গুচ্ছ কবিতা ।। বরুণ কুমার বিশ্বাস

কুমার নদের আয়নায়

কুমার নদের শীতল আয়নায় ডুব দেবো, রৌদ্রের মায়ায়
তুলে নেবো সিলভারিংয়ের বালি; রুপোর উদ্বিগ্ন দানা
কচুরিপানায় বৈঠকে বসা ঘাসফড়িংকে উড়িয়ে দেবো
আয়নার শরীরে ভাসিয়ে দেবো মিনিপ্যাক শ্যাম্পুর ফেনা
কিছু বিষণ্ন কুলকুচি, সাময়িক দুঃখ সংলাপ ও মৃতকোষ

নদীকে ভালোবেসে যমুনায় নেমে দেখেছি—
ওর ভীষণ ঘরে ফেরার তাড়া
কুমার নদ এখনও বাউলজীবনেই আছে, বৈভবহীন
পেতে রেখেছে আশ্চর্যকথার জীর্ণ প্রতিফলন, ঘাটেঘাটে

হিতামপুর ব্রিজ যেন নদের গলার একান্ত রুদ্রাক্ষমালা
ওখানে ভীষণ মায়াময় সন্ধ্যাতারার গান হয়, শুক্লপক্ষে
জেগে ওঠা চরে বসে সবুজধানের প্রাণবন্ত অর্কেস্ট্রা
বেজে ওঠে বায়োস্কোপের ডুগডুগি
আয়নার স্তর ভেদ করে চলে যাওয়া মেঘগামী নৌকায়
সদ্য প্রেমেজর্জর তরুণ-তরুণীর উচ্ছ্বাস, কী যে ঘোর!

কুমার নদের শীতল আয়নায় আবার ডুব দেবো, আবার
বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছি এই মেকি সভ্যতার শহুরে বাতাসে

মুখোশের অবিনাশি সূত্র

প্রতিদিন মানুষের চেহারায় ঢাকা মুখোশ দেখি
                   হরেক রঙের মুখোশভরা মুখ

জলের ঝাপটা দিলেই গলে যায় মুখোশের যৌবন
জলের ছবি তুলে রাখে হোলি খেলারত রাধার বোন
যত্নের প্রযত্নে চলে যায় মুখোশ দেখার দীঘল আয়না
বাসন্তী দুপুরে আমিও লুকাই আমার মুখোশ
                              পুরোনো মুখের আড়ালে

হোলি খেলে রঙজলে ঢেকে ফেলো অভিনয়ের পোশাক
স্নিগ্ধতার উড়ো চিঠি, বিদেশি ফ্যাশন ম্যাগাজিন
             শিয়ালেরডাকও ঢাকতে পারো ঢাকের শব্দে
কণ্ঠ থেকে এখনও যে তোমার মানুষের স্বর বেরোয়
বেরিয়ে আসা শকুনের কান্নাও লুকাও অবশিষ্ট নয়েজে

ছেলেবেলার দোল পূর্ণিমায় সেই "ঝুমুর বীণা পুতুলনাচ"
নিউরনের উঠোনে আজও পাটি পেতে শুয়ে আছে; থাক
সেখানে যেন পুতুলের সাথে কোন কিশোরের বিয়ে হয়েছিল?
সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া; অন্ধকার

মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে?
মুখের ওপরেও ভর করেছে মুখোশের অবিনাশিতার সূত্র
মানুষ বদলে এক বা একাধিক মুখোশে পরিণত হচ্ছে
                                     প্রতিদিন প্রতিনিয়ত
অথচ এতোদিন মানুষকেই দেবতাত্মা বলে জ্ঞান করেছি

জুতোর ফিতে কিংবা ফিতের জুতো

জুতোর ফিতে খুলে গেলে আরো ঝুলে পড়ে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান
                                   ভি-গলা জামার জানালায় বসে কাক
সবচেয়ে চকচক করে ওঠে লম্পটের ভাইরাসাক্রান্ত চোখ
                যেন বক্ষবন্ধনীর সাদা ফিতেয় আছে উপশমকারী মলম
এয়ারহোস্টেজ তবুও শক্ত করে জুতোর ফিতে বাঁধে
বিমানবন্দরের রানওয়েতে তবুও আছে থরে থরে কাকতাড়ুয়া

বোর্ডিংপাসটাও কি কোথাও হারিয়ে গেলো?
বেনোজলে ভেসে গেলো কি স্মৃতির আঁচল?

