গুচ্ছ কবিতা ।। সোহেল হাসান গালিব

অনঙ্গ রূপের দেশে

সুচ এক, সুতো ছাড়া, যুবতীর আঙুলে সে নাচে; 
খেলে যায় ডুব-সাঁতারের খেলা—কাঁথার সমুদ্রে—সারাদিন।

পৃথিবীতে কিছু ফুটল না ফুল, যত্নে তবু আঁকা হলো; 
রাতের অরোরা-চিত্র 
বুঝল না কেউ।

আমি সুতো, গুটলি পাকানো, কেবলই গড়িয়ে যাই—
যদিও জড়াতে চাই, পড়ি গিয়ে জলে। দেখি ঢেউ
অর্থহীন আদিম উল্লাস। 
সে উল্লাসে নারীরা প্রহার ভোলে, পুরুষও ছলনা।

শিখার কবলে পড়ে তাই পুড়ে গেল বায়ু, আগুনেরও আয়ু
ফুরালো কি হাওয়ার ছোবলে? শেষ হলো দাবানল...

কখন ডানার ভস্ম ছেয়ে যায় আকাশদুপুর

বিষণ্ন ব্যাধের বুকে, চেয়ে দ্যাখো পাখি, 
বিঁধেছে এ কোন ব্যাসকূট? 
মর্ম-পরিযায়ী তুমি, ধুপছায়াজয়ী—
পায়ে তবুখড়ের নূপুর।
 
জপমন্ত্র

যে নাম তোমার ওই রুদ্রাক্ষমালায় একদিন
দুলে উঠেছিল, ঘাসবীজ থেকে তুলে এনে
সেই নাম আমি লিখে রেখেছি হাড়ের
শাদা মারবেলে।

—ফুল ফোটাবার আগে, হে পবনদেব, 
বৃক্ষ কি তোমার বুকে হাত ফেলে
এইসব বলেছিল?

পাখিদের সাক্ষী না রেখেই 
পৃথিবীতে কত মনুমেন্টের আড়ালে
কতজনের গান তো সাঙ্গ হলো।

সেসব গানের স্বরলিপি 
বনের ভেতর বনে 
একাকী লুকিয়ে থাকা ঐ যোদ্ধাটির মতো—

সে জানেই না, যুদ্ধ কবে শেষ হয়ে গেছে।
 
সসেমিরা

নিজেকে বইতে না পেরে বট, মাটিতে নামায় ঝুরি—
নতুন একটি কাণ্ডে সে চায় দাঁড়াতে।
যে হাত সহসা থেমে, নেমে আসে হাতে
তাকে প্রশ্ন ক’রো না; প্রশ্নটি নয় তেমন জরুরি।

ছুঁয়ে দ্যাখো, ছুঁলেই তো ফেটে যাবে দোপাটির ফল—
অপেক্ষার গোপন বেদনা।
মনে হবে এ সবই সাজানো, শুধু চমকে দেবার ছল;
হয়তো বুঝবে, হয়তো না।

তারপরও সাহসে কুলালে
কাঁটাঝোপ পার হয়ে বনফুল তুলে নিয়ো।

নীলে ডোবা তুলি এনে হলুদে বুলালে
কী করে সবুজ হয়, বুঝি নি আমিও।

বোবা

পাহাড়ের পাশে কেউ ফেলে গেছে একটি সবুজ
রাফখাতা—শিশুদের বাক্যরচনার—খুব গাঢ়
লাল টিক দিয়ে তাতে ফুটেছে অনামা কিছু ফুল।

সে ফুলের পাশে পড়ে আছে কারো—একটি অবুঝ
বোবা দেহ—কাদামাখা শাদা শার্ট—রক্তলাগা
ক্রস-চিহ্নে তবু লেখা : ‘ভুল নয়, পাপের মাশুল’।

পাখিদের ঠোঁট থেকে খসে পড়া শব্দেরা গড়ায়—
ধুতুরা ফলের কানে গিয়ে বলে, বলে খুব আস্তে :
এ বাতাস কিন্তু চেয়েছিল ফুলেদের রঙে সাজতে। 

চেয়েছিল দুপুরের কোনো সাইকেল-আরোহীর পিছে
যেতে যেতে বনের ভিতর—খুঁজে নেবে ডাকঘর—
পড়ে নেবে পৃথিবীর ভাষা ডাকটিকেটের নিচে।

নির্জনতা তবুও সুদূর গ্রহ—রাত্রি-সীমানায়—
পরিত্যক্ত গ্যালাক্সির এক প্রান্তে ঘুরপাক খায়;
তাতে সূর্য নেই, আছে বাক-স্বাধীনতা, সুগম্ভীর—

সেই বাক বধিরের জন্য শুধু—কেউ না জানুক
আমরা তো জানি। জানি, কাকে বলে অভয়-বাগ্মিতা,
কাকে বলে বাগীশ্বর—ব্রজবুলিগান—বৈষ্ণবীর।


• কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ। 

menu
menu