ভুল সাইরেন বেজে ওঠে

(পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
—জীবনানন্দ দাশ

আনোয়ার কামাল আশির দশক থেকে নিরলসভাবে কবিতা নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর কবিতায় প্রেম, দ্রোহ, মাটি আর মানুষের এক ধরনের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।ভুল সাইরেন বেজে ওঠে  কাব্যের অধিকাংশ কবিতা করোনাকালীন সময়কে ধারণ করে লেখা হয়েছে। কবি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আশা করি  আলোচ্য কাব্যের ৫টি কবিতা ঘুংঘুর-এর পাঠকদের ভালো লাগবে।) 

ভুল সাইরেন বেজে ওঠে

অবরুদ্ধ নগরীতে নীরব কান্নার রোল
নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বসে আছি
বিপন্ন সময়—বিপন্ন মানবতা। 

মৃত্যুর ভূতুড়ে হাতছানি দরজায় দাঁড়িয়ে
বলির পাঠার মতো কাতার বন্দি মানুষ
জীবনের মূল্য যেন তুচ্ছ।

ভুল সাইরেন বেজে ওঠে অসময়ে 
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা—অদৃশ্য জীবাণু ধেয়ে আসে
গাঢ় বেদনায়—ঘোর অমানিশা তাড়া করে।

আমি নির্বাক চেয়ে থাকি; মগজে ঘূর্ণি তোলে
ভুল সাইরেন বেজে ওঠে, কেবলই ভুল...
অস্তিত্বচেতনায় আকীর্ণ এ কোন জন্মান্ধ অন্ধকার!

আত্মবিস্মৃতির নির্বাণ

রবির উত্তাপ নিয়ে এখনো বেঁচে আছি
অগ্নির তাপদাহে বাষ্প নিয়ে বেঁচে আছি
করোনা সুন্দরীর আলিঙ্গন থেকে পালিয়ে
ক্ষারে জারিত হচ্ছি প্রতিক্ষণ প্রতিনিয়ত।

নিজেকে নিজের কাছেই আড়াল করি
মুখোশের অন্তরালে ঢেলে দেই গরল বিশ্বাস
প্রিয়তমার হাঁচি-কাশি আড় চোখে দেখি
সন্দেহের দাবানল চিড় ধরায় মায়াবী বন্ধনে।

এ আমার নষ্ট চেতানায় নতুন অবয়বে বাঁচার আকুতি
স্বপ্নের সব আধার কেন যেন উবে যায় মুহূর্তে 
আপনজন অচেনা হয়ে যায়—নিজেকে গুটিয়ে নেই
আত্মবিস্মৃতির নির্বাণে মানুষ থেকে বেরিয়ে যাই।

সময় এখন

সময় এখন প্রকৃতিময়—মানুষ অন্তর্মুখী
বৃক্ষপল্লবে শুনতে পাই পাখির কলরব
মানুষ এখন বড্ড অসহায়—খুঁজছে
আপন নিলয়—খানিক শান্তির বারতা

কিছু মানুষ ফেরি করছে মানবিকতা
কিছু মানুষ ঘোরের নেশায় ফেরে—
পথের পাথে রুগ্ন কিছু মানুষ খুঁজে ফেরে
বাঁচার নিদেন দিশা
আমরা এখনও মানবিক

বৈশ্বিক মহামারী তাড়িয়ে বেড়ায় অদৃশ্য অণুবীজ—
তাড়া খেয়ে মানুষ পথহারা—
কেবল পথের দিশা খুঁজে ফেরে।

ঈর্ষা

ঈর্ষার অনলে ভূমি পুড়ে সর্বনাশ
মাটির শরীর যেন কমলা রোদ্দুর
মনের গহীন স্বপ্নে নীল রাত্রিবাস
নিজের অপারগতা এক সমুদ্দুর

নিজ নাক কেটে পরের যাত্রা সরাও
এ কেবল ব্যর্থ অভিমান খেলো হোলী
মনের অনলে গোপনে নিজেকে দাও
বোশেখের ঝরা পালকের পদাবলি

মানবিক পৃথিবীর সোনালি আকাশ
ঝরে পড়া ভাবনা অস্ফূট পুনর্বার
ভালোবাসা মেদুরতা ছড়ায় সুবাস
ভাবনায় জমে থাকে গাঢ় অন্ধকার

যতটা রেখেছো সঞ্চয়ে সব আগুন
এলোকেশী বেশে বারবার করো খুন।

এবাদত

কবিতা লেখাই আমার এবাদত।

আমি একটি কবিতা লিখলেই  
আমার এক ওয়াক্ত এবাদত হয়ে যায়—
আমি একটি কবিতার জন্য
এক ওয়াক্ত এবাদতের জন্য
        নিসর্গ নিমগ্ন থাকি—

আমার মানসলোকে বহুকৌণিক আলো
            বিচ্ছুরিত হয়
ধ্যানে কবিতার পঙ্ক্তিমালায় তসবি জপি
আমি যতই ধ্যানস্থ হই—ঈশ্বর প্রেমে মজি 
কবিতার সরস বাক্যে ঊষর মাটি সুধাময় হয়
আমি ধ্যানস্থ হই আর কবিতায় তসবি জপি।

ঈশ্বর ধ্যানে প্রকৃতি যুক্ত হয়, প্রেম যুক্ত হয়
প্রেমের রসায়নে আমি সিক্ত হই, ভুলে যাই
জাগতিক চারপাশ; আমি আমাতে লীন হয়ে যাই।


আনোয়ার কামাল, কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সম্পাদক (এবং মানুষ), ঢাকা

menu
menu