় বছরের কবিতাগুলো বেশ কয়েকটি পাতাল রেল স্টেশন থেকে মোজাইক টাইল শিল্পের বৈশিষ্ট্যযুক্ত নকশায় এবং মাস্টহেডের অধীনে ওভারহেড ‘কার কার্ড’ এ উপস্থাপিত হয়েছিল। কবিতা নিয়ে নানারকম কর্মকাণ্ড করেছে এমটিএ। মাঝখানে দীর্ঘ ছেদের পর ২০১২ সালের মার্চ মাসে পুনর্বার শুরু হয় ‘পোয়েট্রি ইন মোশন’। পুনরুদ্ধার করা প্রোগ্রামটি একটি নতুন লোগোর অধীনে বৃহত্তর “প্রিমিয়াম স্কোয়ার” কার কার্ডে উপস্থিত হয়। প্রতিটি কবিতার সঙ্গে যুক্ত হয় স্বনামধন্য শিল্পীদের চিত্রকর্ম এবং নকশা। প্রতিটি কবিতাই আমেরিকার বিখ্যাত কবিদের, যারা এক বা একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত।
নিউইয়র্কের পাতাল ট্রেন
মূল : বিলি কলিন্স
দু’কানে গানের ছন্দে বিভোর অথবা
গল্পের মুগ্ধতায় হারিয়ে যাওয়া বই হাতে
যে তুমি দ্রুত ভূমির নিচে পাখা মেলে উড়ে উড়ে চলো;
মনেরেখো একদিন এখানে নেমে এসেছিল কেউ,
গভীর আঁধারে দুর্ভেদী পাথরে ছোট্ট একটা গর্ত নির্মাণ করবে বলে।
অগভীর সেই গর্ত থেকে মেদে-ঘামে আর শ্রমের তিতিক্ষায় গড়ে উঠেছে তোমার পথ।
এক সময় এখানে ছিল, শুধু দুর্মর পাথর
আর সীমাহীন নিরেট আঁধারে বিলীন নিথর জীবন।
সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আলোর নাগাল পেতেই মনেরেখো তাদের অমেয় সেই উৎসর্গের কথা।
উদগ্র বাসনার চিরকুট
মূল : টিনা চ্যাঙ
বৃষ্টির পর আজকের এই রাত
সুস্বাদু এক গন্ধে আবিষ্ট।
হাঁসের উপাদেয় হাড়, ভাতের মধ্যে ডুবে থাকা
ডিমের আহত অংশ।
কোনায় একটি দোকান চাবি বানানোর,
যে চাবি দরজা খোলে মানুষের।
দরজার ওপারে নিস্প্রভ কক্ষ। কক্ষটি ধারণ করে আছে
ডাইনিং টেবিলে বসা চার থেকে ছয়জনের
একটি পরিবার। সেই পরিবারে আছে একজন মা।
বিশাল পাত্রে পরিবেশন করছে সিজলিং ফ্লাউন্ডার সবার জন্য।
আর সাধারণ সেই মুখগুলো থেকে আচমকা
আলোর চঞ্চল দ্যুতি হয়ে, ধ্বনিত হচ্ছিল কী অসাধারণ গান!
তোমার প্রতি আমার কথামালা
মূল : জিন ভ্যালেনটিন
স্কার্ফের প্রতিটি সেলাই, তোমার জন্য
আমার নীরব কথামালা।
আমি এর শেষ চাই না কখনো।
হয়তো বা অব্যক্ত কথাগুলো নকশি কাঁথার
নিপুণ বুননে তোমাকে জড়িয়ে রবে
আবারও আকুল উষ্ণতায় এখানে;
মানে, ভালোবাসা যায়নি কোনখানে
ভূমি, আপনজন
মূল : চার্লস সিমিক
কেমন যে আছি, এই কথাটিই আমি
প্রতিদিন সকালবেলা ভুলে যাই।
দিগন্তে নির্মোহ দৃষ্টিতে যখন শহরের
ধূসর আকাশ দেখি।
একাকী অচেনা লাগে, যেন আমি কারো নই।
তারপর মনে পড়ে যায়, আমার জুতোর কথা
কীভাবে পরতে হতো
কতটুকু নতজানু হয়ে বাধতে হতো ফিতে, শুধু
অতি আপন ভূমিকে দেখবো বলে!
রজনীতে সুন্দরীর স্বগতোক্তি
মূল : মার্লিন নেলসন
একরাতে আয়নায় অপরিচিত এক
সুন্দরীর সাথে দেখা।
তাকে বললাম : এই,
কী করছো তুমি এখানে?
উত্তর পেলাম আমি তার,
একই প্রশ্নে।
লুকোচুরি
মূল : গ্যালওয়ে ক্যানয়েল
একদিন আমি হাইড এন্ড সিক নামের
লুকোচুরি খেলছিলাম,
খেলতে খেলতে বাড়ি ফেরার সময় হলে
খেলা শেষ না করেই
ফিরে যায় বাকিরা যে যারমতো!
ভুলে যায়, আমি যে লুকিয়ে আছি তখনো ওদেরই জন্য।
খেলার নিয়ম বাধ্যগত শিশুর মতো আমাকে আটকে রাখে সেখানে।
চারিদিকে বিভ্রান্তিকর সন্ধ্যার হাত;
আমাকে বাড়ি ফেরার পথ দেখিয়েছিল
আকাশের চাঁদ!
লেডি লিবার্টি
মূল : নাথালি হ্যা
সব তারকা ধাবিত নগরীর দিকে।
সে এক স্বর্গদূত, উন্মুক্ত করছে মধ্যরাতের মোড়ক।
অদৃশ্য ভেঁপুতে মুখরিত এক নদী
চাঁদের দু’পাশের হেঁটে চলা পথ।
আলোয় বুঁদ হওয়া
সে এক দুঃখী
পাল তোলা নৌকার বুকে
ভালোবাসা নিয়ে ঘোরা যাত্রী,
খুঁজে পায় নিঁখুত এক দ্বীপ
হাস্যকর
মূল : কেভিন ইয়াং
গরমাগরম খাবারের মতো
আমি তোকে ভালোবাসি।
অনুরূপ ভালোবাসি উষ্ণ রুটি,
শীতল মাংসের গোলাকার ফালি,
মাখন শোভিত স্যামেচের আহ্বান
অথবা ‘থ্যাংকস গিভিং’ এর শেষে
কয়েকদিন পর, যখন আমি চাই
যা কিছু উচ্ছিষ্ট।
পেঁচা
মূল : আর্থার সি
ধূসরিত নবজাত সন্ধ্যার তালুতে ময়ূরী রঙের পথ।
দেখলাম পেঁচা এক অলস বসে আছে গাছের শাখায়। তার পাখা ঝাপটানোর
কম্পনে ভূপাতিত ধূলিকণার হাহাকার ।
আমি তখনো নিশ্চুপ। নীরবতা ভেঙে
পেঁচার কণ্ঠে এবার বেজে ওঠে প্রভাতী সংকেত।
তারপর ভোর আসে, সবুজাভ পথ জেগে ওঠে
সম্ভাব্য আলোয়।
ভালোবাসার ধ্বংসাবশেষ
মূল : জিম মোরে
আমি দূরে একপ্রান্তে দাঁড়ানো আমার মা’কে স্মরণ করছি।
খুব সন্তর্পণে নৈশভোজ শেষে ভাঁজ করছিলেন টেবিল ক্লথ,
যেন ওটা কোনো দেশের পতাকা
যে দেশের অস্তিত্ব এখন পৃথিবীর মানচিত্রে নেই।
কিন্তু একসময় সেই দেশটাই শাসন করতো গোটা বিশ্ব।