তিনটি কবিতা ।।  হানযালা হান

মানবচক্র

তোমাদের সবুজ পৃথিবীতে আমিও ছিলাম এক বিকেল, লাঞ্ছনা বেদনা প্রাপ্তি প্রেম নারীর আদর—সবই ছিল, দেখেছি বাঁচার জন্য মানুষ কতোটা হাঁটে অনিচ্ছায়, মিথ্যা বেলুনের মুখে বাতাস ভরতে কত না মানুষ মরে, তবুও যে বাঁচে সে বেঁচে থাকে—থাকে বেঁচে, যে মরে সে মরে যায়—যায় মরে; 
অনেক অনেক দিন আগে ঘুমিয়ে গেছি আমি, তোমাদের পৃথিবীতে ছিলাম হয়তো, একটা হঠাৎ রোগে দেখেছি কত শত মানুষ ঘুমিয়ে গেছে, এই ঘুম আর ভাঙবে না; যৌবনকে স্বাগত জানায় মানুষ, অথচ বার্ধক্য? কে এড়াতে পারে তাকে?

একটা অপ্রেমের জীবন আমায় তীব্র যন্ত্রণা দিয়েছে, কত কত দিন আমি না খেয়ে থেকেছি, দেখেছি—হাজারো মানুষ না খেয়ে থাকে, রোগে কাতর আর্তমানুষ কীভাবে যে বেঁচে থাকে, তা জানে কেবল এক প্রাচীন বটগাছ, সেই গাছটাও কাটা পড়েছে; আহা, তবে আর এই পৃথিবীতে তোমরা বাঁচবে কী করে ঘূর্ণচক্রের রীতি ভেদ করে? যদি চাও, আমার মতো ঘুমিয়ে যেতে পারো; 

এক সময় আমারও যৌবন ছিল, পাকা সোওয়ারির মতো তেজি ঘোড়ার ওপর চড়ে এক হাতে দড়ি আরেক হাতে চাবুক নিয়ে ছুটতাম, দুপুরের গনগনে সূর্যের মতো ভেজা বালি শুকিয়ে বানাতাম বারুদ, এই সব ছিল একদিন;

মৃত্যুকে ভয় পেয়ে কতো কতো রাত নির্ঘুম কেটেছে, তা জানবে না তুমি; অথচ এখন আমি নাই তোমাদের পৃথিবীতে; তবে কোথায় আছি? এ এক জটিল প্রশ্ন—প্রশ্ন বটে; বেঁচে থাকার কারণ যেমন জানতে পারি নি কোনো কালে, মরে যাওয়ার কারণও জানতে পারলাম না; বাঁচা-মরার এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আর কতোবার পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করলে মানুষের পরিণত জ্ঞান হবে?

তারারা ম্লান হওয়ার আগে চুপি চুপি বলে যায়—বড় বেশি দেরি করেছ বাতাসে কান পাততে, অবিরত এক মায়ার সুর বাজে, সে সুর শোনে কেবল আহত সন্ধ্যারা নদীর ছায়ায় ছায়ায়; 

ঈশ্বরের জলকামান

একটা ঝড় আসছে, আমি সেই ঝড়ের পূর্বাভাস ঘোষণা করছি; তোমরা দেখ ঈষাণ কোনে মেঘ জমেছে, হঠাৎ গাছের পাতারা নড়াচড়া থামিয়ে দিয়েছে, পাখিরা ভয়ে ডাকাডাকি বন্ধ করেছে; পতঙ্গ দল আশ্রয় নিয়েছে গাছের কোটরে, প্রিয়জনের কথা মনে করে আনমনা গায়ের বধূ, সন্তান ফেরার অপেক্ষায় মায়ের মুখে উৎকণ্ঠা;

একটা ঝড় আসছে, পাখির দল জানে না কতগুলো বাসা উড়ে যাবে; বৃক্ষ জানে না কতগুলো পাতা ঝড়ে যাবে—কতগুলো ডাল ভেঙে যাবে; বাগান জানে না কতগুলো ফুল ঝড়ে পড়বে—গাছ উপড়ে পড়বে;  বজ্রপাতে কত মানুষ বধির হবে—প্রাণ হারাবে; যে পাখি শত শত বছর ধরে সুর বিলিয়ে গেল—যে শুঁয়োপোকা পাখার জন্য প্রার্থনায় বসেছিল—তারা বেঘোরে প্রাণ হারাবে;

একটা ঝড় আসছে, ঝড়, পৃথিবীর আর কোনো বন্ধন থাকবে না, মাটি সব মায়া ছিন্ন করবে, মানুষ মানুষে বিশ্বাস হারাবে;

মহাবিপর্যয়

লাখ লাখ বছর পর পর ঘটে মহাবিপর্যয়। মুছে যায় আগের মানুষের গড়া শহরের রেখা। সমুদ্রের তলায় পড়ে থাকে সভ্যতা। সিন্ধু, পম্পেই, বাইজানটাইন, আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নৃত্যপটীয়সী রমণীরা কাঁদে হাওয়ায় হাওয়ায়। পিরামিডের যে প্রযুক্তিজ্ঞান তা কি হারালো নীল নদে? চন্দ্রদ্বীপের পথে পথে আমি দেখেছি মহাভারতেরও আগে এক নগরী কী করে তেঁতুলিয়া নদীতে বিলীন হয়েছে।

লাখ লাখ বছরে ঘটে মহাপ্রলয়। মহামানবেরা আসে। নতুন নতুন পতঙ্গ ও উদ্ভিদ জন্মে। ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের কথা পৌঁছে যায় লোকালয়ে। মানুষ বিস্ময়ে হাঁটে, ঘুমায়, গান গায়; তৈরি হয় মিথ। বর্বরতার বুকে দেখ যোগী গৌতম বুদ্ধ ছড়িয়ে দেন আলো, একা একা।


• হোসেনি দালান সড়ক, ঢাকা 

menu
menu