গুচ্ছ কবিতা ।। কামরুল হাসান

লোকালয়ের কবিতা

প্রত্যহ রমণপ্রিয় পিতাদের সাথে অনিচ্ছুক মাতাদের শোয়া,
তাতে অবাক মিছিল ধরে চলে আসে অপূর্ব শিশুরা;
অমন কাণ্ড থেকে এত আশ্চর্য স্বর্ণচ্ছটা ছোটে?
কোথা থেকে আসে ওরা, রমণেগমনপ্রিয় পিতাদের ক্ষণিক বিলাসে
আর মাতাদের কাষ্ঠদেহ, কাষ্ঠশয্যাপাত
ভেতরে নবীন পাতা, বিস্তারিত সবুজের অঢেল আন্দোলন
সেখাইে ফোটে কুঁড়ি? আগ্রাসী ভ্রমরবীর্যদল আসে ঝাঁকে ঝাঁকে—
ইংলিশ চ্যানেল, আমাজান বা বাংলার ভরা যমুনায়,
পড়িমড়ি সাঁতারের শেষে অনেকে পথশ্রান্ত, বহুজন ডুবে যান জলে
কেবল বিজয়ী যিনি চলে আসেন পতাকা উড়িয়ে,
মাতৃপ্রান্তরের শ্রান্ত সেনাদল, তখন তাঁকিয়ে দেখি
আরে, এ যে আশ্চর্য অনল!

শহর দখলের পূর্বলেখ

বাঁধরাস্তা থেকে নেমে গেল চারজন গ্রামমুখো মানুষ
মিয়ানো আলোর ভেতর তাদের তেরচা শরীর
সুস্পষ্ট বাঁকালো
দূরে কুয়াশা আর তোরসা একাকার।

বালি, ঘাস আর মাটির জুড়নে যে মাঠ
তারা সেই মাঠের ভেতরে গিয়ে নামে,
একটি সরলরেখায় দাঁড়ায়।

অস্পষ্টতার ভেতর বিলীন সাদা পথ,
ওরা সেই পথের শরীরে নামে, সাদা ও সরল।

কয়েকটি স্থির বাতি-খেয়াঘাট;
একটি চলমান আলো-নৌকা;
ওরা কি পেরুচ্ছে সেই নদীর উঠোন?

এইমাত্র নেমে গেল কারা ওরা গ্রামের জমজ?
কাল কাকভোরে মাঠ হতে কেটে নেবে অঘ্রাণের ধান,
স্বরমণীর উত্তাপের ভেতর চলে গেল চারজন যুবক,
সন্তানের করতাল কোলাহলে আপ্লত চারজন জনক।

ওরা কি আসবে ফিরে এই শহরে আবার?
`আসব তোমাদের শহর দখলে,’ —বলে গেল 
গ্রামের চারজন দৃপ্ত কৃষক!

অতীন্দ্রিয় আলোর ভেতর

আলোর পুকুরে দেখি পাখিদের মরাল সাঁতার
আকন্দ ফুলের কাছে ধরা-পড়া বর্ষা কাঁচুমাচু;
বনভূমে স্পষ্ট ঘ্রাণময় হাওয়া, যেন লম্ফমান চিতা,
তেমন ঘোষণা নেই তবু পরী মাটিতে নেমেছে,
হেলেঞ্চা শাকের বনে দ্যুতিময় আলোর ফরাশ
ফর্সা মুখ নিয়ে নিয়ে ঘোরে আর জাগায় বাবুই,
মেঘলোক মন্দ্রিত সুই স্বর্ণের তন্তু দিয়ে বোনে
ঈশ্বরের নিজ গৃহ, আমি তাতে কী করে থাকি?
উপরন্তু উদ্ধারও প্রয়োজন, পথে পথে হাঁটি বাস্তুময়...

বিপ্লবীর মৃত্যু

বাহুডোরে বাঁধা পড়বার আগে তাঁর মুঠি ছিল আকাশে উত্তোলিত। আক্রমণটা এমন আচম্বিত যে, তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। পূর্বে তাঁর বিক্ষুব্ধ চীৎকারের বাতাসের কানে তালা লেগে যেত, শোষকের প্রাসাদ হয়তো নড়ত না, তবে তরুণদের ভেতর নড়ে উঠত বোধ, নিজে তেজী ছিলেন, তেজ জাগাতে তার বাক্যবিন্যাস ছিল প্রতিভাপূর্ণ!

