গুচ্ছ কবিতা ।। যিশু মুহাম্মদ
শিষ কেটে যায় শব্দঘূর্ণি
জ্বেলেছি নিশীথ বিদ্যুন্ময়
স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে সকল
আমার ভেতর তোমার জয়
খুঁড়ে যাও যত গূঢ়তম
ছলকে উঠে বাঁশির সুর
যোগ বিয়োগে ফেরে ঋতু
মেলে ধর যাব অনেক দূর
শান্ত তুলট মেঘ বয়ে যাক
মাথার ভেতর চন্দ্রাভায়
ঝরে পড় মন মর্মমূলে
নিঃশোকে উড়ো বর্ণময়
খুঁটে খাও উসখুস পাঁজর
পায়রার মত চক্রবাক
খুলে ফেল তাবৎ সম্ভ্রম
ডানা মেলে দাও শূন্যে পাক
ধেয়ে আসে দিন অশ্বারূঢ়
মাল্য দিলাম ফুলের রাশ
কথারা নয় শুধুই সংকেত
মেঘে ঘনায় আষাঢ় মাস।
২
তুমি জাগো, আওয়াজ করো না কোন
তুমি দেখো, নৃত্যের তালে ঝরে আলো
হলো ভোর, অচেনা গ্রহগ্রাম চলে যাব
মনে কর, স্বর্গ সভ্যতা পেরিয়ে অনন্ত।
ধরে ফণা, ফুঁসে উঠে মরমে জলকণা
যেন ঢেউ, ভেঙে দিয়ে ক্ষীণ চন্দ্রোদয়
নিয়ে যাবে, অন্তর্দেশে নীলিমার নীলে
গূঢ় রন্ধ্রে, নেচে উঠ অন্ধ বিরল ছন্দে।
রচে দ্বিধা, জীবনের মত ক্লান্ত মনীষা
বেলা নামে, বোবা আশ্চর্য মুখমণ্ডলে
জাগে চন্দ্র, আজও দীর্ঘ নির্ঘুম চোখে
স্বপ্ন ব্যেপে, অফুরান দাগ লেগে রয়।
বলো কথা, বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে
জমে উঠা, উপমার ঝড়ে জলস্রোতে
বেঁচে থাকা, দৃঢ় অলঙ্ঘ্য দেয়াল তুলে
ভুলে গেছি, কবে ভালোবেসেছি তাকে।
আছ পড়ে, জ্যোৎস্নার মতো কিছু চিঠি
মুঠে তুলে, বুকের কোটরে পুরে রাখি
দেহ দস্যু, গাঁথে ক্ষুধার স্বরলিপি আদি
ছোটে তীর, বিঁধে রাখে দণ্ডে একাকী।
ফুটে আলো, আয়ু ধুলোয় লিখি আত্ম
ডাকি দ্রোহে, গিঁট খুলে জলে সাঁতরে
নেমে যাব, সহসা ভাসিনি কোন তলে
মৃত খণ্ড, চিরে ফর্ফর দেখি সব শূন্য।
৩
লোকে বোঝে না রহস্য
দাবি করবে লীলালাস্য
মিছে কথা প্রাণে পুষে।
বনিবনা হয় না আমার
সুরে জড়ানো চিৎকার
আদিম রক্ত প্রাণপণে।
চিরকাল গোঁয়ার আছি
তালি দিয়ে যুদ্ধে নাচি
বাঁধি গান বিস্ফোরণে।
বনের মানুষ বন্য ফণা
মনে ধরি তোমার কণা
মস্ত নিখিল নড়ে উঠে।
ভাঙবো ভঙ্গি মধুভাষে
ডাকছি বঁধূ টালমাটালে
মেঘাবৃত দিনের শেষে।
কব্জি ফুঁড়ে উড়ে পাখি
দাম হেঁকেছে অট্টহাসি
বেচাকেনার কলিকালে।
আয়না বাঁধা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য
জ্বেলে আলোকসামান্য
দেখছ কত বাজার ঘুরে।
হলো অনেক অভিজ্ঞতা
পণ্যমোড়া যৌনতেষ্টা
সর্বাঙ্গ ঘামছে বিভ্রমে।
জন্মাবধি সব কীর্তিনাশী
ইহলৌকিক চিহ্ন আঁকি
মাধুর্যধ্যান ভেঙ্গে দিলে।
হলে তুমি শিবতরঙ্গিনী
উলটে দেব দুনিয়াদারি
সইব কেবল ভালোবেসে।
গাছের পাতা গহনা হবে
দুলে উঠবে গাঢ় প্রণয়ে
