গদ্য আলেখ্য
অভিব্যক্তি
গাছপালা সব ব্রোঞ্জের, পাখিরা অ্যালুমিনিয়ামের, ঘাসপাতা লতাগুল্ম সব প্লাস্টিকের। আগাগোড়া ধাতু ও কংক্রিটে-মোড়ানো সব নিরেট নির্বিকার উল্লম্ব স্তূপরাশি। মানুষেরা সব পণ্যপর্বত আর ভোগপাহাড়ের মধ্যে আটকা-পড়া, অসুস্থ উদ্ভ্রান্ত গিনিপিগের মতো ক্রমাগত ছুটতে-থাকা।
হাঁপিয়ে-ওঠা, হাসফাঁস-করা মানুষেরা কোথায় গেলে পাবে একটু নিরাময়, একটু সবুজ, একটু গা-ছমছমে ভাব, কোথায় গিয়ে উগরে দেবে তাদের দিনগত জহরিলা, ঘোচাবে বিভ্রম বিভ্রাট, লঘু পাপেচ্ছা... তা-ও একটু ভেবে রেখেছিলেন মা প্রকৃতি।
দৃষ্টি-ও-শ্রুতিকঠোর এই ধাতুনগরীর মাঝখান দিয়ে বক্ষসন্ধি বরাবর আগে থেকেই বইয়ে রেখেছেন এক চিলতে ধারালো নদী—জংলি ও খরশান। ছোট্ট নদীর দুই ধারে বিচিত্র প্রাণীপতঙ্গ-অধ্যুষিত জঙ্গলে-ভরা পাহাড়ি অববাহিকা। ঢালের একবার নিচে ওই কৃশকায় বন্যতোয়ার পাড়ে এসে দাঁড়ালে ঘন জঙ্গলজালের আড়ালে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যায় ওই নিষ্করুণ নগরী। কিছুই আর দেখা যায় না তখন ওই স্তূপ-স্তূপ কংক্রিটরাশির।
কোটি কোটি টন ধাতুকংক্রিটের এই দুর্ধর্ষ নগরত্বের বিপরীতে এই এক টুকরো দুর্দান্ত প্রাকৃতিকতা। এক ভয়াল কালাপাহাড়ি জড়ত্বের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইরত এক ফালি সবুজ সজল জৈবিকতা।
শুভেচ্ছা শক্তি
মহাবিস্ফোরণের পর ব্রহ্মাণ্ড যখন ছড়িয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে, তখন ওই ছোট্ট শিশু বিশ্বজুড়ে কেবলই বিকিরণ আর বিকিরণ। আর সেই বিকিরণ থেকে মুহুর্মুহু তৈরি হচ্ছিল কণিকা ও প্রতিকণিকা। ছুটছিল দিগ্বিদিক। আবার তারা যেই মুখোমুখি, অমনি সংঘর্ষ। অমনি পরস্পরে বিলীন হয়ে গিয়ে ফের ফিরে যাওয়া শক্তিতে, বিকিরণে।
বিশ্ব আরো প্রসারিত হতে থাকল ক্রমে। কমে এল উত্তাপ উষ্ণতা। থেমে গেল শক্তি থেকে কণিকা-প্রতিকণিকা তৈরির যজ্ঞলীলা। তবে কী এক দুর্জ্ঞেয় কারণে, সমান-সমান না হয়ে প্রতিকণিকার চেয়ে কণিকা তৈরি হয়েছিল অনেক বেশি। প্রকৃতি দেখিয়েছিল এক স্পষ্ট প্রগাঢ় পক্ষপাত, কণিকার প্রতি।
ভাগ্যিস দেখিয়েছিল! ভাগ্যিস প্রকৃতি নিজেই ভেঙেছিল তার স্বঘোষিত প্রতিসাম্যের নিয়ম! তা না হলে এ-বিশ্ব এখন ভরা থাকত শুধুই বিকিরণে।
সে-কোন বিধান-ভাঙা বিধি, সে-কোন পক্ষপাতদুষ্ট একরোখা শুভেচ্ছাশক্তি প্রকৃতির, যার আবেশে বিশ্ব আজ এমন বস্তূজ্জ্বল, প্রাণ-থইথই?