আজ তাঁর গলা থেকে কণ্ঠস্বরকে চুরি করে নিয়ে গেছে। সহস্র পুলিশের বেষ্টনী যিনি ঝড়ের দাপটে অতিক্রম করে যেতেন, তিনি আজ একটি নরম বেষ্টনী ছিঁড়ে যেতে পারছেন না। তিনি জানতেন না এদের শক্তি, অন্তঃস্থ বৃত্তের পরিসীমা। সুখে, সঙ্গমে, সন্তানে কি ছিল মহাকর্ষ বাঁধা।

বাহুডোরে বাঁধা পড়বার আগে তিনি পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন দেখতেন। আক্রমণটা এতই অভাবিত যে তিনি টেরই পেলেন না কখন পরাস্ত হলেন, কখন মুঠি খুলে গেছে, গলা  থেকে নেমে গেছে স্বর।

ঈশ্বরগৃহ যাত্রা

প্রকৃত নোংরা এই সিঁড়ি, ঈশ্বরের কাছে আমি কিভাবে পৌঁছাই?
তিনি থাকেন উপরতলায়, এতটা উপরে যে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে
ক্রমাগত সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ঊর্ধ্বাকাশে চেয়ে দেখি
শূন্যদানের উপরে বাতাস
আরো ঝুলন্ত, আরো শূন্য, অমানিশা গিরিশৃঙ্গ যত উঠে পড়ি
ঈশ্বর ততই উপরে, উপরন্তু নোংরা রয়েছে সিঁড়ি;
যাবতীয় ভাষণের পাণ্ডুলিপি খসে খসে পড়ে
যাবতীয় মন্ত্রশ্লোক ষড়যন্ত্রধ্বনি
যতই বাতাসে ভাসে যতই আকাশের দিকে উঠে যায় সিঁড়ি
ততই দূরত্ব বাড়ে, একে আমি কিভাবে ভ্রমণ বলি
বলি ঈশ্বরগৃহযাত্রা?
অন্ধসমুদ্র সেঁচে আমি কোন ঈশ্বরের প্রাণভোমরাকে পাব?
রচিত গ্রন্থের পৃষ্ঠা পৃষ্ঠাময় অঙ্কিত বনভূমি গিরিশৃঙ্গদল
কেবলি নোয়ায় শির, অত্যুজ্জ্বল ঐক্য ধরে রাখে,
তাদের কপাট খুলে নিরাকার নিভূমে নেমেছে।
এখানে পাতাল সিঁড়ি অন্তহীন পত্রঢাকা পথ
আত্মার ভেতর থেকে অবিরল অজস্র আত্মা ছুঁড়ে দেয়,
এমন জঞ্জাল ঠেলে কবে আমি ঈশ্বরের নিকটে পৌঁছাব?
আর নোংরা রয়েছে সিঁড়ি, রচিত অক্ষরের ধাঁধা।

সাবান

ঈর্ষা করি ওকে। যেসব অঞ্চলে ও ঘোরে
রীতিমতো ঈর্ষণীয়, আর দেখ কী বিভঙ্গে দ্রবীভূত
গলে গলে ঝকমকে করে তোলে ডাগর যৌবন
যুবতীর মৃত্যুইচ্ছা, লব্ধঋতু যেভাবে সে ধোয়!

উদ্বাহু উপবস্তুর দিকে চলে গেছি সাবান ঘুরেছে
পথে পথে, ধৌতইচ্ছার দিকে পয়মন্ত পৃথিবী ছেড়ে
উদ্বাস্তু শিবিরের পথে সাবান মরেছে মাথা কুটে,
অশৌচ গন্ধময় মানুষের কাতার বেড়েছে।

শত বগলের স্বেদবিন্দু মুক্তো গৌরব
রৌদ্ররশ্মির ভেঙে পড়া গোলকের দেহে
সাবান স্ফুরিত বালকের যৌথ চক্করে আর
ফুঁয়ে ফুঁয়ে উড়ে গেছে বালিকা ডানায়।

বিপুল গন্ধ মেলে ছিল বিস্তারিত মেঘে
পৃথিবীর পাহাড়েরা গাত্র খুলে রাখে
অঝোর শাওয়ার ঐ শ্রাবণের স্নানে
দেখেছি বিদ্যুতের হাতে ঈশ্বরীর তপ্ত সাবান।

শাদা অ্যাপ্রন সুভদ্র করিডোরে

শাদা অ্যাপ্রন সুভদ্র করিডোরে আর্তধ্বনি তোল
বিষম খেয়েছে বালক, বালকের লাজুক জিজ্ঞাসা
শুশ্রূষা তোমাতে বাহিত, প্রতিপ্রায় প্রবাহিত খোল
পরাহত করে আজো যে বাক্যের তুমুল মণীষা।

ধুন্ধুমার লেগে যায় সেবা, মুগ্ধ সেবার স্নিগ্ধতা
পরাগ লেগেছে বুঝি দাগকাটা শিশির অতলে
এ অবোধ্য সিঁড়িঘরে শব্দ তোলে কে, কবিতা?
হাইহিল ছন্দঢেউ বাতাসের পূর্ণ চাতালে।

অনুরাগে বিদ্ধবাহু, আরো কিছু সূঁচের নমিতি
রেখে যেও তেতো স্বাদ, পুরো দাগ, ঠিক ঠিক খাবো
অরূপ রাতের দাঁত প্রায়ান্ধ জন্মের জ্যামিতি
তুমিই শেখালে সব, অনুস্বাদ দীর্ঘদিন পাবো।

