,

অবচেতন মৃত্যু

আমার আর মৃত্যুর মাঝে শুধু তিন হাতের ব্যবধান

মৃত্যুকে সেদিন আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি,
যেদিন চৌরাস্তার মোড়ে, 
                     সারি সারি দোকান আর পথচারীর মাঝে একসাথে শুয়েছিল কুকুর আর মানুষ,
পায়ের তলায় লেগে ছিলো গলা—পিচ, বাসের চাকা যেদিন আমায় উন্মাদের মতো 
গিলে খেতে আসছিল।

মৃত্যুকে সেদিন আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি,
শহরের মাঝে যেদিন জ্বলন্ত দাবানল, 
             পাগলা ঘণ্টির আওয়াজে, চারতলার ওপর থেকে একে একে ঝাঁপ 
দিয়েছিল আমার সব শ্রেণিশত্রু, দাউ দাউ করে পুড়ছিল বহুতল;
আমার আর মৃত্যুর মাঝে সেদিন শুধু তিন হাতের ব্যবধান।

মৃত্যুকে সেদিন আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি,
যেদিন রেলস্টেশনে, সাদা শার্ট পরা সেই প্রৌঢ়কে টেনে নিলো সবুজ-হলুদ 
ইএমইউ,
              চারদিক থেকে জেগে ওঠা শিহরণে আমার বুকের ওপর চাপা 
পড়লো গন্ধমাদন
আমার আর মৃত্যুর মাঝে তখন শুধু তিন হাতের ব্যবধান।

মৃত্যুকে সেদিন আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি 
যেদিন শ্মশানের চিতাকাঠে শুয়ে ছিল আমারই এক নিকট জন,
জীবনের ময়নাতদন্তে যে বেছে নিয়েছিল আত্মহনন
আমার বুকের মধ্যে সহসা বেজে উঠল দায়িত্ববোধ
আমার আর মৃত্যুর মাঝে সেদিন শুধু তিন হাতের ব্যবধান।

গভীর রাতে বিষাদ ঢাকা সুখে,
কবিতার জন্যে, 
শব্দ ঢুঁরে ঢুঁরে, আমি মৃত্যুকে কাছে পেয়েছি
অবহেলায় রোজ খেলা করেছি তার সাথে,
রাত শেষে বারবার সে আমার পাশে এসে বসেছে,
আমার ঘুমন্ত শরীর, মন, অবচেতন— 
কোনো কিছুই তার অস্তিত্ব টের পায়নি;
আমার শরীরের সমগ্র গহ্বর জুড়ে খেলা করেছে লাল-নীল-সবুজ পতঙ্গের দল!
আমার আর মৃত্যুর মাঝে তখন তিন হাতের ব্যবধান!

চব্বিশের যৌবন

ছেলেটা মাঝ রাস্তায় হঠাৎই পথ হারিয়েছে,
তার চারপাশে শুধুই অচেনা পথ—ঘাট, বিক্ষিপ্ত কিছু মানুষজন, দু একটা  
কৌতূহলী চোখ— 
সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, তার আসলে এখন কোন দিকে যাওয়া উচিত?
কিভাবেই বা সে এখানে এসে পৌঁছল,
এতদূর, বিজনে, নির্জনে, গোপনে?
অথচ সবার মাঝে— 
যেখানে কেউ ওর আপন নয়,
সকলেই অচেনা, নাকি মুখোশ পরে ঢেকে রেখেছে আসল পরিচিত মুখগুলো,
এখানে এতদূর একা একা সে কিভাবেই বা টিকে থাকবে?
যেখানে— 
চারিদিকে শুধু ছড়ানো—ছেটানো বিষাদ অশ্রু, অহংকার আর তঞ্চকতার মাঝে  
ঘিরে ফেলা নৈরাশ্য, লুটিয়ে থাকে পথের ধারে ধারে,
কৌতূহলী মানুষগুলোর চোখে মুখে ফিরে ফিরে বেড়ায় উন্মত্ত লালসা,
ছোট ছোট পা নিয়ে যখন সে একটু একটু করে,
এসবের মধ্যে দিয়ে— 
এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে, 
ঠিক তখনই— 
এক উন্মত্ত নগরসভ্যতা নখ-দাঁত বের করে তাকে গিলে খেতে আসে,
ছেলেটা ভাবে এখন সে কীভাবে বাড়ি যাবে?
ওর জন্যে আমার ঠিক তখনই হঠাৎ বড় কষ্ট হয়!

সরল স্বীকারোক্তি

একবার তাকিয়ে দ্যাখো আমার দিকে,
আমার দুই চোখের দিকে, 
কালো, কুতকুতে দুটো চোখ;
যারা শুধু অতর্কিতে শিকারীর হাসি হাসে,
যারা সহ্য করতে পারে না, শূন্যতা
গভীর তমসা ভেদ করে, 
যারা শুধু স্বপ্নকে খুঁজে আনতে জানে।

একবার ছুঁয়ে দেখো আমার দুই হিমশীতল করতল
যারা নিত্যদিন ছক ভাঙার খেলায় অভ্যস্ত,
যারা তোমার জন্যে, 
মাঝরাতে হারিয়ে ফেলে কবিতার ভাষা।
সুদূর দিগন্তের হাতছানি,
উপেক্ষা করে, 
যারা শুধু তোমার জন্যে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন বুনে চলে। 

একবার আমাকে শুধু ছুঁয়ে দেখো,
চেয়ে দেখো আমার দিকে,
আমার থেকে যদি চুরি করে নিতে পারো
আমার সবকিছু,
যা কিছু তোমায় দিতে পারি।
আমার চোখে যা কিছু রোজ অদেখা থাকে,
তারা দিনের শেষে তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তে চায়, নতজানু হয়;
তবুও আমার দৃষ্টি’রা শুধু তোমার দিকেই সর্বদা সত্যবদ্ধ,
চোখের তলায় পুরু কালি জমে,
আমার দেখা শেষ হয় না,
তোমাকে, তোমার অজান্তেই, তোমার থেকে আমি শিকার করে আনি,
আমার মধ্যরাতের স্বপ্নে তাই মিশে থাকে, তোমার অন্তরের লাবণ্য।


অনির্বাণ চৌধুরী কবি। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।

menu
menu