প্রথমপেগ হুইস্কিতে বরফ দেয়ার আগেই জ্বলে ওঠে খাদ্যনালী
ফিতে বাঁধা আঙুলে খুলে দাও সোডার ছিপি, বরফকুঁচির বয়োম

আরেকটু জিরিয়ে চলে যাবো এক হিপোক্রেটের নেমন্তন্নে
সেখানে অর্জুনগাছের ছাল খাওয়ানো হবে, তিনবেলা
জলের পরিবর্তে পান করানো হবে কুসুমগরম থাইস্যুপ
সেখানে তোমারও আসন পাতা হবে, এসো—সেফ ল্যান্ডিংয়ের পর

ফিতের জুতোজোড়া আমি বগলে করেই ইমিগ্রেশনের ঝামেলা চুকাবো, 
বুকেরছাতিতে মেরে নেবো ডিসেন্ট ট্যাটু

সেলুলয়েডের পরিত্যক্ত রোল

কোথাও যাওয়ার নেই
অথচ এই শহরের রাস্তায় যানজট নেই
ক্রলিং করেছি নিয়মিত, একদিন দৌড়াবো বলে
ঘামের আস্তরণে আড়াল করে রেখেছি সকল জীয়ন্ত দুঃখ
বুকের সেলাই আটকে ধরে চুম্বক, কান্না ধরে না

ঘুরছে সেলুলয়েডের পরিত্যক্ত রোল—অহর্নিশ 
শেষ দৃশ্যের কুশীলব আমি, চলছে ফাইট-ফাইট জুয়া
এই বিদেশ বিভূঁইয়েও চমনবাহার মুখে গুঁজে ইশারা দেই
ভালো থাকার ক্লান্তিকর ফিরিস্তির, কিছুটা ভুলে থাকার

কারো সাথে কথা বলার নেই
অথচ ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছি জীর্ণ ক্যানিস্টার
পারস্পরিক সৌজন্য বোধের তর্জমাকারীও নেই
এই শহরে চরমভাবে অবাঞ্চিত—আমিও। হ্যাঁ; 
আরো কিছু পাঁচমিশালী উপকথার পলেস্তারায়
বাজেয়াপ্ত হতে থাকে হরোস্কোপের অ্যাকোয়ারি স

ষড়যন্ত্রের ফাঁদেই পা দেই

রোদচশমার ষড়যন্ত্রে রঙিন দেখায় সাদাকালো স্ক্রিন, 
                                         ফ্যাকাশে ক্যানভাস
বনসাই প্রকল্পের ঘুমপাড়ানিয়া শ্লোকে এখন আর
টানটান ঘুম নেই, জীবনে ভীষণ সময়ের অভাব

পুরনো প্যালেসের ভেতর বেঁচে আছে চুনসুড়কির আস্তর
দুর্বল ইটের ব্লকের এখনও টিকে থাকার চেষ্টায়
সায় দিয়ে ফটকে দাঁড়িয়ে থাকে সৈনিকের জংধরা বর্ম

ষড়যন্ত্র!
ষড়যন্ত্রকারী!
ষড়যন্ত্রের শিকার!
কাগজের রোজকার ফিচার!

বেঁচে আছি তবুও জীবনের ডাইসের চেয়ে ছোট সাইজে
শেয়ারবাজারে প্রতিদিন মানুষ জীবন বেচেই বিনিয়োগ করে নতুনখাতে—তবুও 
উড টেকনোলোজির সুবাদে মরাগাছ খোদাই করে ভাস্কর ফুটিয়ে তোলে        
                                                              লোটাস বুদ্ধ; উদ্যানে
কোথাও মানুষের জন্য নির্ভেজাল অক্সিজেন!

ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে শিকার ফেলে উড়ে যায়
ক্ষুধার্ত ভুবন চিলের দল
ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েও ষড়যন্ত্রের ফাঁদেই পা দেই

তারপর চোখে রোদচশমা পড়ে ট্যুরিস্ট হয়ে পাশ্ববর্তী কাঁটাতারে লটকে থাকি
মধুময় ভেবে নিয়ে ঢকঢক করে গিলি জীবনের লাচ্ছি; আহা
উপেক্ষাসমেত রোজ সোঁদাগন্ধের শরীরের ভেতর সঞ্চালিত হয়, 
                                                বেগুনি রশ্মিজাল, কেউ জানে না


• ঢাকা

menu
menu