কল্পপ্রায়, তুমুল ইচ্ছার সাথে কেঁদে ওঠে প্রাণও
শাদা অ্যাপ্রন, শাদা অ্যাপ্রন, কান্না তুলে আনো।

স্থির প্রতিবেশে

প্রভাতে দেখি অবিকল অক্ষত রয়েছে
সঠিক দূরত্বে নীনাদের বাড়ি, মহাজাগতিক টানে
চলে যায়নি, এলোমেলো পথগুলো পুরনো সম্পর্ক
খুব ধরে রাখে, বাড়িদের হাত সতর্ক ধরে রাখে— 
যেন জল পারাপার করে দেবে, দলবদ্ধ বাড়িদের
মৈত্রীবিন্যাস প্রাচীন গন্ধবাহী, কারুকার্যময়

বহুদূর চলে যাই বিধিধ পোতাশ্রয়ে
পৃথিবীর নীল জল বুকে ঠেলে ঠেলে
দক্ষিণ মেরুর জানু আফ্রিকার গোড়ালি ঘেঁষে
দূর-দূরান্তে ভাসি বহুমুখী স্রোতের মুদ্রায়
মাতাল উটের মতো নৃত্যপর ঘূর্ণমান পৃথিবীর পিঠে।

চলে যাই, তবু ঠিক ফিরে আসি নিজস্ব বলয়ে
মুখস্ত প্রতিবেশে জানি সম্পর্কের মৈত্রীমমতা
আশ্চর্য ধরে রেখেছে বাহু, সতর্ক ধরে রাখে, আর
আশ্বস্ত করে রাখে নির্মাণের কাঠামোভীরুতা।

ঘুমুতে যাবার আগে জানি নীনাদের বাড়ি
আশ্চর্য খুঁজে পাবো প্রভাতে আবার,
মাধবীকুঞ্জের নিচে, হেলানো বারান্দা সমেত।

নম্রফাঁদ এখনি এনোনা

এসব জীবনের ব্যগ্র আয়োজন মৃত্যুকে মুখভঙ্গী করে
বলে, যাও, পিছু পিছু ঘুরো না, পরে এসো অবসরে
তোমার কালীর মূর্তি আঁধারের দিঘিতে ফুটিয়ে
নেব সে পদচিহ্ন ভূমিশয্যা পেতে
কান্নাভরপুর পথে, আমাকেও ওভাবে যেতে হবে...

এখন আনন্দদায়ী দশদিক উজ্জ্বল রেখেছে
ভূ-বসন্তে ডিগবাজী খাচ্ছে শালিক, গলা খুলে গেছে কোকিলের
শিশুর মিছিল দেখ কলহাস্যে ভরেছে নগর
এখন আশ্চর্য শিলা ঈশ্বরের মুখচ্ছবি ধরে।

এখন প্রসন্ন দিন সূর্যের সন্ততি বুকে বাড়ে
মহাপ্রস্তানের পথ থেকে দূরে
অবাক আনন্দলীলা সামান্য সরেছে
যোজন পৃথিবী থেকে দূরে, অতিউল্কা প্রয়াণের পথে।

এমনি অসময়ে কেন মৃত্যু নম্রফাঁদ পাতো
টেনে নাও যুবতীউজ্জ্বল খাটে, বিপুল ঈপ্সায়
মেঘদের কৃষ্ণসভায় ময়ূরের মতো নীল পরীরা নেমেছে
তোমার বিদ্যুৎফলা, বজ্ররথ এখনি এনো না...

যে দিকে আকাশ ভালো 

যে দিকে আকাশ ভালো, মধুছন্দ, কাঁপাকাঁপি নাই
চল আজ সেই দিকে যাই,
যেদিকে কুর্তাপরা মিনারের মহাআনচান
সেইদিকে গিয়া মোরা ভরিব পরাণ।

ভাসিব নিসর্গ নীলে, উপরন্তু বাতাসের দোলা
আমাদের কুর্তা সব খোলা,
সোমত্ত রাত্রির রতি উবু হয়ে আছে
আমরা মহানন্দে চড়িব গাছে গাছে।

আকাশযানে উড়িতে গিয়া বারংবার আছড়িয়া বিধি 
উহাদের অথৈ পরিধি,
পৃথিবী জুড়িয়া চলে মহাদেব, দেবীর তামাশা
আমাদের আশা আজ নিদারুণ মহান হতাশা।

যে দিকে সমুদ্র খোলা, ঢেউছন্দ, দিগন্ত অপার 
চল হই জলঘোড়ায় সওয়ার,
যেদিকে ঘাগড়ামেলা সখীদের মহাহুলস্থুল
সেইদিকে ডুব দিয়া ভেসে উঠি নদীর দুকূল।


• কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, ভ্রমণকাহিনি লেখক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ।

menu
menu