গুচ্ছ কবিতা ।। জেবুননেসা হেলেন

বিপদগ্রস্ত বেলা

ভাঙা চুড়ি হাতে বসে আছে
রাধার বোশেখ।
কালবোশেখীর মতো 
এবার ঝড় উঠেছে
বেঁচে থাকার।

কিছুদিনের মধ্যেই
প্রবাসী কৃষ্ণের বাঁশি
বেজে ওঠার কথা ছিলো
এ তল্লাটে। 

নুয়ে আছে চোখের মুগ্ধতা, 
হারিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের ঘ্রাণ, 
হারাচ্ছে জলের তলায় পা ভেজানো পাতায়
মাছেদের উৎসব, 
নূপুরের নিক্কণ থেমে আছে
গৃহ কারাগারে।

প্রতিদিন প্রজাপতির ডানায়
সুসংবাদ আসবে ভেবে,
জানালায় রাধার মুখে
নতুন নতুন আতঙ্ক এসে বসে।

হাত নেড়ে কতবার
মশা তাড়ানোর ভঙ্গিতে
সে সরাতে চেয়েছে দুঃসময়। 
হায়! তবু সরে নি ঝুলে থাকা
আতঙ্ক বিষ।

প্রতিদিন টিভি স্ক্রিনে ভেসে ওঠে
নতুন নতুন করোনা ছোবল। 

রাধার তখন চুড়িতে হাত কাটে,
সাহসী হৃদয় কেটে কেটে
মৃত্যু সংবাদে লকডাউন 
কোরেনটাইন রক্তক্ষরণ।

অলস প্রহর 

দৃপ্ত প্রহর হাত ইশারায় ডাকে,
চুপি চুপি মনের বাগানের
ফুল চুরি করে মালি।

ছটফটে ভালোবাসা
ফুলরেণু জড়ায় ঘুম পাড়ায়
মালা গেঁথে গড়ে বরণমালা। 

পালাগান হয়, বাউল সংগীত
লালন হাসন হাসে
পল্লীগীতি ভাটিয়ালি 
কাদম্বরী দেবী এসে বসেন
রবীন্দ্রসংগীত গায়ে,
পায়ে পায়ে চলে আসে
চোরা ফুল হাতে মালি।

বালির বাঁধের ওপর আলো বদলে যায়
সোনালি থেকে লাল
এরপর ঘুম পাড়ায় অন্ধকার। 
ভূতুরে ডাক দেয় বসামাল,
কি হলো আজ!
কাজে যাবে না?
এতো ঘুমাও কি করে?

কালো জল

কত সময় মলাটের রঙ তুলি
ফ্ল্যাপের বাণী পরিচয় 
মূলভাবের আর বিষয়বস্তুর
বিপরীতে হেঁটেছে...

তাই বলে কি
গ্রন্থ কেঁদেছে?

বিস্ময় আর বৈচিত্র্য মাঝে
একটা নেংটি আছে।

ষড়ভুজ মায়া

মাত্রা দিয়েছো 
ভালোবাসার আঁচল মেলে ধরে।

সীমাহীন শূন্যতায়
একটা আদল দৃষ্ট।

বৃষ্টির দিনেও মেঘেদের
ফুলেল আকৃতি দিয়ে ফেলো।

জল হাওয়া গায়ে মেখে
খুলে ধরো দরদী ছাতা।

ভেজা স্বভাবকে 
তুলো দিয়ে মুছে স্বচ্ছ করো,
গভীর জ্যামিতিক বৃত্তকে
রুমালের চতুর্ভুজে।

আমাদের উপন্যাসের পাতা গুনে গুনে
সৌন্দর্য বাক্যগুলো 
তবে কি ইতিহাস করে রাখো?

নবরস

মূলমধ্যরেখা বরাবর দাঁড়িয়ে ভাবলাম,
পৃথিবীটা ঘুরে আসি,
কিন্তু উত্তরে যাবো না দক্ষিণে!
ভাবতে ভবতেই চোখে পড়লো
পূর্ব-পশ্চিম দ্রাঘিমারেখাগুলোয়।
ভীত আমি কিছুটা সরে গেলাম উত্তরে,
চেয়ে দেখি বিষুবরেখা পেরিয়ে
অসংখ্য সমাক্ষরেখা ঢেউয়ের মতো
তেড়ে আসছে!

বাজ পড়লো মাথায়
মেঘে মেঘে ইলেকট্রনগুলো নেচে উঠলো,
আমি ঢুকে গেলাম আদিম
এক গুহায়,
পৃথিবীর মধ্য থেকে আওয়াজ উঠলো,
কত ডিগ্রি কৌণিক দূরত্ব অতিক্রম করতে চাও?

আমি ত্রস্ত হয়ে ভাবলাম,
খনি গর্ভে এতো এতো অণুর বন্ধন!
এবার হবে নিশ্চয় সেই
কাঙ্ক্ষিত রাসায়নিক বিক্রিয়া!
পরমাণুগুলো প্রস্তুত হতেই
সর্ববহিস্থ স্তরে লোফালুফি
শুরু হলো।

আমি ভীত হয়ে,
আর্য, অনার্য, পাল, সেন, মোগলদের
ডাকতে লাগলাম,
উঠে এলেন সাহিত্যবোদ্ধারা।
চর্যা থেকে উঠে এলেন,
কাহ্নপাদ, কুক্বুরীপাদ, লুইপাদ।
উঠে এলেন,
দান্তে, সারভানটিস,দস্তয়েভস্কি
কীটস, মোপাসাঁ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবননান্দ আরো শত সহস্রজন।

আমি সংকোচিত হয়ে বললাম,
আমি ভূগোল জানি না
জানি না ইতিহাস
জানি না রসায়ন কিংবা গণিত!

শুধু জানি,বাড়ছে মানুষের খনি,
তলিয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধ,
তোমরা কি পারবে কমাতে
তোমাদের ছন্দ, মাত্রা, ছেদ, পর্বে, লয়, শ্বাসাঘাতে
অমানবিক ক্ষত?

কেউ কেউ হেসে উঠে বললো, এই মানুষটার নাক কেটে দাও,
এ বিজ্ঞান আর সাহিত্যে
"গুরুচাণ্ডালী" করেছে।

আমি তখন সেই যে পালানোর জন্য
ছুটতে লাগলাম
ছুটছি ছুটছি ছুটেই চলেছি...


• ঢাকা

menu
menu