গুচ্ছ কবিতা ।। আনিস আহমেদ
উপেক্ষিত উৎপ্রেক্ষা
চকবাজার কিংবা চৌরঙ্গির ঐ চৌরাস্তার মোড়ের মতোই
কবিতার খাতা এখন খাঁ খাঁ করে শঙ্কিত এক শূন্যতায়
অন্তরপুরের গলি দিয়ে অন্তঃপুরে উঁকি দেয়
কখনও কখনও উপমা-উৎপ্রেক্ষাদের কেউ কেউ
কারফিউতে বেরিয়ে পড়া অবাধ্য কোন বালকের মতোই যেন
তারপর শিশুর মতোই লুকোয় মুখ, বিবেকি বিধানের আঁচলে।
পাছে কোন অণুজীব পরজীবী হয়ে বাসা বাঁধে
পুরোনো এক বটবৃক্ষের মগডালে
বোশেখি ঝড়ের আগেই যদি ঝরে পড়ে পাতারা সব
সেই শঙ্কায় উপমারা আর হাঁটে না কবিতার হাত ধরে
ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দেহ থেকে আত্মারা সব।
এখন কবিতা কেবল মরচে পড়া পুরোনো প্রাণহীন সংবাদ
সকালে যা শুনেছিলাম আমি, বিকেলে তারই শঙ্কার সংস্করণ।
আবৃত্তি নয়, পুনরাবৃত্তিতে দেহ ক্লান্ত যতটা, তারও অধিক মন।
সংক্রমণ কিংবা জীবাণু অথবা মহামারি শব্দদের পদচারণায়
তিক্ত-বিরক্ত আমি আজ, অ্যালার্জিতে হারায় এনার্জিরা সব।
মেসেঞ্জারে, মুঠোফোনে মুঠো মুঠো বার্তা ছড়ায় বন্ধুরা আমার
শুধু আসে নাতো চিত্ত হরণের চিত্রকল্প কোন কাছাকাছি
উৎপ্রেক্ষারা সব অপেক্ষায় থাকে, উপেক্ষায় উবে যায় সহসা
ট্র্যাফিকের আলো সবুজ হয় বটে, কবিতার পথ তবু শূন্য, সুনসান।
চেয়ো না এখন আর কোন কবিতা আমার কাছে
মনের কুঠুরিতে কবিতারা সব লকডাউন আছে।
অন্যরকম অণুজীব
জীবনের খেরো খাতা যতই ভরে প্রতিদিন
ততই শূন্য হয়ে যায় কবিতার খাতাগুলো
ফ্লয়েডের মতো যখনই নামি পথে আমি
বর্ণবাদের আশঙ্কায় বিবর্ণ হয় বিশ্ব আমার।
ভাইরাসের ভায়োলিনে বাজে করুণ সুর প্রতিদিন
এবং জীবনের আয়তন হয়ে যায় ক্রমশই ক্ষীণ ।
জীবন-মরণের এ দড়ি টানাটানির খেলায় দর্শক শুধু আমি
জীবনের জয়ে বাহ বাহ বলি, মরণের টানে নামে অশ্রু শুধু
পাপের ভারে পূণ্যরা কি সব হয়ে যাবে একেবারেই শূন্য
জীবন মাপেন মুদি দোকানির বাটখারায় ঈশ্বরও ইদানীং
আশ্চর্যতো এ পৃথিবীতে জন্ম দিলে কেন তবে আদিপিতা
পরজীবী কোন অণুজীবের ভয়ে জীবনটাইতো হয় বৃথা।
জীবাণুর কথা থাক না হয়, রোগের সংক্রমণতো দেখি সর্বত্রই
করুণা করেছে ফ্লয়েডকে করোনা , পুলিশ দেয়নি কোনই ছাড়
বৈষম্যের অণুজীবেরা আজকাল কেবল কালোদেরই মারে ছোবল
সংক্রমিত তারাই অঙ্গ কৃষ্ণ হবার অপরাধে যারা লঘু হয়ে যায় বারবার
রবি-কবি কেন জানি বলেছিলেন কোন একদিন এক কৃষ্ণকলির কথা
কৃষ্ণকলিরা যুগ যুগ ধরে পদপিষ্ট হয়ে যায়, রবিও জানেননি তাদের ব্যথা।
দুটো ব্যাধিরই লক্ষ্য অভিন্ন, জীবনের বিপরীতে, মরণের জয়গান গাওয়া
তবে বর্ণ বোঝে না করোনা কখনই, মানুষের মাঝেই শুধু বর্ণবাদ পাওয়া।
সাদা-কালো
বড়ই বিপন্ন আজ বিশ্বের তাবৎ কবিকুল
ভাবেননি তাঁরা কখনই
এমন মিথ্যের বেসাতি করছেন আজীবন তাঁরা
কবিতার ট্রেনে বসে ভালোবাসার গান গেয়েছেন অজস্র
জীবনের প্ল্যাটফর্মে দেখেননি ঘৃণার থুথু যত্র তত্র ছড়ানো।
সাপ ও সিঁড়ির লুডুতে কেবল সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নিয়েই ব্যস্ত
দেখেননি বিদ্বেষের সাপেরা কামড়ায় বর্ণ-বৈষম্যের বিষে।
ফ্রয়েডের তত্ত্বে হারায় ফ্লয়েডের নিঃশেষিত নিশ্বাসেরা হায়।
কালোদেরও জীবন জীবনই বটে
এমন শ্লোগান সোচ্চার হয়েছে ইতিহাসে যতবার
প্রয়োগের পরিহাসে হারিয়েছে তারও অধিকবার
ভালোবাসার কথা লিখেছেন কবিকুল ইনিবিনিয়ে বহুবার
শোকের শহরে পরেছেন তাঁরা কালো কালো পোশাক
কে করেছে হায় কালোকে শোকের প্রতীক, কষ্টের প্রতিভূ!