প্রতিভা
এক বৈদ্যুতীন সুপার-সার্কিটের নকশা করেছে বিজ্ঞানীরা। সার্কিটটি এতটাই বিশাল, সূক্ষ্ম ও জটিল যে, কোন কম্পোনেন্টের ভেতর দিয়ে কতটা বিদ্যুৎ বয়ে যাবে, শত সমীকরণ লিখে, হাজার অঙ্ক কষেও তা বের করা যাচ্ছে না।
তবে বাস্তবে সার্কিটটি বানিয়ে সুইচ অন করা হলো যখন, কাউকেই লাগল না, সার্কিটের জড় ব্যাটারিগুলিই মুহূর্তের মধ্যে নিখুঁত অঙ্ক কষে একদম ঠিক-ঠিক পরিমাণ বিদ্যুৎ পাঠিয়ে দিল ঠিক-ঠিক জায়গায়।
এতটা প্রতিভা জড়বস্তুর!
ক্ষমতা
ক্ষমতা থাকলে কাজ হয়। তেলেসমাতির মতো। মুহূর্তের মধ্যে যে যত বেশি কার্য বা দুষ্কার্য করতে পারে, বলা বাহুল্য, তার ক্ষমতা তত বেশি। পদার্থবিজ্ঞান ও ক্ষমতাবিদ্যা উভয়েই একই কথা বলে।
ক্ষমতা হস্তান্তরযোগ্য, এবং তা ভাগ-বাটোয়ারাযোগ্যও বটে। যেমন, পাওয়ার স্টেশন তার পাওয়ার ভাগ করে দেয় একই সার্কিটে-থাকা বড় বাল্ব, টুনি বাল্ব, বড় ফ্যান, পাতি ফ্যান, পাম্প, ধোলাই মেশিন, এবং আরো কত কিছুকে।
ধর্মতন্ত্র
ধর্ম মানবজাতির এক আশ্চর্য উদ্ভাবন। ধর্মে, বিশেষ করে আধুনিক ধর্মকাঠামোতে, সবার ওপরে থাকে এক নিরাকার সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আর নিচে থাকে আপামর জনসাধারণ। জনগণের আকাঙ্ক্ষা আর্তি ও ফরিয়াদের মূর্ত ও ঘনীভূত নিশানা ওই বিমূর্ত সত্তা। ঈশ্বর আর জনমণ্ডলীর মাঝখানে বিরাজ করে শাস্ত্রগ্রন্থ—অবশ্যপালনীয় যার বিধিবিধান, অলঙ্ঘনীয় যার অনুশাসনমালা। আর প্রতিনিধি ও নির্বাহী হিসেবে থাকে খলিফা-ইমাম-আলেম-ওলামা-ও-কাজিমণ্ডলী যারা ব্যাখ্যা দেয় সেই গ্রন্থের অনুশাসনপুঞ্জ ও বিধিবিধানগুচ্ছের, এবং শাস্ত্রের আলোকে প্রণয়ন করে আইনকানুন ও ফতোয়া। তারা একইসঙ্গে শাস্ত্রের হেফাজতকারী এবং তার কানুন, বিধান ও ফতোয়াগুচ্ছের প্রয়োগকারীও বটে। তবে খলিফা ইমাম ওলামা ও কাজিসহ আপামর প্রতিটি বান্দাকেই থাকতে হয় সেই অদৃশ্য সত্তা ও শাস্ত্রের অধীন।
ধর্মতন্ত্রের এই যে মডেল এরই মোটামুটি প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে।
উম্মাহ্
ধর্মতন্ত্রের আরো একটি দিক হচ্ছে উম্মাহ্ গড়ে তোলা। উম্মাহ্-র এই লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা দুই-ই দেখতে পাব আধুনিক বিশ্বের অন্য একটি ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সিস্টেমে। উম্মাহ্-তে যেমন, কর্পোরেটেও তেমনই এক আপাত-অদৃশ্য যোগসূত্রে, এক অমোঘ আবেগে, পরস্পর-অচেনা-অদেখা বহু মানুষ, কর্পোরেটের মোমিন বান্দাকুল, চালিত হয় একই আদর্শ ও লক্ষ্যে, একই রকম আচারবিধি মেনে, পারস্পরিক নিখিল সহযোগিতায়।
অভিসমাজ, অভিসভ্যতা
আরণ্য সমাজ থেকে ধীরে ধীরে উঠে এসে মানুষ প্রাণপণ প্রয়াসে গড়েছে মানবসমাজ। গড়ে তুলেছে ইট-কাঠ-লোহা-কাচ-পাথর-প্লাস্টিকের সভ্যতা। কিন্তু পরকলার মধ্য দিয়ে যেমন তৈরি হয় বস্তুর ওল্টানো প্রতিবিম্ব, তেমনই সমাজ-সভ্যতার বিপরীতে গড়ে উঠেছে এক নিষ্করুণ, ওল্টানো অভিসমাজ, অভিসভ্যতা। এক ছালছাড়ানো দগদগে বাস্তবতা। মানুষই মানুষকে ফেলে দিয়েছে ধাক্কা দিয়ে, একদম নিচে, গহ্বরে। মানুষই মানুষকে করেছে মানবেতর, বাধ্য করেছে এমন এক জীবন যাপনে যা প্রাণিজীবনেরও অধম। মানবসমাজের পাশাপাশি সৃষ্টি করেছে এক নতুন সমাজ। নাম তার মানবেতর-সমাজ।
মানবেতরেরা এখন না-পারছে থাকতে মানবজীবনে, না-পারছে ফিরে যেতে অরণ্যে, প্রাণীর জীবনে। অসহায়ের মতো, ভাষাহীনের মতো, মরিয়া হয়ে তাই তারা কায়মনে কামনা করে—মানুষ হিসেবে নয়, বেঁচে থাকতে পারে যেন অন্তত মানবেতর হিসেবে। মানবাধিকার নয়, অন্তত টিকে থাকে যেন তাদের মানবেতর-অধিকারটুকু।
প্রকৃতি-১
এই গ্রহে প্রাণ বাঁচে প্রাণাহার করে। জীবকোষ বাঁচে, বিকশিত হয়, জীবকোষ খেয়েই। প্রতিদিন অন্য জীব-জীবাংশ গ্রাস করেই বাঁচতে হয় জীবকে। প্ল্যাংক্টন ও শ্যাওলা খাবে ছোট মাছ, ছোট মাছকে খাবে মাঝারি, মাঝারিকে বড়, আর ছোট-বড়-মাঝারি সবাইকে খাবে মহাকায় মাছ। আর ইচ্ছে করলে সবকিছুই গ্রাস করতে পারবে মানুষ। এই যে খাদ্যচক্র, স্তরবিন্যাস, এটাই প্রকৃতির বিধি। খাদ্যশেকলের উঁচু-স্তরে-থাকা বাঘকে তাই ভোর থেকে রাত অবধি ধেয়ে যেতে হয় স্তরান্তরে-থাকা হরিণের ঘ্রাণ অনুসরণ করে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য হরিণকেও ছুটতে হয় বাঘের আগে-আগে, আর প্রাণধারণের জন্য খেতে হয় তৃণগুল্ম।
কিন্তু যদি এমন হতো, জীবদেহ যদি পারত কার্বন ও অন্যান্য জড়বস্তু সরাসরি আহার ও আত্তীকরণ করতে, তাহলে কি থাকত এই নির্মম জীবসংহারী খাদ্যচক্র, প্রাণসোপানের এই নিষ্করুণ স্তরপরম্পরা?
জীবকোষের উদ্ভব ও বিকাশের জন্য মা প্রকৃতি কেন যে বেছে নিয়েছিল এমনই এক উপায়বিধি যা নির্ধারণ করে দিয়েছে এই সত্যটিকে যে, জীব-জীবাংশ খেয়েই বাঁচতে হবে জীবকে—সে এক রহস্যই বটে।
গ্রহের প্রাণীদের ভেতরে এই যে আগ্রাসী, জীবঘাতী নৃশংসতা, এ কি তবে প্রকৃতিনির্ধারিত! প্রকৃতির একেবারে মর্মে নিহিত কি এই নির্মমতা!
প্রকৃতি এমনই, হায়ারার্কিপন্থি। তার আছে নিজস্ব নির্বাচন আর সমর্থন করে সে যোগ্যতমের উদ্বর্তন।
অবশ্য সময়ই প্রতিনিয়ত মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে চলেছে এই স্তরবিন্যাস।
প্রকৃতি-২
প্রকৃতি এমনই। একদিকে প্রাণপালিনী, অন্যদিকে প্রাণবিনাশিনী। প্রাণহরণের মাধ্যমেই হবে প্রাণের পালন—এ-ই তার বিধান। একদিকে সে নিয়ত পরিবর্তনশীল, অন্যদিকে স্থিতিস্থাপক ও অভিযোজনসহায়।
প্রকৃতিশাস্ত্রের এক অনুচ্ছেদে প্রেমযোগ, অন্যটাতে বলপ্রয়োগ। এক পাতায় চিত্রিত প্রকৃতি-মায়ের মমতাময়ী রূপ, অন্য পাতায় লেখা তার নির্মমতার কথা।
প্রকৃতির বিধিবিধান কেনই-বা এরকম, যেরকম দেখছি আমরা? হতে তো পারত অন্য কিছু—মহাকর্ষের বদলে মহাবিকর্ষ বা মহানিরপেক্ষ, পরিবর্তনশীলতার বদলে চিরস্থবিরতা! কিংবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন না হয়ে অযোগ্যের বা যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে সকলের উদ্বর্তন!
সমস্ত বিশ্বব্যাপারের মূলে যে চারটি আদি মৌলিক বল, মহাবিস্ফোরণের পরপরই যাদের জন্ম স্থান আর কালের জমজ হিসেবে, কেন তারা সংখ্যায় চার, আর কেনই-বা তারা ওরকম! কিংবা সেই বিস্ফোরণমুহূর্তে নিঃস্থান-নিষ্কাল-নিঃশক্তি-নিষ্পদার্থক এক শূন্যতা, এক পরম শূন্যতা, কেন দ্বিভাজিত হয়েছিল পজিটিভ ও নেগেটিভ এনার্জিতে! কণা থাকলে কেন থাকে প্রতিকণা, ক্রিয়া হলে কেন হয় প্রতিক্রিয়া সমান সমান!
প্রকৃতির কোন গভীর, জটিল আবেগ কাজ করেছে এসবের পেছনে—অজ্ঞেয়ই কি থেকে যাবে সব?
প্রকৃতির বিধানগুলি কী কী এবং কীরকম, এ যাবৎ তা-ই আবিষ্কার করে আসছে বিজ্ঞান। কিন্তু কেন তারা সেরকম, তা অনেকটাই অজ্ঞাত।
ভবিষ্যতের বিজ্ঞান হয়তো আবিষ্কার ও সূত্রবদ্ধ করতে থাকবে প্রকৃতির সেই প্যাশনাল, ইমোশনাল ট্রুথগুলিকেও।
• কবি, অনুবাদ ও প্রাবন্ধিক, কানাডা।