দুটি কবিতা ।। মাহিনুর আক্তার

মীর ও আমি 

বাগানের লাল গোলাপের রূপে বিমোহিত তুমি
কখনো তার পোকা খাওয়া পাতাটাকে দেখেছো?
কী করুণ তার দশা! আমি তো সেই—
ঘৃণায় তাকাও যতো সবই ভাগ্য মানি নীরবে সহি,
লাল গোলাপের রূপে বিমোহিত এই অভাজন।

এ দশা মীরেরও, দিল্লির রূপে বিমোহিত প্রেমিক!
আবদালী যখন ধ্রুপদ ধৃষ্টতায় দিল্লির ধর্ষণে মত্ত
আগ্রা লখনৌতে মুখ গুঁজেও স্বস্তি পায়নি মহাজন।
ইরান থেকে এসে নেশায় বিভোর করেছে গোলাপ কতো যুগ, হাজারো রাজারাজড়ার হাতে পান্না হয়ে
রানির খাস কামরায় বাতাসকে করেছে কামনার্ত।
এ মোহ আজও বয়ে বেড়ায় অন্ধ প্রেমিকের দল!

আর আমি সব খুইয়ে দিশেহারা অমাবশ্যার কালো
ছায়া হয়ে পড়ে থাকি জন্মান্তরের দৈব আশায়— 
হবো কী কখনো লাল গোলাপের রংমহলের রূপ?
হে মীর, তুমি আমায় বানাতে পারো নিদান প্রেমিক।
লিখে দাও শের যতো পারো রং ছড়িয়ে আমার যাতনায়, কে জানে সে ব্যথার সমুদ্রে অবগাহন!

তুমি হয়েছিলে বন্ধ কুঠুরির দিওয়ানা শাহজাদা।
আজো তাই জগতের প্রেম তোমায় খুঁজে বেড়ায়।
দয়া করো, দয়া করো হে অনন্য সুন্দরের রাজা মীর!

কেন পাতাটাই উদাস আজ আর দশায় কুঁকড়ে—ঘৃণ্য। জন্মান্তরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত! ললাটের দামে ভাগ্য-লিখন।

হে বিধি! তুমি ভেঙে দিয়ে শৃঙ্খল করো অসুরকে সুন্দর। আর ছোট্ট গোলাপ পাতাটা পোকার হাত ছাড়িয়ে হয়ে যাক্ না নবীন রানি। রাজার ভালোবাসা ঘিরে চিরকাল বানাক মহাকাব্য।                           

আমি তো সেই সময়টা তাড়িয়ে বেড়াই স্বপ্নের ঘোরে। বন্দী মাছটা ছটফটিয়ে ওঠে জেলের জালে।                                                                

অপরিচিতা

বাদলা দিনে অলস দুপুরে বসে ভাবি লিখি কবিতা,
শব্দে-ছন্দে পুরাণ-কাহিনি দিয়ে গড়ি  সুর-সজ্জা।   
কাগজ-কলম হাতে নিতেই কল্যাণী নীরবে আসে
চুপটি করে চোখের ইশারায় আমায় প্রশ্ন করে— 

রবি ঠাকুরের কল্যানীরা কোথায় দেশে?
কী বিপদ! প্রমাদ গুনি— 
ও এসে বারবার করে আমায় বিভ্রান্ত নানা প্রশ্নে।    

পাঠক, চিনেছেন তারে— শম্ভুনাথ মিত্রের সেই কন্যা 

বিয়ে ছেড়ে দেশের কাজে হাত দিয়েছিল সেদিন। বিয়ের আসর থেকে অপমানিত হয়ে গেল বরযাত্রী
শতাব্দীর পরেও কেন আজ ঘরে-বাইরে নেই শম্ভু।

শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গলা তুলে পড়াই ব্যক্তিত্ব : বাবা
মেয়ের; সমাজের চাওয়ার হাওয়ায় ভাসমান বুদবুদ।

বুঝতে পারলে না কল্যাণী—রবিবাবুও ছিলেন এক 
অসহায় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। মুক্তি পাননিতো যৌতুক দিয়েও সমাজের পাঁক থেকে। তাই— 

শম্ভুনাথেরা মাথা তুলে নাতো, কলের পুতুল হয়ে সয়ে যায় অনাচার। কল্যাণীরা পরিচিতি পায় নীলে,
কালো থাবায় উদাম পড়ে থাকে রাস্তার পাশে।
ছবি ও খবরে মুখরিত জনতার আলোচনায় ওঠে
আরো বিবস্ত্র হয় লাশকাটা ঘরে।

নারী তো আজও রঙ্গমঞ্চের নটি, সূত্রধর চালায় তারে, যারা বিবেকবান আর বিবেচনায় সেরা।
কতো সেমিনারে হচ্ছে নারীর উর্বর জয়গান যাতে
ঢেকুর তুলছি নারীবাদীরাও।

কল্যাণী, বুঝতে পারবে না জানি এ তত্ত্ব—অতোটা 
শিক্ষিত তোমায় করেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর
হাতও ছিলো বাঁধা সমাজের নিগৃহীত সুতায়। দোষ
আসলে তাঁরই—তোমার গল্পের নাম দিলেন নায়ক
হয়ে ভালোবাসায় সিক্তা মানবী যে অপরিচিতা।
কিন্তু সমাজ নায়ক হলো কই?

ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ, জানালার গ্রিলে এক শালিক
সাদা কাগজটা ফ্যানের বাতাসে উড়ে যায় সেদিক। 


• ফেনী

menu
menu