কালোরা কি হতে পারে না কখনই সাদা মনের মানুষ
সাদাদের মনে কি থাকে না কখনই কোন কালে কলুষ।
সাদা যদি হয়, সব রঙের সমন্বয় তবে কালো কেন পড়বে বাদ
কবিরা কেবল ভালোবাসার কথা বলেন, দেখেন নাতো বিসংবাদ।
অরিন্দমের অণুজীব অরণির জন্য
যন্ত্রণার যন্ত্ররা সব এতটাই সচল হবে কে জানতো
বিশেষত এখন যখন গোটা বিশ্বই স্থবির ও শান্ত
এখনতো নয় ঠোঁটে ঠোঁট রেখে পাখিয়ালী কুজন
দোতারায় সুর বাঁধা নয় এখন, এখনতো সকলে সুজন।
অরিন্দমের ভালোবাসা তবু মুষল ধারায় ঝরে, দিন যখন আষাঢ়স্য
এই দূর্বিপাকের দিনগুলোতে অরণি বোঝে না আদৌ এ সবের কোন রহস্য।
ভালোবাসার অণুজীবেরা কেমন করে বাঁধে বাসা বোঝে না আজও অরণি
বোঝেনি অতীতেও কখনো, আর এখনতো ভিন্ন জীবাণুতে কুপোকাত ধরণী।
মাঝে মাঝে অরিন্দম ভাবে কেন শূন্য হয়ে থাকে তার এ বিশ্ব
এতো শব্দরা বাঁধে বাসা হৃদয় জুড়ে তার, তবু কেন সে নিঃস্ব
খুঁজে পায় না অরণিকে সে কোথাও, নীরবে থাকে কবিতার ছন্দে
যতবার খোঁজে অরিন্দম তাকে, ততবারই হারায় সে এক ধন্ধে।
অরিন্দম অতএব থেকে যায় ভালোবাসার এক কল্পিত স্বর্গেই
নিত্যই জানি বসবাস তার অনুভূতির এক অনুজীবের সংসর্গেই।
উকুন
উকুনের ভয়ে ত্রস্ত থাকতো সে বরাবর
পুলিশের মতোই চিরুণী তল্লাশি চালাতো
পল্লবিত ঐ ঘন চুলেদের অলিতে গলিতে।
গো-বেচারা উকুনেরা সব উৎখাত হতো
কোঁকড়া কেশের কাঙ্ক্ষিত উষ্ণতা থেকে
তারপর স্নান সেরে ছাদের খোলা হাওয়ায়
ভ্রান্ত নিশ্চয়তায় শুকোতো চুল অব্যক্ত আনন্দে
গুনগুনিয়ে শুনিয়ে যেতো নিজেকেই নিজের গান।
এতো যে সতর্ক অভিযান অণুজীব উকুনের বিরুদ্ধে
এতো যে রক্ষণশীল থাকে সুরক্ষিত কেশগুচ্ছের প্রতি
তারপরও কি বলবে সে ভালোবাসার কোন উকুন কখনই
বাঁধেনি বাসা কালো কেশের স্নিগ্ধ ছায়ায়
চুলের অলিতে-গলিতে কি কখনই বাজায়নি শিস
বাউণ্ডুলে বালকের মতো কখনও কি চায়নি তার দিকে।
যতবার তাকে সরাতে চায় আঙুলের কোমল স্পর্শে
ততবারই সে লুকোয় গিয়ে তারই চুলের ভাঁজে ভাঁজে।
না না, রক্তচোষা মোটেই নয় পরজীবী এ প্রেমের প্রাণী
ভালোবাসার সুধারসেই ভরাতে চায় তৃষ্ণার্ত হৃদয়
তাইতো দেখি তেলেতে জলেতে মেশানো সাঁড়াশি অভিযানে
হয়রান ও হতবাক হয় কেশবতী কন্যা কেবল
হারে না তবুও অতি-ক্ষুদ্র এ না-ছোড় বান্দা প্রাণী
হয়তো কখনো কখনো সংক্রমিত হয়েছে বালিকা মন তার
অতঃপর দ্রুতই সুরক্ষার দেয়াল গড়েছে,
ভালোবাসার অণুজীবকে পাশ কাটিয়ে।
নিজেকে নিজেই বাহবাহ দিয়েছে উকুন বিদায়ের আনন্দে
বোঝেনি কখনই অনুভূতির অনুজীবেরা লুকোয় জীবনেরই ছন্দে
• কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্র।