গুচ্ছ কবিতা ।। আজফার আজিজ

বিন্দু থেকে বিশ্বে

ভাঙতে, ভাঙতে, ভাঙতে, ভাঙতে
আমার আর ভাঙার কিছু নেই,
ভাঙনের অতীত আমি আজ,
নিছক বিন্দুমাত্র,
এখন তবে গড়ার পালা শুরু।
অযুত জীবনব্যাপী
ভাঙা-গড়া খেলতে-খেলতে জেনে গেছি
বিন্দুই আকাশ হয়,
বিন্দুই বৃত্ত হয়,
কেন্দ্র গোলক হয় যেভাবে।
একমাত্রিক বিন্দুতে শুরু, মহাবিশ্বে শেষ।
আমার সে বিশ্বরূপ দেখব বলে  
আজও বেঁচে আছি,
গড়ে যাচ্ছি গোলকসমূহ
বিশ্বরূপ গঠন অবধি।

একটি গল্প 

আমার ভেতর দিয়ে,
এই দেহ ভেদ করে
অবিরাম বয়ে যাচ্ছে কাল।
একটি গল্প লিখছে সে,
সাদামাটা, কিন্তু একটু ভিন্ন।

গল্পের গম্বুজের নিচে শুয়ে
নিঃসঙ্গ এক শিশু,
থুড়ি, শিশু নয়, আমিই স্বয়ং
সবুজ চাদর গায়ে শুয়ে আছি
খাঁজা খিজিরের পথ চেয়ে।

তিনি এলে সুতীব্র হ্রেষায় 
এই নীলাভ কাঁচের ডোম 
চৃর্ণবিচূর্ণ করে দেবে
তার বাহন ইউনিকর্ন।
ভাঙা কাঁচের স্তূপে ঢাকা
এই কৃশ দেহ, রক্তাক্ত, একা
পড়ে থাকবে।

রাত হলে, চাঁদ উঠলে,
গোড়ালি-ছোঁয়া শাদা আলখাল্লা পড়ে 
আসবেন সেবিকারা,
অঞ্জলি পেতে ধরবেন
সন্তান হারানোর শোকে চাঁদের কান্না।
সেই অশ্রু কোমল, শীতল হাতে মেখে দেবেন সেবিকারা
আমার সর্বাঙ্গে।
আমি এক জীবনের জন্য ঘুমিয়ে যাব।
ঘুম ভাঙবে এক ডলফিনের কোলে।

এই গল্পটাই লিখছে মহাকাল।

ডাক 

ঝিঁঝিঁর ডাকে 
অন্ধকার আরও ঘন হয়,
জোনাকির আলোয় তবু আলপথে দিব্যি হাঁটা যায়।
মাঝেমাঝে পা হড়কে
মাটিতে গড়িয়ে পড়ি,
উঠে আবার চলি।
কেননা, সূর্য ওঠার আগে,
শুকতারা আকাশে থাকতে,
দেখা করার তলব পাঠিয়েছেন মালিক।
তিনি বিচারাচারও করেন।
তাছাড়া, দীর্ঘকাল তার সাথে দেখা-সাক্ষাত নাই।
তার কথা সব ভুলে গেছি।
তবু তাকে দেখার জন্য
কেন এত  প্রাণ উচাটন।
হাঁটি আর আকাশ দেখি;
আকাশ দেখি আর হাঁটি।
এমন সুযোগ কি আর পাব?

দক্ষযজ্ঞ

হে নারী,
আমি তোমার দেহ
দু'হাতে মাথার উপর তুলে 
নেচেছি তাণ্ডব।
তবু মাটিকে দেইনি, 
আগুনকেও না;
কিন্তু, পুঁজিবাদ
তোমায় ঠিকই নিয়ে গেল
তারকারাজ্যে, বিজ্ঞাপনে,
পেশা ও প্রতিযোগিতায়।

তুমি ভালো আছ?
তুমি মাথা নেড়ে সায় দিলে বলে 
আজো পুঁজিবাদ  চলছে।
তুমি মাথা নেড়ে সায় দিলে বলে 
প্রেম গিয়েছে বিশ্বব্যাংকের ভল্টে।
তুমি মাথা নেড়ে  সায় দিলে বলে
আজো দক্ষযজ্ঞ চলছে।
হয়তোবা এই ভালো।
কিন্তু, আমার জন্য নয়।

অপরিচিত 

আমার ডান হাতটা ভুলে
বাম হাতকে ঝুঁয়ে দিলেই শক খাই,
সারাদেহ থরথর কেঁপে ওঠে ।
যে আমাকে স্পর্শ করল তাকে কি আমি চিনি?
নাতো। 
আমি আমার অপরিচিত।
আমি নিজেকে চিনি না,
তাকে চিনব কীভাবে?
সে আমায় না শেখালে,
প্রেমের আগুনে না পোড়ালে,
আমি পৃথিবীর অজ্ঞতম লোকটাই রয়ে যাব।
আমার বাম হাতটা ভুলে
 ডান হাতটাকে ছুঁয়ে দিলে কিন্তু
বেশ বুঝতে পারি এটা আমি।
সেও আমি,
সে ডোম্বিনী, সহজ সুন্দরী,
সে যখন আসে
অকালবসন্ত হয়,
আমিগুলি হাসে।


আজফার আজিজ, কবি ও কথাশিল্পী, কুমিল্লা

menu
menu