বাজিকর পড়বে দ্বন্দ্বে।
যতনে রেখো এই লেখ্য
লোকে না বুঝুক রহস্য
স্মৃতি উচাটন অলক্ষ্যে।
৪
নোভা নভোযান
আমি নমঃপ্রাণ, ভীত,
এত ঊন, প্রণত
তোমার পায়ের কাছে
শুয়ে দিগন্ত, নাচে
স্বপ্ন সকাতরে
চণ্ড আলিঙ্গনে, রণ,
ছুঁড়ে শর, সাঁতার
বাতাস ফুঁসেছে অন্ধ
দেহ অনন্ত, বাঁকে
ভূত ভবিতব্য
কাঁপে যথারীতি, ফুল্ল,
এলে সন্ধ্যা, সমস্ত
বাতাস তাড়িত চাঁদে
শব জীবন্ত, হাসে
ক্ষুধা ক্ষুরধার
তবু অশোকাভ, নীল,
ধরে গলা, দরজা
নিখিলে এসেছ নেমে
কুহু দুরন্ত, দিনে
নোভা নভোনীল
ডাকি দ্বিধাহীন, নগ্ন,
যত শূন্য, অনন্য
আমার মুঠোয় উড়ে
ফুটে বসন্ত, প্রাণে
জীবনানন্দকে
অ আ করি। অক্ষরগুলো সব মরে যায় যদি, ভয়ে আছি
ধূসর পাণ্ডুলিপি সে তো পুরাতন হয়েছে ঢের এবার,
লিপিকুশলে হৃদয়ের অসুখের কথা কে আর লিখবে ভেবে
রাত জেগে কবি আঙুলে মাখায় রক্ত, লেখে সুপ্রিয় চিঠি।
শব্দ খুড়লেই বেদনার সুরে বাজে ভাবনার অবলেশ
কবেকার, কতদিন আগেকার হাড়কঙ্কাল মনে নেই,
কামনা বাসনার পাখি ধানসিঁড়ি জলের ধারে অগণন
সকলেই জানে আকণ্ঠ মরণে ডুবে প্রেম, সে তো বন্ধন।
ভেতরের আধো পায়চারি লোকের সামনে কি করে আনি
বাক্যের দীনতা নিয়ে কতদূর কে হেঁটে যায় যথারীতি,
হাজার বছর একি পথ ধরে ঊষা থেকে রক্তিম বিকেলে
প্রেম অপ্রেমে বয়স বেড়েছে ফের পৃথিবীর নরনারীদের।
মাঝে মাঝে মনে হয় মৃদু হেসে যে পরিচয় প্রেয়সীর পাশে
হৃদয়ের ছায়ার সাথে চালাকি না করে রচি বিশ্রুতি,
ভুলে গেছি, স্মরণে রেখেছি যত ইতিহাসবোধ এ জীবনে
চিৎ হয়ে লাশকাটা ঘরে শুয়ে শুয়ে সব বলি জীবনানন্দকে।
কালপুরুষ
কালপুরুষের খড়ম ভেজা রক্ত আমার আঙুর গায়ের
ভাবছি এবার গর্ভে ঢুকে চোখ বুজে ঘুম লৌহ লালায়
দেখব না ক্ষত কোষের খাদে জিহ্বানালি রতি চাটে
ভ্রুণের ভেতর ছালচামড়া সমেত, দুধের শিশু বাড়ে।
পুনশ্চ এক দিনের শেষে আত্মতলায় জাদুকথার পাখি
উবু হয়ে ঘুমের ভেতর শিশুর মত জীবন জাপটে ধরি
মৃতের আভা সঙ্গে নিয়ে সারা রাত্রি শোয়ে ছিলাম চিতায়
নিজের ভস্ম নিজে ছিটাই রক্তবীজে সার হয়ে যাই ফের।
ফিরে এসে সেই জখমে শব শব্দের এই নগরে ঘুমাই
ঘাঁড়ের ভাঁজে লালচে চুমু পিঠের রেখায় খামচি তোমার
ফিরতি পথে কিরা কাটি বঙ্গলিপি ছুঁয়ে ছেনে সাজাই
কালগহ্বরে মরবে দেহ তবু প্রেমেই পড়বো তোমার।
স্ববিরোধী এই কথার যুগে দ্রুত বেগে যাচ্ছে ছুটে ট্রেন
সবাই পালায় যে যার দিকে সাক্ষী সাবুদ আছে প্রেম
হাত পেতে ওই দাঁড়ায় সময় টলে কালপুরুষের শরীর
জড়ো করবো গূঢ় রক্তমাটি নুন, ফসকাবে না তিতির।
• কবি ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ।