গুচ্ছ কবিতা...

স্ত্রী বিষয়ক টীকা 

বিবাহের দ্বিতীয় বর্ষে এক অষ্টাদশী রমণীর পায়ের গোছা ও ঘনচুল বাংলারেলের টিকিট কালেক্টর কমরুদ্দিনের মনোযোগ আকর্ষণ করে, ফলে টিকিট চেকের উছিলার বারকতক ফিরে ফিরে সে ঠ-বগির যাত্রীদের বিরক্ত করে। যাত্রীরা সর্বদা নিরীহ তাই তৃতীয় দফাতেও কেউ উত্তেজনা প্রকাশ করলো না। যেহেতু নিশিথ-যাত্রীনির নম্বর বা ঠিকানা জিজ্ঞাসাটা সৌজন্যের সর্বসীমা লঙ্ঘন করে তাই ইচ্ছে-সত্ত্বেও সে নিজকে সংযত রাখে। তারপর দিনকতক ঘনচুল আর রম্ভার-বগলির মতো গোছাদুই স্বপ্নেও হানা দিয়েছিল এবং কিছুদিন সে ছিল অচিন উর্বসীর স্বপ্ন-ঘোরে আচ্ছন্ন। আর ঘোরের বশেই একদিন প্রাতঃরাশের মুহূর্তে স্ত্রীর কাছে সে ঘনচুল ও মোটাগোছার বর্ণনা করে বসে! সেই থেকে শুরু সন্দেহের লাল নীল বিচিত্র গ্রন্থনা, সেই থেকে মাছি-ভনভন সকাল-দুপুর-অষ্টপ্রহর! সেই থেকে স্বপ্ন ও সুন্দরের পিঠে অবিরাম কাকের কীর্তন! 

বিবাহের যুগপূর্তি শেষেও যখন একমাত্র বধূটির আক্ষেপ ও হাহাকার ঘুচলো না তখন কমরুদ্দিন ভাবলো এসব হা-হুতাশ, স্বপ্ন ও সংকট থেকে বহুদূরে নির্বাসনে কেমন হয় একাকী সংসার, দিনগুনে—গুণে গুণে তসবির মালা কোনো তীর্থবিজনে জীবন কেমন?

সুতরাং সে এমন এক তীর্থের উদ্দেশে বাড়ে যার অবস্থান সম্পর্কে কেউ জানে না! এবং পরদিন ভোরসকালে জেগে বধূ যখন পাশের সজ্জাটি খালি এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখল তারপর থেকেই সূচনা ঘটল এক বিরতিহীন কান্নার, যেহেতু লোকটি দূরদেশে ছিল তাই সহধর্মিণীর ভালোবাসা বিষয়ক এমতো অশ্রু ও বিষাদ সম্পর্কে একটুও জানার অবকাশ পেলো না! 
 
মাটির শিথানে 
     
মানুষ এত কই যায় 
পতনে দহনে স্খলনে 
সমরে সংগ্রামে— 
অবিরাম;
অশ্বে-বিমানে-জলযানে...

মানুষ এত কই যায়
শোকে অসুখে অবসাদে 
বিষ ও বিষাদে— 
অবিকার
অবিরোধ আত্মহননে...

মানুষ এত কই যায় প্রাণছুটে
কি আছে সেখানে
আছে কি ফাল্গুন, সূর্যমুখী— 
বর্ণিল রঙের বেসাতি
আছে কি মেঠোপথ আনত নারীর মুখ
আছে কি পারাপার, ভাটিয়ালী
রাতের উজানে ভাসা চারণের বাঁশি
আছে কি নীলখাম—প্রথম প্রেমের দ্বিধা
আছে কি মায়ের ছোঁয়া, কোমল রসনা

মানুষ কই এত যায় 
একবারও চায় না ফিরে
দেখে না কেমন আছে বিরাণ ভূমিটি 
মানুষ কিসে এত ভুলে থাকে—  
কীসের আশায় সে ডুবে!
আমিও সেখানে যাবো— 
মাটির শিথানে দেবো ঘুম।   

হাড়ের পেখম

এবং ওরা কাছে এলো
চোখের পর্দা গেলো বুজে
দৃষ্টি খোঁজে হৃদয় অতল
বুকে ছুটে তরুণ মৃগপাল 

এবং সুপ্তি এলো
পুষ্পশাখে ছড়ায় মৌতাত
ওর টুপি গেলো খসে—
উড়তে লড়ে হাড়ের পেখম

এবং দেহ জ্বলে
স্বপ্ন ঝরে ঘাত-প্রতিঘাতে   
চরম পুলকে নাচে শিরা-উপশিরা—
জমে ওঠে রসের-প্রাশন... 

কিছু ঘর বালিয়াড়ি

বালুকায় মুখ রেখে পাখি
বালিবালি জল ঢালে পাখি;
গভীর যুক্তস্নান চলে তটে

বালুকার প্রেমে পড়ে গিয়ে
বালিয়াড়ি ঘর তোলে কেউ— 
ভীষণের বুকে ঝড় তোলে! 

একটি বিষম গান 

নিমেষেই জৌলশ হারিয়ে ফেলে সুবর্ণ ফুলেরা
দেহে বাঁধে রোগ বাসা
নতুন ঘরে ঘরে সারারাত ঘুণ করে গুনগুন
সব নীল, শাপে-সন্তাপে নীল সব বেদনার পারা

অমোঘ আশ্বাস বলে কিছু নেই 
যেসব মন্ত্রগুণে দিন গুজরায় লোকে—
স্বপ্ন আঁকে সারাক্ষণ 
দিনশেষে সব মিছে— 
চুপেচুপে কথার ধ্বনিরা করে আলোহীন আঁধারের পালা! 

জীবনের ঔরসে জন্ম নেয় মরণের অপরূপ রঙ-লীলা-সাজ 
মতিনের মৃত দুহিতার দিকে চেয়ে এ খবর পেয়েছি আজ!


সৌম্য সালেক আসল নাম আবু ছালেহ মো: আবদুল্লাহ। কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক। প্রকাশিত বই : আত্মখুনের স্কেচ (প্রকৃতি প্রকাশন, কবিতা-২০১৬); ঊষা ও গামিনি (দেশজ প্রকাশন, কবিতা-২০১৮), পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা (সময় প্রকাশন, কবিতা-২০২০) এবং শব্দ চিত্র মত ও মতবাদ (সময় প্রকাশন, প্রবন্ধ- ২০১৯)। সম্পাদিত ছোটকাগজ : চাষারু। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মরত।

menu
menu